রাত এগারোটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। সিলেট থেকে নয়টা কুড়িতে ট্রেন ছাড়লে অনেক আগেই তা মাইজগাঁও স্টেশনে পৌছার কথা। উদয়ন এক্সপ্রেসের যাত্রী আমি। যাব চট্টগ্রাম স্টেশনে। ভোরে চট্টগ্রামে পৌছে সেখান থেকে বাসযোগে খাগড়াছড়ি। অনেক লম্বা জার্নি। ট্রেনের আসার বিলম্বের সাথে আমার কর্মস্থলে পৌছার সময়টাও চুইংগামের মতো লম্বা হবে। বিষয়টি ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। এমনিতেই ট্রেন জার্নি পছন্দ না তার উপর দীর্ঘ অপেক্ষা।
সময় কাটাতে সৈয়দ মুজতবা আলীর "দেশে বিদেশে" বইটি বের করে পড়তে শুরু করলাম। এই নিয়ে কতবার যে বইটি পড়ছি তার কোন হিসেব নেই। কোন বই পড়তে ভাল লাগলে বারবার পড়ি। কারণ আমার বিশ্বাস ভাল বইগুলো একবার পড়ে পুরোপুরি পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এজন্য কয়েকদিন পর পর পড়া। প্রথমবার রকেটের গতিতে পরবর্তী সময়ে বাসের গতিতে পড়া, সাথে লেখকের ভাবনা আর সময়ের খরস্রোতা নদীর সাথে নৌকা নিয়ে এলোমেল বৈঠা বাওয়া। কোন বই পড়া শুরু করে ভাল না লাগলে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে রেখে দেই শেষ না করেই। আবার শুরু করি নতুন করে আরেকদিন।
শীতের রাত। সিলেট অঞ্চলে এবার একটু দেরীতে শীত পড়লেও গত কয়দিন থেকে এতো ঠান্ডা পড়েছে মনে হচ্ছে, যে কয়দিন শীত পড়েনি পাঁজি বুড়ি এখন তা সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে! মেঘালয়ের মনিপুরী পাহাড় আর আসামের সুউচ্চ পর্বতমালার শীতের খনি রাত নিশিতে যেন ঝাপি খুলে বসেছে। সাথে কনকনে বাতাস। স্যুট-টাইয়ের নীচে একটি কালো সুয়েটার পরেছি তার উপরে কাশ্মীরি রেশমি চাদর মুড়িয়ে বসে আছি কিন্ত লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। শীতে টকটক করে কাপছি। বই পড়ায় মনযোগ আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বইটি বন্ধ করে দিলাম।
মফস্বলের ছোট একটি স্টেশনে প্লাটফর্ম আর ওয়েটিং রুমের মাঝে তফাৎ তেমন নেই। খোলামেলা। মনে হচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া যাতে স্টেশনের এপাশ ওপাশ অনায়াসে করতে পারে কোন বিপত্তি ছাড়া তা মাথায় রেখেই ডিজাইন করা হয়েছে স্টেশনগুলো! রাত বাড়লেও স্টেশনের চিরায়ত নিয়ম মেনে দুইটি নেড়ি কুত্তা ঝগড়া করছে। ভবঘুরে মানুষজন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছোটাছুটি করছে। শাড়ি পরা অষ্টাদশী একটি তরুনী মুখে তিব্বত পাউডারের প্রলেপ দিয়ে ঠোঁটে কড়া লাল লিপিস্টক লাগিয়ে কৌতুহলী চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। একজন ভদ্রলোক খাঁচায় ডজনখানেক মুরগী নিয়ে আমার মতো অসহায় দৃষ্টিতে ট্রেনের আগমনের পানে চেয়ে আছেন অপলক দৃষ্টিতে। কয়েকটি ছিন্নমূল বাচ্চা দুইটি গ্রুপে ভাগ হয়ে একটু দূরে ফাইটিং প্রেকটিসে লিপ্ত; এদের কুস্তি-দোস্তি দেখে উপস্থিত সবাই হো হো করে হাসছে। মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের ভদ্রলোকেরা বেশ বিনোদন পাচ্ছে। নেতা-নেত্রীদের ব্যানার-ফ্যাস্টুনে পুরা স্টেশন সয়লাব। নাম না জানা ডজন খানেক নেতার মিষ্টি আর স্মার্ট অবয়ব প্লাটফর্মের কোনায়-কানায় ঝুঁলে আছে বাদুড়ের মত।
এমন পরিস্থিতিতে মেজাজ শান্ত রাখা মুশকিল। মনে মনে রেলের বাপ-দাদা, বউ-শালী, শ্বশুর-শাশুড়ির চৌদ্দগোষ্টি উদ্ধার করছি। অবশেষে শীতের ঠেলায় জুতা খুলে পা দু'টি চেয়ারেরর উপরে তুলে মেজাজ কন্ট্রোল রাখার চেষ্টায় আছি। আমি যা পছন্দ করি না, আমার কপালে সব সময় তাই জুটে। এজন্য মনে মনে আবাল বলে নিজেকেও একটি গালি দিলাম। আমাকে চমকে দিয়ে পাশের চেয়ারে বসা ভদ্রলোক আচমকা বলে উঠলেন,
-- স্যার, চা খাবেন?
ভদ্রলোক কখন আমার পাশে এসে বসেছেন খেয়াল নেই। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামার সাথে সাদা একটি চাদর দিয়ে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মোড়ানো। সাদা পাঞ্জাবীর সাথে সাদা চাদর গায়ে জড়াতে এ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি তাই কিছুটা অবাক হলাম। লোকটির বয়স সত্তর-পঁচাত্তর হবে। একটু বেঁটে। তবে বয়সের ভারে ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকা। লম্বা মানুষদের বয়স হলে শরীরটা বেঁকে যায় কিন্তু খাটো মানুষদের সচরাচর এমন হয় না। তবে ব্যতিক্রমও আছে। লোকটা এই ক্যাটাগরির।
-- চা খাবেন?
-- জি না।
লোকটি আবারো চায়ের অফার করতেই চট করে মুখের উপর বলে দিলাম। যাতে তিনি আর কথা না বাড়ান।
-- আরে মশাই শীতের রাতে গরম চা-টা খেলে আরাম পাবেন। ভেতরটা উষ্ণ হবে। শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত হফিংস্টন টি এস্টেটের চা পাতা দিয়ে তৈরী। এক চুমুক দিলেই বুঝবেন।
-- না মশাই খাব না। তাছাড়া আমি চা তেমন একটা খাইনা। ধন্যবাদ।
-- ওহ!
উটকো লোকদের প্রশ্রয় দিলে অনেক ঝামেলা। এরা অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে। প্রথম দেখাতেই সবকিছু জানতে চায়। অথচ প্রথম পরিচয়ে কাউকে এতো প্রশ্ন করা যে অভদ্রতা তা এসব লোকেরা থোড়াই কেয়ার করে। প্রায় প্রতিবার ট্রেন ঝার্নিতে এমনটা হয়।
-- বুজলেন, এবার এতো শীত পড়েছে মনে হচ্ছে আলাস্কায় আছি। টেম্পারেচার নির্ঘাত শুণ্য ডিগ্রীর নীচে।
ফ্ল্যাস্কের মুখটিকে কাপ বানিয়ে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথাটি বল্লেন তিনি। চায়ে চুমুক দিয়ে অদ্ভুত একটি শব্দও করছেন চুকচুক করে।
-- আপনি কি কখনো আলাস্কায় গিয়েছেন?
-- না গেলেও জানি। গুগল করলে এক নিমিষেই সারা পৃথিবীর খবর হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় এখন।
-- হুম।
-- চা, কফিতে একটু আয়েশ করে চুমুক না দিলে রিয়েল টেস্ট পাওয়া যায় না। টুপ করে গিলে ফেল্লে পানি খাওয়ার মতো হয়ে যায়। পানি পান করা আর চা খাওয়া কি এক হলো বলুন?
-- তা হবে কেন?
লোকটির অত্যাচার থেকে বাঁচতে আবারো সৈয়দ মুজতবা আলীর "দেশে বিদেশে" বের করে নিষ্টার সাথে পড়ার ভান করলাম। আড় চোখে লোকটির প্রতি খেয়াল রাখলাম। এবার সত্যি সত্যি মন চাচ্ছে কড়া করে এককাপ চা খেতে। চাইলে স্টেশনের টং দোকান থেকে খেতেও পারি। কিন্তু লোকটি কি ভাববে তাই ইচ্ছাটি বাদ দিতে হলো।
শীতের প্রকোপে খাঁচার মুরগীগুলো কিচিরমিচির করছে। চারদিক থেকে বাতাসের ছোটে চায়ের কড়া ঘ্রাণের মতো প্রস্রাবের কড়া গন্ধ নাক ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে। মনে হচ্ছে বমি হবে। দেশের সব রেলস্টেশনে একই হাল।
-- চাইলে পান খেতে পারেন মশাই। পান খেলে ভেতরটা চাঙা হয়। কান গরম হয়। তাছাড়া পানে জাবর কাটলে মুখেরও এক্সারসাইজ হয়।
-- ঠিক আছে দেন একটা।
নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে লোকটির কাছ থেকে একটা পান নেই। লোকটি পানের বাটা থেকে কয়েক জাতের মশলাপাতি লাগিয়ে চায়ের মতো আয়েশ করে পানটি মুখে পুরলেন। ডান হাতের সবচেয়ে লম্বা আঙুলে চুন লাগিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চুকচুক করে চুষতে লাগলেন।
-- আপনার মনে হতে পারে আমি বেঁটে, মোটেও হ্যান্ডসাম না। একটু ফর্সায় গেলে বুঝতেন এই বয়সেও আমার চেহারাটি কত উজ্জল। ইয়াং বয়সে তো এলাকার মেয়েদের ক্রাশ ছিলাম।
-- আপনি এখনো যথেষ্ট হ্যান্ডসাম।
-- জানি, আপনি আমাকে খুশি করার জন্য কথাগুলো বলছেন।
-- তিন সত্যি। সিগারেট নেবেন?
লোকটি আমাকে পান খাওয়ালো তাই তাকে সিগারেটের অফারটি করলাম। যাতে তিনি আমাকে এক্কেবারে বেরসিক না ভাবেন। তাছাড়া সিগারেট ছাড়া অফার করার মতো আর কিছুই আমার কাছে নেই।
-- না, সিগারেট লাগবে না। তিন বছর আগেও চেইন স্মোকার ছিলাম। এখন এ্যাজমার প্রবলেম আছে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ। আচ্ছা, আমার যে এ্যাজমা তা কি একটি বারও আপনার মনে হয়েছে?
-- না হয়নি।
আমি উত্তরগুলো যত দ্রুত পারি সংক্ষেপে দেওয়ার চেষ্টা করছি যাতে লোকটি টকটকানি থামায়।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে লোকটি জানাল আজ ট্রেন আসবে না। কুমিল্লার কাছে রেলের একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় আজ রাতের উদয়ন এক্সপ্রেস এবং কালকে সকালের পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের ট্রেন বন্ধ থাকবে।
-- আপনাকে কে বল্ল?
-- অফিসের দরজায় হাতে লেখা একটি বিজ্ঞপ্তি লাগিয়ে স্টেশন মাস্টার চলে গেছে।
-- চলে গেছে মানে? এতোগুলো মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। একটিবার বলারও প্রয়োজন মনে করলো না?
-- স্টেশনে এখন আমি আর আপনি ছাড়া কোন যাত্রী নেই। সবাই যার যার মতো চলে গেছে। আমি একা আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছি।
আমি মোবাইলে টাইম দেখে চমকে উঠি। সময় একটা বেজে তের মিনিট। চারপাশে আর কোন যাত্রী নেই। মুরগী ওয়ালা লোকটি কখন যে বাড়ি ফেরৎ গেছে খেয়াল নেই। অষ্টাদশী কখন কাঙ্খিত ক্লায়েন্ট জুটিয়ে কেটে পড়েছে দেখিনি। দেখলাম ফাইট করা বাচ্ছাগুলো একসাথে জড়ো হয়ে ভাঙা একটি ঘরের মেঝেতে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে কুত্তাগুলো লেজ নাড়িয়ে শান্ত মনে প্লাটফর্ম পাহারায় ব্যস্ত।
-- আপনি বাড়ি যাবেন না?
-- কি করবো বুঝতে পারছি না। আপনি কোথায় যাবেন?
-- আমি কুমিল্লা যাওয়ার জন্য ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন ভাবছি বাড়ি চলে যাব।
-- কোথায় বাড়ি আপনার?
-- হাকালুকি হাওরের ওপারে জিনাতপুর গ্রামে।
-- জিনাতপুর? জিনাতপুর হলে তো চেনার কথা।
-- আপনার বাড়ি কি জিনাতপুর?
-- হ্যা। কিন্তু আপনি........?
-- জিনাতপুরে আমার মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। বলতে পারেন আমার বিয়াইর বাড়ি। তবে দেড়শো বছর আগে আমাদের পূর্ব পূরুষরা এ গ্রামে বসবাস করতেন। আমার জন্ম কুমিল্লায়।
-- ভালই হলো আপনার সঙ্গ পেয়ে। না হলে সারা রাত বসে থাকতে হতো। রাতের বেলা হাকালুকি হাওর কখনো পাড়ি দেইনি আমি। ভয় করে। এখন রওয়ানা দিলে কম করে হলেও বাড়ি পৌছিতে তিনঘন্টা লাগবে।
-- আমি কতবার যে একা একা হাকালুকি পাড়ি দিয়েছি তার কোন হিসাব নেই। চলুন রওয়ানা দেওয়া যাক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।
-- আপনার নামটিতো জানা হলো না?
-- আমি হাজি নেয়ামত হোসেন। আপনি?
-- পারভেজ আহমেদ।
স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু অপেক্ষা করলাম সিএনজি, টমটম বা রিক্সার আশায়। যাতে যতটুকু পারা যায় হাকালুকির কাছাকাছি যাওয়ার। শীতের রাত তার উপর এখন ঘন কুয়াশাও পড়েছে। সামান্য দূরত্বেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোন যানবাহনের অস্থিত্ব চোখে পড়লো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
-- কি হলো ইয়াংম্যান?
-- ভাবছি এতো দূরের পথ, নিশি রাতে কেমনে যাব? তাছাড়া আমি ইয়াংম্যান না। বয়স তেপ্পান্ন শেষ হয়ে চুয়ান্নতে পড়েছে।
-- কি যে বলেন? আপনি কম করে হলেও আমার চেয়ে বিশ বছরে ছোট হবেন। হাঁটার পথে শুধু আমাকে ফলো করবেন। বুড়ো মানুষদের সামনের কাতারে জোরে জোরে হাঁটতে দেখলে ইয়াংরা উৎসাহ পায়।
মনের দিক থেকে ইয়াংম্যান নেয়ামত হোসেন সামনে আর আমি পেছনের সারিতে। ছুটছি তো ছুটছিই। ভাগ্যিস উনার ড্রেসআপ আপাদমস্তক সাদা। কালো বা লাল হলে নির্ঘাত দেখতে পেতাম না। উনি এত দ্রুত হাটছেন যে উনার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমি হাফিয়ে উঠলাম। মাঝে মাঝে আরো জোরে হাটতে সামনে থেকে তিনি উৎসাহ দিচ্ছেন। আমি যত দ্রুত হাঁটি মনে হয় তিনি তত বেশি সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন।
-- বাড়িতে কেন এসেছিলেন?
-- আমি প্রতি তিন মাস পর পর জিনাতপুরে যাই। দেশের যেখানেই পোস্টিং হোক না কেন নিজের জন্ম ভিটার টানটা আলাদা। আমার স্ত্রী অবশ্য বছরে একবার আসেন ছেলেমেয়ে সহ। বর্ষার সময়ে। তখন পাল তোলা নৌকা দিয়ে আরামসে হাকালুকি সাগর পাড়ি দেওয়া যায়।
-- হাকালুকি সাগর!
-- বর্ষার সময়ে হাওরের এক পাশ থেকে আরেক পাশ দেখা যায় না শুধু অথৈ পানি আর পানি। মাঝে মাঝে সাদা বকের মতো পাল তোলা নৌকা দেখা যায়। এছাড়া জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য আর নাম না জানা হাজারো পাখির কিচির মিচির তো আছেই। তবে শীতের সময় অতিথি পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেঁড়ে যায়। এজন্য বর্ষার সময়ে স্থানীয় মানুষ হাওরটিকে সাগর বলে।
-- ওহ!
-- এতক্ষণ থেকে হাঁটছি আপনার টায়ার্ড লাগে না?
-- লাগবে না কেন? তবে সব সময় দূরের পথ যাত্রায় মনোবল চাঙা রাখতে হয়। অল্পতে হাঁফিয়ে উঠলে দূরত্ব পাড়ি দেওয়া যায় না। আচ্ছা, বল্লেন না এবার বাড়িতে কেন এসেছিলেন?
-- আমার দাদার হাতে গড়া একটি হাইস্কুল আছে আমাদের গ্রামে। ১৯৪৩ সালে তিনি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছর স্কুলটি কলেজের অনুমোদন পেয়েছে। এজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছিল। সে সময় অত্র এলাকার বিশ-বাইশটি গ্রামে কোন হাইস্কুল ছিলনা। দাদা মারা যাওয়ার আগে তাঁর পুরো সম্পত্তি স্কুলের নামে উইল করে গেছেন। শুধু বসত ভীটা ছাড়া। বাবাও সরকারী চাকরি করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি স্কুলটি দেখাশুনা করে রাখি।
-- এখন তো স্কুলটি নিবন্ধীত।
-- তা ঠিক। তবে আমাদের ভাটি এলাকাটি এখনো দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পিছিয়ে আছে। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী দরিদ্র। আমি প্রতি বছর বেতন থেকে একটু একটু সঞ্চয় করে বছরের শুরুতে অতি দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের মাঝে খাতা-কলম বিতরণ করি। যাদের স্কুল ড্রেস কেনার সামর্থ্য নেই তাদেরকেও সহযোগিতা করি। আমার আত্মীয়-স্বজন, এলাকার স্বচ্ছল মানুষও সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আমার ছোট ভাই প্রতি বছর অস্ট্রিয়া থেকে এক লক্ষ টাকা স্কুলের জন্য অনুদান দেয়।
আমরা ততক্ষণে পাকা রাস্তা পার হয়ে মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে হাকালুকি হাওরে প্রবেশ করেছি। ঘড়িতে দুইটা বেজে চৌত্রিশ মিনিট। ঘুটঘুটে অন্ধকার গা ছম ছম করছে আমার। এতো বড় হাওর রাতের বেলা পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহস এই প্রথম।
-- পারভেজ সাহেব?
-- জি।
-- আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
-- ভয় পাব কেন?
সত্যি কথা হলো এখন আমার খুব বেশি ভূতের ভয় করছে। ছোটবেলা বাবার কাছ থেকে কত যে ভূতের গল্প শুনেছি তার কোন হিসাব নেই। বেশিরভাগ ঘটনায় বাবা সরাসরি জীন-পরীদের মোকাবেলা করেছন। কোন কোন রাতে দেখতেন শত শত শিয়াল, বাদুড় আর কাক তাঁর পথ আটকে আছে। দুই চার হাত দূরত্বে হঠাৎ দেখতেন আগুনের ফুলকি ধপ করে জ্বলে উঠে দৌড় দিচ্ছে। কখনো কখনো নির্জনে নিশিতে স্পষ্টভাবে হাওরের মাঝামাঝি যুবতী মেয়েদের কান্নার আওয়াজ শুনা যেত। ছোটবেলা বাবার বলা এসব কাহিনী শুনতে খুব ভয় পেতাম। তবুও আরো বেশি করে শুনতে চাইতাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, বাবা মহিলা ভূত কেন কাঁদতো? তাঁর কি স্বামী মারা গেছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা কিছুই বলতেন না। শুধুই হাঁসতেন।
-- চুপটি মেরে আছেন কেন?
আমার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে হাক দিলেন নেয়ামত সাহেব। আমি যে ভূতের ভয় পাচ্ছি তা উনাকে বলা যাবে না। যতই চেষ্টা করছি ভূত-প্রেত ভুলে শুধু হাঁটতে মনযোগী হতে ততো বেশি ভূত মাথায় চাপছে। গলাটা একটু খাকিয়ে বল্লাম, একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় না?
-- হ্যা বিশ্রাম তো নেওয়াই যায়। আমরা এখন হাওরের প্রায় মাঝামাঝি আছি। আসেন বসি কোথাও।
হাসি মাখা মুখে আমার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিতে খেয়াল করলাম উনি একটুও টায়ার্ড হননি। শরীর থেকে দামী আতরের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। তবে এবার বিনা বাক্যে উনার দেওয়া চা-টা নিলাম।
-- রাত্রি নিশিতে বিশাল হাওরের মাঝখানে চা খাওয়ার মজাটাই আলাদা। কি বলেন?
-- এটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। খারাপ না।
-- আমাকে এজন্য আপনার ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ।
-- অবশ্যই।
চারদিকে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। এই শীতেও জোনাকির আলো মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হচ্ছে। ঘন কুয়াশা থাকায় আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তবে দূরে একপাল খেক শিয়ালের হুক্কা-হুয়া আওয়াজ কানে ভাসছে। ততক্ষণে নেয়ামত সাহেব চা শেষ করে পানের খিলি বানাচ্ছেন। আমাকেও একটি দিলেন।
-- চলুন এখন রওয়ানা দেওয়া যাক।
-- হ্যা, চলুন।
আগের মতোই সামনে তিনি, পেছনে আমি।
-- আপনার দাদা চাইলে তো স্কুলটি উনার নামে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তিনি কেন তা করেননি?
-- বিষয়টি আমাকেও ভাবায়। বাবার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, দাদা নাকি বলেছেন কোন দান নিঃস্বার্থ না হলে তা প্রকৃত দান হয়না। উনার নামে স্কুলটির নামকরণ হলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কেউ স্কুলটির মালিকানা দাবি করতে পারে। এছাড়া নিজের নামে স্কুলের নামকরণ হলে দাদার মধ্যে অহংকারি মনোভাব চলে আসতে পারে তাই এলাকার সব মানুষের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি স্কুলের নাম দিয়েছিলেন "জিনাত পুর আদর্শ হাইস্কুল"।
-- সিদ্ধান্তটি কি সঠিক ছিল?
-- অবশ্যই। আজকালকার দিনে এমন মানুষ পাওয়া সত্যি বিরল। এখন তো সবাই কিছু না করে সব কৃতিত্ব নিতে চায়। আসলে আমি খুব দূর্ভাগা মানুষ। এতো গুণী মানুষটির নাতি হয়েও দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার।
-- কেন?
-- আমার বাবা ছোট থাকতেই দাদা মারা যান। বাবার একটু একটু মনে ছিল। একটা ছবি থাকলেও দেখতে পেতাম। বাবার কাছ থেকে দাদার অনেক গল্প শুনেছি। ভাবছি সামনের বছর থেকে দাদার নামে একটি বৃত্তি চালু করবো।
-- দাদার প্রতি তো দেখি আপনার অনেক ভালবাসা।
-- হবে না কেন? এমন গুণী দাদু কয়জনের ভাগ্যে জুটে বলুন।
-- আমরা কিন্তু চলে এসেছি। এই সামনে যে বাড়িটা দেখছেন এটা আমার মেয়ের বাড়ি। তবে আপনার চিন্তা নেই রাতে এখানে বিশ্রাম নিয়ে সকালে যাবেন। তাছাড়া বাড়িতে তো আপনার কেউ থাকে না।
-- না না, সমস্যা নেই। আমার সাথে বাড়ির চাবি আছে।
-- আমি রওয়ানা হওয়ার আগেই মেয়েকে বলে দিয়েছি। আমার সাথে একজন মেহমান আসবেন। এত রাতে আপনাকে ছাড়বো না।
উনার অনুরোধ ফেলতে না পেরে পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকলাম। সত্যি সত্যি উনার মেয়ে বাবার জন্য গরম পানি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। আমাকে দেখে কিছুটা ইতস্ত ভাব হলেও কুশল বিনিময় করলেন। জোর করে রাতের খাবার খাওয়ালেন। তবে ঘরে বাড়তি কোন মানুষের সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। হয়তো বাকি সবাই ঘুমিয়ে আছে মনে মনে ভাবলাম আমি। আমাকে ঘরের আলাদা একটা রুমে পরিপাটি বিছানা করে দেওয়া হয়েছে। নেয়ামত সাহেব শুভ রাত্রি বলে বাতি নিভিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কামরায় শুয়ে পড়লেন। তখন ভোর পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি।
সকালে বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কিচির মিচির শব্দে যখন ঘুম ভাঙলো তখন সকাল আটটা বেঁজে পনেরো মিনিট। শরীরটা ব্যথায় ম্যাজ ম্যাজ করছে। এ কোথায় শুয়ে আছি আমি! এটা তো আমাদের বাড়ির পরিত্যক্ত একটি ঘর। দাদার বানানো ঘরটিতে এখন আর কেউ থাকে না। সবাই নতুন ঘরে থাকে। তবে দাদার স্মৃতি রক্ষার্থে ঘরটি ভাঙা হয়নি। আমি এঘরে কেমনে আসলাম? মনে পড়লো গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘঠনাগুলো। এসব কি স্বপ্নে দেখেছি আমি? ব্যাগ হাতড়িয়ে ট্রেনের টিকেট বের করে মোবাইলের তারিখের সাথে টিকেটের তারিখ মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম গত রাতের উদয়নের টিকেট এটি। গত কাল সন্ধায় মাইজগাঁও স্টেশনে যাওয়া, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা, না পেয়ে হাকালুকি হাওর পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা সবই ঠিক আছে। তাহলে সারা পথ আমাকে সঙ্গ দেওয়া লোকটি কোথায়? কে এই নেয়ামত হোসেন!!
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
উৎসর্গ: গল্পটি আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন শ্রদ্ধেয় ব্লগার 'নূর মোহাম্মদ নূরু' সাহেবকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৯