কিন্তু সমস্যাটা হল আমাদের দেশে প্রফেশনটা এখন আর শুধু মার্চেন্ট মেরিনার লেভেলে নাই। মেরিন একাডেমী এবং বিভিন্ন প্রাইভেট একাডেমীর কল্যাণে এটি এখন পেশা নয়। যেন একটি ব্যাংক। এখানে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট কর। ৫ বছর পর লাইফ ফকফকা!
অন্তত প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের প্রসপেক্টাস দেখিয়ে তো তাই বলতে চায়। তাইনা??
কয়দিন আগে একটা ফোন আসলো। এক বালক। মেরিনার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কতটা বিভোর?? সে আমাকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছে “ভাইয়া আমি তো বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীতে চান্স পাইনাই কিন্তু মেরিনে পড়তে খুব ইচ্ছা। তাই বাবারে বলে জমি বিক্রি করে ১৪ লাখ টাকা ম্যানেজ করেছি। এখন কোন একাডেমীতে ভর্তি হব বুঝতে পারছি না।”
হতবুদ্ধি আমি। এরে কি বলব?
আমরা এখনো ৩য় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। কেউ চোখের সামনে উচ্চ বেতনের চাকরি করতে দেখলে এখনো আমাদের চোখ টাটায়, মন আনচান করে।
কেউ জানে না এই পেশার মানুষের অব্যক্ত কথাগুলো। প্রথম দিকে খুব কষ্ট হত। সারাদিন ডিউটি করে যখন কখনো রাত ২ টা/ ৩ টার দিকে চোখ ডলতে ডলতে আবার ব্রিজে আসা লাগত বা একটা ওয়াকিটকি হাতে ফরোয়ার্ডে যাওয়া লাগত এঙ্কর ফেলার জন্য। নিঃসঙ্গ চাঁদের ক্ষীণ আলোয় নিজের ছায়া দেখতাম আর ভাবতাম ধুর শালা লাইফে টাকাই কি সব?
সিঙ্গাপুর থেকে শুনলাম দাদি অসুস্থ। আমাকে দেখতে চায়। জাহাজ দেশে আসতে আসতেই সব শেষ।
মাঝে মাঝে এমন কোন পোর্টে যেতাম যেখানে কোন ফোন করার সুবিধা নাই। থাকলেও এত কস্টলি যে দেশে ফোন করে ১ ঘণ্টা কথা বলাও চরম বিলাসিতা।২০ দিন পর ৫ মিনিট কথা বলে যেন আরও খারাপ লাগত।
এগুলা কারোরে বলি না। কারন আমি প্রফেশনাল। জাহাজ চালানো আর পিক আপ ভ্যান চালানো এক না যে যখন তখন যা খুশি তা করলাম।
কিন্তু কাউকে যখন বলব যে না এই পেশায় আইস না। অনেক কষ্ট। চোখ বড় বড় করে তাকায়। আর মনে মনে বলে, “হুহ! নিজে এত টাকা কামাও তাই ভাবো আমি আসলে তোমার টাকায় ভাগ বসামু।” তারপর যাই ব্যাখ্যা দিবো সব কানের উপর দিয়ে যাবে। শেষে বলবে জি ভাই বুঝছি। কিন্তু দুইদিন পর এসে বলে, স্যার ভর্তি হয়ে আসলাম। মনে হয় আমি কতটা হিংসিত তা আমার মুখের অভিব্যক্তিতে দেখার চেষ্টা করছে। ২ টা বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার।
মেরিন পেশা কে আলু পটলের ব্যবসার মত সস্তা বানানো হল। কতটা সস্তা?? একসময় ঢাকার সব সিএনজি এর পিছনে মেরিন সিটি র এড দেখতাম। তখন থেকেই শুরু। এরপর??
ছ্যাঁচড়ামি তে রেকর্ড।
এক এক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ভাষা। “গর্ব কর বাংলাদেশ, গর্ব কর!!”
রাস্তার মোড়ে মোড়ে মেরিনে ভর্তির রঙ্গিন বিজ্ঞাপন। এমনকি রাস্তার আইল্যান্ডেও।
তারপর সর্বশেষ সংস্করণ। মেইলে ছ্যাঁচড়ামি। EKHANEI.COM এ একটা এড দিয়েছিলাম। পরের দিন সকালে মেইল চেক করতে গিয়ে দেখি ঐ এডের রিপ্লাই এ এক প্রাইভেট মেরিন একাডেমীর মেইল।
ছ্যাঁচড়ামিও এখন ডিজিটাল। হা হা হা! আমার লেখা গুলো পড়ে মনে হচ্ছে প্রাইভেট একাডেমীর সাথে এক অঘোষিত শত্রুতা আছে আমার। না প্রাইভেট একাডেমী না শুধু। আমার নিজের একাডেমীর প্রতিও আমার বিদ্বেষ। যারা ইমেজ ফান্ডের নামে প্রতি মাসে ক্যাডেটদের কাছ থেকে ১০০০ টাকা করে আদায় করছে এবং দেশ বিদেশে মেরিনারদের ইমেজ উদ্ধার করছে।
হুম। তাইলে তো ঠিক ই আছে। একাডেমী ক্যাডেট কমানোর জন্য তারা ক্যান সুপারিশ করবে? প্রতি মাসে ২৫০X১০০০ টাকা উপরি ইনকাম। সোনার ডিম পাড়া হাঁস কমে গেলে তো লস। তাই সরকারকে বুঝাও যত ক্যাডেট তত রেমিটেন্স, বাইরে মেরিনারের অনেক ডিমান্ড। ক্যাডেট প্রোডাকশন ১৫০/২০০ দিয়া হবে না। ৫০০ কর। মন্ত্রীরে যা বুঝাও তাই বুঝবে।
যত মুরগি, তত পালক, আর তত আমাদের আরামের তুলতুলে বালিশ।
হুম। কোয়ালিটি প্রোডাক্ট বন্ধ করা যাবে না। তোমরা কোর্স শেষ করে জব না পায়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরো। আমাদের কি। IMO STANDARD গোল্লায় যাক। বাংলাদেশ STCW তে ব্ল্যাক লিস্টেড হোক। মইরা যাক। আমাদের ব্যাংক একাউন্ট এখন LOADING…. ডোন্ট ডিস্টার্ব আস।
এই বাণিজ্যে কার লাভ? দেশের নাকি আমাদের?? নাহ। যারা খাঁচায় মুরগি ভরছে তাদের। তুমি আর আমি ট্রেইনী ক্যাডেট, জুনিয়র অফিসার। সুস্বাদু রোস্ট। তোমার স্বপ্ন কান্না হবে। আর ওদের পকেট ভারি হবে।
আমার এক বন্ধু মনের দুঃখে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো। “শালা বিমান চালানো ও আন্তর্জাতিক পেশা, তাদের স্যালারী ও হাই, তাদের লাইফ স্টাইল আমাদের মত এবং ক্ষেত্র বিশেষে আরও অনেক ভালো। কিন্তু তারা তো এরকম হাজারটা একাডেমী খুলে ব্যবসা করতেছে না, ডাহা মিথ্যা কথা বলে টাকা হাতাচ্ছে না।”
আরেক ব্যাচমেট তার নিচে কমেন্ট করছে, “কারন তাদের পেশায় কোন চুতিয়া এবং হারামজাদা কিসিমের সিনিয়র নাই।”
আমাকে ফোন করা ঐ ছেলেটারে কিছু বলি নাই। কারন যে এত ডিটারমাইন্ড তারে আর কি বলব। শুধু বললাম, “যেটা পছন্দ হয় ভর্তি হয়ে যাও। সব এক ই। পাস করে সবার অবস্থাই এক।”
তারে যা বলতে ইচ্ছা করছিল, “ভাইরে লাইফটা এভাবে নষ্ট করিছ না। জমি বেছচস টাকা বাপরে দিয়া আয়। কি দরকার টাকাটা পানিতে ফেলার? প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, টাকা কামানোর অনেক লাইন আছে। একদম পড়ালেখা করতে মন না চাইলে ফ্রীল্যান্সিং কর। চোখের সামনে আমার লগের পোলাপান ৮/১০ পৃষ্ঠার প্রোগ্রামিং কোড লিখে, গ্রাফিক্সের কাজ করে মাসে ২ লাখ টাকা কামায়। যা কোর্স কইরা এগুলা শিখ। কামে দিব। কি দরকার জীবিকাটারে হুমকির সম্মুখীন করার? ”
কিন্তু বলি নাই। কারন I AM A PROFESSIONAL MARINER.
তথ্য সম্পর্কিত মিডিয়া নিউজ লিঙ্ক এবং স্ক্রিন শট সোর্স
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৫১