১৫ ই মার্চ, ১৯২১ সাল।
বার্লিন, জার্মানি।
প্রতিদিনের মতোই সকালে ঘুম ভাঙ্গলো পাশা সাহেবের। সকালটা অন্য যেকোন দিনের চেয়ে আরও স্নিগ্ধ ও সুন্দর মনে হচ্ছিলো তার কাছে। তিনতলা বাড়িটার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকালেন বাইরে। কি সুন্দর সকাল! বাড়ির সামনে দিয়ে পিচঢালা সড়ক গিয়ে মিশেছে দূরের আরেকটা সড়কে। পাশা সাহেবের মনে হলো এই সুন্দর সকালে বাইরে একটু হাঁটলে মন্দ হয় না। শুধু আজ নয়,হাঁটাটা অবশ্য তার প্রতিদিনেরই অভ্যাস।
যেই ভাবা সেই কাজ। সুন্দর সকালের প্রকৃতি দেখতে দেখতে হাঁটতে বের হলেন পাশা সাহেব। বাড়ির একটু সামনেই দাঁড়িয়ে রোগা পাতলা দেখতে একটা লিকলিকে ছেলে । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুল উশকোখুশকো, গায়ে মলিন শার্ট, স্বাস্থ্য একেবারে ভঙ্গুর। মনে হয় যেন কোন চালচুলোহীন ভবঘুরে যে এক সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি। পাশা সাহেব হেঁটে আসছেন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে । পাশা সাহেব ছেলেটির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটির শরীরে যেন বিদ্যুত খেলে গেলো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাঁকালেন পাশা সাহেবের দিকে। ঠিক যেমন করে ক্ষুধার্থ বাঘ তার শিকারের দিকে তাঁকায়। পকেটে হাত দিয়ে কি যেন চেক করে নিলো ছেলেটি।
জগিং করতে করতে পাশা সাহেব ছেলেটিকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলো। ঠিক তেমন সময় পকেট থেকে রিভালবার বের করে পাশা সাহেবের ঘাড় বারাবর তাক করে তিনবার ট্রিগারে চাপ দিলো। ঠাস ঠাস ঠাস তিনটা শব্দের পরেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন পাশা সাহেব। ছেলেটি পরম তৃপ্তির পাশাপাশি তীব্র ঘৃণা ভরে পড়ে থাকা পাশা সাহেবের দিকে একবার তাঁকিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
না, এটা কোন থ্রিলার মুভি বা গল্পের কাহিনী নয়। রোগাপাতলা ছেলেটি বা পাশা সাহেবও গল্পের বা মুভির কোন চরিত্র নয়। পুরো ঘটনাটি অপারেশন নেমেসিসের একটা অংশ মাত্র। পাশা সাহেব আর কেউ নয়, তুরস্কের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা। যিনি কিনা আর্মেনিয়া গণহত্যার অন্যতম একজন মাষ্টারমাইন্ড। আর খুনী ছেলেটি সগোমন তেহলিরিয়ান, জাতিতে আর্মেনীয় এবং আর্মেনীয় গণহত্যার পর বেঁচে যাওয়া অল্পসংখ্যক মানুষের একজন।
কিভাবে আর্মেনিয়ার মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন? অপারেশন নেমেসিসের প্রেক্ষাপটই বা কি ছিলো তা জানতে হলে ধৈয্য নিয়ে পড়তে হবে পুরো লিখাটি-
অপারেশন নেমেসিসের প্রেক্ষাপটঃ
আর্মেনিয়া চতুর্থ শতকে পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করার ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজার অধীনে তারা শাসিত হয়েছে। পনের শতকে তারা অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। অটোমানরা শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য তাদের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখতো। অটোমানদের চোখে আর্মেনীয়রা ছিল ‘অবিশ্বাসী’। তাই সুযোগ পেলেই অটোমানরা আর্মেনীয়দের উপর নিপীড়ন চালাতো।আর্মেনীয়রা ইতিহাসে দুবার অটোমানদের দ্বারা গণহত্যার শিকার হয়। একবার উনিশ শতকের শেষ দিকে ১৮৯৫-৯৬ সালে এবং আরেকবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান তুর্কিরা অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং একই সাথে অক্ষ শক্তির খ্রিস্টানদের বাদে বাকি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ‘হলিওয়ার’ ঘোষণা করে। হলিওয়ারের প্রধান শিকার হয় আর্মেনীয়রা। অটোমানরা আর্মেনীয়দের পুরো জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্নকরার জন্য ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা সংঘটিত করে। তুরস্কের বাইরে ও আজারবাইজানে বাস করা সংখ্যালঘু আর্মেনীয়রা নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়। প্রায় দেড়মিলিয়ন আর্মেনীয় মানুষ এই গণহত্যার শিকার হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই গণহত্যার বিচার শুরু হয়। প্রহসনের বিচারে একত্রিশ জনের মধ্যে চারজনকে অভিযুক্ত করা হয় কিন্তু এরাও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। তুরস্কের বাইরে পুরো পৃথিবীতে অবাধে ভ্রমণ করতে থাকে। এটা গণহত্যার পর বেঁচে থাকা আর্মেনীয়রা মেনে নিতে পারেনি। এরপর১৯২০সালে আর্মেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণাকরে। ইয়েরেভান’কে আর্মেনিয়ার রাজধানী করা হয়। সেখানে আর্মেনিয়ান রেভ্যোলুশনারি ফেডারেশনের ৯ম বিশ্ব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ব কংগ্রে সে আলোচনার মূলবিষয় ছিল আর্মেনীয় গণহত্যায় যারা জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা। কংগ্রেস গুপ্তহত্যা অভিযানের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা পরবর্তীতে ‘অপারেশন নেমেসিস’ নামে পরিচিত হয়। অপারেশন নেমেসিস এর ‘নেমেসিস ‘ হলো গ্রিক দেবদেবী।
আরমেন গারো, এ্যারন শাখালিন, শাহান নাটালি-এই তিনজন ছিল অপারেশন নেমেসিসের মাস্টারমাইন্ড। এরাই মূলত অপারেশনের সব পরিকল্পনা করতেন। তবে অপারেশন পরিচালনার দলগুলো বিভিন্ন পেশার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আর্মেনীয়দের নিয়ে গঠিত হয়। অপারেশনের মূল টার্গেট ছিল তালাত পাশা। তালাত পাশা’ই মূলত গণহত্যার নির্দেশ দেন এবং জাতিগতভাবে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে বলেন।
তালাত পাশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে জার্মানিতে আত্মগোপন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি তার নাম পাল্টিয়ে ফেলেন এবং ব্যবসায়ীর বেশে থাক থাকা শুরু করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। ১৯২১ সালের ১৫ মার্চ তাকে বার্লিনের শার্লোটেনবার্গের রাস্তায় গুলি করে মারা হয়।
জামাল পাশা ছিলেন অপারেশন নেমেসিসের আরেক টার্গেট এবং কুখ্যাত তিন পাশার মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন মিলিটারি লিডার। অত্যন্ত নির্মম প্রকৃতির একজন মানুষ। এজন্য তাকে ‘জামাল দ্যা বুচার’ বলা হতো। তাকে ১৯২২ সালের ২১ জুলাই তিবলিসিতে স্টেফান জেঘিগিয়ান নামের গুপ্তহত্যাকারী দিয়ে হত্যা করানো হয়।
তিন পাশার সর্বশেষ পাশা ছিল এনভের পাশা। তিনি পেশায় একজন মিলিটারি অফিসার এবং ১৯০৮ সালে সংঘটিত হওয়া ‘তরুণ তুর্কি বিপ্লব’ এর একজন নেতা ছিলেন। তাকে তাজিকিস্তানে ১৯২২ সালে হ্যাকপ মেলকুমোভ নামের একজন অপারেশনের সদস্য দ্বারা হত্যা করা হয়।
ফাতালি খান খয়স্কি ছিলেন আজারবাইজানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯১৮ সালে বাকুতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয় তার পুরো দায়ভার চাপানো হয় তার উপর। তাকে ১৯২০ সালের ১৯ জুন তিফলিসের এরেভেনিয়ান স্কয়ারে আরাম ইয়েরগেনিয়েন নামের একজন আততায়ী হত্যা করে। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গুপ্তহত্যার শিকার হন, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিলেন।
পুরো অপারেশনে মাত্র দুজন আততায়ী ধরা পরেন। তার মধ্যে একজন হলেন বার্লিনে অপারেশন পরিচালনাকারী সেই তেহলিরিয়ান। তাকে আদালতে ডাকা হয় এবং তিনি দ্ব্যার্থকণ্ঠে বলেন-
”আমি জানি আমি আমার বিবেকের কাছে নির্দোষ। আমি একজনকে হত্যা করেছি কিন্তু আমি মার্ডারার নই, কারণ আমি যাকে হত্যা করেছি সে আমার পরিবারসহ দেড় মিলিয়ন মানুষের হত্যার জন্য দায়ী। আমি নিজের চোখের সামনে আমার মায়ের মাথা দেহ থেকে আলাদা হতে দেখেছি,আপন বোনকে ধর্ষিত হতে দেখেছি।”
তেহলিরিয়ানের আইনজীবী আদালতে যুক্তি প্রদর্শন করে যে তেহলিরিয়ান গণহত্যাকালীন যে ট্রমার মধ্যে ছিল, সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং সে তালাত পাশাকে হত্যার সময় মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না। আদালত এ যুক্তি গ্রহণ করে তাকে মুক্তি দেয়। অনুরূপভাবে আরেকজন আততায়ীকেও মুক্তি দেয়া হয়। ১৯২২ সালের শেষের দিক থেকে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও জর্জিয়ার সরকার একসাথে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ‘প্রমিথিউস’ বিল পাশ করলে আর্মেনীয় সরকার এই অপারেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তথ্যসুত্রঃ
১। http://www.operationnemesis.com
ও ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:২৩