মানব জাতির গোড়াপত্তনের সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই। বিজ্ঞানীদের ধারণা তা কয়েক মিলিয়ন বছর হতে পারে। পৃথিবী হচ্ছে সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আনুমানিক ৪৫৪ কোটি বছর আগে পৃথিবী গঠিত হয়েছিল। আর প্রায় ১ বিলিয়ন বছরের মধ্যে পৃথিবীতে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে দু'টি গ্রহের তীব্র সংঘর্ষ হয়েছিল। সংঘর্ষের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, এ সময় গ্রহ দু'টি জুড়ে যায়। 'পৃথিবী' নামক গ্রহের সঙ্গে চরম সংঘর্ষ হয়েছিল 'থিয়া' নামের একটি গ্রহের। সংঘর্ষের সময় পৃথিবীর বয়স ছিল ১০ কোটি বছর। সংঘর্ষের জেরে থিয়া ও পৃথিবীর এক সাথে জুড়ে যায়, তৈরি হয় নতুন একটি গ্রহের। সেই গ্রহটিতেই আমরা বাস করছি।
পৃথিবীর সৃষ্টি আর পরবর্তী সময়ে মানুষের আবির্ভাব ও বিচরণের ক্ষেত্রে মানুষের জীবন-জীবিকা, খাওয়া-পরা, সামাজ-সাংস্কৃতিক, শিক্ষা-সাহিত্য, রাস্ট্র-অর্থনীতি, বিজ্ঞান-গবেষণা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগে হাজারো পরিবর্তন এসেছে; এখনো হচ্ছে; ভবিষ্যতেও তা চলমান থাকবে। মানব সভ্যতার বিশাল এ পরিবর্তনের পরও খুন-ধর্ষণ এবং খুনি-ধর্ষকের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয় নাই। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একই রকম আছে। বড়ই সুযোগ সন্ধানী এ মানসিক অসুখটা।
প্রাগৈতিহাসিক জৈবিক ব্যাধি, বটে ।
সাধারনভাবে বলতে গেলে কোন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত তার সাথে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করলে বা করার চেষ্টায় লিপ্ত হলে এই আচরণকে আমরা ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করি। তবে দেশে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞায় ঊনিশ-কুড়ি পার্থক্য আছে। এছাড়া অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রপ্ত বয়স্ক নারী/পুরুষের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হলে তা ধর্ষণের আওতায় পড়ে। মূলতঃ সারা পৃথিবীব্যাপী পুরুষদের দ্বারাই ধর্ষণ সংগঠিত হয়। তবে পুরুষে পুরুষে, মেয়েতে মেয়েতে ধর্ষণের অভিযোগও আছে। তবে এমন অভিযোগ সংখ্যার বিচারে অল্প।
একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষণের হার অনেক বেশি। কারাগারে পুরুষ কতৃক পুরুষ এবং নারী কতৃক নারী ধর্ষণের ঘটনা সারা বিশ্বব্যাপী অহরহ ঘটে। যদিও এগুলো বাইরের জগতের মানুষ তেমন জানে না। একটা সময় যখন দাস প্রথা প্রচলিত ছিল তখন তাদেরকে মালিকরা ধর্ষণ করতো। এখনো গৃহকর্মীরা বিভিন্ন দেশে এমন নির্যাতনের শিকার হয়। তৃতীয় বিশ্বে এ চিত্র ভূরি ভূরি পাওয়া যায়। আরবের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অহরহ পাওয়া যায়।
যুদ্ধ বিগ্রহ, গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেশী ঘটে ।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া অথবা কোনো নারীকে মৃত্যু বা শারীরিক আঘাতের ভয় দেখিয়ে সম্মতি দিতে বাধ্য করলে অথবা নাবালিকা অর্থাৎ, ১৬ বছরের কম বয়স্ক শিশু সম্মতি দিলে কিংবা না দিলে (সে যদি নিজ স্ত্রীও হয়) অথবা কোনো নারীকে বিয়ে না করেই ব্যক্তিটি তার আইনসঙ্গত স্বামী এই বিশ্বাস দিয়ে যদি কোনো পুরুষ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে আইনের ভাষায় ধর্ষণ বলা হবে"।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালত (২০১৭) একটি রায়ে বলেছেন, "স্ত্রীর বয়স যদি ১৮ বছরের কম হয় তবে তার সাথে যৌন কর্ম করা হবে ধর্ষণের সামিল এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ"।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আরেক মামলার রায়ে বলেছেন, "কেউ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে কারো সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায় তাহলে তা ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হবে না"।
২০১২ সালের পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ধর্ষণকে কেবল নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করত। তবে ২০১২ সালে তারা ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে বলে, “The penetration, no matter how slight, of the vagina or anus with any body part or object, or oral penetration by a sex organ of another person, without the consent of the victim.”
১৯৯৮ সালে রুয়ান্ডার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ধর্ষণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, "চাপ প্রদানের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির ওপর সংঘটিত যৌন প্রকৃতির শারীরিক আক্রমণ"।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু আলোচিত ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনা বাংলাদেশ সংঘটিত হয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে বাসে রূপা খাতুনকে গণধর্ষণ ও পরে নৃশংসভাবে হত্যা। কুমিল্লায় আলোচিত তনু ধর্ষণ ও হত্যা। ঢাকার বনানীতে রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণ মামলা এবং সাম্প্রতিক সময়ে হবিগঞ্জে বিউটি ধর্ষণ ও হত্যা সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে।
দক্ষিণ দিল্লিতে ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যারাতে এক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরতে বাসে উঠেছিলেন ফিজিওথেরাপির ইন্টার্ন মেয়েটি। বাসে ছিলেন চালক ও তাঁর ভাই-বন্ধু-সহকারী মিলে মোট ছয়জন, একজন তখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। চলন্ত বাসে বন্ধুটিকে গণমার মেরে তাঁরা মেয়েটিকে ক্ষতবিক্ষত করে ধর্ষণ করেন। হাত আর লৌহদণ্ড দিয়ে মেয়েটির অন্ত্র টেনে বের করেন। তারপর দুজনকেই রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন। ১৩ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মেয়েটি মারা যান।
ধর্ষণের কারণ অনুসন্ধানে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত দিয়ে থাকি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা অনুসন্ধানমূলক হয় না। আমরা মনগড়া যার যার মতো করে যুক্তি দাঁড় করাই। বিষয়টির গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি না। কারণ- জাতি হিসাবে আমরা শুনতে নয়, বলতে বেশি পছন্দ করি। যুক্তি মানি না, নিজে দিতে পারি না বলে। কোন কথা অর্ধেক শুনার পর পুরোটা বুঝে ফেলি! লেখার শিরোনাম পড়েই মন্তব্য করি। অথচ কোন বিষয় পুরোপুরি বুঝতে হলে কথা আর লেখার শেষ অংশটাই আসল। ধৈর্য ধরে শুনে ও পড়ে মন্তব্য করলে নিজেরও শেখা হতো, মন্তব্যটাও যুক্তিপূর্ণ হতো।
আমাদের এত ধৈর্য নেই। সময় কই !!
তবে, একজন রেপিস্টের ধর্ষক হয়ে উঠার মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো জানাটাও খুব জরুরি-
(১) সাইকোপ্যাথিক চরিত্রের লোকেরা রেপ/গণ ধর্ষণ করে। কামপ্রবৃত্তি সম্পন্ন মানসিক বিকারগ্রস্থ লোকেরাও ধর্ষণ করে।
(২) মাদকাসক্তি মানুষের স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ লোপ করে। এটিও রেপের আরেকটি কারণ।
(৩) একাকিত্ব বোধ, অক্ষমতাবোধ, রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা বা ব্যক্তিজীবনে কষ্ট, অপ্রাপ্তি এসব থাকলে ধর্ষণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়।
(৪) ধর্ষকদের মনে মেয়েদের প্রতি তীব্র অশ্রদ্ধা, ক্রোধ, আক্রমণাত্মক মনোভাব ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা থাকলে তারা রেপ করে।
(৫) যেসব পর্নোচিত্রে মেয়েদের সঙ্গে জবরদস্তিমূলক যৌন সম্ভোগে মেয়েদের তা উপভোগ করতে দেখানো হয় বা মেয়েদের প্রতিবাদ করতে দেখানো হয় না, সেসব দেখে অনেক পুরুষ রেপে উৎসাহিত বোধ করে।
(৬) কখনো কখনো বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে হয়ে বা শক্তিশালী হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য রেপ করে। ইত্যাদি।
(৭) কোনো মেয়ে প্রেমে বা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে মেয়েটির ‘না’- কে সহ্য করতে না পেরে রেপ করে।
(৮) অপরাধী মানসিকতার লোকেরা খুব সহজে, বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় রেপসহ যে কোনো অপরাধ করতে পারে, করে। এটি রেপের অন্যতম কারণ।
আমাদের দেশে আরেক পক্ষ উচ্চমার্গীয় সুশীল ধর্ষক আছেন; যাদেরকে পারতপক্ষে আইন আদালত পর্যন্ত ঘাটতে চায় না। উনারা সমাজের উঁচু তলার মহাদেব; এসব মহামান্যদের ঘাটতে নেই। উনাদের কেউ রাজনীতিবিদ; কেউ এমপি/মিনিস্টার; কেউ সরকারি আমলা; কেউ পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা; কেউ করপোরেট বস; কেউ ধর্মীয় লেবাসধারী ভন্ড বাবা; কেউ মুখোশধারী সুশীল; কেউ মানবাধিকার বস; কেউ বা আবার নাটক/সিনেমার প্রযোজক/পরিচালক। বেশির ভাগ ভিকটিম এদের অধীনস্থ কর্মচারী অথবা তাদের দ্বারা সুবিধাভোগী। এজন্য চাকরি হারানো, সামাজিক অসম্মান আর জীবন হারানোর ভয়ে মুখে তালা দিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন ভিকটিমরা। এদের দাপট এতো বেশী হয় যে, কখনো কখনো আইন আদালতকেও নিজের পছন্দ মতো এরা চালাতে পারে।
আর বাসা/বাড়িতে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করা একটি কমন বিষয় ।
যুদ্ধের সময় রেপকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যুদ্ধের সময় রেপকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এখনো। আমেরিকান বিখ্যাত সাংবাদিক Susan Brownmiller ১৯৭৫ সালে লেখা তাঁর বিখ্যাত "Against Our Will: Men, Women, and Rape" বইতে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিজেতারা বিজিতদের শাস্তি দিতে বা ভয় দেখাতে ধর্ষণকে রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত ধর্মযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য রেপের ঘটনা ঘটে। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডররা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পার্সি ও কাজাখ অঞ্চলে প্রচুর রেপ করে।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়ামের মহিলাদের; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ন্যাৎসি বাহিনী কয়েক লক্ষ পোলিশ ইহুদী মহিলা ও শিশুকে ধর্ষণ করে। আমেরিকান সৈন্যরা ভিয়েতনামে আগ্রাসন (১৯৫৯-১৯৭৫) চালানোর সময় ভিয়েতনামী মহিলা ও বালিকাদের; ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের মেয়েদের; সার্বীয় সৈন্যরা (১৯৯২-১৯৯৫) বসনীয় মেয়েদের; ১৯৯০ সালে কুয়েত দখলের পর ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতি মেয়েদের রেপ করে। আইএস দ্বারা ইরাক-সিরিয়া যুদ্ধে (২০১২-২০১৫) হাজার হাজার রেপের ঘটনা ঘটে। এখনো কাশ্মির, আফগানিস্তান, সুমালিয়া, মায়ানমার, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশে প্রচুর রেপ হয়।
গালফ দেশগুলোতে বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া মহিলা কর্মীরা দিনের পর দিন পরিবারের ছোট বড় প্রায় সব সদস্যদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ আছে। বন্ধী জীবন যাপন এবং দেশগুলোর আইনের দূর্বলতার কারণে ভিকটিমরা কোন সহযোগিতা পায় না।
আমাদের দেশের বোডিং মাদ্রাসা, এতিমখানা ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের ধর্ষণের অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। ধর্মীয় বাধার কারণে এরা সহজে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না, নিষিদ্ধ পল্লীতে যেতে পারে না, প্রকাশ্যে প্রেম করতে পারে না। ফলে তাদের অবদমিত যৌন চাহিদার কারণে কখনো কখনো তারা ছাত্রদের রেপ করে। এছাড়া অসহায় এসব শিশুগুলোর ওপর জুলুম করা সহজ। কারণ এরা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে এরা দুর্বল থাকে। তাই ভয় দেখিয়ে বা জোর করে এদের রেপ করা যায়।
আমাদের দেশে মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিকটাত্মীয় ও পরিবারের পরিচিত জনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েরাই বেশি আক্রমনের লক্ষবস্তু হয়। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেয়েরা সহপাঠী ও বন্ধুদের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দ্বারাও এমনটা ঘটে! যা চরম ন্যাক্কারজনক। নির্জন রাস্তায়, বনে বাদাড়ে, বিলে-ঝিলে, খেত-খামারেও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয়। রাতের অন্ধকারে একাকী চলতে গিয়ে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ওৎ পেতে থাকা মানুষরূপী হায়েনাদের দ্বারা এদেশের মেয়েরা সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের শিকার হয়।
ইদানিং নাইট বাসে অসংখ্য ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড ঘটেছে; যা চরম লজ্জা ও ভীতির। এছাড়া প্রেম ঘটিত কারণেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিছু কিছু প্রেমিক পুরুষ মেয়েদের সরলতার সুযোগ নিয়ে এমন জগণ্য ঘটনা ঘটায়। অনেক সময় এসব কাপুরুষরা খুন পর্যন্ত করে বসে।
বেপরোয়া জীবন-যাপন করতে গিয়েও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় ।
উপরোক্ত কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধর্ষণের জন্য ড্রেসকোড খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নিজের বাসা বাড়িতে যখন কোন মেয়ে নিকটাত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়; তখন কী মেয়েটির পোষাকের কোন দায় আছে? তবে মেয়েটির পরিবারের অসতর্কতার দায় অবশ্যই আছে। মেয়েকে অবাধে সবার সাথে মিশতে দেওয়ার দায় আছে। একা বাসায় রেখে যাওয়ার দায়ও অবশ্যই আছে।
স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মেয়টি সহপাঠী ও বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলো; এ ক্ষেত্রে কী ড্রেস কোডের কোন দায় আছ? তবে মেয়েটির অতি ডলাডলি ও না বুঝে যার তার সাথে বন্ধুত্ব করা এবং মেসবাড়ি/বাসায় একা বেড়াতে যাওয়ার দায় অবশ্যই আছে। ঠিক তেমনি বাসে, নির্জন স্থানে ও রাতের অন্ধকারে যেসকল ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এতে কী তার পোষাকের কোন দায় আছে?
আসলে ধর্ষকের কাছে পোষাক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, সময়-সুযোগটাই আসল। এতে আপনি যে পোষাকেই থাকেন না কেন। এজন্য শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। বৃদ্ধারা ধর্ষণের শিকার হয়।
পোষাকের শালীনতা?
অনেকে এমন প্রশ্নও করেন। আসলে পোষাকের শালীনতা দেশ, কাল, পাত্র ও সমাজ ভেদে তারতম্য হয়। যেমন আরব দেশগুলোতে স্কার্ফ দিয়ে মাথার চুল ঢেকে রাখা এবং বড় গাউন/বোরকা দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা হল শালীনত। এর ব্যত্যয় ঘটলে মানুষ সমালোচনা করে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে মেয়েদের জিন্স প্যান্ট-সার্ট পরা, অফিস আদালতে স্যুট-প্যান্ট পরা, হাটু পর্যন্ত ড্রেস পরা এবং টাইট লেগিন্স পরা হচ্ছে শালীন পোষাক। আবার আমাজন জঙ্গল, আফ্রিকা মহাদেশ, পাপুয়া নিউগিনি এবং আন্ধামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে যে সকল আধিবাসী মানুষ প্রায় ন্যাংটা থাকে, মেয়েদের বক্ষ উন্মুক্ত থাকে তাদের কাছে সেটাই শালীন পোষাক।
তার মানে এই নয় যে, আপনি আমাজনের মেয়েদের মত সভ্য সমাজে বক্ষ উন্মুচন করে হাঁটবেন। বাংলাদেশে বসে ইউরোপ-আমেরিকার মেয়েদের মতো ঊরু বের করে, বক্ষ টান টান করে, পেট দেখিয়ে হাঁটবেন। আপনি যে দেশে থাকবেন সে দেশের কৃষ্টি-কালচারকে গুরুত্ব দিতে হবে। ড্রেস কোড ফলো করতে হবে।
লন্ডনে দেখেছি বড় বড় ফ্যাশন শপগুলোতে সবচেয়ে দামী ও আধুনিক পোষাকগুলোর সবচেয়ে বড় ক্রেতা আরব মেয়েরা। এরা সবচেয়ে দামী টাইট জিন্স, টাইট গেঞ্জি, সার্ট, জুতা আর কসমেটিক্স কিনে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী লেডিস হ্যান্ডব্যাগের ক্রেতাও আরব মেয়েরা। শুধু লন্ডন কেন? এ চিত্র প্যারিস, মাদ্রিদ, বার্লিণ, নিউইয়র্ক এবং লসএঞ্জেল্সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। টাইট জিন্স ও টাইট সার্টের সাথে মাথায় স্কার্ফ দেখে একদিন পরিচিত কুয়তি একটি মেয়েকে কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। জবাবে বলেছিল, আরব দেশগুলোতে চুল ঢেকে রাখা ট্রেডিশন। তাই বলে টাইট জিন্সের উপর!! তবে নিজেদের দেশে এভাবে চলাচল করতে পারে না বলে জানাল। এজন্য লন্ডনে এসে আরব মেয়োরা খোলামেলা চলাফেরা করে।
তাহলে ধর্ষণের জন্য পোষাকের কী কোন দায় নেই?
হ্যা, আছে।
তবে তা ক্ষেত্র বিশেষে।
আমাদের দেশের প্রগতিশীল একটা পক্ষ আছে, যারা পশ্চিমা দেশগুলোর গুণ-কীর্তন করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। ধর্ষণের জন্য পোষাক কোন বিষয় নয়, পুরুষের মানসিকতাই আসল বলে বিজ্ঞ মত দেন। উনারা বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ফ্যাক্টগুলো কতটুকু জানেন বা বুঝেন জানি না। তবে এ বিষয়ে জানার অনেক ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি।
আপনি কী জানেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয় কোন কোন দেশে? আপনি বলবেন- কেন? বাংলাদেশ, ভারত, নাইজেরিয়া ইত্যাদি গরীব ও জনবহুল দেশগুলোতে। সহজ উত্তর। আমি যদি বলি ভাই হয়নি। তখন আপনি আমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে থাকিয়ে বলবেন, মূর্খ কোথাকার! দেশের খবর কিছু রাখ!!
হ্যা, ভাই আপনাকে বলছি। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলীয়া, সাউথ আফ্রকা, বোতসোয়ানা, নিকারাগুয়া ও পানামায়। প্রয়োজনে ইন্টারনেট ঘেটে দেখতে পারেন। এসব দেশে কঠিন আইন থাকার পরও এত এত ধর্ষণের ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী নাইট লাইফ, মেয়েদের অতি স্বাধীনচেতা মানসিকতা, ক্লাবিং এবং অতিরিক্ত মদ্যপান।
পৃথিবীতে ধর্ষণের যত ঘটনা ঘটে তার অতি ক্ষুদ্র অংশ প্রকাশিত হয় ।
লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে (সিটি) দীর্ঘ ছয়-আট বছরে রাতের বেলা কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এগুলো। শেষ রাতে ইয়াং মেয়েরা ক্লাব থেকে যখন ড্রাঙ্ক হয়ে বের হয়, তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এ সময় শত শত মেয়ে অপরিচিত ছেলেদেরকে পরিচিত ভেবে, বন্ধু ভেবে তাদের সাথে চলে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর যখন নতুন বিছানা, অপরিচিত সঙ্গী পাশে শুয়ে থাকতে দেখে তখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, চৈতন্য ফিরে আসে। বিশেষ করে উইকএন্ডে (শুক্র-শনি) অসংখ্য ছেলে ড্রাঙ্ক মেয়েদের পটিয়ে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে আসে। এসব ক্ষেত্রে ভিকটিমরা বেশিরভাগ সময় পুলিশি ঝামেলায় যায় না। এটা প্রমাণ করাও সহজ নয় যে, মেয়েটি স্ব ইচ্ছায় ছেলেটির সাথে যায়নি। হিসাব করলে প্রতি মাসে এমন ঘটনা শুধু লন্ডন সিটিতেই কয়েক'শো হবে।
লন্ডন ওয়েস্ট এ্যান্ডে শেষ রাতে ক্লাবিংয়ের পর অন্ধকার চিপা গলিতে অসংখ্য মাতাল মেয়েকে রেপ হতে আমি দেখেছি।
শুধু কী মেয়ে?
পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক ছেলেও ধর্ষণের শিকার হয়।
এসব দেশগুলোতে পারস্পরিক সম্মতি থাকলে পূর্ণ বয়স্ক যে কোন ছেলে-মেয়ে যৌন কর্ম করতে পারে, এতে আইনগত কোন বাঁধা নেই। এ বিষয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশে ছেলেদের দ্বারা ছেলেদের রেপের ঘটনা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশে মেয়েদের দ্বারা মেয়েরাও রেপের শিকার হচ্ছে ইদানিং। তবে তা এখনো উচ্চবিত্ত, ড্রাগি, ধুমপায়ী ও মানসিক বিকারগ্রস্থ মহিলা সমাজে এ প্রবণতা বেশী। এছাড়া নারীবাদী মানসিকতা, পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাবও একটি অন্যতম কারণ।
দেশে দেশে ধর্ষকের গায়ের রং ভিন্ন ভিন্ন হলেও চরিত্র এক ।
গবেষণায় দেখা গেছে উন্নত দেশগুলোতে নাইট লাইফ মেয়েদের ধর্ষণের জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। এছাড়া মেয়েদর অতিরিক্ত মদ্যপান এবং অতি খোলামেলা পোষাক-পরিচ্ছদও কম দায়ী নয়। তবে দিনের বেলায় খোলামেলা পোষাক পরলেও মেয়েদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রবনতা খুবই কম। আইনের কড়াকড়ির কারণে এসব দেশের ধর্ষকরা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক।
এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি। পশ্চিমা মেয়েরা পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর মোটামোটি সবাই অবাধে বয়ফ্রেন্ডের সাথে মেলামেশা করে। এজন্য ধর্ষণের ঘটনায় তুলনামূলক কম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে একটি মেয়ের কাছে কুমারিত্ব অনেক বড় কিছু। এসব মেয়ে যখন এমন ন্যাক্কার জনক ঘটনার মুখোমুখি হয় তখন মেনে নিতে পারে না। অনেক একরোখা মেয়ে অভিমান করে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বেছে নেয়। যা সত্যি বেদনাদায়ক।
ড্রেস কোড ধর্ষণের প্রধান কারণ না হলেও অতিরিক্ত খোলামেলা পোষাক ধর্ষককে উদ্ভোধ্য করে।
উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের অভিযোগ পেলে পুলিশ সর্বাচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে। প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা হয়। ভিকটিমের পরিচয় গোপন থাকে। তবে ধর্ষক কাপুরুষটির ছবি প্রকাশ করে। আমাদের দেশও এখন ধর্ষণের বিচারগুলো সরকার গুরুত্ব দিয়ে করছেন। অপরাধীরা ধরা পড়ছে। এটা ভাল লক্ষণ। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। ভিকটিম মেয়েটার ছবি ও পরিচয় আমরা যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করি। যা দায়িত্ববোধ থাকলে করতাম না। ভাবুন ভিকটিম মেয়েটি আপনার বোন, আপনারা মেয়ে। এমন অসহায়, বিপর্যস্ত আর কাটা-ছেড়া, পঁচা গলা দেহটি মানুষের কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাবে ঘোরাঘুরি করছে দেখলে নিশ্চয় আপনার ভাল লাগবে না।
আসুন এখন থেকে ভিকটিম নয় ধর্ষকের ছবি ভাইরাল করি। তারা যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায় সেজন্য পরিবারটিকে সহযোগীতা করি। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সমাজকে সচেতন করি।
ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে ধর্ষককে সচেতন ও সতর্ক করাটা জরুরী; ধর্ষণের শিকার হওয়া ভিকটিমকে নয়।
ধর্ষনের মতো একটি জঘন্য অপরাধ আমাদের সমাজে হুহু করে বাড়ছে; এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতাই এর জন্য দায়ী। ধর্ষককে রক্ষা করার লজ্জাহীন দালালী এই সমাজে খুবই লক্ষণীয়। ধর্ষকের জন্য দল বা গোত্র পরিচয় একেবারে অর্থহীন, বিচারিক দীর্ঘসূ্ত্রীতাও অন্যায়। কেবল কঠোর বিচার এবং এ ব্যপারে জিরো টলারেন্সই পারে ধর্ষকের মনে তুমূল আতঙ্ক সৃষ্টি করতে। ধর্ষকদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন অপরাধ করতে সাহস না পায়। ফলে সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপুরুষরাও সতর্ক হবে। এ দায়িত্ব আমাদের পুরুষদেরই নিতে হবে। প্রতিটা পুরুষ যদি বিবেক তাড়িত হয়, মেয়েদরকে সম্মানের চোখে দেখতে শিখে তাহলে বিশ্বব্যাপী ধর্ষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এজন্য পুরুষ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরী। পাশাপাশি পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধ ও আইন মানার প্রবণতা থাকতে হবে।
একজন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন "মানুষ" হওয়াটা সবার আগে দরকার।
তথ্যসূত্র -
U.S. Dept of Justice, (January 6, 2012)
Criminal code, (ডিসেম্বর, ২০১২)
Sexual violence chapter (6) World Health Organization (২০১৫)
The Trauma of Sexual Assault Treatment;
Prevention and Practice. (২০০৩)
The Incidence of Prisoner-on-Prisoner Rape, (FBI statistics)
ডক্টর আকতার বানু আলপনা, (ভোরের কাগজ, মে ২০১৭)
www.trendrr.net (জুলাই ৩, ২০১৮)
Susan Brownmiller Papers, Harvard Library, (June 3, 2010)
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত, লাইক ও কমেন্ট প্রাপ্ত পোস্ট।
গল্প লেখার সহজ পাঠ
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:১৩