ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা আমাদের গণমাধ্যম সুকৌশলে চেপে রেখেছে। বিশ্বকাপ-২০১৫ চলাকালে ঘটনাটি আমার নজরে এনেছেন চট্টগ্রামের মুস্তফা কামাল আখতার। ঘটনাটি হচ্ছে— আশির দশকে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা চট্টগ্রামে প্রকাশ্য স্টেডিয়ামে বেধড়ক গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছিলেন! পঞ্চাশোর্ধ্ব মুস্তফা কামাল সেই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শীও বটে। তার সরবরাহকৃত লিংক ও উইকিপিডিয়া ঘেঁটে জানা গেল সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত।
১৯৮০ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আসিফ ইকবালের নেতৃত্বে বাংলাদেশে দুটো প্রীতি ম্যাচ খেলতে আসে পাকিস্তান। প্রথম ম্যাচের ভেনু ছিল চট্টগ্রাম। বিমানবন্দরে নেমেই ইমরান খান হাত-ইশারায় আগ্রহী দর্শকদের উদ্দেশে 'নমস্কার' জানাল। তখনই প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তরুণরা। ইমরান খান গোটা বাংলাদেশকে ভারতের অংশ ভেবে এবং সব বাংলাদেশীকে হিন্দু ভেবে দর্শকদেরকে সেদিন সালামের বদলে 'নমস্কার' জানিয়ে বিদ্রূপ করেছিল।এই ঘটনার সাক্ষী চট্টগ্রামের সেলিমউদ্দিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, 'শুরু থেকেই ওদের শরীরী ভাষায় তাচ্ছিল্য ছিল, এসব সহ্য হয়নি সদ্য-স্বাধীন-হওয়া দেশের তরুণদের। বিমানবন্দরেই পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদ আরেকটি ভয়াবহ কাজ করে। একজনের ছুড়ে-দেওয়া মালা সে পায়ে মাড়ায়! ফলে, মানুষ মারমুখো হয়ে ওঠে।'শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান দল পুলিশ-পাহারায় বিমানবন্দর ত্যাগ করলেও সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়, যার প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে। আবদুল আজিজ স্টেডিয়ামে ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের কথা শোনালেন জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী— 'চা-বিরতির পর হঠাৎ দেখি শোরগোল। বেশ কিছু যুবক স্লোগান ধরেছিল— একাত্তর ভুলি নাই, পাকিস্তানের ঠাঁই নাই।' মূলত পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের এদেশের স্বাধীনতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের কথা পত্রিকায় চলে আসায় মানুষ ক্ষেপে গিয়েছিল বলে জানান জাহাঙ্গির আলম।
পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা সেদিন আক্ষরিক অর্থে গণপিটুনির শিকার হয়েছিল। এই কথা জানা যায় শরদিন্দু দস্তিদারের কাছে— 'সেদিন দর্শকরা যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছেন, তা নিয়েই মাঠে ঢুকে পড়েছেন। তখনকার সময়ে নিরাপত্তার বিষয়টিও খুব-একটা গুরুত্বের সাথে দেখা হতো না। বোলার ইকবাল কাসিম দৌড়াতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনের সামনেই হোঁচট খায় এবং ১৮/১৯ বছরের একটি ছেলে তাকে চড় মারে।'এখনও চট্টগ্রামবাসী এই ঘটনাকে নিজেদের বীরত্ব বলেই মনে করেন।
এই নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল আনোয়ার বলেন, 'পাকিস্তানের সেই ক্রিকেটারদের মধ্যে খেলোয়াড়সুলভ কোনো মনোভাব ছিল না, ফলে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে আমরা ভুল করিনি।' মুস্তফা কামাল আমার পোস্টে মন্তব্য করে জানিয়েছেন— সেদিন পাকিস্তানি ক্রিকেটারদেরকে চট্টগ্রামবাসী চেয়ার দিয়ে পিটিয়েছিলেন!এই ঘটনার পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ক্রিকেটসম্পর্ক স্থগিত থাকে, দীর্ঘদিন তারা বাংলাদেশে দল পাঠানো থেকে বিরত থাকে। যথাযথ নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে নব্বইয়ের দশক থেকে তারা আবার বাংলাদেশে দল পাঠাতে থাকে।এই হচ্ছে প্রকৃত বীর বাঙালি!
বাঙালি তখনই জয়ী হয়, যখন তারা রুখে দাঁড়ায়; বাঙালি পরাজিত হতে থাকে, যখন পলাশির মতো তারা অন্যায় দেখে নিষ্ক্রিয় থাকে। এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্টেডিয়ামে খেলা চলাকালে এখন হাজার-হাজার পাকিস্তানি পতাকা দেখা যায়, এমনকি বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ চলাকালেও! বিজয়ের আট বছরের মাথায় বাঙালি সেদিন খোদ ক্রিকেটারদেরকে পিটিয়েই তাদের ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছিল। চুয়াল্লিশ বছরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় ঢের জল গড়িয়েছে, বাঘা বাঙালির তপ্ত রক্ত ব্যাঙের রক্তের মতো শীতল হয়েছে। পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমরা খোদ পাকিস্তানিদের দম্ভের দাঁতভাঙা-হাতভাঙা জবাব দিয়েছিলাম, এখন আমরা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি বেওয়ারিশদেরই জবাব দিতে পারি না। বছরে-বছরে কতটা অক্ষম, কতটা অথর্ব আর অমেরুদণ্ডী হয়েছি আমরা!খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না— বলে যেসব ভণ্ডের দল পাকিপ্রেমকে খেলাপ্রেমের আড়ালে জায়েজ করার চেষ্টা করে, তারা জেনে রাখুক— তাদের অবৈধ পিতা ইমরান-মিয়াদাঁদরা আশি সাল থেকেই খেলার সাথে রাজনীতি মিশিয়ে আসছে, এ দেশে খেলতে এসে আচরণ করেছে পাকিস্তানি সেনাদের মতোই, গণমাধ্যমে রেখেছে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য, পদদলিত করেছে বাংলাদেশী ভক্তদের উপহৃত মালা, বাংলাদেশকে বিবেচনা করেছে হিন্দুস্তানের অংশ হিশেবে আর সব বাংলাদেশীকে ভেবেছে হিন্দু!
এরপরও কি ভণ্ডের দল খেলার সাথে রাজনীতি না মেশাবার মাসআলা দেবে?বাংলাদেশ পাকিস্তানি শত্রুমুক্ত হয় ষোলোই ডিসেম্বর। মিরপুর শত্রুমুক্ত হয় ত্রিশে জানুয়ারি। অর্থাৎ জাতীয় বিজয় সূচিত হবার পরও মিরপুর দেড় মাস অবধি পাকিস্তানপন্থি বিহারিদের দখলে ছিল, মুক্তিযুদ্ধকালে যারা গঠন করেছিল আল-শামস নামক কিলিং স্কয়াড। বাংলাদেশের বৃহত্তম বধ্যভূমি বোধহয় মিরপুরেই অবস্থিত। সেই মিরপুরে আজ বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ, আজ সতেরোই এপ্রিল— ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ দিবস। আজকের এমন দিনে স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের কোনো বাঙালি সমর্থক দেখা গেলে ঘটনাস্থলেই তাকে প্রতিহত করা হোক। আইন হাতে তুলে নেয়া ভদ্রজনোচিত নয়; কিন্তু বাংলাদেশের জল-জোছনায় বেড়ে উঠে যারা বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচেও চানতারা-খচিত ঝাণ্ডা ওড়ায়, তাদের জন্য ভদ্রতা নয়, যথোপযুক্ত ডাণ্ডাই তাদের প্রাপ্য। কোনো বাঙালির হাতে আজ পাকিস্তানি পতাকা পাওয়া গেলে ঐ পতাকা দিয়েই পিঠমোড়া দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হোক, কারো গালে চানতারা-খচিত শাদা-সবুজ উল্কি দেখা গেলে তার গাল চটকানায়-চটকানায় লাল-সবুজ করে দেয়া হোক। যে বাঙালির হাত পঁয়ত্রিশ বছর আগে প্রতিহত করেছিল ইমরান-মিয়াদাঁদদের মতো বেআদবদেরকে, আজ সেই বাঙালির হাত প্রতিহত করুক ইমরান-মিয়াদাঁদদের বাংলাদেশী অবৈধ পুত্রকন্যাদেরকে।
(লিখাটি অনেক দিন আগে পেয়েছিলাম আমার এক প্রিয় ব্যক্তির কাছ থেকে। আজ যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে আফ্রিদি কটাক্ষ কারার পরও এদেশী পাকিপ্রেমীদের পাকিপ্রেম দেখি তখন শুধু এই লেখার কথাই মনে পড়ে।)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ৮:২৬