একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে ছাত্র রাজনীতি খুব কাছ থেকে দেখতে হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি যারা করে তারা যে রাজনৈতিক কোনো আদর্শ থেকে তা করে তা নয়। মূল বিষয় হচ্ছে হলে থাকা, রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় থেকে সুবিধা আদায় করা। অসচ্ছল পরিবারের সন্তানরা অধিক সংখ্যায় ছাত্ররাজনীতে যুক্ত হতে বাধ্য হয়, কারণ হলে থাকাটা তার জন্য অনেক জরুরী। হলের বাইরে থাকা খাওয়ার খরচও বেশি। অনিচ্ছা সত্বেও এরা ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। একারণে ক্ষমতার রদবদল হলে ব্যাপক ছাত্রকে ডিগবাজি খেতে দেখা যায়।
ছাত্র রাজনীতিবিদদের আরো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা পরীক্ষা ড্রপ দেওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত পারদর্শী, হলের ক্যান্টিনে ফ্রি খাওয়ায় এদের জুড়ি মেলা ভার। একদল ব্যস্ত থাকে টেন্ডারবাজিতে, আরেকদল ব্যস্ত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাইতে। ভার্সটি খোলা বন্ধ থাকা তাদের মর্জির ব্যাপার। বাংলাদেশের পাবলিক ভার্সিটির সেশন জ্যাম ছাত্র রাজনীতির একক অবদান। জামাত শিবিরের ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে ওঠা সম্ভব হতো না, যদি ছাত্র রাজনীতি না থাকতো।
এক শ্রেণীর শিক্ষকরা ছাত্র রাজনীতির সাফাই গান। আবার ঐ শিক্ষকই যখন কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন, তখন গর্ব করে বলেন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নেই। প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রোস্পেকটাসে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলা হয় যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র রাজনীতি নেই।
এদেশে রাজনীতিবিদরা একটা যুক্তি দেন যে, মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার কোনো মানে হয় না, তাই তারা মনে করেন ছাত্র রাজনীতি জরুরী। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে দেখা যায় না। হয় বিদেশের কোনো ভার্সিটি অথবা দেশের কোনো নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করে। হাজার সনি, আবু বকর, ফারুক মরলেও এই রাজনীতিবিদদের কিছু আসে যায় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজনীতি না করলে তাদের হয়ে কে লেজুরবৃত্তি করবে এই চিন্তাই রাজনীতিবিদদের কাছে প্রাধান্য পায়।
ছাত্র রাজনীতির সমর্থকদের আরো একটি খোঁড়া যুক্তি হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়। নটরডেম কলেজে প্রায় উনিশটি ক্লাব আছে । এক্লাবগুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে সেখানকার ফাদারদের একটি বিশেষ চিন্তা কাজ করেছিলো। ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্ব ও মননশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে। এই কলেজ তা করে দেখিয়েছে। আজ দেশের বড় বড় সরকারি কলেজগুলো যেখানে ছাত্রনেতাদের ভর্তি বাণিজ্য, রাজনৈতিক দস্যিপনার শিকার, সেখানে প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও নটরডেম কলেজ শিক্ষা ও এক্সট্রা কারিকুলার ক্ষেত্রে তার সাফল্য ধরে রেখেছে। আমার মনে আছে কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক করতে বিচারকের আসনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির যে সব ছাত্র রাজনীতিবিদরা বসে ছিলো তাদের জ্ঞানের বহর দেখে আমরা আড়ালে হাসাহাসি করেছিলাম। জীবনে কখনো বিতর্ক না করেও শুধু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সেখানে বিতর্কের বিচারক হওয়া যায়!!!!!!
আমরা যারা সাধারণ ছাত্রছাত্রী তারা অন্তত এটুকু বুঝি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার জন্য, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য, দেশাত্ববোধ জাগ্রত করার জন্য আর যাই হোক ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি ছাড়াই জ্ঞানচর্চা সম্ভব হচ্ছে, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে, সেখানে আমাদের দেশে পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি উপহার দিচ্ছে একদল আত্মমর্যাদাহীন অন্তঃসারশুন্য অমানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৩৯