মানুষ; আরো বৃহৎ অর্থে মানবজাতি বা বৃহৎ/ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই হচ্ছে একটা গোটা বিশ্ব সংস্কৃতি; মানুষের প্রয়োজন, প্রাপ্তী-অপ্রাপ্তী, আকাঙ্খা এবং অভিলাস থেকেই সংস্কৃতির জন্ম। মানুষ যা বলে, যা পরে, যা খায়, যা ভাবে, যা শুনতে পছন্দ করে তা-ই তার সংস্কৃতি। কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকেরা কিভাবে চিন্তা করে, কিভাবে কাজ করে এবং তাদের আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাব প্রকাশের মাধ্যম/ভাষা, ধর্মীয় ক্রিয়াকালাপ, সংগীত, সাহিত্য, সাধনা ইত্যাদির মিলিত রূপ হচ্ছে একটি সংস্কৃতির চিত্রনাট্য। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কোন না কোন সংস্কৃতিতে জন্মেছে এবং সামাজিকভাবে বাসবাস করার মাধ্যমে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি আয়ত্ত বা ধারণ করে। সংস্কৃতি এমন এক জিনিস যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রমিত হয় এবং সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃতি সহজাত; জন্মের পর থেকেই মানুষ পরিবার, সমাজ, বিশ্বাস এবং রাষ্ট্র থেকেই সংস্কৃতির শিক্ষা পায়।
পোলিশ বংশদ্ভূত অস্ট্রিয়ান লেখক ও সমাজ বিজ্ঞানী ব্রানিসলো ম্যালিনোস্কি সংস্কৃতির খুব সংক্ষেপ কিন্তু অর্থবহ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, 'সংস্কৃতি হলো মানব সৃষ্ট এমন সব কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।'
সংস্কৃতির বিকাশ, বৈচিত্র্য ও বিবর্তনের গতি বিংশ শতাব্দীতে অনেক বেগবান হয়েছে। মানুষের অভ্যাস, ভাবনা, শিক্ষা এবং মূল্যবোধের এই পরিবর্তনের মূল কারণ বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে সহজে যোগাযোগ স্থাপন। সংস্কৃতির প্রচার এবং আদান-প্রদান সংস্কৃতিকে বহুরূপী করে তোলে। এতে ভিন্ন মত/ভাষা/সংগীত/আচরণ ইত্যাদির প্রতি পারস্পরিক সম্মান এবং আগ্রহ বাড়ে। স্থানচ্যুতি/দেশত্যাগে মানুষের সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া সংস্কৃতিতে ভাষার প্রভাব অনেক। সম্রাজ্যবাদ এবং একটি রাষ্ট্রের অর্থ, বিত্ত এবং বিশ্বে রাজনৈতিক প্রভাব মানুষের সংস্কৃতি পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। যখন রাষ্ট্র ছিল না, তখন স্থানীয় সংস্কৃতি মানুষের ন্যায় বিচার এবং সামাজিক সহাবস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মানুষ বিভিন্নভাবে অন্য সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হতে পারে; যার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সংগীত। সংগীতের কোন ভাষা নেই, কিন্তু এর সুর ও প্রভাব মানুষকে প্রভাবিত করে সবচেয়ে বেশি। সংগীতের সাথে আবেগ, বোধ, বেদনা, সংগ্রাম, সাফল্য সব নিহিত। এছাড়া নৃত্য, সিনেমা, টেলিভিশন, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষ অন্যান্য সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়। তথ্য-প্রযুক্তির সহজিকরণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ/অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, ভাষা ও সাহিত্যের বিনিময় সংস্কৃতির বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। সংস্কৃতির এই প্রসার হচ্ছে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং দার্শনিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর 'সংস্কৃতির বিবর্তন' গ্রন্থে বলেন, 'বিবর্তন মানে বিচ্ছেদ নয় কিন্তু রাষ্ট্রের দ্বিখণ্ডিতা সংস্কৃতির বিচ্ছেদ ঘটায়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য মানে রামায়ন, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, চৈতন্য চারিতামৃত; পরবর্তীতে চর্যাপদ বা বৌদ্ধ সাধন পদাবলী, নাথযোগীদের গীত, বাউল গীত এবং পুঁতি সাহিত্য। মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত, সঞ্চারিত, সংগৃহীত লোকগীতি, লোককথা, বচন, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথার প্রচলন ছিল যুগযুগ ধরে। বাঙালি সমাজচিন্তা, সংস্কৃতির বিকাশ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই লোক সাহিত্য আমাদের পূর্ব পুরুষদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একটি ভান্ডার। কিন্তু দেশভাগ, সংস্কৃতির বিবর্তন, বিশ্ব সংস্কৃতির আদান-প্রদান, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি অতি উৎসাহি মনোভাব ইত্যাদি কারণে বাঙালি সংস্কৃতির বিবর্তন তার স্বাভাবিক গতি পায়নি।'
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, 'সংস্কৃতির বিবর্তন সমস্তক্ষণ চলছে, কোথাও তার ছেদ নেই। কিন্তু ইতিহাসে এমন এক-একটা ঘটনা ঘটে যাতে এক ধারা, দুই ধারা হয়ে যায়। সাতচল্লিশ সালে দেশভাগ, প্রদেশভাগ বাঙালি সংস্কৃতির স্বভাবিক ধারাকে ব্যাহত করে।'
গ্রীকদের কাছে আমরা ইন্ডিয়ান হিসাবে পরিচিত ছিলাম; পরে পার্সিরা নাম রাখলো হিন্দু। বার'শো শতাব্দীতে আরবদের আগমনে মুসলিম, তুর্কি ও মোঘলরা ডাকতো হিন্দুস্থানী বলে আর সবশেষে ইংরেজরা নাম দিল ভারতীয়। প্রাচীণ বা মধ্যেযুগের সাহিত্যে ভারতের উল্লেখ থাকলেও ভারতীয়দের উল্লেখ নেই। কারণ, তখনকার সময়ে মানুষের পরিচয় হত ধর্ম/সংস্কৃতি দিয়ে রাষ্ট্র দিয়ে নয়; অর্থাৎ মানুষ পরিচিত হতো কাস্ট অনুসারে, দেশ হিসাবে নয়। ভারতের ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, নৃত্যকলা, সংগীত, স্থাপত্যশৈলী, খাদ্যাভ্যাস ও পোষাক-পরিচ্ছদ অঞ্চলভেদে ভিন্ন; তা সত্ত্বেও ভারতীয়দের মধ্যে সংস্কৃতির একটি সাধারণ একাত্মতা আছে। ভারতের সংস্কৃতি কয়েক সহস্রাব্দ-প্রাচীন এই সব বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও রীতি-নীতিগুলির একটি সম্মিলিত রূপ।
ভারতীয় সভ্যতা/সংস্কৃতি প্রায় আট হাজার বছরের পুরনো। এই সভ্যতার আড়াই হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহাসিকরা এই সভ্যতাটিকে 'বিশ্বের প্রাচীনতম জীবন্ত সভ্যতা' মনে করেন। ভারতীয় ধর্ম, যোগ, সঙ্গীত, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস সহ ভারতীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি ভারতীয় নিজেদের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সর্বস্তরে। যা আমাদের সংস্কৃতির বিশ্বায়ন।
উপমহাদেশের জনসাধারণের মধ্যে যে ধর্মভিত্তিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশ/অঞ্চলে দেখা যায় না। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রায় ধর্মই কেন্দ্রীয় ও প্রধান ভূমিকা পালন করে যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। ধর্মীয় সহনশীলতা এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহনশীল আচরণ উপমহাদেশের মানুষকে সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করেছে। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাসের এই ফারাক মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিনির্মান এবং সংস্কৃতির বিনিময়কে বাধাগ্রস্ত করছে। একটি অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সহাবস্থান মানুষকে উদার ও জ্ঞানী বানায়। ভারত হচ্ছে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের উৎপত্তিস্থল; যা ভারতীয় ধর্ম নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বর্তমানে হিন্দু ও বৌদ্ধ যথাক্রমে বিশ্বের তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম ধর্মবিশ্বাস। এই দুই ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা ২ বিলিয়নেরও বেশি। এছাড়া আহমদিয়া ধর্মের উৎপত্তিস্থান এই ভারতবর্ষে।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ মোতাহার হোসেন চৌধুরী 'সংস্কৃতি কথা' প্রবন্ধে বলেছেন, 'ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার; আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদেরকে ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।'
খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের পূর্বে প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছরব্যাপী প্রাচীন যেসব সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে 'সিন্দু সভ্যতা' যা ভারত উপমহাদেশের পাঞ্জাব অঞ্চলকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ব্রোঞ্জ যুগীয় এই সভ্যতার অন্যতম প্রধান শহর ছিল হরপ্পা। ভারতীয় বহুজাতিক, বহুভাষার মানুষ ও তাদের সংস্কৃতির বিকাশে হরপ্পার ভূমিকা অগ্রগণ্য। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ো সভ্যতা, ব্যবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসেরীয় সভ্যতা, ক্যালেডীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, ফিনিশীয় সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা, অ্যাজটেক এবং মায়া সভ্যতা ইত্যাদি ছিল মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও বিবর্তনের প্রধান কেন্দ্র।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিক-অধ্যুষিত দেশগুলি রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এসময় গ্রীকরা জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, রাজনৈতিক দর্শন/বিতর্ক, নীতিশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, অ্যান্থোলজি, যুক্তিবিদ্যা, জীববিজ্ঞান এবং অলঙ্কারশাস্ত্র সহ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। যা বিশ্বের যেকোন রাষ্ট্র, সভ্যতা থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস ছিলেন দর্শন, বিতর্ক এবং সমাজ চিন্তার অগ্রপথিক। পরবর্তীতে প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ বিশ্বখ্যাত দার্শনিক তা এগিয়ে নিয়েছেন। তাদের ভাবনা, কথা এবং ভবিষ্যত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংস্কৃতির বিকাশ, বিবর্তন এবং বিশ্বায়নে দর্শন তথা গ্রীক দার্শনিকদের অবদান অনেক।
খৃষ্টপূর্বে প্রতিষ্ঠিত ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এসব সভ্যতা খৃষ্টাব্দের শুরু থেকে স্বাধীন, স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারাতে শুরু করে; যার অন্যতম কারণ ছিলো ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। এজন্য দক্ষিণ এশিয়া, আরব, পারস্য এবং মিশরে প্রাচীন সংস্কৃতির অনেক ধারা তাদের নিজস্ব প্রবাহ হারায়; এটি সংস্কৃতির বিবর্তন না হলেও বর্তমানে তা স্থানীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্ম হচ্ছে আদেশ কিন্তু সংস্কৃতি হচ্ছে দীর্ঘদিনের আবেগ ও অভ্যাস। দু’টির মৌলিক ধারায় সুক্ষ পার্থক্য থাকলেও মানুষের বিশ্বাস বংশপরম্পরায় অভ্যাসে পরিণত হয়; একটা সময় তা ঐ জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে। ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি অন্য ধর্ম কিংবা ধর্মহীন সংস্কৃতিকে সহজে ভিড়তে দেয় না; এর অন্যতম কারণ ভয়। জ্ঞান, বিজ্ঞান, স্বাধীন মতবাদ, মুক্তচিন্তা এবং গবেষণায় এই অঞ্চলের মানুষের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্বাসের সংস্কৃতি।
গ্রীক, রোমান, চৈনিক, ইনকা ইত্যাদি সভ্যতার মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মুক্তচিন্তা, গবেষণা এবং সংস্কৃতির চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংস্কৃতি বিশ্বাস নয়; অভ্যাস। আর অভ্যাসের ব্যাপ্তী হয় মুক্তচিন্তা ও মুক্তচর্চায়। ল্যাটিন আমেরেকার গুরুত্বপূর্ণ ইনকা সভ্যতা স্পেনীশ ও পর্তুগীজ আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ইনকা সভ্যতার স্বাভাবিক বিবর্তন ব্যবহত হয়েছে ইউরোপীয় ভাষার আগ্রাসনে। আমাদের উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর আগ্রাসন থাকলেও বহুভাষী ভারতবর্ষে কোন আগ্রাসী ভাষা একক কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারেনি। ভারতের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রভাব এখনো কমেনি। ভাষা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও নতুন সংস্কৃতির পরাগায়ন সংস্কৃতির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চৈনিক সভ্যতা কখনো পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্ধী ছিল না বলে সমৃদ্ধ এই সভ্যতার বিকাশ ও পরিবর্তন স্বাভাবিক গতিতে চলছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংস্কৃত, গ্রীক, মান্দারিন, হিব্রু, আরবি এবং তামিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের বহুল প্রচলিত ভাষা এগুলোর কোনটিই নয়। ইংরেজি ভাষার এত ব্যাপ্তীর অন্যতম কারণ হচ্ছে সময়ের সাথে এই ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষজন তাদের মেধা, মনন, মুক্তচিন্তা, পরিশ্রম এবং গবেষণা দ্বারা বিশ্বসভায় নেতৃত্বে আসা। তাই সংস্কৃতি শুধু অভ্যাস কিংবা জাতি গোষ্ঠীর ঐতিহ্য নয় বরং এই কালচারকে নিজের মধ্যে সংক্রমিত করে সংস্কৃতির বিকাশ এবং আগামীর পথকে আরো গতিশীল করা; যারা পেরেছে তারা বিশ্ব সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশ এবং আমেরিকায় গ্রীক, স্পেনীশ, ফরাসী এবং পর্তুগিজ সংস্কৃতির বিকাশে তাদের নাবিক, ব্যবসায়ীদের অবদান অপরিসীম।
ল্যটিন আমেরিকার মতো ভাষার আগ্রাসনে ওশেনিয়া মহাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ইংরেজদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মান্দারিন ভাষা চীন অতিক্রম করেনি বলে তা বিশ্বভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। ভাষা যত ছড়িয়ে পড়বে সেই ভাষাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠা সাহিত্য, সংস্কৃতি তত বিকশিত হবে। ফরাসি, রাশিয়ান এবং পার্সি সাহিত্যের ভান্ডার এসব অঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছে। তবে বিশ্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও পরিবর্তনে ভাষার পাশাপাশি অর্থ-বিত্তের প্রভাবও কম নয়। এজন্য চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আগামী দিনগুলোতে তাদের সংস্কৃতির বিশ্বায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সংস্কৃতির প্রসারে কার্নিভাল/উৎসবের গুরুত্ব অনেক। রিও কার্নিভালের কল্যাণে ব্রাজিলের সাম্বা নৃত্য এবং সংগীত বিশ্ব সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। গ্রীক ওয়াইন দেবতাকে উৎসর্গ করে এই নৃত্য এবং আয়োজনে রোমান সংস্কৃতিরও প্রচার হয়। যুক্তরাজ্যের নটিংহিল কার্নিভালের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এবং তাদের সংস্কৃতি তথা গান, নৃত্য, বাদ্য এবং পোষাকের বাহারী প্রদর্শনী। চীনের হারবিনে বিশ্বের অন্যতম বড় আইস ও তুষারপাতের কার্নিভাল রিও কার্নিভালের মতো জনপ্রিয় এবং বিশ্ব কার্নিভাল হয়ে উঠতে পারেনি বহু সংস্কৃতি ও ভাষাভাষী মানুষের অংশগ্রহণ না থাকায়। আমাদের বৈশাখী উৎসব, প্রভাত ফেরী, নৃত্যগীতির প্রচার ও প্রসার বাঙালি সংস্কৃতির ভীত মজবুত করে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে। একদিন বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের অংশগ্রহণে তা বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হবে।
একটা সময় বাঙালি সংস্কৃতি দু'টি ধারায় বিভক্ত হলেও সাতচল্লিশে দেশভাগ বাঙাল-ঘটির ব্যবধান অনেকটা ঘুচিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এলিট ঘটিরা পূর্ববঙ্গের সাধারন খেটে খাওয়া কৃষক, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি মানুষের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস এবং সামাজিকতার প্রতি যে অবজ্ঞা দেখাতেন তা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির বিপরীত। জমিদারী প্রথা এবং কলকাতা ভিত্তিক শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড গড়ে উঠায় পূর্ববঙ্গের মানুষের সাথে তাদের দূরত্ব বেড়ে যায়। এতে পূর্ববঙ্গে সুফিজম তথা আরব সংস্কৃতি এবং ধর্মের বিস্তার লাভ করে; যা বর্তমান বাংলাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাতচল্লিশে দেশভাগে পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত শ্রেণীর একটি বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত হওয়ায় পূর্ববঙ্গে ব্রেনড্রেন হয় আর পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তা ইতিবাচক হয়। সাতচল্লিশ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠে তার সিংহভাগই করেছেন পূর্ববঙ্গ থেকে দেশান্তরি হওয়া বাঙালরা।
আধুনিক এবং উত্তর আধুনিক বিশ্বে যেসক জাতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্য ভাষা, সংস্কৃতি, সংগীত এবং মতবাদকে গুরুত্ব দিয়েছে, আপন করে নিয়েছে; তারা অর্থ, খ্যাতি এবং সম্মানে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। উন্নত দেশগুলো অন্য সংস্কৃতি থেকে আসা মানুষগুলোর সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দিলে, তাদের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখলে এসব মানুষ তাদের দেশে বসবাস করা সম্ভব হতো না। পারস্পরিক সংস্কৃতির প্রতি সম্মান এবং মুক্তচিন্তা ও চর্চার সুযোগ মানুষকে উদার করে। তৃতীয় বিশ্বের মেধাবীরা উন্নত দেশগুলোতে স্থায়ী আবাস গড়ার পেছেন শুধু অর্থ নয়, মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের এই দেশত্যাগ সংস্কৃতির বিবর্তন এবং সংযোজনের একটি অদৃশ্য সেতু।
ফটো ক্রেডিট- গুগল।
তথ্যসূত্র -
(১) এ কে এম শওকত আলী খানের 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' বই।
(২) রিগনান্ড মেসির 'ভারতের নৃত্যকলা; ইতিহাস, কৌশল এবং সংগ্রহশালা' - অভিনব পাবলিকেশন্স (ভারত)
(৩) মাহমুদা মালিকের 'ভারতের বহুজাতিক সংস্কৃতির ভিত্তি' - আকার বুকস (ভারত)
(৪) Robert Arnett এর বই 'India Unveiled' - Atman Press.
(৫) লেখক Shaloo Sharma বই 'History and Development of Higher Education in India' - Sarup & Sons.
(৬) লেখক Mark Kobayashi বই 'Hillary Outsourcing to India' - Springer.
এই লেখাট ১৪তম বাংলা ব্লগ দিবস উপলক্ষে ফিচার লেখা প্রতিযোগিতার 'সংস্কৃতি ও পুরাতত্ত্ব' বিভাগের জন্য লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:১৩