ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম সাম্যের ধর্ম। প্রকৃত ইসলাম ধর্মে যারা বিশ্বাসী তারা কখনও জনগণকে শোষণ করতে পারে না। ইসলামের পরিপন্থী কোন নীতিহীন আদর্শকেও তারা অনুসরণ করতে পারে না।
কোরান শরীফের বিভিন্ন যায়গায় বারবার শান্তির কথা উল্লেখ করা আছে, সাম্যের কথা আছে-ভ্রাতৃত্বের কথা আছে। সূরা কাফেরুনে স্পষ্ট লেখা আছে ‘লা কুম দ্বীনো কুম ওয়ালিয়া দ্বীন’।
আমরা যদি বিশ্বাস করি এই পৃথিবী আল্লাহ পাকের ইশারা ছাড়া চলে না। তাহলে এর ভালমন্দ সবই তাঁর সৃষ্টি। খোদার ওপর খোদাকারী চলে না। শেষ-বিচারের ভার তো তিনিই নিয়েছেন, মানুষের ওপর ছেড়ে দেননি। শেষ-বিচারের দিনে কোন রাষ্ট্রপ্রধান দিয়ে দেশবাসীর জন্য ওকালতি চলবে না বা সে নিয়মরীতিও ইসলাম ধর্মে নেই। কাজেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণার কোন অর্থ হয় না। আমরা যারা এই পৃথিবীতে রয়েছি, তাদের নিজ নিজ কাজের হিসেব নিজেকেই খোদার কাছে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় ধর্মের প্রবক্তা এজন্য কোন দায়দায়িত্ব গ্রহণ করবে না।
ধর্মনিরপেক্ষতার অমর বাণীও পবিত্র কোরান শরীফ থেকেই আমরা পাই। ধর্মকে ব্যাক্তিগত স্বার্থে বিশেষ এক শ্রেণী ব্যবহার করে থাকে। কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে বসার জন্য, কেউ ক্ষমতায় যাবার জন্য ব্যবহার করে। যারা প্রকৃত মুসলমান, যারা মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে খোদার ইবাদত করে তারা কখনও তারস্বরে প্রচার করে বেড়ায় না। এ হল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুভূতি ও বিশ্বাস। এর মাহাত্ম্য প্রচারযোগ্য। কিন্তু তাই বলে কোন ব্যক্তিবিশেষ যদি টেলিভিশন ও পত্রিকায় এবং মসজিদে দাঁড়িয়ে নির্বিচারে মিথ্যা কথা প্রচার বা আত্মপ্রচারের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, তবে তা ধর্মের প্রতি অবমাননা ছাড়া কিছুই নয়। ধর্ম নিয়ে কোন জবরদস্তি করা ইসলাম বিরোধী। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাও উচিত নয়। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত নয় যা অন্য ধর্মাবলম্বীদের জীবনযাত্রা বা অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। এটা সম্পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থি।
‘বিসমিল্লাহ’ লাগানোর পর এখন প্রশ্ন-অন্য ধর্মাবলম্বীরা যখন সংবিধান পড়বে তখন কি ঐ অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়বেন? তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশ্বাস থেকে, তারা কি এটা মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে? তবে কি সংবিধান তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়?
ইসলাম মানবতাবাদী ধর্ম। শান্তি ও মৈত্রীর অমর বাণী ইসলামের মূল কথা। ইসলাম উদার ধর্ম। এখানে সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই। যে ইসলাম ধর্মের আদর্শকে সমুন্নত রেখে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে মুছে ফেলার জন্য এবং ব্যাক্তিস্বার্থ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ইসলামকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার এক অশুভ তৎপরতা শুরু হয়েছে।
এই উদ্দেশ্যেই কিছুকাল আগে সংবিধানের প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা হয়েছে। মুসলমান মাত্রই যে কোন কাজ শুরু করার আগে মনে মনে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কাজ শুরু করে থাকেন। ধর্মীয় অনুভূতি ও নিয়ম হিসেবে তারা এটা করে থাকেন। এটাকে ঘটা করে বা ফলাও করে উচ্চারণের মাধ্যমে স্মরণ করা অর্থই ধর্মীয় অনুভূতিকে অবমাননা করা। যিনি মুসলমান, তাকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই যে তিনি মুসলমান।
শুধু তাই নয়, সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের প্রয়াস থেকে বাঙালির পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ শব্দের আবির্ভাব ঘটেছে এই তথাকথিত মহলবিশেষের পক্ষ থেকে। গণবিরোধী শাসকবর্গ সবসময়ই ক্ষমতার ভিত দুর্বল থাকে বলে সরলপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করতে চায়। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ হচ্ছে ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করবার জন্য। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে কুক্ষিগত করা ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করা। পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠী এভাবেই দেশকে শাসন-শোষণ করেছিল।
আমাদের দেশে বাংলায় কথা বলেন না এমন নাগরিকও আছেন। এরা ভারত থেকে দেশ বিভাগের সময় ভারতীয় নাগরিকত্ব ছেড়ে এসে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বসবাস শুরু করেন। এর মধ্যে অনেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে চলে যায়। পরে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে। এরকম বহু অবাঙালি ও কিছু উচ্ছিষ্টভোগী বাঙালি যারা সব সময় পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের পদলেহন করেছে, দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গণ-বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে-তারাই আবার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রধান সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাদের সঙ্গী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্ম ও মসজিদকে রাজনীতির উপরে না রেখে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করবার জন্য ধর্ম ও মসজিদকেই ব্যবহার করেছে। এ অতি পরিচিত খেলা।
১৯৭৬ সাল থেকেই এদের পুপুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। ‘বাঙালি’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশী’ করে এদের ফেরত আনা শুরু হয়। সম্পত্তি ফেরত নেবার কাজও শুরু হয়। বাংলাদেশী হল Made in Bangladesh অথবা Product of Bangladesh আর আমরা ‘বাঙালি জাতি’ হিসেবে একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে যারা মুছে ফেলতে চায় তাদের মনে রাখা উচিত বাঙালি হিসেবে আমরা সংগ্রাম করেছি-যুদ্ধ করেছি, যুদ্ধ জয় করেছি, ইতিহাসের পাতায় রয়েছে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়।
উল্লেখ্য যে, পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ব করে নেয়া হয় স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে। আওয়ামী লীগ সরকার অনেক কষ্ট করে এসব ধ্বংসপ্রায় শিল্প-কারখানা ও ব্যাংক-বীমা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে ধীরে ধীরে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে। বসতবাড়িগুলো শহীদ ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারকে দেয়া হয়। অনেক বাড়িঘর মাতৃসদন আর হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে তথাকথিত ‘বাংলাদেশী’দের কাছে এইসব বাড়িঘর ফিরিয়ে দেবার হীন উদ্দেশ্যে শহীদ পরিবারদের উৎখাত করা হয়। সরকারি লোক দিয়ে তাদের মালপত্র রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও শহীদ সঙ্গীতকার আলতাফ মাহমুদসহ বহু পরিবারকে কী নিদারুণ পরিস্থিতির সম্মুখীনই না হতে হয়েছে, তা আমরা সকলেই জানি। অথচ পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা অনেক বাঙালি তাদের সহায়-সম্পত্তি সেখানে ফেলে এসেছেন; সেগুলো ফেরত পাবার জন্য কোন দাবী তোলা হচ্ছে না।
আমাদের দেশের কোটি কোটি টাকার পাওনা পর্যন্ত ফেরত আনার ব্যাপারে এদের নীরব ভূমিকা দেখে এদের প্রতি ধিক্কার ছাড়া আর কিছুই জানানো যায় না। এমনই পাক-প্রেমী এরা যে নিজের দেশের পাওনাটুকুর দাবী তোলে না।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যে যুক্তিই তারা দেখান না কেন তা অত্যন্ত খোঁড়া যুক্তি বলেই আমি মনে করি।
আমাদের জাতিগত কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারায় আমরা বাঙালি হিসেবে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত। আমাদের ভাষা সাহিত্য-শিল্প, আচার-পদ্ধতি। জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, চালচলন, সামাজিক রীতিনীতি-সবকিছু মিলিয়ে আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র নিয়ে আমাদের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে সেটাই আমাদের জাতীয়তাবাদ। বাঙালি হিসেবে হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা বাঙালি। বাঙালি হিসেবেই যুদ্ধ করে, জীবনপণ লড়াই করে স্বদেশের মানুষ যে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল, যে ভৌগোলিক সীমারেখায় স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে যে স্থানে পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেকে চিহ্নিত করে নিয়েছে সেই আমাদের বাংলাদেশ। এই সীমারেখায় অবস্থানকারী নাগরিক নিজেকে বাংলাদেশী বলতে পারে, নাগরিক হিসেবে নিজেকে বাংলাদেশী বলা যায়। কিন্তু জাতি হসেবে ‘বাংলাদেশী’ বলবার কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। এটা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত।
তারা যুক্তি দেখায় যারা অবাঙালি তারা নিজেদের কি পরিচয় দেবে? তারা তো ভাষাগত সংখ্যালঘু। যারা উপজাতীয় হিসেবে নিজস্ব ভাষায় কথা বলে, তারা কীভাবে নিজেদের বাঙালি হিসবে পরিচয় দেবে? তাই জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য বাঙালি নয় বাংলাদেশী প্রবর্তন করা হয়েছে।
এ যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য? এটা তো সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত এবং কার স্বার্থ রক্ষার জন্য এই সিদ্ধান্ত সেটা দেশের মানুষ ভালোভাবেই জানে। ১৯৭৫-এর পর এ নিয়ে কেন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল? তার আগে তো এ ব্যাপারে কোন সমস্যা দেখা দেয়নি? আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাভাষী বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা নিজেদের ‘ভারতীয়’ হিসেবে পরিচয় দেয়। ভাষাগতভাবে যদিও তারা বাংলাভাষী, কিন্তু জাতি হিসেবে তারা ভারতীয়। ইংরেজি ভাষার জাতি হিসেবে ব্রিটিশরা ইংরেজ। আমেরিকানরাও ইংরেজি ভাষী, কিন্তু তারা ইংরেজ নয়। অস্ট্রেলিয়া কানাডাসহ বহু দেশে ইংরেজি ভাষার চল রয়েছে, কিন্তু তারা নিজেদের ইংরেজ বলে না।
আমরা জানি স্বাধীনতার পর থেকেই পরাজিত পাক-প্রেমীরা অত্যন্ত তৎপর ছিল। এখনও আছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও তৎপর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালি জাতির বিজয় এরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ‘জয় বাঙলা’ স্লোগানও এরা সহ্য করতে পারে না। অথচ কে না জানে যে জাতির সেই দুঃসময়ে ‘জয় বাঙলা’ শ্লোগান আমাদের চেতনাকে কতখানি উজ্জীবিত করে তুলত। আসলে এই শ্লোগানের মধ্য দিয়ে বাঙালির জয় ও পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘোষিত হয়। এটা পাক-প্রেমীদের মনঃপুত হবার কথাও নয়। তাই তো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নিষিদ্ধ হল। ‘বাংলাদেশ বেতার’ হল ‘রেডিও বাংলাদেশ’।
এরা ক্ষমতা অর্জন করেছে বুলেটের সহায়তায়। হত্যা, ক্যু, পালটা ক্যু ও ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। ক্ষমতা দখলের পর এরা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসকে বিসর্জন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের জয়ের সব নিশানা মুছে দেবার প্রয়াসেই ‘বাংলাদেশী’ প্রবর্তন করা হয়। একদিকে বাঙালি বাদ দিয়ে বাংলাদেশী প্রবর্তন করা হয়েছে ভাষাগত বৈষম্য রক্ষার তাগিদে। ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে যদি তারা উদারতার পরিচয় দিতে চায় ভালো কথা কিন্তু পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন দানা বাঁধে, সেটা হলো-সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহর রহমানির রাহিম’ লাগানো হয়েছে। এবার এখন রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণার পাঁয়তারা চলছে, এটা কোন যুক্তিতে?
এদেশে যেমন বিভিন্ন ভাষাভাষী রয়েছে তেমনি বিভিন্ন ধর্মের নাগরিক রয়েছে। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সব মিলিয়ে প্রায় আঠারো উপজাতীয় এদেশে বসবাস করে। তাদের ধর্মীয় রীতিনীতিতে ভিন্নতা রয়েছে।
সংবিধান রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত। দেশ ও জাতির দিকনির্দেশনা কি হবে, সরকারি কাঠামো ও আইন, অর্থনৈতিক নীতিমালা, সামাজিক আইন-কানুন ইত্যাদি সর্ববিষয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল হচ্ছে এই সংবিধান। দেশের সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী নাগরিক এ সংবিধান মেনে চলতে বাধ্য। ‘বিসমিল্লাহ’ লাগানোর পর এখন প্রশ্ন-অন্য ধর্মাবলম্বীরা যখন সংবিধান পড়বে তখন কি ঐ অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়বেন? তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশ্বাস থেকে, তারা কি এটা মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে? তবে কি সংবিধান তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? সংবিধান কি কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য প্রণীত হয়েছে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ? আপাতদৃষ্টিতে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি সেটাই কি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না? যে কোন অরাজকতা, নিয়ম-ভঙ্গ তারা করতে পারেন? দেশে যে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে এটা কি সংশ্লিষ্ট মহল ভেবে দেখেছেন?
ধর্মগত সংখ্যালঘিষ্ঠতার জন্য এসব তথাকথিত বাংলাদেশীদের কি কোন দায়দায়িত্ব নেই? তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? স্বাধীনতা যুদ্ধে এদের মা-বোন লাঞ্ছিত হয়েছে, এদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয়রা কাঁধে কাধ মিলিয়ে একসঙ্গে যুদ্ধ করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছে। তাই তাদের আত্মত্যাগকে যাতে কোনদিন ছোট করে না দেখা হয় সেজন্য সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বীজ সমূলে উৎপাটন করে যাতে কখনও কোন বিষয় দাঙ্গায় রূপ না নেয়, বরং পাশাপাশি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবন্ধ থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা যেতে পারে তার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা। কোন যুক্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হল সেটা তারা আজও স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেনি। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত দিল, তাদের এদেশে স্থান হল কিন্তু সংবিধানে উল্লেখিত অধিকার কেড়ে নেয়া হল। আর যারা গণহত্যার সহযোগী দালাল আলবদর-রাজাকার তাদের পুনর্বাসিত করা হল ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় দিয়ে।
ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কি? এর অর্থ হলো সহনশীলতা- ধর্মহীনতা নয়। একের প্রতি অপরের সহনশীল থাকাটাই বড় উদারতার পরিচয়।
আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শুধুমাত্র ধর্মের জনগোষ্ঠী নিয়ে যদি কোনো রাষ্ট্র গঠিত হয় সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যে সব দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী রয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয়বিধি প্রয়োগের অর্থ হলো, সংঘাত সৃষ্টির ব্যবস্থা করা। এই খেলায় এদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির গৌরবময় বিজয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে ফেলার অপচেষ্টায় পাকিস্তান-প্রেমিকরা সদা তৎপর। সমগ্র জাতিকে এই ধোঁকাবাজদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। দেশের মানুষকে শোষণ করার জন্য তারা নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণার পাঁয়তারা আর কিছুই নয়, বাঙালি জাতির পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে শোষণের শাসন কায়েম রাখাটাই বর্তমানে এদের প্রধান ষড়যন্ত্র।
(লিখাটি শেখ হাসিনা রচিত ‘ওরা টোকাই কেন‘ বইটি থেকে নেওয়া)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:৩৯