একাডেমীতে ন্যাভিগেশনের কোন এক ক্লাসে এক ইন্সট্রাক্টর বলছিলেন আজ তোমাদের আমি কিছু তারা চিনাবো। খুব সুন্দর জিনিস। তোমরা তোমাদের গার্লফ্রেন্ডকে ইম্প্রেস করতে পারবে। গার্লফ্রেন্ডকে ইম্প্রেস করা আর হয়ে উঠেনি। তবে আপনাদের কে কিছু তারা শিখিয়ে দেই। চেষ্টা করে দেখেন আপনারা কাউকে ইম্প্রেস করার ক্ষেত্রে সফল হন নাকি। অবশ্য এর জন্য একটু রোমান্টিক হতে হবে। ছাদে গিয়ে তারা দেখাতে দেখাতে কথা বলুন।
আমি যখন ক্লাস ওয়ান টুতে পড়তাম তখন রাতে লোডশেডিং এর সময় গরমে বিরক্ত হয়ে আম্মার সাথে বাইরে বেরুতাম। তেমনি কোন এক রাতে আকাশে তিনি কিছু অদ্ভুত সুন্দর তারার বিন্যাস দেখিয়েছিলেন আমাকে। উনি তখন এর নাম বলছিলেন আদমসুরত। পরে জানতে পেরেছিলাম এই আদমসুরত আসলে কালপুরুষ বা অরিয়ন। মানুষের আকৃতি বলে প্রাচীন ভারতে এটি আদমসুরত নামে পরিচিত। পাঠকরা যদি দেখতে চান তবে এখনকার বাংলাদেশ সময়ে রাত সাড়ে এগারোটা বা বারটায় (উঁচু দালানের জন্য দেখতে না পেলে রাত ২ টায়)পূর্ব আকাশে চোখ মেলুন। অন্য সময় সন্ধ্যাতেও থাকে। উদয় অস্তের সময় ঋতু ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। তিনটি তারা উপর থেকে নিচে পর পর সাজানো এরকম খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। খুঁজে পেতে খুব বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এর উল্লেখযোগ্য তারাগুলো মহাকাশের বিষুবীয় অঞ্চলে অবস্থান করায় পৃথিবীর সব অঞ্চল থেকে একে দেখা যায়। উত্তর গোলার্ধে শরতের শেষ সময় হতে বসন্তের প্রাথমিক সময় পর্যন্ত কালপুরুষ দেখা যায়।
এবার এদের কে মনে মনে রেখা টেনে যোগ করুন। অনেকটা এরকম ভাবে।
কি ব্যপার?? আকৃতিটাকে কি একজন যোদ্ধা ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে?? তাহলে নিচের ছবিটা নিয়ে মিলিয়ে ফেলুন। তিনটি তারা কালপুরুষের বেল্ট।
এবার তারাগুলোর নাম শিখে নিন। কালপুরুষের কোমরের টানা তিনটি তারার নাম যথাক্রমে Mintaka(চিত্রলেখ), Alnilam(অনিরুদ্ধ) এবং Alnitak (ঊষা). এই তারাসমষ্টিটি এক সরলরেখায় উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মুখ করে অবস্থান করে। সর্ব উত্তরে চিত্রলেখ এবং সর্বদক্ষিণে ঊষা অবস্থান করে। উপরে তরবারি ধরা বাহুতে একটি ভিন্ন উজ্জ্বলতার তারা যা দেখে সহজেই আলাদা করা যায়। এর নাম Betelgeuse (আদ্রা). অপর বাহুতে যে সিংহ (অনেকের মতে যোদ্ধার ঢাল) ধরা ওই পাশের উজ্জ্বল তারাটির নাম Bellatrix (কার্ত্তিকেয়).এর অপর নাম হচ্ছে নারী যোদ্ধা বা Warrior woman। কার্তিকেয়'র পশ্চিমে ছোট ছোট কয়েকটি তারা ধনুকের আকৃতি ধারণ করে আছে দেখা যায়। এগুলো কালপুরুষের হাতের দন্ডের আকার দেয়। আর কালপুরুষের দুই পা এর ডান পায়ের তারাটির নাম Saiph (কার্তবীর্য)। কোমরবন্ধের নিচে পূর্বদিকে এর অবস্থান। আর বাম পায়েরটি Rigel (বাণরাজা). বেল্ট এর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এটি একটি অতিদানব নীলাভ-সাদা তারা। আকাশের উজ্জ্বলতম তারাগুলোর অন্যতম। কালপুরুষের তারাগুলোর মধ্যে আমাদের থেকে সবচেয়ে কাছে রয়েছে Bellatrix (২৪৩ আলোকবর্ষ ) আর সবচেয়ে দূরে Alnilam (১৩৪২ আলোকবর্ষ)।
পশ্চিমারা এই তারকা গুচ্ছকে ORION বলে। কিন্তু আরবীয় সংস্কৃতিতে একে বলে দানব (THE GIANT). প্রাচীন মেক্সিকানরা অরিয়ন বেল্টের তিনটি তারাকে ও এদের কাছাকাছি আরও কয়েকটি তারাকে একত্রে ডাকতো Mamalhuaztli বা the new fire. আবার Polinesian রা এই বেল্টকে ডাকত বিড়ালের দোলনা the cradle of cat বলে।
সুমেরীয়রা কালপুরুষকে একটি জাহাজ হিসেবে কল্পনা করত। প্রাচীন চীনে এটি ছিল রাশিচক্রের ২৮ টি রাশির একটি যার প্রতীক ছিল Xiu (宿)। এই রাশিটি সেখানে শেন নামে পরিচিত ছিল যার অর্থ তিন । কালপুরুষের কোমরবন্ধের তিনটি তারা দেখেই তারা এই নামকরণ করেছিল।
কালপুরুষের কোমরবন্ধ এবং তরবারি নিয়ে প্রাচীন এবং আধুনিক অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। বর্তমানকালেও আমেরিকার ২৭ পদাতিক ডিভিশনের কর্মকর্তা ও সৈন্যদের কাঁধের প্রতীক হিসেবে কালপুরুষের কোমরবন্ধ এবং তরবারি ব্যবহৃত হয়। এর একটি কারণ হতে পারে এই ডিভিশনের প্রথম সেনাপতি ছিলেন জন এফ অরিওন।
যে যাই ডাকুক এই ৭টি তারা সমুদ্রচারীদের জন্য Navigational star হিসেবে পরিচিত। এরকম আরও ৫০ টি Navigational star রয়েছে যারা গভীর সমুদ্রে সমুদ্রচারীদের পরম বন্ধু।
আশা করছি আপনারা অনেক আনন্দ নিয়ে লেখাটি পড়বেন। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:০৩