প্রথমবার ক্লাসে স্যার তার পরিচয় পর্বের সময় প্রশ্ন করলেন, “তোমরা জান, কয়টি ফন্টে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো” । আমরা বলেছিলাম, ‘এগারোটি’ । স্যার হেসে বললেন, ‘না। দুইটি ফন্টে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এক, অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধ। দুই, যন্ত্র হাতে বাঁজিয়ে গান গেয়ে বা ফুটবল পায়ে খেলে। আমি ছিলাম একজন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক।’ তারপর তার জীবন, পড়ালিখা তার আবিষ্কার নিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন সেদিন।
১৯৫৪ সালে নীলফামারীতে জন্ম। তিনি যখন ১৬ বছরের তরুণ তখনই দেশে শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙ্গালী জাতির উপর পাক বাহিনীর এমন পৈশাচিক নির্যাতন তিনি চোখ বুঁজে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি খুব ভালো তবলা বাজাতে পারতেন। যোগ দিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ । সেখান থেকেই বিভিন্ন দেশাত্নবোধক, অনুপ্রেরণামুলক গান তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দেন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ই্উনিয়নে যে কয়জনকে পাঠান তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মস্কোতে কৃতিত্বের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেন। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন নীলফামারী জেলা সমিতি ঢাকার সাধারণ সম্পাদক এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক।
১৯৯৪ সালে জুট জিও টেক্সটাইল ও জাহিদ’স মডেল আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হন। দেশ-বিদেশে তার আবিষ্কার ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তিনি বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইরোসন কন্ট্রোল এসোসিয়েশন (আইইসিএ), ইন্টারন্যাশনাল জিওসিনথেটিক সোসাইটি, ভারতের এশিয়ান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্টাল জিওটেকনোলজিসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ছিলেন। দেশে বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে তার বহু সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রধানের নাম বিশ্ব সাহিত্য ভবন থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোর মানচিত্র বইয়ে বাংলাদেশের কৃতি সন্তান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। মস্কোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষাকতা করেন তিনি।পাশাপাশি মহাকাশযান ডিজাইনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অথচ,
আবাসন ব্যবসায় নেমে রাজধানীতে নির্মাণ করেন বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন। অথচ গত চার বছর তাকে ঠাঁই নিতে হয়েছিল অফিস কক্ষে। আজীবনের এই যোদ্ধাকে শেষটাই হার মানতে হয়েছে জীবনযুদ্ধে। ঋণের বোঝা, পরিবারের অসহযোগিতা, কাস্টমস কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ- নিসঙ্গতা, হতাশা আর অপমানের হাত থেকে বাঁচতে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। বাড়ির একটি ফ্লাটে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন জাহিদ প্রধান।
কানাডা প্রবাসী ছেলে, আদরে বড় করা মেয়ে বা সব সম্পত্তি নিজের নামে নেওয়া স্ত্রী কেউ তার কোন খোঁজ রাখেননি। তার মতো একজন শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী আমাদের থেকে চলে গেলেন । যা দেশ ও জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। জাতির জন্য, দেশের জন্য করা যুদ্ধে জিতেছিলেন ঠিকই, কিন্তু হেরে গেলেন জীবনযুদ্ধে। তার মতো মানুষের এমন পরিণত কখনোই কাম্য ছিলো না।
ওপারে ভালো থাকুন, প্রিয় স্যার.....।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৮:৫৫