আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সময় যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বারবার টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেই বাঘকে যদি সত্যিই রক্ষা করতে হয় তাহলে প্রয়োজন সত্যিকার রেড অ্যালার্ট। তা না হলে কালক্রমে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বুক থেকে হারিয়ে যাবে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার । ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে ইকো সিস্টেম। উইলিয়াম ব্লেইকের বিখ্যাত কবিতা আছে দি টাইগার। এখনো ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি করে--
"Tiger, tiger burning bright
In the forest of the night,
What immortal hand of eye
Could frame thy fearful symmetry?"
ফিকে হয়ে যাবে এ কবিতা। ফিকে হয়ে যাবে সত্যজিতের "হীরক রাজার দেশে"র গোপী গাইন ও বাঘা বাইনের সেই বিখ্যাত গান--
"পায়ে পড়ি বাঘ মামা... তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত?"
✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺✺
আমরা এখন :রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার" সম্বন্ধে বিস্তারিত জানব---
✔ বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় যে সুদর্শন বাঘ দেখা যায় তা পৃখিবীব্যাপী রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার (Royal Bengal Tiger) নামে পরিচিত। কয়েক দশক আগেও (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০), বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ ছিলো। পঞ্চাশের দশকেও বর্তমান মধুপুর এবং ঢাকার গাজীপুর এলাকায় এই বাঘ দেখা যেতো; মধুপুরে সর্বশেষ দেখা গেছে ১৯৬২ এবং গাজীপুরে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ৩০০০-এর মতো আছে, তন্মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভারতীয় উপমহাদেশে। এই সংখ্যা হিসাব করা হয় বাঘের জীবিত দুটি উপপ্রজাতি বা সাবস্পিসীজের সংখ্যাসহ। ২০০৪ সালের বাঘ শুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৪৫০টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর সংখ্যা ২০০-২৫০টির মতো।
░░░░░░░░░░░░ দৈহিক বৈশিষ্ট্য ░░░░░░░░░░░░
এর গায়ের রঙ হলুদ থেকে হালকা কমলা রঙের হয়, এবং ডোরার রঙ হয় গাঢ় ক্ষয়েরি থেকে কালো; পেটটি হচ্ছে সাদা, এবং লেজ কালো কালো আংটিযুক্ত সাদা। একটি বদলানো বাঘের জাতের (সাদা বাঘ) রয়েছে সাদা রঙের শরীরের উপর গাঢ় ক্ষয়েরি কিংবা উজ্জল গাঢ় রঙের ডোরা, এবং কিছু কিছু শুধুই সাদা। কালো বাঘের রয়েছে কমলা, হলুদ কিংবা সাদা রঙের ডোরা। স্মাগলারদের কাছ থেকে উদ্ধারিত হয় যে একটি কালো বাঘের ত্বকের মাপ হচ্ছে ২৫৯ সেঃমিঃ, এটি নিউ দিল্লীর National Museum of Natural History তে প্রদর্শন করা হয়। ডোরাবিহীন কালো বাঘ রিপোর্ট করা হয়েছে কিন্তু কোনো প্রমান এখনও পাওয়া যায়নি। লেজসহ একটি নর বাঘের দৈর্ঘ্য ২১০-৩১০ সেঃমিঃ, যেখানে মাদিদের দৈর্ঘ্য ২৪০-২৬৫ সেঃমিঃ। লেজের পরিমাপ হচ্ছে ৮৫-১১০ সেঃমিঃ, এবং ঘাড়ের উচ্চতা হচ্ছে ৯০-১১০ সেঃমিঃ। পুরুষদের গড় ওজন হচ্ছে ২২১.২ কেজি এবং মহিলাদের হচ্ছে ১৩৯.৭ কেজি। উত্তর ভারতের পুরুষ বাঘেরা সাইজে সাইবেরিয়ান বাঘের (Siberian tigers) মতোই, যার মাথার সর্ব্বেচ্চ দের্ঘ্য ৩৩২-৩৭৬ মিঃমিঃ।উত্তর ভারত ও নেপালে পুরুষদের গড় ওজন ২৩৫ কেজি আর মহিলাদের ১৪০ কেজি।বর্তমানে বিভিন্ন বাঘ জাতির ওজনের উপর পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে যে গড়ে বেঙ্গল টাইগারেরা সাইবেরিয়ান বাঘের চেয়ে বড়। একটি বেঙ্গল টাইগারের গর্জন ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত দুরে শোনা যায়।
░░░░░░░░░░░ বাঘের খাদ্য ░░░░░░░░░░░░░
বিশেষজ্ঞর মতে, প্রতিদিন একটি বাঘের ১৮-৫০ কেজি খাবার প্রয়োজন হয়। সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শূকর, বেজী, মাছ, কাঁকড়া, সাপ ও ব্যাঙ বাঘের খাদ্য। ইদানিং সুন্দরবনের বাঘের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। এই সূত্র জানান, প্রতিবছর নভেম্বর- ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত বাঘের মানুষ শিকার মাত্রা ৪৫.৫ শতাংশ, এপ্রিল- জুন মাস পর্যন্ত ৩২.৫ শতাংশ, বাকী ৫ মাসে ৯.৫ শতাংশ। বর্তমানে সুন্দরবনের বাঘের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খাদ্য। রাজকীয় এই প্রাণীর প্রধান খাদ্য হরিণ। সুন্দরবনের চোরা শিকারীদের হাতে প্রতিনিয়ত হরিণ নিধন হচ্ছে। ফলে বন থেকে হরিণ কমে যাচ্ছে। আর হরিণ কমতে থাকায় সুন্দরবনে বাঘেরও খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া বিচরণ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বাঘের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত একটি পূর্ন বয়স্ক স্ত্রী বাঘের ১৪ থেকে ১৬ কিলোমিটার ও একটি পুরুষ বাঘ ৩৫ তেকে ৩৬ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বিচরণ করে থাকে। এর মধ্যে অন্য কোন বাঘ ঢুকে পড়লে আগে বিচরণ করা বাঘটির সঙ্গে তার সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এতে পরাজিত বাঘটি বন সংলগ্ন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। বয়স্ক বাঘও দিনের পর দিন বনের মধ্যে শিকার করতে না পেরে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে মানুষসহ গবাদিপশুর ওপর হামলা চালায়। তাছড়াা সুন্দরবনের ভেতরের যেসব প্রাকৃতিক জলাধারসমূহ যুগ যুগ ধরে বাঘসহ বন্য প্রানীদের মিঠা পানির চাহিদা মিটিয়েছে সে সকল জলাধার সমূহ যুগ যুগ ধরে বাঘসহ অন্য প্রাণীদের মিঠা পানির চাহিদা মিটিয়েছে সে সকল জলাধার সিডর ও আইলাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মারাত্মকভাবে লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বনের মধ্যে মিঠা পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এসব জলাধারের লবণাক্ত পানি পান করে বাঘ লিভার সিরসিসে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া বনের ভিতরে প্রবাহিত বহু নদী- খাল ভরাট হয়ে গেছে। মূলত এ সকল কারণে বাঘ সহজেই লোকালয় প্রবেশ করছে। এদিকে বন সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষও সব সময় বাঘ আতঙ্কে থাকে। ফলে বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করলে গ্রামবাসী তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। তার ওপর প্রাকৃতিকভাবেও প্রতি বছর বেশ কিছু বাঘ মারা যায়।
░░░░ মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার পরিমান বাড়ায় বাঘ নরখাদক হয় ░░░░
১৯৮১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের প্রায় ৪শ’ জন নারী- পুরুষ বাঘের থাবায় নিহত হয়েছে। বাঘ নরখাদক হওয়ার কারণ ‘নুনের প্রভাব বাঘের মানুষ খাওয়ার লোভ বাড়ছে সুন্দরবনে’ সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে নুনের ভাগ বেড়ে সুন্দরী গাছ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বাভাবিক জীবন চক্র পাল্টে যাচ্ছে। বাড়ছে মানুষ খাওয়ার প্রবণতা। বাঘের আচরণ নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলেছেন যেভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলাচ্ছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বভাব পাল্টাতে বাধ্য। এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জার্মান বাঘ বিশেষজ্ঞ রোনাল্ড হেন্ড্যাকে, মার্কিন পরিবেশ বিদ মর্গান ও ম্যাক ইন্টারের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে নুনের পরিমান বাড়ায় বাঘের নরখাদাক হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। মানুষের মাংস মিষ্টি, তাই বাঘের দৃষ্টি সেদিকে থাকে।
░░░░░░░░░░ বাঘ বাচঁলে সুন্দরবন বাঁচবে ░░░░░░░░░░
বাঘ বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। এতে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারনে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ: সঙ্কুচিত হচ্ছে। আবার ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর হঠাৎ করে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। কারন সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভেতরে প্রবেশ করে আর বের হতে পারছেনা। এতে বনের মিষ্টি পানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টি পানির আশায় লোকলয়ে প্রবেশ বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেরীতে হলেও বাঘ উপদ্রুত এলাকার মানুষকে বাঘের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তাছাড়া লোকালয়ে প্রবেশ করা বাঘকে ট্রাংকুলাইজার গান দিয়ে গুলি করে অচেতন করার জন্য বেশ কয়েকজন বনকর্মীকে প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে। তারা বলেন, এতদিন বন বিভাগের কাছে ট্রাংকুলাইজার গান থাকলেও দক্ষ লোকের অভাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন থেকে লোকালয় ঢুকে পড়া অধিকাংশ বাঘকে জীবন্ত উদ্ধার করে চিকিৎসার পর পুনরায় বনে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।
❆❆❆❆❆❆❆ পুরাণের একটি গল্প❆❆❆❆❆❆
░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░একবার মহাসত্য তাঁর ছোট ভাইকে নিয়ে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটি হাড়সর্বস্ব বাঘিনীকে দুটি ছোট বাচ্চাসহ দেখতে পেলেন। বাঘিনী এতটাই ক্ষুধার্ত যে নিজের একটি বাচ্চা খেয়ে ফেলার উপক্রম করছে। মহাসত্য সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে ত্যাগ করে বাঘের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু বাঘিনী এতটাই দুর্বল যে তাকে খাবার শক্তি পর্যন্ত তার নেই। মহাসত্য তাঁর শরীর ফুটো করে রক্ত বের করে দিলেন। বাঘ সে রক্ত পান করে শক্তি জুগিয়ে তাঁকে ভক্ষণ করল। এবার মহাসত্য বোধিসত্যরূপে ধরাধামে পুনর্জীবন লাভ করলেন।
একালের বিজ্ঞ জনেরা বলবেন, নিজেকে বাঘের সামনে সঁপে দেয়া বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু পুরাণের এ কাহিনীতে একটি মেসেজ আছে। বাঘকে স্বাভাবিক জীবনধারণের অধিকার দেওয়া আমাদের কর্তব্য। লোকালয়ে বাঘ ঢুকলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়াই শ্রেয়, পিটিয়ে হত্যা করা নয়। এ কথা বাংলাদেশের মানুষকে এখন উপলব্ধি করতে হবে। ░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░░
বাংলাদেশে সুন্দরবনই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শেষ আশ্রয়স্থল। মানুষের আগ্রাসনে গোলপাতার ঝোঁপ আর গাছ যেভাবে কমে যাচ্ছে, তাতে বাঘের বিচরণ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। খাদ্যঘাটতি দেখা দিচ্ছে জঙ্গলের ভিতরে। এভাবে ক্রমে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্তির হুমকিতে অবস্থান করছে । আসুন রক্ষা করি আমাদের বাংলার বাঘকে ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:১৯