উইলিয়াম সমারসেট মমের (William Somerset Maugham) 'দি লাঞ্চিয়ন' (The Luncheon) গল্পটি আমার খুব প্রিয়। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় ইংরেজি সাহিত্যে গল্পটি পাঠ্য হওয়ায় বিখ্যাত ব্রিটিশ এ ঔপন্যাসিক ও গল্পকারকে চিনতে পারি। পরবর্তী সময়ে তাঁর বিখ্যাত লেখা The Painted Veil, The Moon & Sixpence, Of Human Bondage, The Narrow Corner, Up at the Villa, The Razor's Edge বইগুলো পড়েছি। ঊনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বাস্তব চিত্র সহজ ভাষায় ও হাস্য রস দিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন তিনি। ব্রিটিশ হলেও জীবনের বেশীরভাগ সময় প্যারিসে কেটেছে তাঁর। এজন্য সমারসেট মমের লেখায় ফ্রান্সের মানুষের জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব ছিল স্পষ্ট।
'দি লাঞ্চিয়ন' গল্পটি একজন নবীন লেখক ও তাঁর একজন পাঠিকার মধ্যে সাক্ষাৎ হওয়া, মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ করা ও খাওয়া দাওয়ার পটভুমি নিয়ে আবর্তীত। লাঞ্চিয়ন শব্দটি লাঞ্চ (Lunch) এর পরিশব্দ। কোন বিশেষ গেস্টকে গুরুত্বপূর্ণ কোন স্পটে/রেস্তোরায় মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানালে লাঞ্চিয়ন শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
ঘটনার বিশ বছর পর যখন প্যারিসের একটি থিয়েটারে লেখকের সাথে তাঁর পাঠিকার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয় তখন সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলা। সেদিন মহিলাটি বল্লেন, দেখ সময় কত দ্রুত চলে যায়? সেদিনের কথা কি তোমার মনে পড়ে, যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল? সেদিনের কথা আমি এক মুহুর্তে ভুলিনি, মনে হচ্ছে এইতো সেদিন আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হল। মনে থাকবে না কেন? এমন স্মৃতিময় দিনের কথা কি ভুলে থাকা যায়, জবাবে বলেছিলাম আমি। ঘটনাটি বিশ বছর আগের, তখন আমি প্যারিসের ছোট্ট একটি এ্যপার্টমেন্টে বসবাস করতাম। সে সময় আমার আয় এতো সীমিত ছিল যে, কোনমতে নিজের জীবিকা রক্ষা করে আরাম আয়েশের জন্য বাড়তি পয়সা খরছ করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
একদিন আমার একজন পাঠিকার কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। যিনি আমার বইটি পড়ে প্রশংসা করেছেন। খুশি হয়ে উত্তরে তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। কিছু দিনের মধ্যে উনার কাছ থেকে আরেকটি চিটি পেলাম। তিনি লিখেছেন কিছু দিনের মধ্যে প্যারিস হয়ে দূরে কোথাও যাবেন তিনি। এজন্য সম্ভব হলে যাত্রা বিরতিতে আমার সাথে দেখা করতে চান। আর সময় থাকলে বিখ্যাত ফয়েট'স রেস্তোরাঁয় একসাথে লাঞ্চ! ফয়েট'সের কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এটি এত ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্ট যে, আমার মত ছাপোষা কেরানির এমন উচ্চভিলাস কোনদিন কল্পনায়ও আসেনি। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আবার বয়সটা এত কাঁচা ছিল যে একজন যুবতী মেয়েকে না করব তা মনে সায় দিচ্ছিল না।
----------"আই ওয়াজ টু ইয়াং টু সে নো টু এ্য উইম্যান"----------
হাতে যে টাকা আছে মাসের বাকি দিনগুলো কোন মতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ফয়েট'সে গেস্টকে আমন্ত্রণ করলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম যা হওয়ার পরে হবে, কোন অবস্থাতে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রতি উত্তরে তাকে সম্মতি জানিয়ে দিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে ঠিক সময়ে রেস্তোরায় আমাদের সাক্ষাৎ হল। কিন্তু হায়, এ কি দেখলাম? বছর চল্লিশের একজন বেঁটে ও মোটা মহিলা তিনি। মোটেও আমার কল্পিত অল্প বয়সী সুন্দরী তরুণী নন। আমাকে দেখে এমন অট্ট হাসি দিলেন যে, বত্রিশটি দাঁত দেখা যাচ্ছিল। ওয়েটার মেন্যু নিয়ে আসলে গেস্ট আমাকে নিশ্চিত করলেন, তিনি মধ্যাহ্নভোজে কখনও একটির বেশি খাবার গ্রহণ করেন না। রেস্তোরাঁর খাবার যতটুকু ব্যয়বহুল ভেবেছিলাম মেন্যুটি তার চেয়ে অনেক বেশি দামী ছিল। ভদ্রতার খাতিরে বল্লাম, কি যে বলেন আপনি? একটা খাবেন কেন, যে যে খাবার পছন্দ অর্ডার দিতে পারেন। একটু 'সালমন ফিস' হলে খারাপ হয় না, গেস্ট বল্লেন। আমি একটু অবাক হলাম, কারণ এটি মেন্যুতে ছিল না। ওয়েটার জানাল বছরের এ সময়ে নদীতে মাছটি পাওয়া না গেলেও তাদের সংগ্রহে আছে। তবে দাম একটু বেশি পড়বে। মাছটি রান্না করতে একটু সময় লাগবে এজন্য আর কিছু লাগবে কি না, ওয়েটার জানতে চাইল। তিনি আবারও বল্লেন, আমি কখনও একটি পদের বেশি লাঞ্চে কিছু খাই না। তবে 'ক্যাবিয়ার' দিলে খারাপ হয় না, যদি তা তোমাদের সংগ্রহে থাকে। ক্যাবিয়ার মেন্যুর সবচেয় দামী খাবার, এটা সত্যি এফোর্ড করার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু গেস্টকে কিছুই বুঝতে দিলাম না। তাঁর জন্য একটি ক্যাবিয়ার অর্ডার দিলাম, আর আমার জন্য মেন্যুর সবচেয়ে কমদামী মাটন চপ।
ড্রিংকের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বল্লেন, অতিরিক্ত পান করতে তাঁর নাকি ডাক্তারের নিষধ আছে। তবে একেবারে না করলেও তো হয়না, ভদ্রতা বলে একটি কথা আছে। তাই তিনি সবচেয় দামী ফ্রেঞ্চ হোয়াইট ওয়াইনের অর্ডার দিলেন। আমার জন্য বেছে নিলাম এক গ্লাস পানি। আমি লাঞ্চে কেন মিট খাই এজন্য বারবার ভৎসনা করলেন আর জ্ঞান দিতে লাগলেন। আমি গো বেচারার মতো তাঁর আদেশ ও উপদেশগুলো বাধ্য ছেলের মত গিলতে লাগলাম।
হঠাৎ ওয়েটারকে তিনি ইশারা করলেন। কাছে আসলে জানতে চাইলেন 'এসপ্রাগাস' আছে কি না? তিনি আরো যোগ করলেন প্যারিসে নাকি মোটা মোটা ভাল মানের এসপ্রাগাস পাওয়া যায়। এটি না খেয়ে প্যারিস থেকে চলে গেলে প্যারিস ভ্রমনটা বৃথা হয়ে যাবে। ওয়েটার জানাল তাদের ভাল মানের এসপ্রাগাস মজুদ আছে। শুনে খুশিতে আমার গেস্টের ষোল ফালি দাঁত বের হল। একে একে সুস্বাদু সব খাবার সামনে আসতে লাগল। অল্প সময়ে মহিলাটি খাবারগুলো সাবাড় করে ফেল্ল। একটি বারও আমাকে একটু চেখে দেখতে অফার করল না। কফি চা কিছু চলবে, জানতে চাইলে সে কফি ও আইসক্রিমের অর্ডার দিল। কফির জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম তখন রেস্তোরার প্রধান ওয়েটার এক ঝুঁড়ি বড় বড় পীচ্ ফল নিয়ে হাজির। ওয়েটার জানাল এগুলো ইতালি থেকে এসেছে, খেতে সেই রকম স্বাদ। ওয়েটার বলতেই আমার গেস্টের চাঁদ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টেনশনে আমার কথা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পকেটের যা অবস্থা, বিলটা যদি অনেক বেশি হয় কি করব?
ওয়েটার বিলটি নিয়ে আসলে দেখলাম পকেটে যা আছে কোনমতে বিলটা পরিশোধ করতে পারব। বিলটি পে করে পকেটের শেষ পয়সাটুকু ওয়েটারকে দিয়ে খালি মানিব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। জানিনা সামনে পড়ে থাকা মাসটি কেমন কাটবে। আর আমার দামী গেস্টটি একটি রুমান্টিক হাসি দিয়ে হ্যন্ডশেক করে লাফ দিয়ে একটি ক্যাবে চড়ে হাওয়ায় মিশে গেল। যদিও যাওয়ার আগে লাঞ্চে বেশী মিট না খাওয়ার জন্য উপদেশটা আবার স্বরণ করে দিল।
উইলিয়াম সমারসেট মমের গল্পটি আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে বেশ মিলে যায়। লেখকের আর্থিক অবস্থা নাজুক হলেও নতুন যৌবনের উদ্দীপনা, একটি সুন্দরী প্রেমিকা পাওয়ার আকাংখা ও ভালবাসার জন্য টগবগে একটি প্রেমিক মন ছিল। এজন্য সামর্থ্য না থাকার পরও মহিলাটিকে না চিনে, না বুঝেও সাক্ষাতের আকাংখা দমিয়ে রাখতে পারেননি। আমাদের দেশের হাজার হাজার তরুণ আছে যাদের অনেকের আর্থিক সচ্ছলতা নেই কিন্তু ভালবাসা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। আছে সুন্দর একটি মন ও দু'চোখ ভরা স্বপ্ন। পছন্দের মানুষটির প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে চিরদিনের মতো কাছে পেতে চায় তারা।
অনেক সময় ধার কর্জ করেও প্রেমিকার দামী রেস্তোরায় খাবার আবদার পূরণ করে। দামী গিফ্ট কিনে দেয়। মোবাইলের ব্যালেন্স/এমবি দেয়। অনেক সময় মোবাইল, ট্যাবও কিনে দিতে হয়। তবে বেশির ভাগ সময় প্রেমিকার শর্ত থাকে তোমাকে ভাল চাকরি পেতে হবে, বেশি বেশি টাকা পয়সা আয় করতে হবে। তা না হলে আমার আব্বু আম্মু কোন অবস্থাতে তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দেবে না। একটা সময় আসে বেশিরভাগ ছেলে শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। সময়মতো চাকরি নামক সোনার হরিণ জোটে না, দিন দিন বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে। সুযোগ বুঝে ভালবাসার মানুষটিও উড়াল দেয় যে শর্ত পূরণ করতে পারবে তাঁর নীড়ে। আমাদের সমাজে ভালবাসতে সমস্যা নেই, কিন্তু বিয়েটা অনেক কিন্তুর উপর নির্ভর করে।
আমরা অনেক সময় রেস্তোরায় আমন্ত্রণকারী ব্যক্তির পকেটের অবস্থা না বুঝে সুযোগ পেয়ে একটার পর একটা অর্ডার দেই। মাগনা খাবার পেলে বাঙালীর পেটের খিদেটা এক লাফে বেড়ে যায়। অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অন্যের টাকায় সবচেয়ে দামী জিনিসটি কিনতে চাই। আমাদের মধ্যে অনেকে আছি যারা পকেটে পয়সা থাকলেও অন্যের পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে দিনের পর দিন আবদার করি। ইউরোপে দেখেছি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রেমিক-প্রেমিকা রেস্তোরায় খেতে বসলে সবাই স্বেচ্ছায় ভাগ করে বিল পরিশোধ করে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী হলেও। ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক ভাল থাকে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। এতে মাইন্ড করার কিছু নাই।
অনেক সময় আমরা নিজে যা মানি না, যা বিশ্বাস করি না তা অন্যকে পলন করতে জোরাজুরি করি। আর উপদেশ দেওয়ার হুজুগটা আমাদের মজ্জাগত। সুযোগ পেলে বাঙালীরা কাউকে উপদেশ দিতে ছাড়ে না। এটা আমাদের অনেকগুলো ট্রেডমার্ক গুণের মধ্যে অন্যতম। সময়ে-অসময়ে, আপনে-পরে, যেখানে-সেখানে উপদেশ বিলি করাটাকে বাড়তি দায়িত্ব মনে করি আমরা। আর কেউ কিছু বুঝতে বা জানতে চাইলে তো কথাই নেই, রীতিমত উপদেশের বর্ষণ ঝরে। যদিও নিজেদের বেলায় এগুলো খাটে না। এটা এক প্রকার অভদ্রতা। হ্যা, প্রয়োজনে পরামর্শ দেওয়া যায়, খারাপ কিছু চোখে পড়লে সতর্ক করা যায়। কিন্তু তাই বলে উপদেশ? অবশ্যই নয়।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৪:৫৫