ট্যুরিষ্ট গাইডের কাজ করতে গিয়ে সারা বাংলাদেশ গাড়িতে করে ঘোরার রেকর্ড অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। সেই সুবাদে ট্যুরিজম সেক্টরের অন্তত শ'খানেক ড্রাইভারের সাথে আমার সখ্য। তাঁদের অন্তত ডজনখানেক আমার বন্ধুর পর্যায়ে পরে। এরা আসলে দেশের সেরা ক্লাসিক ড্রাইভার। তাঁদের পাশের সিটে বসে আমার কেটেছে হাজারো মাইল আর শত ঘন্টা। ফলে নিজে ড্রাইভার না হলেও সেক্টরের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী। তাই চলমান "নিরাপদ সড়ক চাই" হট্টগোলের বিপরীত দিকটা অর্থাৎ মুদ্রার অপড় পিঠটা একটু খতিয়ে দেখব - ড্রাইভার্স ফ্রেন্ডলি মানুষ হিসেবে লেখাটা একটু একপেশে মনে হলেও চলমান প্রেক্ষাপটে ড্রাইভারদের যেভাবে এককভাবে দোষা হচ্ছে তাঁর তুলনায় এটা কমই হবে -
ঢাকাসহ সারা দেশের কোথাও নিরবচ্ছিন্ন চালানোর মত এক কিলোমিটার রাস্তাও নেই। এরপর নিজে খেয়াল করে দেখবেন, আসলেই নেই। প্রতি কিলোমিটারের কোথাও না কোথাও হয় একটা গর্ত, নাহয় একটা ম্যানহোল (খোলা অথবা ঢাকা) যা আবার রাস্তার লেভেল থেকে উচু নাহয় নীচু। হয় স্পীড ব্রেকার নাহয় স্পীড ব্রেকার তুলে নেয়া খন্দক। কোথাও বাজার কোথাও ময়লার বিন। কোথাও কাটা কোথাও ফাটা। কোথাও কাটার যন্ত্র কোথাও ফাটা বোজানোর রোলার। এরকম ৫০০ আলাদা অবস্ট্যাকল বলতে পারি যা বলে আপনার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতে চাচ্ছিনা যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন তাহলে বাদ দিলাম।
এরপরে রয়েছে রাস্তার ধারে স্তূপীকৃত নির্মাণসামগ্রী, পণ্য লোড-আনলোড, পরিত্যক্ত ভাংগারী, ঠেলাগাড়ি-ভ্যানগাড়ী স্ট্যান্ড, টং-দোকান আর ফেরিওয়ালা।
পথচারীদের কথা আর কি বলব?! যেখানে খুশী বা যেখানে তাঁর প্রয়োজন ঠিক সেই বরাবর হাত উচিয়ে গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পাড় হবে। ফুটপাত, জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ ইত্যাদির অবস্থা এবং ব্যবহার সম্পর্কে আপনি নিজেই আমার চেয়ে ভাল জানেন। জানেন ঠিকই কিন্তু বলবেন না কারণ আপনি নিজেও বাসার ড্রয়িংরুমে কিংবা চায়ের টেবিলে ছাড়া এসব নিয়ে ভাবেন না। হিপোক্রেসীর চুড়ান্ত পর্যায়ে আমরা একেকজনা। যাই হউক, যা বলছিলাম -
এদেশের সকল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, পার্ক, বিনোদনকেন্দ্র, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করে রাস্তার ধারেই তাঁদের থাকতে হবে। যেন রাস্তা থেকে ১০গজ দূরে হলে আর মুসল্লি মসজিদে যাবেনা, রোগীর জীবন বাচবে না অথবা কাস্টমার দোকানে আসবেনা। রাস্তার ধারে প্রতিষ্ঠান থাকলেও অন্তত সেখানে আগমন-নির্গমনের পথ কিংবা আগত মানুষের যানবাহন রাখার তো জায়গা রাখতে হবে! কি দরকার? সরকারী রাস্তা আছেনা? সরকারী মানেই তো পাবলিকের। আমিও তো পাবলিক! কি সুন্দর অনুবাদ!
বুঝলাম জনগন ভুল করছে কিন্তু সেটা দেখার জন্যইতো লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ - প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পূর্বেই তো যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি, অনুমোদন বা লাইসেন্সের দরকার হয়। তাঁরা কি জানেনা হাসপাতাল হলে রোগীর এ্যাম্বুলেন্স চলাচল বা পার্কিং এর জায়গা লাগবে? হোটেল হলে বোর্ডার, স্কুল-কলেজ হলে ছাত্র-ছাত্রী আসবে। জানে, কিন্তু যেই শহরে ১০ তলা এপার্টমেন্টের সামনে লেখা থাকে "অতিথিদের গাড়ি বাইরে পার্কিং করুন" সেখানে কি আর বলার আছে! বাইরে বলতে কিন্তু ঐ সরকারী রাস্তায়। একটা এপার্টমেন্টে বহু ফ্যামিলি বসবাস করে কিন্তু পার্কিং স্পেস সুতায় মেপে এপার্টমেন্টের সংখ্যার সমান। তাহলে কি সেখানে গাড়িওয়ালা অতিথি বেড়াতে আসা নিষিদ্ধ। এ কেমন আর্কিটেক্ট প্ল্যান আর কেমন অরুচীকর রিয়েল এস্টেট কোম্পানী আর তাঁর ফ্ল্যাট গ্রহিতা!? প্ল্যান পাস করা লোকেদের কথা নাই বললাম - কেননা সেসব প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরী করলে ঢাকায় বাড়িওয়ালা হওয়া যায়! যদিও সেইসব বাড়িওয়ালা আর প্রথম শ্রেণীর চাকরী করা বাড়িওয়ালাদের বাড়ি মোটামোটি একই রকম। এখানে স্ট্যাটাসের পার্থক্য পাবেন না কারন এদের পদ-পদবীর পার্থক্য থাকলেও এরা আসলে মাসতুতু ভাই।
বাড়িওয়ালারা নাহয় মাসতুতু ভাই হয়ে অপকর্ম করেছে কিন্তু সরকারী ভবন, হাসপাতাল, কর্পোরেট কোম্পানীর হেড অফিস, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর শো-রুম ইত্যাদি ইত্যাদি কেউই তো তাঁদের প্রতিষ্ঠান স্থাপনে প্রয়োজনীয় স্পেস রাখেনি। তা পার্কিং স্পেস হউক আর হউক ফায়ার সার্ভিস কিংবা এ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াত পথ। পার্কিং স্পেস ইন্সপেকশন সম্পন্ন হলেই রাতারাতি হয়ে গেল রেষ্টুরেন্ট ইত্যাদি। যেই হারে ঢাকা শহরে পুরনো ভবন ভেংগে নতুন মাল্টিস্টরিড তৈরী হয়েছে আর হচ্ছে তাঁর কোন একটি যদি দুর্ঘটনাবশত ভেংগে পরে বা ভাংতে হয় তাহলে তাঁর প্রতিটি ইট হেলিকপ্টারে করে সড়ানো ছাড়া উপায় আছে কি? ওয়াল টু ওয়াল স্থাপনায় এক ইঞ্চি জায়গাওতো অবশিষ্ট নেই। এইসব প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘরে গাড়ি প্রবেশ করতে আর বাহির হতে সিগন্যাল দিয়ে রাস্তা বন্ধ করতে হয় যা দারোয়ানের অন্যতম কাজ। প্রতিবার ঢুকতে আর বের হতে ড্রাইভারদের রীতিমত কসরত করতে হয়। ঘষা খেলে চাকরী নট। অবশ্য প্রাইভেট কার ব্যতীত অন্য গাড়িতে ঘষা খেলে চাকরী নটের ভয় নেই - রাস্তার বাসগুলোর চেহারা দেখলেই বুঝবেন, ঘষা খাওয়া কোন ব্যাপার না, বডি খুলে না গেলেই হলো।
আবার রাস্তায় ফিরে আসি -
আমার ড্রাইভার বন্ধুরা সবসময় বলে, রাস্তায় যত ট্র্যাফিক সাইন এবং নির্দেশনা আছে তাঁর ৯০ভাগই ড্রাইভারদের উদ্দেশ্যে, পথচারী বা পাবলিকের উদ্দেশ্যে তেমন কোন ডিক্টেশন চোখে পরেনা। কথা কিন্তু সত্য! আবার সেই সাইন আর নির্দেশনায় ইংরেজী ভাষার বহুল ব্যবহার, কোথাও কোথাও বাংলা আর ইংরেজী দু'টোই। এই ইংরেজীগুলো কে পড়বে যেখানে আমাদের ড্রাইভারেরা বাংলাই পড়তে জানেনা! আবার বহু ক্ষেত্রে আমি নিজেও লক্ষ্য করেছি, সাইনগুলো সঠিক জায়গায় নেই, থাকলেও পোষ্টার-ব্যানারের জ্বালায় তা দেখাই যায়না। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের চৌরাস্তার মনুমেন্ট গুলো এমনভাবে পোষ্টার ব্যানারে ঘেরা যে ড্রাইভারের পক্ষে তাঁর উদ্দিষ্ট গন্তব্য বা বাঁক ১০ মিটারের আগে বোঝারই কায়দা নেই। ঢাকা-সিলেট বলছি কেন? স্বয়ং ঢাকা শহরে জিপিও'র সামনের জিরো পয়েন্টে বিভিন্ন শহরের যে দুরত্ব লিখা আছে তাই তো পড়া যায়না!
ঢাকা শহরের একজন পথচারী বা বাস যাত্রীও ১০মিটার হেটে বাস স্টপেজে যেতে রাজী নয় - সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকেই বাসে উঠবে আর ঠিক তাঁর বাসার সামনে বা নির্দিষ্ট গন্তব্য প্রতিষ্ঠানের সামনে নামবে। ফলে বাসের ড্রাইভারকে প্যাসেঞ্জার পেতে হলে হাত দেখানো যায়গাতেই থামতে হবে। তাছাড়া ব্যস্ত ট্র্যাফিক মোড়গুলোই যেন যাত্রীস্ট্যান্ড। যাত্রীস্ট্যান্ড বা যাত্রীছাউনীর বালাই মুক্ত এই শহরে যাত্রীরাই বা কোথায় অপেক্ষা করবে তা বুঝবে কেমন করে? এখন বলতে পারেন ড্রাইভার যত্রতত্র গাড়ি না থামালেই পারে! ঠিকই বলেছেন, সকল সচেতনতার দায় অশিক্ষিত ড্রাইভারের। এবারে আসি ড্রাইভার কেন নির্দিষ্ট যায়গা ছাড়া থামে -
আপনি জেনে অবাক হবেন, ঢাকার লোকাল বাসের ড্রাইভার আসলে চাকরী করেনা - তাঁর কোন নিয়োগ পত্র, বেতন-ভাতা স্কেল, ডিউটি টাইম, ডিউটি রোষ্টার কিছুই নেই। সে সকাল বেলা স্ট্যান্ডে যায় আর বাস মালিকের প্রতিনিধি সুপারভাইজার বা সুপারম্যানের ইচ্ছা-আনুকল্যে গাড়ির চাবি হাতে পায় এবং রোডে বের হয়। তাঁর বেতন রুট অনুযায়ী প্রতি সিঙ্গেল ট্রিপ হিসেবে নির্ধারিত। আসলে তাঁর বেতন নির্ধারিত নয়, প্রতি ট্রিপের জন্য মালিকপক্ষকে দেয় অংক নির্ধারন করা আছে। এরপরে যেটা থাকবে তা ড্রাইভার-হেল্পার-কন্ডাক্টর আনুপাতিক হারে ভাগ করে নেয়। সেক্ষেত্রে মালিকের লক্ষ্যপূরন আর নিজের কাংখিত আয়ের চাপ তাঁর মাথায় সার্বক্ষনিকভাবে চেপে আছে বিধায় তাঁর পক্ষে যা করনীয় সে তাই করে। তাঁর লক্ষ্য রাস্তার দিকে নয় বরং রাস্তায় হাত তুলে ইশারা দেয়া নারী-পুরুষের দিকে। প্রতিটি উত্তোলিত হাত তাঁর কাছে ৫/১০ কিংবা ২০টি টাকা।
একই রোডে চলা ১০ প্রকার যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহনের ভিড়ে তাঁর পক্ষে রাস্তার সাইডে গিয়ে নিরাপদে যাত্রী তোলা বা নামানোর নুন্যতম অবকাশ নাই, যাত্রী নিজেও রাস্তার মাঝখানে থেকেই হাত তোলে ফলে রাস্তার মাঝখানে কোনরকম ব্রেক চেপে তাঁর কাজটি তাঁকে করতে হয় - দুর্ঘটনা না ঘটাই এখানে অস্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, ঢাকা শহরের পিক টাইমে যেমন যানবাহনের সংকট ঠিক অফ পিকে আবার যাত্রী সংকট। ফলে পিকটাইমে অতিরিক্ত যাত্রির ভিড় আর অফপিকে যাত্রীর জন্য ইতিউতি করা ড্রাইভার-হেল্পারের দৈনন্দিন কাজ। সকাল বিকাল যানবাহন সংকট আর যাত্রী সংকটের বাইরে যানজট সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা নৈমিত্তিক ঘটনা। আধা ঘন্টার দুরত্ব কয় ঘন্টায় যাবে তার যেমন কোন নিশ্চয়তা নাই আবার দৈব-দুর্ঘটনায় যাত্রীদের সাথে ভাড়া নিয়ে বচসা, চড়থাপ্পর আর গণধোলাইয়ের সম্ভাবনা সার্বক্ষণিক।
প্রতি মিনিটে ২০বারের বেশী ব্রেক চেপে চেপে শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলা ড্রাইভার যখন একটু ফাকা পায় তখন খানা-খন্দক এড়িয়ে গতি বাড়িয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টায় তা বেপরোয়া পর্যায়ে পৌছে যায় নিজেরই অজান্তে। নির্বিকার পথচারী আর ফুটপাতবিহীন (দখলীকৃত) রাস্তায় এরচেয়ে বেশী কি আর আশা করা যায়?
এবারে আসুন ড্রাইভার প্রশিক্ষন আর স্ট্যাটাসের বিষয় -
ফিটনেস থাকুক আর নাই থাকুক, যানবাহনের সংখ্যা কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঠিকই জানা আছে। সেই রেশিওতে ড্রাইভার প্রশিক্ষন আর তাঁদের লাইসেন্সিং এর আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান কি আদৌ আমাদের আছে? বি,আর,টি,এ আর বেসরকারী মিলিয়ে ড্রাইভার তৈরী করার মোট ক্ষমতা সত্যিকারের প্রয়োজনের অর্ধেকও না। তাহলে বাকী ড্রাইভার আসল কোথা থেকে? এসেছে খেয়ে না খেয়ে ড্রাইভার/ওস্তাদ বন্ধুবান্ধবের হাতে পায়ে ধরে, গাড়ির হেল্পারি করতে করতে আর দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাত পাকা করে। তাঁদের না আছে প্রশিক্ষন না আছে লাইসেন্স। লাইসেন্স থাকলেও তা কেবলই টাকার বিনিময়ে প্রাপ্ত পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্স যা মূলত মানুষ মারার লাইসেন্স। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা আর যথাযথ প্রশিক্ষন বিহীন এইসব ড্রাইভার, সংগত কারনেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরী পায়না ফলে সে লোকাল বাসের ড্রাইভার যা কিনা দিনমজুর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর নেই কোন সামাজিক মর্যাদা, নেই কোন ইন্সুরেন্স বা অন্য কোন প্রকার আর্থিক নিরাপত্তা।
উপরোক্ত বিষয়াবলীর কোনটার দিকেই আমাদের মন নেই, আমরা কেবল ড্রাইভারের বদৌলতে নিরাপদ সড়ক চাচ্ছি। আমি তো মনে করি, ঢাকা শহর গাড়ি চালানোর উপযুক্ত কোন শহরই নয় - যারা পেটের তাগিদে গাড়ি চালিয়ে এই শহরকে সচল রেখেছে তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার, দরকার তাঁদের জীবনমান আর স্কিল বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রনোদনা আর ব্যাপক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ। নিরবচ্ছিন্ন সড়কপথ আর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক প্রয়াস ছাড়া নিরাপদ সড়কের শ্লোগান আত্নপ্রতারনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কায়েশ খান
পেশাদার ট্যুরিষ্ট গাইড এবং সাধারণ সম্পাদক, ট্যুরিষ্ট গাইড এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ
ঢাকা, বাংলাদেশ।