প্রকৃতি আর মানুষের সহজ মুক্তির অবাধ স্ফুরণ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। দুটি গ্রাম্য ছেলেমেয়ের ভালোবাসার নক্সীবুনন জসীম উদ্দীনের কাহিনী কাব্য ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। কাঁথার জমিন জুড়ে ভালোবাসার জ্যামিতিক নকশা আঁকা এ কাব্য, দুটি প্রাণের অন্তর ও বাইরের দ্বন্দ্ব, সুখ-দু:খের, গানের অনুভবকে প্রকৃতির আবরণে একীভূত করে দেয়। প্রকৃত বিচারে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’র দুটি হৃদয়ের সুখ-দুঃখের পুরোটাই দখল করে আছে প্রকৃতি। কাব্যটির চৌদ্দটি খণ্ডের মাঝে প্রকৃতিই আশা জাগায়, সমৃদ্ধিতে ভরে দেয়, আবার প্রকৃতিই দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে, কখনোবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গোষ্ঠীবদ্ধ দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বয়ে আনে দুঃখময় পরিণাম-হতাশা। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’র কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র সাজুকে যে নক্সী কাঁথা বুনতে দেখি, তা প্রকৃতপক্ষে নারী হৃদয়েরই প্রতিকৃতি। নারী হৃদয় সাধারণত মনের মাধুরি মিশিয়ে পাড়তোলা সুতোয় অপূর্ব ফোড়নে কাঁথার জমিন জুড়ে ফুল, পাতা, মাছ, ধানের ছড়া, চাঁদ, তারা, হাতি, ঘোড়া প্রভৃতি আঁকে। কিন্তু সাজু এখানে অন্যরকম ব্যতিক্রম। কাঁথার জমিন জুড়ে কেবল তাদের সংসার যাত্রার মায়াবী ছায়াছবি ঘেরা দাম্পত্য জীবনের সেই সুখের মুহূর্তগুলো ঘুরেফিরে আসে, রূপাই বাঁশি বাজায়, সাজু বসে বসে রাঙা ঠোঁটে গুন গুন করে গান গায় আর কাঁথার জমিনে সুচ চালায়। শেষ দৃশ্যে নকশায় রূপাই এর ফেরার হয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি আঁকে সাজু। এই তাদের শেষ দেখা, এই ছিল চার চোখের শেষ চাওয়া। কিন্তু কবির সৃষ্টি নক্সী কাঁথায় কবিতার শরীর যে জমিনে পায়চারি করে বেড়ায় তা আবহমান গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপকেই তুলে ধরে। কাজেই এ নক্সী কাঁথা সুতোর ছোট বড় ফোড়নের মায়াবী নকশা নয়। এ নক্সী কাঁথা কবির মনোভূমি। যার অন্তর জুড়ে থাকে যুগযুগান্তের গ্রামবাংলার লক্ষ কোটি হৃদয়ের স্পন্দন।বাংলার সংস্কৃতি হৃদয় দিয়ে অনুভব করার তৃষ্ণা নিয়ে কবি গ্রামের পর গ্রাম পরিভ্রমণ করেছেন। এর মাধ্যমে জীবনের অন্যরকম অর্থও খুঁজে পেয়েছেন। যে মানুষটি অতি কাছের, তাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরা সম্পূর্ণ নতুন রূপে দেখা দিল কবি চোখে। খেটে খাওয়া মানুষের মুখ, সাহসী পেশী সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থিত হলো কবিকল্পনায়। পল্লী বাংলার জীবনচিত্রের মাঝে জাতির শিকড় সূত্রের বীজমন্ত্র খুঁজে পেলেন কবি। আর তাঁর সোনারকাঠি যাদুর পরশ বুলিয়ে দিল কবির দৃষ্টিশক্তির সীমা পরিসীমায়।
*** কাঁথার জমিন
‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যে গ্রাম্যজীবনের গভীরে প্রবেশের যে প্রচেষ্টা তা অন্য যে কোনো কবির চেয়ে মধুরতর ব্যতিক্রম। এই কাব্যে বাংলার মানুষের সেই জীবনযাত্রাকে খুঁজে পাই, যেখানে জীবন্ত হয়ে আছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক, ছড়া, ধাঁধা, বিশ্বাস, সংস্কার, লোকাচার, লোক ধর্মাচার প্রভৃতির অপূর্ব সমন্বয়। যে নক্সী কাঁথায় একটি মাঠের দুপ্রান্তে দুটি গ্রাম এক সুতোয় বাঁধা। দুটি গ্রাম পরস্পরের দিকে মুখোমুখি চেয়ে আছে। মাঠ ভরা ফসল। ছোটো ছোটো ঘর, এখানে ওখানে সবুজ গাছ। বিলের জলে শাপলা-শালুক-পদ্ম ফোটে, নানা রঙের পাখি ডাকে, গ্রামের লোকেরা সাঁতার কাটে, গাঁয়ের বধূ কলসী কাঁখে হেঁটে যায়, সারাদিন কাজ শেষে রাতের খাবার খেয়ে চাষীরা বাঁশি বাজিয়ে, গান গেয়ে রাত পার করে দেয়। এক গ্রামের যুবকের বাঁশির সুরে অন্য গ্রামের মেয়ের মন ভেঙে যায় কিংবা, এ গ্রামের কৃষকের ভাটির টানে পাগল পারা হয়ে যায় ও গ্রামের মেয়ে। পারিবারিক অনুশাসন উপেক্ষা করে ঘরের বেড়ার সাথে কান লাগিয়ে থাকে ও গ্রামের মেয়ে, কখন শুনতে পাবে সেই সুমধুর সুর। দুটি গ্রামের লোকেদের মধ্যে মিলের অন্ত নেই; আবার প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাঠি ধরে। রক্তাক্ত করে দুটি হাত, সেই সাথে বিলের কালো জলও।
*** রূপাই চরিত্রের পরিচয়
গফরগাঁয়ের চির সুন্দর কালো রঙের ছেলে রূপাইয়ের বংশ গৌরবও কম যায় না। রূপার দাদার নাম শুনে লোকে এক সময় ভয়ে কাঁপত। এক সময় কাজল তলা গ্রামের কাজীদের পেয়াদা ছিল রূপার নানা। সৈয়দ ঘেষা মিঞা বলেও তাদের খ্যাতি রয়েছে। গ্রামের চৌকিদার অবধি রূপাইর বাপকে রীতিমত তোয়াজ করে কথা বলত। রূপাইর চাচা অছিমদ্দি সাহেবের মুখে ইংরেজি বুলি শুনে দশ গ্রামের লোক হতভম্ব হয়ে যেত। মাথা ভর্তি লম্বা চুল। মায়া ভরা মুখ খানি ঠিক যেন কচি ধানের পাতার মতো শান্ত, স্নিগ্ধ, সুশীতল, ছায়াময়। হাত দুখানি যেন জালি লাউয়ের ডগার মতো। শ্রাবণ মাসের তমাল গাছের ন্যায় তার শরীরের গঠন। লাঠি খেলায় অসাধারণ দক্ষ রূপাই। খেলার সময় তাকে নিজেদের দলে টানতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় খেলোয়াড় দলগুলোর মাঝে। তার মতো জারি গানের গলা দ্বিতীয়টি আর নেই। সকল কাজেই অসাধারণ পটু বলে সবার মাঝেই রূপাই এর আদরের শেষ নেই। কৃষি কাজে অসাধারণ পরিশ্রমী রূপাইয়ের প্রিয় শখ বাঁশের বাঁশিতে সুর তোলা। নিজ হাতে বাঁশ কেটে বাঁশি তৈরি করে সে। এছাড়া গৃহস্থালির ব্যবহার্য যাবতীয় বাঁশের উপকরণ সে নিজ হাতেই তৈরি করে। ঝড়ে ভেঙে পড়া ঘর নতুন করে মেরামত করে রূপাই। রূপাই দশখণ্ড জমির মালিক, তিনটে হালের গরু রয়েছে, তার ধানের বেড়ি ঘরের চাল পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়। পরিশ্রমী এবং সংসারী ছেলে বলে রূপাইর সুনাম দশ গ্রাম জোড়া।
*** সাজুর পরিচয়
sajuবনগাঁয়ের পিতৃহীন মেয়েটির নাম সোনা। বাড়ির সেজ মেয়ে বলে সবাই তাকে সেজ বলে ডাকে, সেজ থেকে সাজু। মাঠের ওপারের গ্রামের ছনের ছাউনি দিয়ে ঘেরা বাড়িতে থাকে সে। সোনার মতোই শরীরের রং তার। ভরাট মুখের মাঝে দুখানি রাঙা ঠোঁটে তাকে ঠিক যেন হলদে পাখিটির মতো দেখায়। সোনাভরা মাঠের ফসল, অথবা কদম ফুলের ন্যায় মেয়েটির শরীরে জড়ানো শাড়িটি ঠিক যেন লাল মোরগের পাখার মতো ওড়ে। তার কচি হাত পা গুলোয় যখন সোনা মাখা রং খেলা করে তখন মনে হয় যেন কেউবা তুলসী তলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার রূপ দেখে গাঁদাফুল কিংবা চম্পাকলির কথা মনে পড়ে যায়। তার রূপের কাছে হার মানে রংধনুর সাতটি রং, মাঠের বুনো ফুল কিংবা তুলসী ফুলের মঞ্জরী। অল্প মাত্র গয়নাতেই তাকে দেবালয়ের পঞ্চপ্রদীপের ন্যায় দীপ্তিময় দেখায়। সে ঘরকন্নার কাজে এতই নিপুণা যে তার মতো মিহি করে কেউ সেমাই কাঁটতে পারতো না, নানা রকমের নকশি করা পিঠা তৈরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। লোক শিল্পেও অসাধারণ দক্ষ সাজু। সরাচিত্র, কিংবা হাঁড়ির উপর বিবিধ নকশা আঁকা থেকে শিকেয় ফুল তোলার কাজে তার তুলনা নেই। সাজুর গানের গলা অসাধারণ। বিয়ের গীত তার গলায় অতিমিষ্ট শোনায় বলেই নারী মহলে তার গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশেষ করে বিয়ের আসরে গীত গাওয়ার জন্য তার ডাক পড়ে সবার আগে। তার সুরে সুর মিলিয়েই সকল মেয়েরা গায়। ‘সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে’ -বলে কি লোক সাধে?
*** গ্রীষ্মের দাবদাহ
চৈত্র মাসের খরা, কোথাও পানি নেই। চারিদিকে হাহাকার। একটু বৃষ্টির জন্য চাষীদের অধীর প্রতীক্ষা। বৈশাখ মাসের কাঠফাটা রোদে মাঠ ফেটে চৌচির, যেন চারিদিকে আগুন ঝরছে। জমিতে লাঙল চালানো যায় না, পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে মাটি। গরু লাঙল টানতে পারে না, ঘরে রাখতে রাখতে মরচে ধরে গেছে লাঙলের ফলায়, ধুলো জমে গেছে লাঙলে-জোয়ালে। মাঝে মাঝে ঘূর্ণি বাতাস মাঠের এপার থেকে ধুলি ছড়িয়ে উড়ে চলে যায় ওপারে। মাটির ঢেলাগুলো এত বেশি শক্ত আর শুকনো যে একটু আগুনের ছোঁয়া পেলে তারা যেন কাঠের মতো জ্বলে উঠবে। মানুষ বৃষ্টি কামনায় দরগা তলায় মানত দিতে শুরু করেছে, কল্পিত পীরকে দেবতা জ্ঞান করে ভোগ হিসেবে ভাণ্ডের পর ভাণ্ড দুধ দিতে শুরু করেছে, শিরনি নিয়ে আসে ভার বোঝাই করে। নল্যা ডাকার উৎসব করে মাতম করছে, তবুও বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টি নামানোর চেষ্টায় মেয়েরাও কম যায় না। বদনা বিয়ের গান গেয়ে গেয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুড়ে ঘুড়ে নেচে নেচে মাঙন করতে থাকে মেয়েরা। কেউ চাল, কেউ ডাল, কেউবা লবন, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন দেয়। সারাদিন মাঙন শেষে শিরনি করবে তারা; তবু যদি বৃষ্টি নামে। বদনা বিয়ের গান শুনতে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে, নারী-পুরুষ সকল শ্রেণীর মানুষ। মেয়েরা মেঘকে আমন্ত্রণ জানায় সে যদি আসে তবে বিয়ের পর তারা কপালে কালো টিপ এঁকে দেবে। আড়িয়া, হাড়িয়া, কুড়িয়া এরূপ নানান কল্পিত নামে মেঘকে ডেকে আরও বলে তারা যদি আজ এসে মাঠ ডুবিয়ে দেয় তবে, নাকের নোলক বিক্রি করে তাদের মাথার ছাতা কিনে দিবে। কিংবা সিঁদুর মেঘ যদি লাল রং নিয়ে আসে তবে তার গায়ে কৌটা ভর্তি সিঁদুর দিয়ে দেবে। ছয়টি মেয়ে গান গাইতে গাইতে রূপাইদের রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। রূপাই তখন ঘর বাঁধার কাজে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ রূপাইয়ের চোখ পড়ে যায় মেয়েগুলির দিকে। একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারে না। যেন অপর পাঁচটি মেয়ে থেকে সে আলাদা। সবকটি মেয়ের রূপ যেন একটি মেয়ের মাঝেই ফুটে উঠছে। রূপাইর মা এক সের ধান দিলেন; তাতে রূপাই তৃপ্ত না হয়ে পাঁচ সের চাল এবং এক সের মুগের ডাল দিল মাঙনরত পছন্দের মেয়েটির হাতে। মেয়েরা মাঙন শেষ করে বনগাঁওয়ে ফিরে গেল। মেয়েটি রূপাইর মনে ছায়াপাত করলো, চার চোখে তাদের প্রথম চাওয়া হলো।
*** রূপাই সাজুর প্রণয়
আশ্বিনের গহীন ঝড়ে দমকা বাতাসে গ্রামগুলো কেঁপে ওঠে। গাছগুলো ভেঙে পড়ে, ঘরের চালা উড়ে যায়, ভেঙে পড়ে বেড়া। রূপাইদের রান্নাঘরের ছাউনি, গোয়াল ঘরের চালা উড়ে গেলো প্রচণ্ড বাতাসে।nakshi ঘর মেরামতের জন্য রূপাই পাশের গ্রামে বাঁশ কিনতে যায়। বিভিন্ন বাঁশের ঝাড় দেখে অবশেষে একটি বাঁশের ঝাড় খুব পছন্দ হয়ে যায়। বাঁশ কাটতে গিয়ে রূপাই দেখে একটি মেয়ে বাঁশের নিচ দিয়ে হেঁটে চলেছে। মেয়েটি শুকনো গাছের ডাল সংগ্রহ করে করে রান্নার জ্বালানির ব্যবস্থা করছে। মেয়েটিকে কোথাও যেন দেখেছিল রূপাই। ঠিক মনে পড়ে গেল, বদনা বিয়ের গান গাইতে যাওয়া গ্রাম আলোকিত করা সেই হলুদ পাখিটি।
‘খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুকনো গাছের ডাল,
শুকনো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আকার জ্বাল।’
এক পর্যায়ে রূপাইর কথা হলো সাজুর সাথে। পরিচিত হলো সাজুর মায়ের সাথেও। রূপাইর মা আর সাজুর মা একে অপরের খেলার সাথী, সেই সূত্রে রূপাইর খালা। সাজুদের বাড়িতে ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু করে রূপাই। কখনো বাজার থেকে ফিরতি পথে সাজুর মাকে দেখার ছল করে গজা নিয়ে আসে। কখনো বা সাজুর হাতে বেঁধে দেওয়ার জন্য রঙিন সুতো নিয়ে যায়, নানান ছুতোয় রেশমি চুড়ি কিনে দেয়। ঢাকাই শাড়ি, হাঁসুলি, হাতের বাজু কিনে দিয়েছে বলে চারিদিকে রটে যায়। এভাবে এক কান দুকান করে সাজু-রূপাই প্রণয়ের কথা গ্রামময় জানাজানি হয়ে গেলো। সাজুর মায়ের কথা-
‘শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি,
ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি।’
সাজুর মায়ের সাজুকে মারপিট, রূপাইকে কঠিন কথা বলা। রূপাইর মাঝে হতাশা। সাজু-বিরহে খাওয়া নেই, ঘুম নেই, কাজে মন নেই। একটি মাত্র ছেলের এমন অবস্থা দেখে দুঃখিনী মা পীরের দরগায় শিরনি দিলেন; জলপড়া দিলেন কিছুতেই ছেলে সুস্থ হয়ে ওঠে না। প্রতিবেশীদের নিন্দা, সাজুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব, দুখাই ঘটককে প্রেরণ এবং উভয় অভিভাবকের সম্মতিতে পরিশেষে বিয়ে।
মুখ দেখে তার বুঝলো ঘটক—লাগছে ওষুধ হাড়ে,
বলল তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে।’
*** বিয়ের সানাই বাজেরে
nakshiআজ বিয়ে, কুটুমেরা আসতে শুরু করেছে সাজুর মায়ের বাড়িতে। কাছারি ঘর লোকে লোকারণ্য। গোয়াল ঘর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে বিছানা পাতা হয়েছে, গ্রামের লোকেরা খোশ গল্পে মেতে উঠেছে, মোল্লা মোড়লেরা এই উপলক্ষে পুঁথিপাঠ করছে- গাজি, কালু, চম্পাবতী, হানিফা, সোনাভান, জয়গুণ বিবির পুঁথি। বাচ্চাদের হৈ চৈ, মহিলাদের ঝগড়া, রান্না, কাজের ব্যস্ততা। চারিদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ-
‘বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখছে জনে জনে;
ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠছে রূপার মনে।
ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার ‘জোড়া জামা’ গায়,
তেল-কুচ্-কুচ্ কালো রঙে ঝলক দিয়ে যায়।’
বিয়ের নানা আচারের মধ্যে একপর্যায়ে পান শরবত, সাদা পাতা, সিঁদুর, মিঠাই, কনে সাজের উপকরণ, এয়োদের সাজের উপকরণ সবকিছু ঠিকঠাক মতোই বুঝে নেয় পাত্রী পক্ষ। কথায় বলে, বিয়ের বিয়াল্লিশ কথা শেষ না হলে যেন সকল আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ হয় না। সাদা পাতা মনের মতো হয়নি, সিঁদুর কম হয়েছে, পরনের শাড়ি ছোট হয়েছে এরকম তুচ্ছ অভিযোগে কনের মামা-খালু-চাচার সাথে বরের চাচার এক চোট হয়ে গেল। বিয়ের আসর থেকে উঠে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও মোড়লের হস্তক্ষেপে সবকিছুর সমাধানের মাধ্যমে বিয়ের পর্ব সম্পন্ন হয়।
‘এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে,
সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে;
রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর,
হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীর।
ভাবল রূপাই অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে,
দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে।’
*** রূপাইর মায়ের মৃত্যু
বিয়ের পর্ব শেষ হলে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরল বরযাত্রী দল। শুরু হলো নব দম্পতির সংসার যাত্রা। সুখেই দিন কাটছিল তাদের। মায়ের মুখে চিরদিনের হাসির ঝিলিক। হঠাৎ আষাঢ় মাসের এক দিনে বিষম বিকার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রূপাইর মা মরে গেলেন।সাত আট দিন ধরে রূপা সাজুর কোনো খাওয়া নেই।
‘লালনপালন যে করিত ঠোঁটের আঁধার দিয়া’
সেই মা আজি মরে রূপার ভাঙল সুখের হিয়া।
ঘামলে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা;
সেই শ্বাশুরী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা।
সাজু রূপা দুই জনেতে কান্দে গলাগলি;
গাছের পাতা যায় যে ঝরে, ফুলের ভাঙে কলি।’
কৃষাণ কৃষাণীর উঠোন ভরা ধান
মায়ের মৃত্যুর পর রূপাই এবং সাজু নতুন করে সংসার সাজালো। সারাদিন মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকে রূপা। ঘরকন্নার কাজ আর নতুন ফসল তোলার জন্য প্রস্তুতি নেয় সাজু। ঘরদোর পরিষ্কার করে। আঙিনা লেপে মুছে তকতকে করে রাখে। কার্তিক মাসে ধান পাকতে শুরু করল। গ্রাম জুড়ে ধান তোলার উৎসব শুরু হয়ে গেল। মাঠ ঘাট সর্বত্র ধানের পর ধান। এতটুকু অবসর নেই রূপাইর। ধানকন্যা আজ রূপা-সাজুর উঠানে। গৃহিনী ভুলে গেছে খোপা বাঁধা, কৃষাণ ছেড়েছে বাঁশি; আজ তাদের শুধু কাজ আর কাজ। আজ ধানের ধুলোর অলঙ্কার পড়েছে কৃষাণী। কাজের ধুমে পাড়া বেড়ানোর কথাটি ভুলেই বসেছে মেয়েরা।
‘অর্ধেক রাত উঠানেতে হয় ধানের মলন মলা,
বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা।
দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায় কৃষাণীর কাজ ভারি,
ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি।
কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান,
কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান।’
ভালোবাসার ঘর গেরোস্তি
ধানের মওসুম শেষ হয়। অবসরের আনন্দে কৃষকের হাতে এখন কাস্তের পরিবর্তে বাঁশের বাঁশি। রূপাই সন্ধ্যা হলেই বাঁশি নিয়ে বারান্দায় বসে যায়। এতদিনের সব ভালোবাসাবাসি তারা আজ পূর্ণ করে নেয়। ধানকন্যার কাজে একে অপরের মুখের দিকে তাকানোর অবসর টুকু তারা পায়নি। নতুন সোহাগে আদরে দুটি প্রাণে ভালোবাসার বাণ ডেকেছে যেন। বাঁশি বাজাতে বাজাতে মধ্যরাত পার হয়ে যায়। ঘুমের দেশের রাজকন্যারা নতুন কৃষাণীর চোখের পাতায় ভর করে।
ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাঁজাইবে যদি বাঁশী,
সিঁদুর আজি পরিবনা ভালে, কাজল হইবে বাঁসি।
দেখ কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল,
আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল।’
‘বাঁশি বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে।’ রূপাই এবার বাঁশির প্রতি করজোড়ে প্রার্থনা করলো আজকে তার নিরব থাকা চলবে না। যদি আজ তার প্রাণের অধরা সিঁদুর না পড়ে, কানের দুল খুলে ফেলে রাখে, তবে সিঁদুরের রঙে সন্ধ্যা আর হবে না, ভোরের ফুলের হাসি আর দেখা হবেনা। তার চেয়ে এক হাত হয়ে যাক আজ। তার পানখীর অধর ছোঁয়া গানেই বাঁশির গলার ফাঁসি হয়ে যাক। বাঁশির সুর আরো মিষ্টি, আরও সুমধুরতর হয়ে উঠলো। কখনো বউয়ের ঠোঁট ছুঁয়ে, কখনো তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে রূপাই বাঁশিতে সুর তুলতে লাগলো।
‘পুনঃ জোর করে রূপা কহে, “এই অধমের অপরাধ,
ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!”
রূপার বলার এমনি ভঙ্গি বউ হেসে কুটি কুটি,
কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি।
পরে কহে, “দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও হাতে
এমনি করিয়া দোলাও তো দেখি নোলক দোলার সাথে।’
নোলকের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে বাঁশি বাজে। বউ টি তার বরকে বলে-
‘আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী-লতার হার?
এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর,”
তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর! ’
দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, “এরি মত,
তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত।”
রূপার বাঁশি বাজতে থাকে। বাঁশি শুনে শুনে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে সাজু। বাঁশির সুরে সুরে বাঁকা চাঁদ এসে যেন বউয়ের রাঙা মুখে পড়ে। ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে রূপা। আলতো করে চুলের বেণিটি খুলে ইচ্ছে মতো চুলের ফাঁকে হাত চালায়, বউয়ের রেশম নরম হাতটি বার বার বুকের কাছে টেনে নেয়। রাঙা দুটি পা আরো ভালো করে ছুঁয়ে দেখে, কুসুমের রঙে রাঙিয়ে দেয়। নিঃশ্বাসের ওঠানামা আরো কাছে থেকে অনুভব করে।
হঠাৎ রূপার মন বিষণ্নতায় ভরে উঠে। তার কাছে মনে হয় এই সুখের রাত হয়তো আর ফিরে আসবে না। সকালের রোদ উঠলেই শুকিয়ে যাবে ভোরের ফুল। এত টুকু আঘাত সইতে না সইতে যদি ভেঙে যায় এই সুখের ঠিকানা? দুটি দেহে দুটি প্রাণ এক কূলে একাকার, কখনো যদি অকূলের পাণে দুটি পথ দুদিকে বেঁকে যায়? অজানা আশঙ্কায় রূপার দুচোখের পাতা ভিজে যায়। সাজু ঘুম চোখে দেখে-
“ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল?
একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল?
ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?”
বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল!
বাহূখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে,
“শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!”
রূপার কাছে সংসারের সবকিছু শূন্য মনে হয়। কে যেন তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায় তার সাজুকে। বাঁশির করুণ সুর সে কথাই বলে যায়। রাত্রি শেষ হয়ে আসে। হঠাৎ কার যেন গলার হাক শোনা যায়।
গাজনা চরের কাইজা
বছির মামুর ডাকে হকচকিয়ে ওঠে রূপাই। সাধের গাজনা চরের মাঠ। চর জেগে ওঠার পর গফরগাঁয়ের লোকেরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসলের চাষ করেছে। আজ সে ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনগাঁয়ের লোকেরা। রূপার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দুচোখে আগুন ঝরে। শাবল, সড়কি, ঢাল মাজায় ঝুলিয়ে বের হয় রূপা। একে একে রূপাকে অনুসরণ করে রহম চাচা, কলম শেখ, ছমির মিঞা, খাঁ বাড়ির লোকজন, কাজীর ছেলে, কাজেম খুণী, গদাই ভূঁঞা, মোহন ভূঁঞার ভাইয়ের ছেলে প্রমুখ। আলী আলী রব করতে করতে এগিয়ে চলে গাজনা চরের দিকে। রূপার গর্জনে একে একে বেড়িয়ে এলো মোড়ল সহ গাঁয়ের লোকেরা। রূপা আগে আগে সবাই পিছে পিছে। বনগাঁয়ের মোল্লারা গাজনা চরের অর্ধেক ধান কেটে নিয়ে গেছে। গ্রামের লোকের সামনে রূপা তাই প্রতিজ্ঞা করল, যারা গতকাল কাঁচির খোঁচায় ধান কেটেছে, আজ তাদের নাকের ডগা বাঁধবে লাঠির মাথায়। বাদ্যের তালের ন্যায় কাঁসার থাল বাজাতে থাকে লোকেরা। যুদ্ধের দামামা বাজার ছন্দে এগিয়ে চলে লাঠিয়ালেরা। রামদা, কুঠার, লাঠি, হাঁসুয়া, যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয় রূপাই। আলী সাধন করে রূপা দুপুরের সময় মাঠে নামলো। তার পিছে পিছে হাজারো লাঠিয়াল। মন্ত্র জপ করে রূপা শূন্যের দিকে লাফ দিল, মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ দাঁত দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলো। আলী আলী শব্দ করতে করতে মটিতে বুক আর মুখ ঘর্ষণ করলো কয়েক বার। এর পর মাটিতে দাঁড়িয়ে বেশ কবার আলী আলী ধ্বনি করলো। সকল লাঠিয়াল এক যোগে আলী আলী, হযরত আলী বলে চিৎকার করে বনগাঁয়ের লোকেদের মুখোমুখি হলো। গফরগাঁয়ের লোকেরা ধাওয়া করে বনগাঁয়ের লোকেরা পিছু হটে, আবার বনগাঁয়ের লোকেরা এগিয়ে আসে গফরগাঁয়ের লোকেরা স্থান বদল করে। এভাবে সাত আট বার ঘটার পর রূপাই আলী আলী করে বনগাঁয়ের লোকেদের মধ্যে ঢুকে পড়ে আক্রমণ চালালো। তাল ঠুকে তারা বনগাঁর লোকেদের এলোমেলো করে দিল।
‘মার মার মার’ হাঁকল রূপা, মার মার মার ঘুরায় লাঠি’
ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি।
........................................................
মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে।’
বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রূপার লোকও ফিরল বহু
রূপা তবু নাচছে, গাঁয়ে তাজা-খুণের হাসছে লোহু।’
বাঁশি বাজিবে না আর
সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। রূপাই গেছে কাইজা করতে। লোকে লোকারণ্য চারিদিক। একে একে সবাই ফিরে আসছে। রূপাইর ঘরে ফিরে আসার নাম নেই। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে যায় বউ। তার মনে আশঙ্কা জাগে সে কি আর ফিরে আসবে না!
‘কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ,
তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ!
বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া,
আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই? নেচে ওঠে তার হিয়া।
আঁচলে বার বার চোখ মুছে, না, সে তো আসে না। দিনের আলোর শেষে রাতের অন্ধকার নামে। পথ ঘাট দেখা যায় না, তবুও অন্ধকারে পথের দিকে চেয়ে থাকে বউ। পথের যে অন্ধকার তার অধিক অন্ধকার ছেয়ে ফেলে সাজুর মন। একবার ঘরে আসে আবার বাইরে পথের পানে তাকিয়ে থাকে। নক্সী কাঁথাটি মেঝেতে বিছিয়ে সেলাই করতে বসে, হঠাৎ কার যেন পায়ের শব্দ শোনা যায়। একটি পাতা খসে পড়ার শব্দেও চমকে ওঠে সে। দরজা খুলে আলো হাতে নিয়ে বার বার পথের পানে তাকায়। মাঝে মাঝে পাখি ডাকে। কখনো মনে হয় পাখিটির মতো যদি পাখা থাকতো তাহলে উড়ে গিয়ে বন্ধুর খবর নিয়ে আসতো। নক্সী কাঁথায় সাজু প্রথমে কিছু ফুল আঁকে। প্রথমে বদনা বিয়ের গানের দিনের চার চোখের চাওয়া সে মুহূর্তটি ফুলের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখে। এরপর তাদের বিয়ের বাসর, রূপাইর বাড়ি আঁকলো। এমন সময় কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেলো। দুয়ার খুলতেই দেখা দিলো রূপাইর মলিন মুখ। তুমি এতক্ষণে এলে? আমার দেহে প্রাণ ছিল না, জানো? তুমি আর কক্ষণো কাইজা করতে যেওনা। তোমার লাঠি যাদের মাথায় পড়ে, তাদেরও তো ঘরে কচি বউ, ছেলেমেয়ে রয়েছে। বউয়ের মুখে এরকম অনেক কথা শুনে কেঁদে উঠল রূপা। সে বলল-
‘লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে
আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে।’
আগে যদি জানতাম বউ, ‘তবে কি এই রক্ত স্রোতে স্নান করতাম, আগে যদি জানতাম তবে কি তোমার বুকের মালা এভাবে ভাসিয়ে দিতাম, তোমার আঁচলের সোনা কি এভাবে খসে যেতে দিতাম? এরকম অনেক কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে রূপাই। বউ মনে করে রূপাই হয়তো শরীরের কোথাও আঘাত পেয়েছে সে কারণে ব্যথায় কাঁদছে। রূপাই বলে-
‘লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়
তোমার শাড়ীর আঁচল ছিড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়!
তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়–, ছিঁড়েছে গলার হার,
তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর।’
ফেরারি রূপাই
কাইজায় অপর পক্ষের অনেক লোক খুন হয়। সকলেই যে যার মতো পালিয়েছে। রূপাকে পুলিশ খুঁজছে। পিছু পিছু ধাওয়া করেছে। কাপড়ে তখনও রক্তের দাগ লেগেছিল। বউয়ের সাথে শেষ দেখাটি করার জন্য সে এসেছিল। আর কখনো চার চোখে চাওয়া হবে না দুজনের, আর দুটি পাখি এক ডালে বসে গান গাইবে না। ‘আমি আর আমার জন্য ভাবি না। তুমি যে লতা হয়ে আমার জীবনে জড়িয়ে ছিলে তার কি পরিণতি হবে’ এরকম আত্মজিজ্ঞাসা রপাইকে তাড়িত করে। কোনো প্রশ্নের উত্তরই আজ তার কাছে নেই-
‘হায় বনফুল, যেই গাছে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক,
সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ।’
রূপার অনেক কথাই মনে পড়ে আজ। যদি মা বেঁচে থাকতেন তবে পুত্র বধূকে আগলে রাখতেন। যদি একটি ভাই থাকতেন তবে ভাইয়ের বউকে সম্মানের সাথে রাখতেন। কিন্তু আজ কে দেখবে তার সাজুকে, কে তাকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করবে। সাজু বিদায়ের সময় এই কথা গুলি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। রূপাই তাকে ছেড়ে যাবে এ কথা ভেবে সাজুর মনে হয়-
‘সাজু কেঁদে কয়, “সোনার পতিরে তুমি যাইবে ছাড়ি,
হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি।
সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া
এ পোড়া রূপেরে কি দিয়ে ঢাকিব—ভেবে মরে মোর হিয়া।’
রাত শেষ হয়ে আসছে। মোরগ ডাকছে-
‘রূপা কয়, ‘সখি! যাই আমি─ রাত বুঝি নাই বাকি।’
সাজু জিজ্ঞাসা করে-
‘আর কিগো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন?’
‘রূপা ফিরে কয়—না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর,
ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়ার ধার।’
রূপাই শেষ কথাটি বলে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। রূপাই ফিরে আসে না। শূন্য উঠান খা খা করে। ঘর দরোজা ভেঙে পড়ে। সাজু মায়ের বাড়িতে যায়। সেখানেই দুঃখিনী মায়েরকোলে তার জীবন সন্ধ্যা নামে।
রেফারেন্স:
১। বাংলা পিডিয়া
২। নক্সী কাঁথার মাঠ
৩। "নক্সী কাঁথার মাঠঃ বাঁশি বাজিবে না আর"---(আমিরুল ইসলাম)