লন্ডন ওয়েস্ট এন্ডে (সেন্ট্রাল লন্ডন) বাংলাদেশী খাবারের দোকান নেই বল্লেই চলে, হাতে গোনা যে দুই-চারটি রেস্টুরেন্ট আছে সেগুলো আমার মত সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। এমনিতেই ইংল্যান্ডে বাংলাদেশী রেস্তোরাগুলো খুব ব্যয়বহুল, সেন্ট্রাল লন্ডনে (সিটিতে) দাম তুলনামূলক ভাবে আরো বেশি। আমরা বাংলাদেশী যারা সারা রাত সেখানে কাজ করতাম সবাই যার যার মত করে কাজের ফাঁকে ম্যাকডুনাল্ড (McDonalds), কেএফসির (KFC) মত খাবার খেতাম। কারণ এগুলো তুলনামূলক সস্তা ও সহজলভ্য। তবে মাঝে মাঝে বাংলাদেশী একটি ছেলে কন্টেইনারে ভরে খাবার নিয়ে আসত বিক্রির জন্য। আমরা অনেকেই তার কাছে থেকে খাবার কিনে খেতাম।
একদিন দেখলাম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক কনটেইনার ভরে খাবার নিয়ে এসেছেন বিক্রির জন্য। বয়স আনুমানিক পয়ষট্টি-সত্তর হবে। হাল্কা-পাতলা রোগা চেহারা। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ১৭ বছর থেকে লন্ডনে আছেন কিন্তু লিগ্যাল (বৈধ নাগরিক) হতে পারেন নাই। দিনের বেলা একটি অফ লাইসেন্স (Off Liscence) শপে কাজ করেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় খুবই অল্প বেতনে মালিক তাকে খাটায়, সাহস করে বেতন বাড়ানোর কথা বলেন না। যদি চাকরি চলে যায় এই ভয়ে! ইংল্যান্ডে ভারত ও বাংলাদেশী মালিকরা এই সুযোগটা নেয়। কারণ অবৈধ কাউকে চাকরি দেওয়া সে দেশের আইনে দন্ডনীয় অপরাধ। কথা প্রসঙ্গে বল্লেন, দেশে উনার এক ছেলে দুই মেয়ে। ছোট মেয়েটির জন্ম তার প্রবাসে আসার পর। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ১৭ বছর থেকে দেশে যেতে পারেন নাই। তাই সরাসরি ছোট মেয়েটিকে দেখার সুযোগ হয়নি। এখন ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। ছেলেটি ইন্টার পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছে।
বড় মেয়েটি সিলেট ওসমানী মেডিকলে এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। লক্ষ্য করলাম, বড় মেয়ের ডাক্তারী পড়ার কথা বলার সময় খুশিতে ভদ্রলোকের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঠিক যেমন শীতের সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুর উপর সূর্যের আলো পড়ার পর চিকচিক করে। বল্লেন জান বাবা, এই মেয়েটাই আমার সব, আমার আশার আলো। মেয়েটা ডাক্তারি পাশ করলে দেশে চলে যাব। অনেক চেষ্টা করলাম, হয়ত আর লিগ্যাল হতে পারবো না। দেশে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। দোকানে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে থাকা খাওয়ার পর তেমন কিছু থাকে না। তাই বাসায় ফিরে রান্না করে খাবার নিয়ে এখানে আসি বাড়তি সামান্য আয়ের আশায়।
মাঝে মাঝে সরকারি ফুড ইন্সপেক্টররা ওয়েস্ট এন্ডে আসে রাস্তায় কোন খাবার বিক্রি হয় কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে। কারণ, অনুমোদন ছাড়া সে দেশে সব ধরনের খাবার বিক্রি করা দন্ডনীয় অপরাধ। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হয়। চাচা ও সতর্ক ছিলেন। কিন্তু একদিন দেখলাম যে ব্যাগটিতে উনার খাবারগুলো রাখা ছিল সে ব্যাগটি ফুড ইন্সপেক্টররা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। তবে খাবারগুলো কার তা শনাক্ত করতে পারেনি। কারণ টের পেয়ে চাচা সরে পড়েছিলেন। এদিনের তার লজ্জিত ও অপমানিত চেহারা আজো আমাকে পীড়া দেয়। সেদিনের পর উনাকে আর ওয়েস্ট এন্ডে দেখিনি।
বিলেতে যাওয়ার আগে লন্ডনের চাকচিক্য, উন্নত জীবন যাপন, উচু উচু অট্টালিক, পাউন্ড স্টার্লিং, টাওয়ার ব্রীজ আর লন্ডন আইয়ের ছবি সবার মনে ভাসে। যারা যেতে পারেন না তাদের অনেক আফসুস না দেখার। কিন্তু যাওয়ার পর ধীরে ধীরে রং ফ্যাকাশে হতে থাকে, স্বপ্নগুলোতে মরিচা ধরে। মনে হয় এটি আমার দেশ নয়, নিজেকে আবেগ অনুভূতিহীন একজন যাযাবর মনে হয়। যার কোন দেশ নেই, পরিচয় নেই। অনেক স্বপ্ন নিয়ে মানুষ উন্নত জীবনযাপনের আশায় লন্ডনে যায়। কিন্তু কয়জনই বা পায় সেই আলাদীনের চেরাগ?
যারা স্টুডেন্ট ভিসায় ইংল্যান্ডে আসেন তারা নিজের থাকা খাওয়ার খরছ যোগিয়ে টিউশন ফির টাকাও আয় করতে হয়। মাঝে মাঝে দেশে ফ্যামেলিতে টাকা পাঠাতে হয়। সেদেশের সরকার আইন করে বিদেশি ছাত্রদের সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজের অনুমতি দিয়েছে। তবে যারা কলেজে পড়ে তাদের কাজের অনুমতি নেই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে ২০ ঘন্টা কাজের অনুমতি মিলে। এই টাকা দিয়ে নিজের থাকা খাওয়ার খরছ উঠে না। তাই বাধ্য হয়ে ছাত্ররা অবৈধভাবে কম পারিশ্রমিকে বেশি কাজ করতে হয়। অনেক মেয়ে বাধ্য হয়ে সর্টকাট পথ বেছে নেয়। দেশে অনেকের পরিবার তার হাতের দিকে চেয়ে থাকে। তাই নিজে না খেয়ে, না পরে দেশে টাকা পাঠাতে হয়। কখনো দেশের আপনজনকে মুখ খুলে বলতে পারে না সে কেমন আছে। নিজের কষ্টের ভাগ বাবা-মা, ভাই-বোনকে দিয়ে তাদের কষ্ট বাড়াতে চায় না সে। পরিবারের যেকোন দুঃসংবাদে ভেঙ্গে পড়ে। শত কষ্টের মাঝে পরিবারের ভাল থাকাটাই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন।
এরা দেশের যেকোন খারাপ সংবাদ শুনলে কষ্ট পায়। প্রবাসীদের কাছে পুরো দেশটাই তো তার পরিবার। যখন দেশের কোন ভাল সংবাদ শুনে সবাইকে শেয়ার করে জানাতে মন চায়। যখন শুনে তার রক্ত ঝরা রেমিটেন্স দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয় তখন নিজের সন্তান হারানোর মতো কষ্ট পায়। কিন্তু তার কষ্ট, তার আকুতি কেউ দেখে না। সে একজন সাধারণ কামলা মাত্র। দেশের স্যুট টাই পরা ভদ্রলোকরা তাদের কষ্টের রেমিটেন্স লোপাট করেন, বিদেশ পাচার করে। এসব মহামান্য স্যারদের বিরুদ্ধে কামলাদের কথা বলা মানায় না, এটা তো বেয়াদবির শামিল!!
ইউকে বর্ডার এজেন্সি (UK Border Agency) যখন কোন অবৈধ ইমিগ্রেন্ট ধরতে রেইড দেয়, তখন এমনভাব করে দেখে মনে হবে খুনের পলাতক আসামী ধরতে এসেছে। আর যদি কাউকে পেয়ে যায় মনে হবে জংলী হায়েনা অনেক দিন পর কাঁচা মাংসের স্বাদ পেয়েছে। এদের আচরণ খুব হিংস্র ও উদ্যতপূর্ণ হয়। অনেকের আবার ইংল্যান্ডে থাকার অনুমতি আছে কিন্তু কাজের কোন অনুমতি নেই, তাই তাদেরকেও এরা ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেয়। একদিন নর্থ লন্ডনে এক মামার রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। তিনি সেখানকার ম্যানেজার। বল্লেন, গতককাল আমাদের একজন ওয়েটারকে বর্ডার এজেন্সি ধরে নিয়ে গেছে। তার অপরাধ ভিসা আছে কিন্তু কাজের কোন অনুমতি নেই!! তাই অনুমতি না থাকার মহা অপরাধে নিয়ে গেল। তিনি জানালেন ছেলেটি খুব মেধাবী, জানি না কী দূর্গতি তার কপালে আছে। সে একটি ভাল কলেজে পড়ে। দেশে পরিবারকেও মাঝে মাঝে সাপোর্ট দিতে হয় তার।
বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশী নাগরিক ও স্টুডেন্টদের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপল, অলগেট, কমার্শিয়াল রোড, বেথনাল গ্রীন ও ব্রিকলেনে অসংখ্য ল'ফার্ম আছে। ব্রিটেনে এসব ল'ফার্মের আইনজীবিদের 'সলিসিটর' বলা হয়। টাকার বিনিময়ে এরা এমন কোন অপকর্ম নেই যা করতে পারে না। সময় সুযোগে এরা অসহায় বাংলাদেশী অবৈধ নাগরিক ও বিপদগ্রস্ত ছাত্রদের কাছ থেকে কৌশলে হাজার হাজার পাউন্ড হাতিয়ে নেয়। এদের বেশিরভাগেরই ব্রিটেনে আইন পেশার কোন সনদ নেই। এজন্য বাংলাদেশীরাই হচ্ছে একমাত্র টার্গেট। অনেকে এদেরকে 'সলি-চিটার' অথবা 'দালাল' বলে থাকেন।
ইমিগ্রেশন নিয়ে আমারও অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। একদিনের জন্য অবৈধ না হয়েও অনেক হয়রানির শিকার হয়েছি। চলার পথে, কাজের সময় কতবার যে আমার আইডি চেক করেছে তার কোন হিসাব নেই। একদিন তো শত শত মানুষের সামনে আমাকে দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে জেরা করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। অপরাপ হলো আমার চামড়া সাদা নয়। একদিন তো ধরে থানায় নিয়ে গেল। নেওয়ার পর কত কিছু করলো!! নিজেকে আমাজনের একজন খাঁটি জংলী মনে হলো তখন। ঊনিশ ঘন্টা পর ছেড়ে দেওয়ার পর জাস্ট 'সরি' বল্ল। তবে বলে দিল তাদের এ ভুলের জন্য চাইলে মামলা করতে পারবো!! আর এয়ারপোর্টে হয়রানির কথা কী আর বলবো। শত শত সাদা চামড়ার লোকজন অনায়াসে ইমিগ্রেশন পার হলেও আমাদের চেহারা দেখলেই তাদের হুশ থাকে না। কত শত প্রশ্ন আর পাণ্ডিত্য!! দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এসব ইমিগ্রেশন অফিসারদের মধ্যে বাংলাদেশী ও দক্ষিণ এশিয়ান বংশধর বৃটিশরাই বেশি আমাদের টর্চার করে।
অথচ তাদের দেশের নাগরিক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের কাজের অনুমতি থাকার পরও অনেকে লুকিয়ে সরকারকে না জানিয়ে কাজ করে। কারণ সরকার জানলে তারা ফ্যামেলি বেনিফিট কম পাবে, ঘর ভাড়া দিতে হবে তাই। অনেকে আবার টাকার জন্য নিজের বেডরুম ভাড়া দিয়ে বসার ঘরে সোফায় ঘুমান। এটা তাদের আইনে দন্ডনীয় অপরাধ হলেও সরকারের লোকজনের খুব দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ে না। সব দোষ আমাদের নিরীহ ছাত্র/অবৈধ বাংলাদেশীদের, যারা শুধুমাত্র জীবিকার স্বার্থে কাজ করে বাঁচার চেষ্টা করেন মাত্র।
প্রতি বছর শত শত বাংলাদেশী ছেলে-মেয়ে ইংল্যান্ড থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাড়ি জমায় নাগরিকত্ব ও ভাল কাজের আশায়। ইউকেতে বৈধভাবে কাজ করে যেখানে নিজের থাকা খাওয়ার পয়সা উপার্জন করা যায় না, সেখানে ইউনিভার্সিটির খরছ যোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেক ছাত্র/ছাত্রী ৭-৮ বছর ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করেও কুলাতে না পেরে ইউরোপে পাড়ি দিতে দেখেছি। দেশে ফিরতে অনেকেই ভয় পান। যতই কষ্ট হোক অজানা আশংকায় দেশমুখী হন না।
ইংল্যান্ড আজব এক দেশ। যেখানে সারা পৃথিবীর বিখ্যাত দুর্নীতিবাজ, ড্রাগ ডিলার, চোরাকারবারি ও খুনের সাজাপ্রাপ্তরা সহজে টাকার জোরে ব্রিটেনে বৈধভাবে থাকার অনুমতি পায়। অথচ যারা দীর্ঘদিন সেদেশে থেকে পড়াশুনা করলো, ট্যাক্স পরিশোধ করলো, সে দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলো, যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের প্রমাণ নেই, তাদের নাগরিকত্ব দিতে যত আপত্তি। নিজ দেশে খুনের অপরাধী ও বিভিন্ন মামলা আছে প্রমাণ করতে পারলে সিটিজেন হতে সহজ হয়! এছাড়া ধর্মহীন ও গে সমাজের মানুষদের জন্যও বৈধ হওয়া অনেকটা সহজ। আপনি নিরেট ভদ্রলোক হলে নাগরিক হওয়ার চান্স সীমিত।
ইতালী, ফ্রান্স,স্পেন, পর্তুগাল, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড ও জার্মানী বাংলাদেশীদের ইংল্যান্ডের তুলনায় মানুষ হিসবে অনেক বেশি মর্যাদা দেয়। অল্পদিনে নাগরিকত্ব দেয়। ব্রিটিশরা দুইশো বছরের বেশি আমাদের দেশ শাসন করলেও এখন বিলকুল ভুলে গেছে। তারা যতই আমাদের কমনওয়েলথভূক্ত দেশ বলে বুলি আওড়াক না কেন বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন নাই। আর মানবাধিকার বলে এরা শুধু গরীব দেশগুলোতে খবরদারী করে। "এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল" বৃটেনে পয়দা হলেও সেখানে তাদের কোন কার্যক্রম/গর্জন তেমন একটা দেখা যায় না। আর বাংলাদেশ হাই কমিশন!! দাওয়াত খাওয়া, ফিতা কাঁটা আর জন্মদিনে কেক খাওয়া ছাড়া বৃটেনে এদের দৃশ্যমান কোন কাজ কখনো চোখে পড়ে না।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩০