আমার ছোটবেলার খুব ঘনিষ্ট এক বন্ধু তিন বছর আগে একটি ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছে, তার সাথে দেখা হলে শুধু ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে, পড়ালেখার বিষয়াদি নিয়ে কথা বলে; ভেতরে ভেতরে খুব উদ্বিঘ্ন দেখায় তাকে। সে একটি কলেজের প্রভাষক, তার স্ত্রী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। যদিও ছেলেটির স্কুলে ভর্তির বয়স এখনো দুই-তিন বছর বাকি! বড় হলে ছেলেকে কোথায় ভর্তি করবে; স্কুলে না মাদ্রাসায়? মাদ্রাসায় হলে কওমি না আলিয়ায়? স্কুলে হলে বাংলা না ইংলিশ মিডিয়ামে? বাংলায় হলে সরকারী প্রাইমারিতে না প্রাইভেট স্কুলে? ইংলিশ মিডিয়াম হলে বৃটিশ কারিকুলাম না বাংলাদেশী সিলেবাসে ইংলিশ মিডিয়ামে? নাকি ক্যাডেট কলেজে? আরো কত কী সিস্টেম এ বঙ্গে আছে!
আসলে প্রশ্নগুলো কোন একজন অভিবাবকের নয়, এটা পুরো দেশেরই সাম্যক চিত্র। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক গাইডলাইন না থাকায় দেশের অভিবাবকরা কমিবেশি এমন সমস্যার মোকাবেলা করছেন; ভয় পাচ্ছেন বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রতিনিয়ত। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার সঠিক মাধ্যম কোনটি তা নিয়ে সন্দিহান সবাই।
বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে, তা বহু বছর আগে। এজন্য সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে কোন ছেলে-মেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের উদাসীনতা এবং সরকারি স্কুলগুলোর নিম্নমান ও অপ্রতুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য কিন্ডার গার্ডেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা। কোন কোন স্কুলে তো এসব শিশুদের রীতিমত ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে, লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও শিশুদের জন্য সমমান ও একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আজও আমরা চালু করতে পারলাম না।
এজন্য ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের মনে মানুষের শ্রেণী বৈষম্যের বিষ রোপিত হয়। যারা দামী স্কুলে পড়ে তাদের কাছে কমদামী স্কুলের বাচ্চাদের 'ছোটলোক' মনে হয়। যারা দামী গাড়ি নিয়ে স্কুলে যায় তাদের কাছে হেঁটে আসা সহপাঠীকে 'কামলা শ্রেণীর' মনে হয়। তবে এ শ্রেণী বৈষম্যটা শুরু হয় পরিবার থেকে। বাচ্চাটি ঘরের কাজের মেয়েটার সাথে বাবা-মায়ের ইতরামী দেখে এই মেয়েটিকে মানুষ নয় 'ভিন্ন প্রজাতির' ভাবতে শেখে। নিজেও পিচ্চি বয়স থেকে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় মেয়েটিকে গালি দেয়, তুই-তুকারী করে। এখানেই 'অমানুষ' হওয়ার প্রাথমিক শিক্ষাটা হাতে কলমে পায় সে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এগুলো ডালপালা মেলে বিশাল আকার ধারণ করে।
এখন কিন্ডার গার্ডেন স্কুল বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেখান থাকার কথা ছিল সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ সেখানে হচ্ছে ব্যবসা। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে এমন নির্লজ্জ ব্যবসা নেই। সেবা খাতগুলো যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তা লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসা ও গণ পরিবহন তার নিষ্টুর উদাহরণ।
প্রাইমারি লেভেলের একটি বাচ্চাকে চৌদ্দ পনেরটি বই নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। তার সাথে খাতা-কলমসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র তো আছেই। এজন্য অনেক সময় বইয়ের ব্যাগ বহন করার জন্য বাবা-মা অথবা অন্য কেউ বাচ্চাটির সাথে যেতে হয়। অথচ শিশু শিক্ষা হওয়ার কথা ছিল আনন্দের। সে হেসে খেলে পড়াশুনা করবে, যাতে তার মনে শিক্ষাভীতি না আসে। ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি শিশুরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় না, তার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো স্কুলে থাকে। তার পড়াশুনার পাঠ স্কুলেই শুরু, স্কুলেই শেষ। নেই হোমওয়ার্কের বাড়তি ঝামেলা। এজন্য মনের আনন্দে শিশুরা স্কুলে যায়।
আর আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। যত দামী স্কুল তত বেশী বই-খাতা ও হোমওয়ার্ক। এটা কেমন শিক্ষা ব্যাবস্থা? একটি বাচ্চার ওজনের চেয়ে বইয়ের ব্যাগের ওজন বেশি হবে কেন? তাহলে শিক্ষা কি শিশুদের জন্য বোঝা? যে বয়সে আনন্দের সাথে বাচ্চারা শিক্ষা অর্জন কারার কথা সে বয়সে আমরা শিশুদের মনে শিক্ষা ভীতি তৈরি করছি। শিক্ষা কী? তা বুঝে উঠার আগেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিচ্ছি, তোতা পাখির মত মুখস্থ করাচ্ছি, ভয় দেখিয়ে দিচ্ছি। আর উপরি উপদ্রব হিসেবে আছে বিভিন্ন সিস্টেমের গৃহশিক্ষকের ব্যাবস্থা।
সেকেন্ডারী শিক্ষা ব্যাবস্থা তো আরো ভয়াবহ। প্রতিদিন স্কুলগুলোতে ৬-৮ টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়, গড়ে একেকটি বিষয় ৩০-৩৫ মিনিট করে পড়ানো হয়, এতে করে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। মফস্বলের কোন কোন ক্লাসে তো ২০০-২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে। একজন শিক্ষকের দ্বারা ইচ্ছা থাকলেও এত অল্প সময়ে বিপুল শিক্ষার্থীদের কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। আছে শিক্ষক স্বল্পতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের অপর্যাপ্ত বসার আসন । এছাড়া আছে কম দক্ষতাসম্পন্ন ও ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের ছড়াছড়ি।
কিছু অসাধু শিক্ষক বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর জন্য শ্রেণীকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান করে না। একটি ছাত্র যদি স্কুলে পড়ার পরও একই শিক্ষকের বাসায় সারা বছর প্রাইভেট পড়তে হয় তাহলে স্কুলের প্রয়োজন কেন? এমনও শোনা যায় স্কুলের শিক্ষকের বাসায় না পড়লে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা যায় না। আবার কোন কোন বেসরকারী স্কুল শিক্ষকদের এতো অল্প বেতন দেয়, তা শিক্ষকদের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে শেষ হয়ে যায়। এজন্য অনেক সময় বাধ্য হয়ে তারা প্রাইভেট কোচিং করান।
ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এত বিষয় পাঠ দান করা হয় সত্যি তা ভীতিকর। নবম শ্রেণীতে উঠলে তো আবার বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য কত যে শাখা প্রশাখা। আমাদের দেশের মুখস্ত নির্ভর শিক্ষা ব্যাবস্থা, যা আমাদের শিক্ষার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যেখানে হওয়ার কথা ছিল জ্ঞান অর্জন করা, গবেষনা করা, মূল্যবোধ সৃষ্টি করা; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা আজ পরীক্ষা ও চাকরি নির্ভর। যে দেশে লক্ষাধিক ছেলে মেয়ে এস এস সি পরীক্ষায় A+ পায়, সে দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা শুধু গলদপূর্ণই নয়, জাতির মেধা বিকাশের অন্তরায়ও বটে।
ছেলে মেয়েরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যদি স্কুলের পাঠ্যবই নিয়ে স্কুল আর শিক্ষকদের বাসায় বাসায় দৌড়ায় তাহলে তার সৃজনশীল মন মানষিকতা সৃষ্টি হবে কখন? সবাইকে বুঝতে হবে মানুষের জন্ম হয়নি শুধু পড়াশুনা করা জন্য। সরকার ও অভিবাবকদের দায়িত্ব ছাত্র/ছাত্রীদের প্রয়োজনীয় বিনোদন ও খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা; তাদের শারিরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যা অত্যাবশ্যক। সৃজনশীল মননের জন্য প্রয়োজন স্বাধীনভাবে চিন্তা শক্তিকে বিকশিত করার পর্যাপ্ত সময় ও পরিবেশ। কিন্তু পাগলাটে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্র ছাত্রীদের সৃজনশীল ও স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না। ছাত্র ছাত্রীদের পাশাপাশি বাবা মায়েরা সারা বছর ব্যস্থ থাকেন সন্তানদের পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের নেশায়। যত টাকা লাগুক এ+ যে পেতেই হবে।
আমার মনে আছে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় সারা রাত ল্যাণ্ঠন জালিয়ে গরুর রচনা মুখস্ত করেছি, অথচ জন্মের পর থেকে গরু দেখে দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু বইতে লেখক যেভাবে গরুর বর্ণনা করেছেন, ঠিক সেভাবে মুখস্ত করতাম। যদি বলা হতো আমি যেভাবে দেখেছি সেভাবে নিজের মতে করে গরুর রচনা লেখতে, তাহলে আমি ঠিকই পারতাম। কষ্ঠ করে মুখস্থ করতে হতো না। এতে আমার বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা হত, চিন্তাশক্তিও বাড়তো। জীবনে না বুঝে কত যে উপপাদ্য মুখস্থ করছি তার কোন হিসাব নেই। একটি গাইড বইয়ে লেখক তার মত করে বিষয়টি নিয়ে লেখেন। এজন্য তার বিশ্লেষণটা শিখতে হলে মুখস্থ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। গাইড বই পড়ে হয়ত এ+ পাওয়া যায়, কিন্তু কখনো মেধার বিকাশ হয় না।
আসলে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যাবস্থাই গলদপূর্ণ। এ কেমন শিক্ষা ব্যাবস্থা? আর এর উদ্দেশ্যই বা কী? শিশু-কিশোররা কৌতুহল প্রবণ। তাদের সেই কৌতুহল বিন্দুমাত্র না মিটিয়ে বিরক্তিকর মুখস্থ শিক্ষার বোঝা চাপিয়ে তাদের শেখার আগ্রহ অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়া হচ্ছে। এই রোবটিক শিক্ষা ব্যাবস্থার ফলে ছেলে মেয়েরা কোন বিষয়ে গভীরে যেতে পারছে না। একটা বা দুইটা বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বা ভালোবাসা তৈরী হচ্ছে না। এজন্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের ছেলে মেয়েরা অনেক বেশী পড়াশুনা করলেও তাদের মতো বড় মাপের সাইন্টিস্ট, দার্শনিক, প্রযুক্তিবিদ, ডাক্তার ইত্যাদি হতে পারে না।
ইংল্যান্ডে GCSE (General Certificate of Secondary Education) যেটি আমাদের SSC সম মানের, পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক ভাবে English, Mathematics ও science নিতে হয়। তার সাথে অপশনাল হিসাবে থাকে আরো ৪টি সাবজেক্ট। এটা ডিপেন্ড করে ছাত্র ছাত্রীদের পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটিতে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে চায় তার উপর। তবে চাইলে ৫টি বিষয় নিয়ে ও পরীক্ষা দেওয়া যায়। Advanced Level (A Level)-এ মাত্র চারটি বিষয় নিলেই হয়। সেখানে ছাত্র ছাত্রীদের পূর্ণ স্বাধীনতা (freedom of choice) থাকে এবং অপেক্ষাকৃত কম বিষয়ে পড়তে হয় বলে স্বাধীনভাবে চাপমুক্ত হয়ে আগ্রহ নিয়ে এর গভীরে গিয়ে চর্চা করার পর্যাপ্ত সময় পায়। তাদের কোন ছাত্রকে কোচিং করতে হয় না, সর্বোচ্চ ১০% ছেলে মেয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে, তবে আমাদের মত সারা বছরব্যাপী নয়। বড়জোর একমাস।
লন্ডনে কিছুদিন স্কুলে পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। ওদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাকে অবাক করেছে। ওরা কোন ছাত্রকে জোর করে পড়ায় না। ক্লাসে অন্যদের সাথে পেরে না উঠলে আলাদা করে কেয়ার করে। তারপরও না পারলে রেখে দেয়। শুধুমাত্র প্রকৃত মেধাবীদের এরা পুস করে আর ভাল করার জন্য। এ হার শতকরা ২৫-৩০%। কিন্তু কখনো এদেরে প্রেসার দেয় না। ছাত্ররা যাতে মনের আনন্দে পড়াশুনা করে তার ব্যবস্থা করে দেয়। এদের আলাদা কোচিং লাগে না, টিচারের বাসায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করা লাগে না। এমনকি বাসায় এসে সর্বোচ্চ ২-৩ ঘন্টা পড়াশুনা করে। গার্ডিয়ানদের কোন হেল্প লাগে না।
ওদের সিলেবাসটা আমাদের চেয়ে ছোট, বইয়ের সংখ্যাও অনেক কম। এরা এ+ এর ফ্যান্টাসিতে ভোগে না। স্কুল থেকে ছাত্রদের সহজাত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে। তাদের ইচ্ছার বিরূদ্ধে যায় না। এজন্য মেধাবীরা স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। এজন্য আমাদের ছাত্রদের তুলনায় এরা অনেক মেধাবী হয়। একেকটা ছাত্র একজন গবেষক হয়। কারণ ছোটবেলা থেকে বাচ্ছাদের এরা থিংকার বানায়, তোতাপাখি নয়।
আমরা জোর করে মেধাবী বানাতে চাই, আর ওরা মেধাবীদের চেনে গবেষক বানায়। এখানেই আমাদের সাথে তাদের পার্থক্য। তারা জানে মেধা হচ্ছে সহজাত। জোরাজুরিতে হয়ত পরীক্ষায় ফল আসে, কিন্তু দেশ ও জাতির কোন লাভ হয় না। ইউকেতে এখনো GCSE পাশের হার ৬০-৬৭%। গত ৫-৭ বছর আগেও ছিল ৪০-৪৫%।
আর সৃজনশীলতার নামে আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এই শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষাও নয়, আবার সৃজননশীলও নয়। আর কোচিং বাণিজ্য নিয়ে কী আর লেখবো। শিক্ষাকে ক্লাসরুমে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রচলন, প্রয়োজনীয় কিন্তু ছোট আকারের সিলেবাস তৈরী করা, চাকরি ও রিজাল্ট নির্ভর মেন্টালিটি পরিহার করে জ্ঞান নির্ভর ও গবেষনাধর্মী শিক্ষা ব্যাবস্থা শুরু করা। সর্বাপরি অভিবাবকদের সচেতন হওয়া, যাতে বাচ্চাদের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন বাদ দিয়ে কত ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে এবং কতজন শিক্ষক/কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে তা মুখ্য না হয়।
আসলে ভাল স্কুল, ভালো কলেজ বলতে কিছুই নেই। ভাল পড়াশুনা নির্ভর করে ছাত্র ছাত্রীদের মেধা, পরিশ্রম ও শিক্ষকদের সঠিক গাইড লাইনের উপর। কিন্তু আমাদের সমাজে ভাল স্কুল হচ্ছে; যে স্কুলগুলোতে ভর্তি ফি বেশি, ভর্তি হওয়া কঠিন, মাসিক টিউশন ও পরীক্ষার ফি বেশী, স্কুলের বিল্ডিং ও অবকাঠামো সুন্দর, স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক ব্যাচ আকারে বেশি পারিশ্রমিকে বাসায় প্রাইভেট পড়ান এবং ধনী ও উচ্চ পদস্থ চাকরীজীবীদের ছেলে মেয়ে যে স্কুলে পড়াশুনা করে। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। এটি অভিবাবকদের লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় মাত্র।
অভিবাবক ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যতটুকু সম্ভব ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি সদয় ও বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। কখনো গালি গালাজ ও তিরষ্কার করা যাবে না। পড়ালেখায় অমনোযোগী হলে এবং দুষ্টামী করলে বুঝিয়ে বলতে হবে। বাচ্চার সামনে কোন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীর কাছে তার ব্যাপারে কম্প্লেইন করা যাবে না। বাসায় সব সময় পাঠ্য বই নয়, তার পছন্দের বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা করতে উৎসাহ দিতে হবে এবং কোন সমস্যা দেখা দিলে তিরস্কার নয়, খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
আপনি কী চান তা বাচ্চার উপর চাপিয়ে না দিয়ে, বরং সে কী চায়, কোন বিষয়টি তার পছন্দ বোঝার চেষ্টা করুন। বাসায় বাচ্চাদে সাথে নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা উচিৎ, এতে সম্পর্ক আর গাঢ় হবে। স্কুলে যাতে শুদ্ধ করে বাংলা শিখতে ও বলতে পারে সেজন্য শুরু থেকে শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বর্ণমালা শেখানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন, তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, সময় পেলে বাচ্চাদের নিয়ে তাদের পছন্দের জায়গায় ঘুরে আসুন। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি-কালচার নিয়ে আলোচনা করুন।
যাদের ছেলে মেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে, খেয়াল রাখবেন যাতে শুদ্ধ করে বাংলা লেখতে, পড়তে ও কথা বলতে পারে। পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজ নিজের মাতৃভাষা বাদ দিয়ে বিজাতীয় ভাষা চর্চা করে না। এজন্য সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করে বলে বাংলার ব্যাপারে উদাসীন হলে চলবে না। শুধু ইংরজি কেন? সম্ভব হলে জাপানিজ, চায়নিজ, রাশিয়ান, কোরিয়ান, জার্মান, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ ও ডাচ ইত্যাদি ভাষা চর্চায় উৎসাহ দিতে পারেন।
ব্রিটিশ কারিকুলামের ছাত্র ছাত্রীদের ইংরেজিতে কথা শুনলে দুঃখ হয়, অনেকটা আমেরিকান উচ্চারণের মতো হলেও আসলে বাংলাদেশের FM Radio মার্কা বাংলিশ, ব্রিটিশদের মতো নয়। চাইলে ছাত্র ছাত্রীরা BBC news, BBC documentary ফলো করতে পারে। এতে ছাত্ররা সঠিক উচ্চারণে British English শিখতে পারবে।
পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা মানে ভাল ছাত্র হওয়া বুঝায় না। এটা যদি হতো তাহলে ৯০% এ+ প্রাপ্ত ছেলে মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে ফেল করত না। আপনি কয়টা জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন এটা মুখ্য বিষয় নয়। এটা যদি হতো তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকরা অন্যের গবেষণা পত্র হুবহু নকল করতেন না, নিজে থেকে গবেষণা করতেন। আসল কথা হলো আপনি এত বছর পড়াশুনা করে নিজে কী অর্জন করেছেন এবং সমাজ ও রাষ্ট্র আপনার কাছ থেকে কি পেয়েছে।
খোঁজ নিলে দেখা যায় পৃথিবীর বেশীরভাগ খ্যাতিমান সাইন্টিস্ট, দার্শনিক, সমাজ কর্মী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনদিন পড়াশুনা করেন নাই। এদের বেশিরভাগের একাডেমিক শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না, এজন্য ক্লাসের পরীক্ষায় তাদের ফলাফল আশানুরুপ হতো না। আজ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানী ও গবেষক প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ালেখা করে সফলতা পান নাই।। সফলতা আসে নিজের সৃজনশীল চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও সঠিক দিকনির্দেশনার ফলে।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:২৬