কিছু কিছু লিখার ভূমিকা লিখা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই ভূমিকা ছাড়াই শুরু করতে হয়। বিশেষ করে যখন দেখি আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটি মূলত নষ্টদের আস্তাকুঁড় আর আমরা সেটা দেখেও না দেখার ভান করি তখন একটা গভীর লজ্জা পেয়ে বসে আমাকে। যাই হোক, ভূমিকার অকাল শ্রাদ্ধ করে মূল টপিকে আসি। আমেরিকাতে প্রতি ছয়টি ছেলেশিশুর একজন ১৬ বছর বয়সের আগেই সেক্সুয়াল এবিউসের শিকার হয়। আর আমাদের পাশে দেশ ভারতে সেক্সুয়াল এবিউসের শিকার হওয়া শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫৩.২২%। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী। ভাবছেন আমরা খুব ভালো আছি ধর্মীয় রক্ষা কবচের আড়ালে? আমরা ভালো নেই। এদেশে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। জরিপের আড়ালে মেইনস্ট্রীম পত্রিকার উড়নচন্ডী রূপ আমাদের অজ্ঞাত নয়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল সেক্স শব্দটা বর্তমানে আমাদের দেশের জন্য একটা ট্যাবু হয়ে গেছে। আর আট দশটা ঘটনার মত শিশু নির্যাতনের কোনো খবরেও তাই আমরা থাকি কেমন যেন নিস্পৃহ। অনেকটা শামসুর রাহমানের একটি ফটোগ্রাফ কবিতার সেই শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবার মত, যার সন্তানের মৃত্যু স্মৃতি হয়ে ঝুলে থাকে দেয়ালের ফটোগ্রাফ হয়ে। আর বাবার নির্লিপ্ততায় ফটোগ্রাফের সন্তান শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আজ আমাদের সমাজে শিশুদেরও একই ঘটনা অতিক্রম করতে হচ্ছে। কিছু বিষয় মেনে নেয়া কষ্টকর;এমনই কষ্টকর যে নিজেদের মানুষ ভাবতে ঘেন্না হয়। আজ এমনই এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি।
প্রথমেই জেনে নিই শিশু নির্যাতনের শুরু কিভাবেঃ শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন কোন নতুন ঘটনা নয়। প্রাচীন গ্রীসে ছেলেশিশুদের সাথে বয়স্ক ব্যক্তিদের যৌন সম্ভোগকে শিক্ষার অংশ বলে মনে করা হত। প্রাচীন এথেনিয়ান উচ্চবিত্ত সমাজে এটি ছিল একটি শিক্ষা – সম্বন্ধীয় প্রথা যেখানে একটি সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত ছেলেদের পরিবার বহির্ভূত বয়স্ক পুরুষদের সাথে যৌন সঙ্গম ঘটে। এই বিষয়ে স্যার হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা মুভির কথা উল্লেখ করা যায়। প্রায় দুই হাজার বছর আগে মিশরীয় যাজক যাজিকারা একটা ধর্মীয় প্রথা পালন করতো যাকে বলা হয় হায়ারোস গামোস যার অর্থ হল পবিত্র বিয়ে। হায়ারোস গামোসের সাথে যৌনাকাঙ্খার কোনো দৃশ্যত মিল নেই। এটাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক ব্যাপার। ঐতিহাসিক ভাবে যৌনমিলনকে দেখা হত নারী পুরুষের ঈশ্বর দর্শনের অভিজ্ঞতা হিসেবে। এই বিষয়ে যদি কারো বিস্তারিত জানতে ইচ্ছা হয় তাহলে Faramerz Dabhoiwala এর The Origins of Sex বইটা পড়ে নিতে পারেন। এই বইতে আদিম কাল হতে চলে আসা যৌনতার দৃষ্টিভঙ্গী বিবর্তন নিয়ে খুব সুন্দর রেফারেন্স দেয়া হয়েছে যা এই বইটাকে মাস্টারপিস বানিয়ে দিয়েছে। মিশরীয় মিথ অনুযায়ী নারী পুরুষের মিলনের মাধ্যমে পুরুষ সম্পূর্নতা অর্জন করে যাকে বলা হয় gnosis বা স্বর্গীয় জ্ঞান। মিশরীয় রা পবিত্র নারীদের বিশেষ করে কম বয়স্কা কুমারীদের ব্যবহার করে হায়ারো গামোস অনুষ্ঠান পালন করতো। সেই অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হত মিশরীয় যৌনতার দেবতা amon এর কাছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, দেবতা amon এর ছিলো তীক্ষ্ণ বাঁকানো শিং, যে শিং বা horn থেকে এসেছে আধুনিক যৌন স্ল্যাং horny। আর প্যাগানরা একই ভাবে নারী শিশুর উপর যৌন নির্যাতন করতো। কারন তাদের মিথ অনুযায়ী জেসাস ক্রাইস্ট কুমারী মেরীর গর্ভে জন্ম নিয়ে অপবিত্র করে দিয়েছিলো নারীদের রক্ত। সেই রক্ত পবিত্র করতে তারা অদ্ভুত আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারী শিশুদের উপর যৌনাচার করতো। এমনকি প্রথম দিকের ইহুদী ঐতিহ্যেও ছিলো শিশুদের উপর ধর্মীয় যৌনাচার। পুরুষরা আধ্যাত্মিকরা সম্পন্ন করতে যৌনাচার করতো শিশুদের সাথে (হিব্রুতে যার মানে হল হায়ারোস ডুলে)। ইহুদি টেট্রাগ্রামাটন YHWH হচ্ছে ঈশ্বরের পবিত্র নাম যার উদ্ভব জিহোভাহ্ থেকে-যা হল পুরুষ জাহ্ এবং নারী ইভ্ এর প্রাক হিব্রু নাম হাভাহ্ এর সম্মিলিত রূপ। উপমহাদেশে নারী শিশুদের বাল্য বিবাহ প্রথা বিরুদ্ধে আন্দলন শুরু হয় অষ্টাদশ শতকে এসে। ঠিক কবে কোন গোত্রে এই প্রথার শুরু হয়েছে সেটা জানা না গেলেও এই প্রথা উপমহাদেশের সমাজ সংস্কৃতির স্বাভাবিক অনুষঙ্গ ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায় বিভিন্ন ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের বর্ণনায়। ঐ যুগে অবিবাহিত নারী ছিল সমাজের চোখে একটি নিন্দনীয় বিষয়। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে তৎকালীন সমাজের বাল্য বিবাহ প্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে স্ক্রাফটনের মন্তব্য, “এই উপমহাদেশের ছেলেমেয়েদের শিশুকালে বিয়ে দেয়া হতো। ১২ বছর বয়সে একজন রমনীর কোলে একটি সন্তান- এটা ছিলো সাধারণ দৃশ্য”। সে যুগে ৬-৭ বছর বয়সের পর অবিবাহিত নারী ঘরে থাকা মানেই অসম্মানজনক একটি বিষয়। অবিবাহিত নারীর বাবা-মা সমাজের সকলের চোখে ছিলো নিন্দনীয়। যাই হোক, এই বিষয়ে আরো অনেক রেফারেন্স আমি দেখাতে পারবো। কিন্তু পোস্ট অযথা বড় করার ইচ্ছে নাই।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনঃ গত পাঁচ বছরে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৬০ শতাংশের শিকার হয়েছে শিশুরা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের তথ্য হলো, গত ১০ বছরে ধর্ষণসহ যত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মামলা হয়নি। বিচারের হার এক শতাংশেরও কম। ব্র্যাকের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগাল এইড সার্ভিসেসের পরিচালক ফস্টিনা পেরেরা প্রথম আলোকে বলেন, 'শিশুদের জন্য পরিবেশ এখন আগের চেয়েও বেশি অনিরাপদ। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজের। কিন্তু সমাজ এগিয়ে আসছে না।’ জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সাবেক নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার উদ্বেগজনক। সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সংশোধনের চেষ্টা করছে।’
আরো কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাইঃ WHO এর হিসেব মতে প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশে এই সংখ্যাটি কত তার কোন পূর্নাঙ্গ পরিসংখ্যান আমি পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক ফারাহ দীবার করা সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা যায় স্কুলপড়ুয়া ছেলেদের প্রায় ৭ শতাংশ এবং মেয়েদের ১৬ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়। ইউনিসেফের রিপোর্টটিতে যে ৬৯টি কেস স্টাডি আছে ওতে ডাটা কালেকশনের সময় কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটিকে অধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সরকারীভাবে কোন সমীক্ষা চালানো হয় নাই যেটা কিনা ভারতে হয়েছে। ভারতে সরকারীভাবে Ministry of Women and Child Development এর অধীনে ১৩ টি রাজ্যে চালানো এই সমীক্ষায় দেখা যায় প্রায় ৫২.৯৪% ছেলেশিশু আর ৪৭.০৬% মেয়েশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। ফারাহ দীবার করা সমীক্ষাটি স্বল্প পরিসরে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। আর ইউনিসেফের রিপোর্টটিকে আদেও কোন সমীক্ষা বলা চলে না। তবে ধারণা করা যায় পুরো চিত্রটি বুঝি আরও বীভৎস, ভয়ংকর। এটি এমন এক প্লেগ যা বাংলাদেশের সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এদেশে নির্যাতিত শিশুদের মোট সংখ্যাটি ভারতের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়।
সবচেয়ে অনিরাপদ হল কন্যাশিশুরাঃ মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিউম্যান রাইটস মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ সালে ৪৫৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়। এদের মধ্যে ২০২ জন নারী ও ২৫২ জন শিশু। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৪৫৬ জনের মধ্যে ২১৩ জন ছিল নারী ও ২৪৩ জন শিশু। ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা ছিল ২৯৯ জন ও শিশু ৪৭৩ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, শুধু ২০১৩ সালের
জানুয়ারিতে নয়জন নারী ও ২৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে আটটি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের অনুসন্ধানে পর্নোসাইটে ৮৪টি ওয়েবসাইট ও ওয়েবপেজ খুঁজে পাওয়া গেছে । তবে এই পরিসংখ্যান নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। গুগলে বাংলাতে নারী, মেয়ে ইত্যাদি লিখে সার্চ দিলেই হাজির হয় বিকৃত রুচির সব গল্প। ফেসবুকে ঢুকলেই দেখা যায় বিভিন্ন বিকৃত রুচির ওড়না পেইজ। এসব পেইজে লাইকও আছে প্রচুর। তাছাড়া মেয়েদের ছবি নিয়ে ব্যবসা তো আছেই। অশ্লীল পেইজে নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে এসব ছবি। নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিও, স্থিরচিত্র, পতিতাবৃত্তির জন্য বিজ্ঞাপন বা অশ্লীল কাহিনী প্রচার-প্রকাশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯২, ২৯৩ ধারা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন ২০০৬-এর পরিপন্থী। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়,বর্তমান ইন্টারনেটের তথ্য ভান্ডারের প্রায় ২৫ ভাগই পর্ণোগ্রাফী। বর্তমানে ইন্টারনেটে মোট ২০,৫২,০৩,২০০ টি ওয়েবসাইটের মধ্যে ৫১,০০০০০০ টি পর্ণোগ্রাফী ওয়েবসাইট রয়েছে। শিশুদের নিয়ে তৈরি অশীল ছবির ওয়েবসাইট রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি। ১০ লাখের বেশি শিশুর ছবি রয়েছে এসব সাইটে। ১০ লাখের মতো অপরাধী এ সব অবৈধ ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। এইসব দেখার জিন্য কেউ নেই। বরং অনেক সহজেই ব্যবসা করে যাচ্ছে এসব পর্নসাইট। সত্যি বলতে কি আমি স্পষ্ট করেই বলতে পারি,বাংলাভাষায় গুগলে মোট ইনফরমেশনের প্রায় ৮০% হল বিকৃত রুচির গল্প। আমি নিজেই এই পোস্ট লিখতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছি। গুগলে কিছু বিশেষ ট্যাগ ওয়ার্ড লিখে সার্চ দিলেই হাজির হচ্ছে যৌবন আমার লাল টমেটো টাইপের বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ ও ওয়েবসাইট। কি লজ্জাকর!!
বিচারের অগ্রগতি কেমন এইসব বিকৃত রুচির ঘটনারঃ মানবাধিকারকর্মী ও সমাজ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিচার হয় না বলেই ধর্ষণের ঘটনা কমে না। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে যারা সহযোগিতা পেয়েছে, তাদের মামলাগুলোর কী অবস্থা, জানতে চাইলে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, গত ১০ বছরে ঢাকায় ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার
৯৮০টি। মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৫৬টি। শাস্তি হয়েছে ৪০টি ঘটনায়।
নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য হলো, রাজশাহীতে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের চার হাজার ১৬৯টি ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১৪টি, শাস্তি হয়েছে ২৫ জনের। চট্টগ্রামে দুই হাজার ৩৭টি ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৯৯টি, শাস্তি হয়েছে পাঁচজনের। সিলেটে দুই হাজার ২১৯টি ঘটনায় মামলা ৩৮৬টি, শাস্তি হয়েছে দুটিতে। খুলনায় দুই হাজার ৩১টি ঘটনার মধ্যে ২৯৩টি মামলা হয়েছে, শাস্তি হয়েছে দুটিতে। বরিশালে এক হাজার ২০০টি ঘটনায় মামলা হয় ৩৫৩টি, শাস্তি হয়েছে চারটিতে। তাও এসব পরিসংখ্যানের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যে দেশে শুধু মাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কেউ যদি শাপলা চত্বরে দুই হাজার লাশের রূপকথা সৃষ্টি করতে পারে সেই দেশে এমন নির্যাতনের দুই হাজার ঘটনাকে দুইশত তে নামিয়ে আনা অসম্ভব কিছুই নয়।
শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন কিছু পরিবার বলেছে, এ ক্ষেত্রে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর মামলা ঝুলতে থাকে। ২০১০ সালে ঢাকার কাছে আড়াই বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটির পরিবার উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা থেকে সে বছরই রাজধানীতে আসে। মেয়েটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর ধরে মামলা চলছে। কবে মামলা শেষ হবে, তা কেউ
কচ্ছেও না।’
পুলিশের ব্যর্থতায় পরিস্থিতি আরো লাগামছাড়াঃ পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগও তুলেছে ভুক্তভোগী বেশ কিছু পরিবার। রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় ধর্ষণের শিকার হয়ে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী আফরোজা আক্তার (১৪)। গত ২০ জানুয়ারি একই গ্রামের লেবু মিয়া মেয়েটিকে ধর্ষণ করে বলে পরিবারের অভিযোগ। পুলিশ এখনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
গত ৩০ জানুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় আসামি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের ছেলেকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মা জানান, মামলা তুলে নিতে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর ট্রপিকানা টাওয়ারে সংঘটিত ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও পুলিশ অভিযোগপত্র দায়ের করতে পারেনি। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজির উদ্দিন বলেন, ৫৪ ধারায় কয়েকজনকে আটক করে হাজতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরা প্রকৃত আসামি কি না, বোঝা যাচ্ছে না। ভবনের মালিক ও নিরাপত্তারক্ষীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন শিশুটির মা। তাদেরও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ কৌঁসুলি আলী আজগর বলেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশের তদন্ত শেষে মামলা যখন আদালতে গড়ায়, তখন প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে অনেকে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। তখন রাষ্ট্রপক্ষের কিছু করার থাকে না। তিনি আরও বলেন, পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে পারে না ল বলে অনেক সময় আসামি জামিনে বেরিয়ে আসে।
পুলিশের ব্যর্থতার এটা শুধুমাত্র! না জানি, এমন আরো কত শত বা হাজার ঘটনা পুলিশের ধূলিসর্বস্ব ফাইলের আড়ালে চাপা পরে ইঁদুর তেলাপোকার খাদ্যবস্তু হয়েছে কিংবা এমন কত শত ফাইল কেজী দরে বিক্রি হয়ে গেছে আর সেই ফাইলের কাগজে বানানো ঠোঙাতে কত শত শিশু দুইটাকার ঝালমুড়ি খেয়ে নিজেদের অজান্তেই এই অপকর্মের সাক্ষী হয়েছে!! জানিনা, জানা সম্ভব নয়।
শিশু নির্যাতন রোধে আইনঃ ‘শিশু আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলে গণ্য করা হবে। মিছিলে, সমাবেশে শিশুদের ব্যবহার করা এখন দণ্ডনীয়
অপরাধ। শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনপল্লিতে ব্যবহার করা হলে অথবা শিশুদের দিয়ে কোনো ধরনের মাদক বা আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ কিছু বহন করানো হলে দায়ী ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হবে। ইচ্ছে করলেই কোনো ধরনের মামলায় নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করা যাবে না। শিশুসংক্রান্ত মামলার দেখাশোনা করবেন নিয়োগ পাওয়া প্রবেশন কর্মকর্তা। আর শিশুর বিচার হবে বিশেষ শিশু আদালতে। নতুন শিশু আইনের ১১টি অধ্যায়ে রয়েছে ১০০টি ধারা। শিশু আইনকে ‘বহুদিনের প্রত্যাশিত’ আইন হিসেবে উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের অনেক ভালো আইনের মধ্যে এটি একটি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আইনের কারণে বাংলাদেশের শিশুদের বয়স নির্ধারণের বিভ্রান্তি ঘুচেছে। ফলে শিশুদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা আরও সহজ হবে।’ যথাযথ উপায়ে আইন বাস্তবায়নের পক্ষে জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অনেক ভালো আইন রয়েছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকবে বলেই
আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশে ৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু বাড়িতে মা-বাবা ও বড়দের কাছ থেকে মৌখিক সাজা (বকা ও গালাগালি) পায়। আর ৪০ শতাংশ শিশুকে বাড়িতে লাথি বা মার খেতে হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার চার হাজার পরিবারের ওপর করা এক জরিপ থেকে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৯১ শতাংশ শিশু স্কুলে বিভিন্ন পর্যায়ের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, ৭৪ শতাংশ বাসায় বড়দের হাতে। এসব নির্যাতনের ধরনের মধ্যে রয়েছে লাঠি দিয়ে মারা, চক বা ডাস্টার ছুড়ে মারা, চড় মারা, কান বা চুল ধরে জোরে টানা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট শিশুর ১০ শতাংশ কাজ করে। ভারী কাজ, কম বেতন, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ ছাড়াও শিশুশ্রমিকের তিন চতুর্থাংশ প্রতিনিয়ত মার খায়। শিশুশ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ জানায়, কর্মক্ষেত্রে চড়-থাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের।
ধর্ষনের সবচেয়ে প্রচলিত শাস্তি ক্ষতিপূরণ বা বিয়েঃ ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে কর্মরত আইনজীবী ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দেখা গেছে, সাধারণভাবে ১০ বছরের নিচে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলে বাবা-মা টাকার বিনিময়ে মীমাংসা করে ফেলেন। ১০ বছরের ওপরে মেয়েদের সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনা ঘটে অহরহ। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট কেরানীগঞ্জে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে এবং যথাসময়ে অভিযোগপত্রও দেয়। কিন্তু কিছুদিন পরই আক্রান্ত পরিবারটি মামলা তুলে নিতে চায়। পরে আমরা জানতে পারি, ধর্ষকের সঙ্গে ওই কিশোরীর বিয়ে হয়েছে।’
অবশেষে আমার উপসংহারঃ ইউনিসেফ চাইল্ড অ্যাবিউসের সঙ্গায় বলেছে,
"mistreatment of a child by a parent or guardian, including neglect, beating, and sexual molestation."
অভিবাবক কর্তৃক শিশুকে শারিরীক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আইন পাস করা হয় সুইডেনে। ১৯৬৬ সালে সর্বপ্রথম শিশুদের উপর অভিবাবকের বিশেষ অধিকার আইন অপসারন করা হয়। এবং অভিবাবক কর্তৃক শিশুদের শারিরীক প্রহারকে ১৯৭৯ সালের জুলাইতে আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ গন্য করা হয়। কিন্তু তারপরও বন্ধ হয়ে যায়নি এই বিকৃত যৌন নির্যাতন। প্রতিদিনই আমাদের কানে ভেসে আসে কোনো শিশুর নিরব চিৎকার।
১৯৯৯ তে নিউজ রিপোর্ট অনুষ্ঠানে সাইকোলোজিস্ট অ্যালিস মিলার বিবিসিকে বলেন,
"Close-knit family life in India masks an alarming amount of sexual abuse of children and teenage girls by family members, a new report suggests. Delhi organisation RAHI said 76% of respondents to its survey had been abused when they were children - 40% of those by a family member."
পরিস্থিতি লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে। শিশু অধিকার নিশ্চিতকল্পে সরকারের আরো কঠোর পদক্ষেপ আশা করছি। আর, শিশু নির্যাতন আইনের উপর কড়াকড়ি চাই। কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরকেই। নয়তো, আমাদের স্বপ্ন মাথা কুটে মরবে নষ্টদের যৌনতায় , শ্রেষ্ঠদের মৌনতায়। শিশুদের এই অধিকার যেন না হয়ে যায় আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন।
উৎসর্গঃ সকল নির্যাতিত কোমলমতি শিশুদের
তথ্যসূত্রঃ
১। দ্য দা ভিঞ্চি কোড, ড্যান ব্রাউন
২। দ্য লস্ট সিম্বল, ড্যান ব্রাউন
৩। ডিজিটাল ফরট্রেস, ড্যান ব্রাউন
৪। শিশু নির্যাতনঃ উইকিপিডিয়া
৫। শেখ সাবিহা আলম, প্রথম আলো, জুন ৮, ২০১৩ (বিশেষ কৃতজ্ঞতা)
৬। সামহোয়্যার ইন ব্লগ
৭। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, জুন ২০১০