দেশ থেকে শত সহস্র মাইল দূরে বিশাল নীল জলরাশির মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দে পানি কেটে এগিয়ে চলছে একটি জাহাজ। নাবিকেরা সবাই বাংলাদেশি। মাসের পর মাস দেশ থেকে, মাটি থেকে আর প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। বেতন হিসেবে পাওয়া ইউ এস ডলার বা ইউরো গুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশে। মাঝে মাঝে বুকের কোনে নিঃসঙ্গতার সুর বাজে। কাজের ফাঁকে হয়ত মনে পড়ে যায় প্রিয়জনের মুখটা। গুন গুন করে কেউ হয়ত গেয়ে উঠে “ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া।/ বন্দী হইয়া মনয়া পাখি হায়রে কান্দে রইয়া রইয়া।”
সমুদ্র জীবন নিয়ে মানুষের অনেক কৌতূহল থাকে। আমার সমুদ্র জীবনের মাত্র ১২ মাস হতে চলল। এখনও এই ক্যারিয়ারে আমি ছুটু মানুষ। আজ সমুদ্র জীবনের কিছু মজার গল্প শেয়ার করি। আগেই বলে রাখি। এগুলো সব শোনা গল্প অথবা বিভিন্ন জায়গায় পড়া। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নয়। তবে মনে হয় সবারই ভালো লাগবে। বিশেষ করে ব্লগে আমার মেরিনার বন্ধুদের।
IRISL ইরানের জাতীয় শিপিং কোম্পানি। বাংলাদেশের যেমন BSC. ওই জাহাজে কোন এক অফিসার। ৯ মাসের কন্ট্রাক্ট পেপার সাইন করে উঠেছে। এর মধ্যে জাহাজ পুরা দুনিয়া এক চক্কর দিয়ে ফেলেছে। ৯ মাস শেষ হয়ে ১০ মাস, ১১ মাস, ১২ মাস। কোম্পানি সাইন অফ ই করায় না। এই পোর্ট এ এই প্রবলেম, ওই পোর্ট এ এই প্রবলেম এসব হাবিজাবি বলে বেচারার সাইন অফ ব্লক। হয়ত তাদের ইচ্ছা জাহাজ আবার ঘুরে ইরান গেলেই ওরে নামাবো। তো এবার এক ক্রু তাকে বুদ্ধি দিল। স্যার আমি তো এই কোম্পানিতে বহুত দিন আছি। এক কাজ করেন। আবার সাইন অফ লেটার দেন। তবে সাইন অফের কারন হিসাবে লেখেন আমার বউয়ের বাচ্চা হবে। জরুরী ভিত্তিতে নামা দরকার। মুসলিম দেশ তো। এই জিনিসকে গুরত্ব দেয় আর আপনার সাইন অফ কনফার্ম। ওই অফিসার তাই করলো এবং হাতে হাতে ফল। নেক্সট পোর্ট এই প্লেন টিকিট ধরায়া বাড়ি পাঠায়া দিল। কিন্তু পরে সবাই বুঝতে পারলো আয়হায় এইটা কি হইল। কোম্পানি বুঝতে পারলো না ক্যান?.........। যাহোক আপনি ধরতে পেরেছেন তো??
আরেকটা ঘটনা বলি। আমাদের দেশি কোন একটা জাহাজের ঘটনা। ওই জাহাজে নতুন (ফ্রেশ) একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (জুনিয়র) উঠেছে। তো জাহাজের ডেক ক্যাডেট আর থার্ড মেট প্ল্যান করলো ওরে বকরা বানানো যায় কিভাবে। প্ল্যান অনুযায়ী তার কাছে গিয়ে বলা হল, জাহাজের সিস্টেম অনুযায়ী সাপ্তাহিক ভিত্তিতে আপনাকে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল পরিশোধ করা লাগবে। এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে তার কাছে বিল আসতে থাকল। জাহাজের কম্পিউটার রুম থেকে প্রিন্ট করা সুদৃশ্য বিল। তার উপর আবার মাস্টার এর সিল। অবিশ্বাসের কোন কারন নেই। খালি পানি আর বিদ্যুতের দাম টাই অবিশ্বাস্য। কখনো ৪.২৫ ডলার, কখনো ৫.৩৭ ডলার, কখনো ৩.৬৯ ডলার। এরকম অড ফিগার। বেচারা ভেবেই পায় না কোন মিটার ছাড়া এত নিখুঁত হিসাব জাহাজে কিভাবে করে। শুরু করলো রেশনিং। পানি খরচ কমিয়ে দুই দিনে একবার গোসল করা শুরু করলো। কেবিনে বিদ্যুতের অপচয় কমাতে এসি, ফ্যান, লাইট, টিভি সব অফ। তাও মাস শেষে বিল হিসাবে ১৫ ডলারের মত পে করা লাগলো। বাপরে না করেই এই অবস্থা। খরচ করলে তো পুরা বেতন ই যাইত এই ভেবে বেচারা শিহরিত হয়। আর পুলকিত হয় যাহোক খাদ্য তো ফ্রি। এটা দিয়া ওইটা পুসায়া নিমু। কিন্তু কয়দিন পর এক পার্টিতে যখন তাকে বিশেষ বকরা পুরস্কার হিসেবে ১৫ ডলার দেয়া হল এবং সবার সামনে ঘোষণা করা হল তখন সে বুঝতে পারলো আসলে সে ষড়যন্ত্রের শিকার। এতদিন সবাই মজা দেখার জন্য বিষয়টা চেপে যাচ্ছিল।
আজ এ পর্যন্তই থাক। আরেকদিন সময় পেলে লিখব। ভালো থাকবেন সবাই। আজ কালের মধ্যেই আবার চলে যাচ্ছি দেশ ছেড়ে। দোয়া করবেন।
সমুদ্রবাড়ি
তারা পরিচিতি- কালপুরুষ, THE ORION
তারা পরিচিতি- সপ্তর্ষিমণ্ডল, THE URSA MAJOR
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:২৯