(৪)
জেগে উঠলো মানুষ নতুন করে
ক্ষিণ সুরে স্বাধীনতার ঘোষনাটি ভেসে এলো। স্বাধীনতার ঘোষনা শুনে দারুণভাবে উজ্জিবিত হয়ে উঠলো মানুষ। গাছপালা যেমন করে ঝড়-তুফানের পরে পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় বিভ্রান্ত মানুষ নতুন করে জেগে উঠলো। মেজর জিয়ার কন্ঠে বার বার ভেসে আসতে থাকলো স্বাধীনতার ঘোষনা। দিশেহারা মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো সংগ্রামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। মেজর জিয়ার কন্ঠ শুনে সামরিক সামর্থের ব্যাপারেও মানুষ আশ্বস্ত হলো।
দশ বারো জনের টগবগে বাঙালী সৈনিক একটি লরিতে করে এসে হাজির হলেন। তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পক্ষ ত্যাগ করে এসেছেন। তাদেরকে সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ফ্রন্টে। তাদেরকে দেখে মানুষের মধ্যে উচ্ছাশের ঢেউ খেলে গেলো। তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তারপর এক কনভয় বোঝাই জলপাই রঙের পোষাক পরা সেনারা এলো। তারা সাহায্যকারী ভারতীয় সেনা। মানুষের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে, পাকিস্তানী সেনাদের আর মখদুর নেই এদিকে আসার। শোনা গেলো মুক্তি বাহিনীর কমান্ডে আছেন মেজর সি আর দত্ত। জঙ্গী বিমান ব্যবহারের কথা পাকিস্তান তখনও অস্বীকার করে চলেছে। মুক্তি বাহিনীকে সরাসরি সহায়তা করার কথাও ভারত অস্বীকার করে চলেছে।
ভইটিকরের দিক থেকে ভেসে এলো প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ। হঠাত করেই শুরু হলো। ট্যা-ট্যা-ট্যা-ধুম। সময় বাড়ার সাথে গোলাগুলির প্রচন্ডতা বাড়তে লাগলো। কিছু সময় পর গুলির শব্দ ধীর হয়ে এলো। ভারতীয় সেনাদের কয়েকটি গাড়ি ফিরে যেতে দেখা গেলো। মানুষ বলাবলি করলো যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা বদল করা হচ্ছে। পরে দেখা গেলো সারিবদ্ধ কনভয় বোঝাই সেনারা চলে যাচ্ছে। তখনও ফ্রন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন গুলির শব্দ ভেসে আসছে। ভারতীয় সেনাদের চলে যাওয়া হয়তো কৌশলগত কারণ। কারণ তখনও ভারত মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদেরকে কাপুরুষ ঠাওরালো। বিদ্রুপাত্তক মন্তব্য করলো। মুক্তি সেনারা রয়ে গেলো ফ্রন্টে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালী যে সেনা দলটি এলো তাদেরকেও ফিরতে দেখা গেলো না। তারা কী অবস্থায় আছে, কেউ বলতে পারছে না। গ্রামের মানুষ উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়লো। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামে একজন ড্রাইভার ছিলেন। তিনি কোথাও হতে একটি মুড়ির টিন বাসগাড়ি নিয়ে হাজির। মানুষজন জটলা করে শলা-পরামর্শ করতে লাগলো। মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ে আসতে যাবেন কি না। শেষ পর্যন্ত অদম্য সাহসী লোকটি একাই গাড়ি নিয়ে ফ্রন্টের দিকে অগ্রসর হলেন। যে বাসটিকে পরে আর ফেরত আসতে দেখা গেলো না। ঘুটঘুটে নীরবতার মধ্য দিয়ে রাতটি কেটে গেলো।
আমাদের পুকুর ঘাট থেকে বড় সড়ক দেখা যায়। সেই সড়ক ধরে পাকিস্তানী সেনারা অনেক তফাত রেখে একজন একজন করে হেঁটে যাচ্ছে। কাধেঁ রাইফেল। মাথার হেলমেটে এ পাতালতা জড়ানো। আরো অনেক সেনা সব কিছু লন্ডভন্ড করে প্রামের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকে। পায়খানার পেছন দিয়ে। গোয়াল ঘরের পাশ দিয়ে। কেওয়া বনের ভেতর দিয়ে। অনেকের ঘর বাড়িতে আগুন দিতে দিতে সেনারা অগ্রসর হতে থাকে। সকাল ৮/৯টা হবে। পুকুর ঘাটে বসে আমরা একটি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। চায়নিজ রাইফেলের শব্দ। পাকিস্তানী সেনারা যে রাইফেল বহন করছে। এখান থেকে পোয়া মাইল পূবে বড় সড়কের লাগোয়া রজিদ আলীদের বাড়ি। পাটের মতো সাদা কাঁধ অবধি ঝাকড়া চুল। সুঠাম দেহ। আমেরিকা প্রবাসী রজিদ আলী এসময় দেশের বাড়ি এসেছিলেন। একজন পাকিস্তানী সেনা তাঁর দিকে এগিয়ে এলো। তাঁর কাছ থেকে এক গ্লাস পানি খেলো। তারপর ফিরে যাওয়ার সময় কয়েক পা গিয়ে তাঁর দিকে ফিরলো এবং তাঁর বুক বরাবর একটি গুলি করে চলে গেলো। পুকুর ঘাটে বসে এই গুলির শব্দটিই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম।