৭০ এর দশকের কথা। বিক্রমপুরের আড়িয়ল নামক ছোট্ট একটি গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমাদের বাড়ীতে ঢোকার আগেই বিরাট পুকুর। পুকুরের দক্ষিন পাড় ধরে বাড়ি থেকে বেরুলেই সদর রাস্তা! সদর রাস্তা বলতে ইউনিয়ন পরিষদের কাচা রাস্তা - বর্ষায় অন্তত ৪ মাস যেটা পানির তলাতেই থাকত। বাকী ৮মাস এই রাস্তাটি ছিল কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ২০/৩০ টি গ্রামের মানুষের জন্য ইউনিয়ন/থানা/জেলা মুখী একমাত্র রাস্তা। বর্ষার আলাপ অন্যদিন করব। এখন গ্রীষ্মের আলাপেই থাকি ...
আমাদের বাড়ির নিজস্ব রাস্তা যেখানে ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তায় পরেছে, ঠিক সেই যায়গায় বেশ বড় সাইজের একটা রেইন্ট্রি (কড়ই জাতীয় গাছ) ছিল। দুর-দুরান্তের পথিক ক্লান্ত হয়ে সে বৃক্ষছায়ায় খানিকটা জিড়োত। আমরা নিজেরাও ফাক পেলেই সে গাছের নীচে বসে থাকতাম। হাটের দিনে (রবি ও বুধ) প্রায় সারাদিন এবং অন্যান্য দিনে সকাল-বিকাল ঐ রাস্তায় প্রচুর পথিক যাতায়াত করত। আমাদের বাড়ির পরেই বিলের মাঝখান দিয়ে দুরবর্তী গায়ের প্রায় ফাকা পথ। তাই পথিকেরা এই যায়গাটিতে একটু বিশ্রাম নেয়ার সুজুগ হাতছাড়া করত না। লোকেরা যখন ওখানে খানিকটা বসে শরীর জুড়িয়ে নিত তখন তারা পানীয় জলের অভাব অনুভব করত। আমার মা তখন আমাদের ছোটদের কাউকে না কাউকে দিয়ে এক জগ পানি আর একটা গ্লাস দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন পথিকের তৃষ্ণা নিবারন করতে। বাবা বাড়ি থাকলে তিনি প্রায় নিজেই পানি নিয়ে যেতেন অথবা পুকুর পাড় থেকে হাক ছেড়ে কাউকে পানি নিয়ে যেতে বলতেন। তৃষ্ণায় একটু জল পেয়ে পথিকের তৃপ্ত মুখ দেখে আমরা যারপরনাই আনন্দ পেতাম। লোকেরা আমাদের ধন্যবাদ দিতে কখনো কার্পন্য করেনি। এই পথিকদের মধ্যে হাটুরে, দুরের গায়ের মেহমান কিংবা শিশু পুত্র-কন্যা নিয়ে পিত্রালয় থেকে শশুরবাড়ি কিংবা শ্বশুরালয় থেকে বাবার বাড়ি যাওয়া বেড়াতে যাওয়া গৃহবধু থেকে নিয়ে নানা কিসিমের লোক থাকত। কখনো বা আসামী ধরতে আসা পুলিশও বাদ যেতনা। অবশ্য পুলিশ দেখলে আমরা খানিকটা ভয় পেলেও পানি পান করাতে কখনো অনীহা করিনি। ছেলেবেলার সেই স্মৃতি এখনো মনের কোঠায় জ্বলজ্বলে। গ্রামীন জনপদের পথিককে পানি পানের সুজুগ না পেলে নির্দ্বিধায় খাল/পুকুরের টলটলে জল পান করতে দেখেছি, আমরা নিজেরাও অনেক সময় মাঠে খেলতে গিয়ে কিংবা দুরের গায়ে হাডুডু-ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে পুকুর/দিঘীর পানি আজলা ভরে পান করেছি। দু'চার গ্রাম মিলে তখন একটা/দু'টা টিউবওয়েল মাত্র বসতে শুরু করেছে। তার গায়ে লেখা থাকত "ইউনিসেফ"। ব্যক্তিগতভাবে যেসব স্বচ্ছল পরিবার নিজেদের বাড়িতে টিউবওয়েল বসিয়েছে তা একেবারে বাড়ির অন্দরমহলে থাকত।ফলে সাধারনের জলপান বলতে রাস্তা-ঘাটে ঐ আজলা ভরে পুকুর/দিঘীর পানি আর বাড়িতে একই পানি একটু ফিটকারী সহযোগে।
এরপর এসএসসি পাশ করে ঢাকায় চলে এলাম ৮০'র দশকে। ঢাকায় তেমন একটা টিউবওয়েল দেখতাম না, মিউনিসিপ্যলিটির নিষেধ ছিল, ওরাই তখন পাইপলাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করত। হোটেল-রেস্তোরা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালতেও মানুষ নির্দ্বিধায় সেই ট্যাপের পানিই পান করত। কিন্তু পথিকের জন্য পানি পানের কোন ব্যবস্থা ঢাকা নগরীতে তখন আমি লক্ষ্য করিনি, যদিও তৃষ্ণা পেলে ছোট বড় যেকোন রেষ্ট্যুরেন্টে ঢুকলেই পানি পান করা যেত। সেই সময় শান্তিনগরে একটা যায়গায় একটা মাটির বিশাল মটকা এবং তার সাথে বেধে রাখা একটি ছোট্ট টিনের মগ দেখতাম। লেখা ছিল "পানীয় জল"। এর পৃষ্ঠপোষক ছিল কোয়ান্টাম মেথড। জিনিষটি আমাকে দারুনভাবে অনুপ্রানিত করে এবং ছোটবেলায় প্রশিক্ষন নেয়া তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো আমার জীবনের একটি অন্যতম শখ, ইচ্ছা যাই বলেন। ধন্যবাদ "কোয়ান্টাম মেথড"! বর্তমানে আমি একটি চ্যারিটি সংগঠনের সাথে যুক্ত। যেটি আমার জীবনের সর্বোচ্চ ভাল কাজ বলে আমি মনে করি। সামাজিক অবস্থান থেকে জনসেবা- এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে? আমার এই চেতনার বীজ বোপিত হয়েছিল সেই ছোটবেলায় পথিককে পানি পান করিয়ে।
বিষয়ান্তরে না গিয়ে আবার মুলকথায় ফিরে আসি। ৯০ এর দশকে ঢাকায় প্রথম বানিজ্যিক ভাবে বোতলজাত পানি বিক্রী শুরু হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে পানি বিক্রী হতে দেখে খুবই অবাক এবং হতাশ হয়েছিলাম। পুকুর-দিঘীর পানি আজলা ভরে পান করা এবং বিনে পয়সায় পানি পান করানো এই আমি পানি কিনে খেতে একেবারেই রাজী ছিলাম না। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। একদিন প্রচন্ড গরমে রিকশায় করে এক জায়গায় যাচ্ছি, প্রচন্ড তৃষ্ণা লেগেছে কিন্তু সয়ে যাচ্ছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে রিকশাওয়ালা রিকশা সাইড করে আমাকে বসিয়ে রেখে ১০টাকা দিয়ে এক বোতল মাম পানি কিনে নিয়ে এলো এবং আমার চোখের সামনেই আরামসে পান করল। আমি প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। সেইদিন আমি বুঝতে পারলাম পানি পান আর ফ্রি থাকবে না। এরপর দিনে দিনে পানির বোতল, পানির জার, পানির ডিস্পেন্সার ইত্যাদিতে মার্কেট সয়লাব হয়ে গেল। একপর্যায়ে চায়ের দোকানে, গলির ধারের রেষ্ট্যুরেন্টেও ১ টাকা গ্লাস পানি বিক্রী হতে থাকল। কর্পোরেট সমাজে পানি নয় বাতাসও একসময় বিক্রী হবে। একবার কোথায় যেন শুনেছিলাম যদি কোনদিন ৩য় বিশ্বযুদ্ধ হয় তবে তা হবে পানীয় জল নিয়ে। সত্যি হলেও হতে পারে। ফারাক্কা বাধ হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের খাল-বিল-নদীতে পানির প্রবাহ কমতে শুরু করে যা কালক্রমে উজানে স্থাপিত অন্যান্য বাধের কারনে তলানিতে ঠেকেছে। একসময় পানের পানির জায়গায় গোসলের পানিও হয়তো কিনতে হবে, ইতিমধ্যেই মাঝে মধ্যে কিনতে হচ্ছে!
আমার শুধু একটাই কথা, পানি যতই দুর্মূল্য হউক না কেন পথিক বা তৃষ্ণার্তের জন্য একটু পানি ফ্রিই থাকুক। প্রত্যেকটা অফিস, প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরে, স্কুল-কলেজে সাধারনের মানুষের জন্য একটু পানি পানের সুজুগ অবারিত থাকুক এটাই কামনা।
একজন মুসলিম হিসেবে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো আমার ধর্মীয় কর্তব্য বলে মেনে করি।