স্কুলে পড়ার সময় থেকে টুকটাক কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। তবে কলেজে উঠার পর কবিতা লেখার প্রতি টানটা একটু বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের বাংলার স্যারও কবিতাপ্রেমী ছিলেন। তিনি কবিতা নিয়মিত লেখতেন এবং বিভিন্ন কবিতা উৎসবে যোগ দিতেন। একদিন কি যেন ভেবে আমার লেখা একটি কবিতা স্যারকে দেখালাম। ষোল লাইনের কবিতাটি পড়ে স্যারের মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে আমাকে বল্লেন কবিতা লেখার চেষ্টা করা ভাল, তবে আধুনিক কবিতা লেখতে হলে এ যুগের কবিতা বেশি বেশি পড়তে হবে। এ যুগের বিখ্যাত কবিদের লেখা অনুসরণ করতে হবে। তাদের কবিতার ভাষা, ভাব ও লেখার প্যাটার্ন বুঝতে হবে।
সোজা কথায় স্যারের মতে, আমার লেখা কবিতা এ যুগের আধুনিক কবিতার ধারে কাছে যায়নি। আমার মন খারাপ দেখে স্যার দু'টি কবিতার বইয়ের নাম লিখে দিলেন স্থানীয় একটি লাইব্রেরী থেকে কিনে পড়ার জন্য।
"শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভূঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে'।
কহিকলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী ভূমির অন্ত নাই-
চেয়ে দেখো মোর, আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাই"।।
..........রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (দুই বিঘা জমি)
বই দু'টির নামের অর্থ যদিও বুঝিনি তারপরও কিনে আনলাম। পড়ে তো হতবাক। কবিতাগুলোর ভাষা খুবই দুর্বোধ্য ও কঠিন ছিল। বারবার পড়লাম, তবুও ঠিকমতো বুজতে পারলাম না। একটি বইয়ে স্যারেরও দু'টি কবিতা ছিল। কিন্তু তাঁর দু'টি কবিতা বার বার পড়ার পরও কিছুই বুঝলাম না। তাহলে এগুলো এ যুগের আধুনিক কবিতা? যা বুঝতে হলে উচ্চমার্গীয় দার্শনিক হতে হবে? যা কবি ছাড়া সাধারণ পাঠকের কেউ বুঝতে পারেনা তাই আধুনিক কবিতা? ছোটবেলা থেকে কবিতা চর্চা করেও যদি আধুনিক কবিতা বুঝতে না পারি তাহলে সাধারন পাঠকদের অবস্থা কী হবে? আধুনিক কবিতা কি সব শ্রেণীর পাঠকদের জন্য নয়?
আমার মনে হয় আধুনিক এ কবিতাগুলো শতকরা ১০% পাঠকও বুঝে না। এজন্য পড়বে না, নিশ্চিত। এমনও হতে পারে এ যুগের কবিতা বোঝার মতো আক্কেল আমার নেই। স্বীকার করছি এটা আমার ব্যর্থতা। সেদিন থেকেই আমি কবিতা লেখা ও পড়া বন্ধ করে দেই। তবে স্যারকে এ বিষয়ে কিছু বলিনি, জানতেও চাইনি।
ছোটবেলা থেকে কবিতা লেখার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। লেখতে ভাল লাগত তাই মনের আনন্দে লেখতাম। তবে সেগুলো কবিতা হয়েছে কিনা জানি না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি সেগুলো আধুনিক কবিতা ছিল না। কারণ যে কেউ পাঠ করলে কবিতাগুলো বুঝতে পারবে। আধুনিক কবিতা তো সাধারন পাঠকদের জন্য নয়! সাধারন পাঠক কবিতা বুঝতে পারলে তা আধুনিক কবিতা হতে পারে না। সেদিন বুঝেছিলাম এখনকার আধুনিক কবিতার নামে যা হচ্ছে তা নিছক পাগলামী। এখানে সাধারন পাঠকদের প্রবেশাধিকার নেই। কবিতার নামে কাল্পনিক, বানোয়াট, উদ্ভোট ও বাস্তবতা বিবর্জিত কিছু লেখার চেষ্ঠা মাত্র।
"গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে মানুষ জাতি"।।
..........কাজি নজরুল ইসলাম (মানুষ)
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই লেখার ধারাবাহিতা। দুর্বোধ্য শব্দ আর যত্র তত্র দাড়ি/কমা/সেমিকোলন ইত্যাদির ব্যবহার। আর এটাও বুজেছিলাম বাংলা সাহিত্যে এসব কবিতার স্থান কোন দিন হবে না। তবে সবাই যুগের স্রোতে গা ভাসাননি। অনেক ভাল ভাল কবি এ যুগেও আছেন। তারা মাতৃভূমি নিয়ে, আমাদের মাটি ও মানুষ নিয়ে, সাধারন মানুষের আবেগ অনুভূতি নিয়ে সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় কবিতা লেখেন। তবে সংখ্যাটি অল্প।
একটি বাংলা কবিতা বুঝতে হলে কতবড় বাংলাবিদ ও দার্শনিক হতে হবে তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কুলায় না। কত শত যুগ ধরে যে বাংলা কবিতা পাঠের তালিম নিয়ে এর অর্থ বোঝতে হবে তা ভেবে শিউরে উঠি। একটা গল্প, উপন্যাস এমনকি প্রবন্ধ পড়তে তো সাধারন পাঠকদের এতো বেগ পেতে হয় না। শুধু কবিতার ক্ষেত্রে খুঁজে খুঁজে কঠিন শব্দগুলো কেন ব্যবহার করা হয় তার যৌক্তিক কোন কারন আছে কি না জানা নেই। যাহোক বোধ্য-দুর্বোধ্য, জঠিল-সরল, মিত্রাক্ষর-অমিত্রাক্ষর, ছন্দময়-ছন্দহীন আকৃতি নিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতা এগিয়ে যাক এ কামনা করি।
"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীতের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন"।।
..........জীবনানন্দ দাশ (বনলতা সেন)
বিভিন্ন শব্দ ভান্ডার হতে টুকরো টুকরো শব্দ নিয়ে স্বযত্নে একটি করে চরণ বসিয়ে অথবা দুনিয়ার সব দুর্বোধ্য শব্দ চয়ন করে অন্তমিল গোজামিল যত মিল আছে তা দিয়ে কবিতার আকৃতি দেওয়া যায়। আর আকৃতি দেওয়ার পর যখন মনে হবে কবিতাটি জটিল প্রকৃতির হয়েছে, কবি নিজেও এর শানে-নুযুল ঠিকমত ধরতে পারছেন না তখন বুঝতে হবে কবিতাটি হয়েছে একটি উচ্চমার্গীয় আধুনিক কবিতা।
কবিতাটি পড়ে আমার মত সাধারন পাঠক যখন বলবে কিছুইতো বুঝিনি। জবাবে লেখক বলবেন, কেন আপনি বুঝলেন না? সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার। আধুনিক কবিতা বুঝার ক্ষমতা আপনার নেই। অতি হক কথা। কবিতা পাঠের যোগ্যতাই যে আমার নেই।
"ভাল মেয়ে ঠিক কাকে বলে, জানো?
ভালো ছেলে মানে কী?
তুমিও বলবে, সহজ প্রশ্ন মাপকাঠি একটি
যে মেয়ে পেয়েছে অঙ্কে একশো,
যে ছেলে ভূগলে সেরা!
তারাই তো ভালো সবাই বলছে
হীরের টুকরো এরা।
কাগজে ওদের ছবি ছাপা হয়,
টিভিতে দেখায় মুখ।
ওদের জন্য আমারও তো ভাই
আনন্দে ভরে বুক।
তবু কেন জানো, তোমাকে বলছি
দেখে শুনে পাই ভয়।
শুধু এতো এতো নম্বর পেলে
ভাল ছেলে-মেয়ে হয়?"
..........কার্তিক ঘোষ (তুমিও বলবে)
কবি কি লেখবেন তা একান্ত তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কবিতাটি লেখে যদি নিজের ব্যাক্তিগত ডায়রিতে রেখে দিতেন তাহলে পাঠকদের আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তি হল বই আকারে কবিতাপ্রেমীর হাতে পৌছার পর যখন সাধারন পাঠক বুঝে উঠতে পারেন না কবিতাটির সারমর্ম। পকেটের টাকা খরছ করে পাঠক এমন কোন সাহিত্যকর্ম কিনতে চায় না, যা পড়ে বুঝতে পারেনা।
এটা কবির ব্যর্থতা নয় কি? শুধু কবিতা কেন? গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, প্রবন্ধ যাই লেখেন না কেন তা সাবলিল ও সহজপাঠ্য না হলে কেউ পড়বে না। এটা লেখকদের মাথায় রাখা প্রয়োজন। নিজে শুধু শুধু লেখেই কবি/সাহিত্যিক হওয়া যায় না। পাঠকদের স্বীকৃতিটাই আসল।
কবিতা লেখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়; জানতে হয়। টিনেজ বয়সে ছেলে মেয়েদের শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে আবেগী মন থেকে যে কবিতা আসে, তাতে বাস্তবতার চেয়ে আবেগের জয়গান বেশি থাকে। এজন্য এগুলো কালজয়ী কবিতা হয় না; টিনেজ মানেই কবি আর কবিতার চাষবাস। এজন্য এই বয়সের তরুণ, তরুণীরা গল্প লেখে না, শুধু কবিতা লেখতে চায়। অনেকে টিনেজ বয়সের এই অপরিপক্ব কবিতা পাকা বয়স অবধি টেনে নেন; ফলে বয়সের সাথে কবিতায় পরিপক্কতা আসে না। ভাল কবি হওয়ার পূর্বশর্ত হলো ভাল পাঠক হওয়া; কবি ও কবিতার ইতিহাস পড়া; আধুনিক গুণী কবিদের কবিতা পড়ে আত্মস্থ করার চেষ্টা করা।
"আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছাট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়িতো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে"।।
..........জসিম উদ্দিন (আসমানী)
কবিতার ক্ষেত্রে একটি লাইন থেকে পরের লাইনে যাওয়ার সময় যেন একটি যৌক্তিক সূত্র থাকে। কবিতা পড়া শেষে পাঠক যেন একটি অর্থবহ সারমর্ম পায়, যাতে পরিপূর্ণ ভাবে কবিতা পড়ার স্বাদ আসে সেটা কবিদের মাথায় রাখাটা প্রয়োজন। অনেকে অযথা জটিল শব্দ দিয়ে অস্ম্পূর্ণ ভাব বাক্যে কবিতা লেখেন, অনেক সময় একটি লাইনের সাথে পরবর্তী লাইনের বক্তব্যের মিল থাকে না। ফলে পাঠকরা পুরো কবিতা পাঠ করেও কিছুই বুঝতে পারে না। একজন লেখক হিসাবে এ দায়টা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এখন প্রমিত বাংলার যুগ। মানুষ সহজ কথাটি সহজে বুঝতে চায়। অযথা ঘুরিয়ে পেচিয়ে আর দুর্বোধ্য শব্দ দিয়ে কবিতা লেখলে পাঠকের আগ্রহটা নষ্ট হয়ে যায়। এখন বিনোদনে হাজারো ক্ষেত্র আছে। এজন্য সহজপাঠ্য সাহিত্য না হলে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেয়। তিনিই তো শ্রেষ্ঠ কবি/সাহিত্যিক যিনি কঠিন কথাটি পাঠককে সহজ ভাবে বোঝতে পারেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এবং আধুনিক বাংলা কবিতার পুরোধা জীবনানন্দ দাশের কবিতা বুঝতে তো সাধারন পাঠকদের কোন বেগ পেতে হয় না। এছাড়া বর্তমান সময়ের কবি শামসুর রহমান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি আল মাহমুদ ইত্যাদি কবিদের কবিতায় এদেশের মাটি ও মানুষের গন্ধ পাওয়া যায়; কবিতাগুলোও সহজপাঠ্য। পাঠক হিসেবে যেকেউ তার পাঠ উদ্ধার করতে পারে। হাজার হাজার মানুষ আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন তাদের কবিতা পাঠ করে। কবিতায় নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ ও ভাব-ভালবাসা খুঁজে পায় পাঠক। জীবনের অনেক না জানা প্রশ্নের উত্তর জানা হয়। তাঁদের কবিতা অল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত সবাই পড়তে পারে, বুঝতে পারে। এসব কবিতা বুঝতে উচ্চমার্গীয় দার্শনিক হতে হয় না।
"হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমন
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচারি"।।
..........মাইকেল মধুসূদন দত্ত (বঙ্গভাষা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের সময়ে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব অনেক বেশি ছিল, এছাড়া সাধু ভাষার প্রচলন ছিল সর্বত্র। এখনকার মত এত শিক্ষিত মানুষও সে সময় ছিল না। তারপরও তাদের লেখা পড়তে পাঠকদের কোন সমস্যা হয়নি। শত বছর পরও তাদের কবিতা/ছড়া/গীতিকাব্য মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়ে, বছরের পর বছর মনে রাখে, গবেষণা করে। তাদের লেখা কবিতা মানুষের জীবনমুখী ছিলো। সাধারন মানুষের আবেগ অনভূতি, তাদের পাওয়া না পাওয়ার বেদনা, প্রেম ভালবাসা ও প্রকৃতির খেয়াল নিয়ে সহজ ও সাবলিল ভাষায় তারা তা তুলে ধরতেন। এখনো তাদের কবিতায় পাঠকরা নিজেদের জীবনের অস্থিত্ব খুঁজে পায়। তাঁরা কবিতা দিয়েই সমাজ পরিবর্তন করেছেন।
কবিগগুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, গান সহ বাংলা সাহিত্যের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যা তাঁর লেখায় সমৃদ্ধ হয়নি। তারপরও কবি হিসেবেই মূলত বিশ্বব্যাপী তিনি পরিচিত। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথরা সাধারন মানুষকে ভিত্তি করেই কবিতা লেখতেন, সমাজে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়-আসয়, অন্যায়-অত্যাচারের কাহিনী অত্যন্ত সাবলীল ও সহজ ভাষায় তুলে ধরতেন। যাতে সাধারন মানুষ সহজে তা বুঝতে পারে।
আমার কেন যেন মনে হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশরা এ যুগের আধুনিক কবিতার মর্ম বুঝতে হলে বাংলা অভিধান থেকে উচ্চমার্গীয় শব্দের অর্থ খুঁজতে হতো।
বিদ্যেবোঝাই বাবু মশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন, "বলতে পারিস সুর্য্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?"
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাঁসে।
বাবু বলেন, "সারা জীবন মরলেরে তুই খাটি
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে ষোল আনাই মাটি।"
..........সুকুমার রায় (ষোল আনাই মিছে)
ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপে আধুনিক রেনেসাঁর জন্ম হলেও সাহিত্যের ধারায় সেই পরিবর্তন হয়েছে অনেক পরে। পশ্চিম ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ফলে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, চিন্তা-চেতনা, পরিবেশ-সামাজিকতা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। হঠাৎ করে নতুন এক জীবন ব্যবস্হায় মানুষ ইউ- টার্ন করে। আর এই ইউ- টার্নই হলো আধুনিক জীবন ব্যবস্হা। যা পরবর্তীতে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তখন পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর বিশ্বব্যাপী কলনিয়াল রোলার হিসাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
তবে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে অনেক পরে; বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। এ ধারাটি শুরু করেছিলেন বাংলা ভাষার সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্থক মাইকেল মধুসূদন দত্ত; কৈশর ও যৌবনে তিনি বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন বলেই তিনি আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নিয়েছিলেন। এজন্য জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মাতৃভাষায় যখন লেখা শুরু করেন তখন থেকেই তাঁর লেখা কবিতায় ইংরেজি আধুনিক সাহিত্যের ছাপ পড়ে। এ ধারাটি আরো গতিময় হয় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। মূলতঃ তাদের ইংরেজী সাহিত্যের উপর পড়াশুনা ছিল বলে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার ধারাটি তাঁদের হাত দিয়ে রোপিত হয়।
তখন থেকেই বাংলা কবিতায় শব্দ গঠন, ভাষাশৈলীর বৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবন চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন আসে। আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শৈল্পিক ভাবনা ও মানুষের অনুভূতির সতস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ।
বাংলা ভাষার গত হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বাংলা ভাষাটি "পালি-প্রাকৃত, ওড়িয়া, অসামিয়া, সংস্কৃত, সাধু, চলিত" ইত্যাদি বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তন হয়েছে; সর্বশেষ এ ধারায় যুক্ত হয়েছে 'প্রমিত বাংলা'। এগুলোর মাধ্যমে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষা লেখার এবং পড়ার রীতি সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে। আধুনিক মানে স্মার্ট । কবিতা যেহেতু এ যুগের স্মার্ট মানুষদের জীবন ও চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ সেহেতু কবিতার ভাষাও স্মার্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন- গত বিশ বছর আগে যখন স্মার্ট ফোন ছিল না; তখন মোবাইল প্রযুক্তি এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না; এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে কিন্তু এর ব্যবহার সহজ হওয়ায় এবং নতুন নতুন ফিচার সংযুক্ত হওয়ায় মোবাইল হয়ে উঠেছে মিনি কমপিউটার। ঠিক তেমনি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কবিতার কারুকাজ আরো উন্নত হওয়ার পাশাপাশি কবিতা আরো বেশী সুখপাঠ্য হওয়ার কথা ছিল। দুঃখজনক হলেও তা হয়নি।
কবিতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে যিনি আধুনিক কবিতা লিখে নিজেই বুঝতে পারেন না, কবিতাকে কঠিন থেকে আরো কঠিন করে তুলতে অভিধান থেকে শব্দ ধার করেন, ভাব-ভাষা আর সময়ের তাল-লয়ে গোলমাল করেন তিনি স্ব ঘোষিত আধুনিক কবি হবেন। তিনি মানুষের কবি নয়। কবিতা লেখা খুব সহজ কিন্তু কবি হওয়া খুবই কঠিন; অনেক সাধনা লাগে। আধুনিক সময়-সমাজ কিংবা আধুনিক পাঠকের কবি তিনি কখনো হতে পারবেন না; যদি না পাঠক নিজেকে কবিতায় আবিষ্কার করতে না পারে । যা আধুনিক জমানার মানুষ বুঝে না, তা আর যাই হোক কবিতা নয়। যিনি আধুনিক পাঠকদের মন-মানষিকতা, সমাজ-রাষ্ট্র, প্রকৃতি-প্রেম আর জীবন-যৌবন নিয়ে কবিতা লেখেন তিনিই এ যুগের কবি।
কবিতার একনিষ্ঠ একজন পাঠক হিসাবে এটি আমার দুঃখ। দিনকে দিন কবিতার ভাষা সহজ হওয়ার পরিবর্তে কঠিন হচ্ছে; তবে তা কেন হচ্ছে তা পাঠকের মনে এক অজানা রহস্য। আমার পরিচিত একজন কবি আছেন; এ বিষয়ে একদিন তিনি বলেন, অনেক সময় কবিতার ছন্দ মেলাতে ডিকশনারি থেকে খুঁজে খুঁজে এমন কিছু দুর্বোধ্য শব্দ বের করেন; যে শব্দটা তিনিও কোনদিন শুনেন নাই।
কবি নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত 'হুলিয়া' কবিতাটি আমার মতো অনেকেরই প্রিয়। কবিতায় এদেশের মাটি, মানুষ, আবেগ, প্রেম, স্মৃতি সবই আছে। আছে নিজের মতো করে কবিতা লেখার অবাধ স্বাধীনতা। হৃদয় ছোঁয়া কবিতা লিখতে কঠিন হৃদয়ে কঠিন শব্দবানের দরকার নেই। দরকার দেশ-মাতা-মাটির কণ্ঠ বুঝে নিজের মতো করে প্রকাশের ভাবনা।
আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি।
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না।
বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনলো না।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি।
সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি।
আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া।
অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে।
পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো।
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি।
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল।
হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম।
সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে।
পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে – -।
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম,— “মা’।
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো।
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম।
[(হুলিয়া কবিতার একটি অংশ)]
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত/লাইক/কমেন্ট প্রাপ্ত পোস্ট।
গল্প লেখার সহজ পাঠ।
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
[কিছু কথা - আমি আধুনিক কবিতা লেখতে পারি না বিধায় কবিতা লেখি না; কিন্তু কবিতার একজন একনিষ্ঠ পাঠক আমি। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ কবিতার ভাব বুঝতে অপারগ হওয়ায় ইদানিং কবিতা পড়া কমিয়ে দিয়েছি; স্বীকার করছি পাঠক হিসাবে এটি আমার ব্যর্থতা। যারা কবিতা লেখেন সবার প্রতি আমার শুভ কামনা রইলো। লেখাটি ব্লগে আসার আগের; তবে ব্লগে বেশ ভাল কয়েকজন কবির কবিতা পড়েছি; পাশাপাশি ছড়াও পড়া হয় নিয়মিত। তবে সময়ের অভাবে হয়তো সব কবিতায় কমেন্ট করা হয় না। আমি কারো নাম নিচ্ছি না; কারো নাম বাদ পড়ে যেতে পারে এজন্য।]
উৎসর্গ - লেখাটি সামু ব্লগের স্টার আমার প্রিয় গুরু ঠাকুরমাহমুদ ভাইকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ২:০০