১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের যেভাবে নির্বিচারে হত্যা করা হয়ে ছিল তা বিশ্ব ইতিহসের এক কালো অধ্যায়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এই অপারেশনের সামরিক নাম দিয়ে ছিল “অপারেশন সার্চলাইট”। বুলেটর আঘাতে বাঙালীদের দ্রোহকন্ঠ চিরতরে বন্ধ করার ব্যার্থ চেষ্টায় নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছিল এই দিনে, যা দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলতে থাকে। এই গণহত্যায় শহীদ হন ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ, সম্ভ্রম হারায় আড়াই লক্ষ মা-বোন। আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর, জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি পেল বাঙালী নিধনের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিটি। গত ১১ মার্চ ২০১৭, জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চকে “গণহত্যা দিবস” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। এর কয়েক দিন আগেই এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলে ছিলেন, “যেহেতু ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে শুধু দেশে নয় বিদেশেও পালিত হয়, সুতরাং এই দিবসটি জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি না পাওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না।” ফলশ্রুতিতে আজ শনিবার (২৫ মার্চ ২০১৭) আমরা রাস্ট্রীয় ভাবে প্রথমবারের মত “গণহত্যা দিবস” পালন করছি।
কি ঘটে ছিল ঐ “অপারেশন সার্চলাইটে” সে কথা আমাদের জানা দরকার কিন্তু এতো সংক্ষিপ্ত পরিসরে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে বাঙালী নিধনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবুও সামান্য ধারনা দেবার জন্য “অপারেশন সার্চলাইট” বা ”গণহত্যা ” সম্পর্কে কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও বাঙালদের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হচ্ছেনা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসর্কোস ময়দানে বক্তৃতা করলেন। আমাদের দাবি পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য ঢাকায় আসলেন। ১৮ মার্চ থেকে আলোচনা চলছে, চতুর্থ দিন ২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আড়াই ঘণ্টা ধরে বৈঠকের পরও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কোনো প্রস্তাব মেনে না নিয়ে নতুন নতুন ফর্মুলা দিতে শুরু করলেন। আলোচনায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এম কামারুজ্জামান ও ড. কামাল হোসেন অংশ নিয়ে ছিলেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, “আমরা আমাদের স্বাধিকারের মূল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ফর্মুলাই মেনে নেব না।” প্রেস ব্রিফিংসের পর বঙ্গবন্ধু সরাসরি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীতে এসেে আর একাট বিবৃতি দিলেন, “আগামী ২৩ মার্চ “লাহোর প্রস্তাব দিবস” উপলক্ষে সাধারণ ছুটি থাকবে”। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, 'একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সবাই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রয়েছে। চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম চলতেই থাকবে।' এই আলোচনার ফাঁকে ইয়াহিয়া, টিক্কা খান ও তাদের দোসররা বাঙালি নিধনের নীলনকশা চুড়ান্ত করে ফেলেছে। নাম দাওয়া হয়েছে “অপারেশন সার্চলাইট”।
“অপারেশন সার্চলাইট” এর মূল লক্ষ্য ছিল ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, বর্তমানে বিজিবি) ও পুলিশসহ বাঙালী সেনা সদস্যদের নিরস্ত্র করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ আওয়ামীলীগ নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ১৬ জন ব্যক্তির বাসায় হানা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা। মূল অপারেশনের সময়সীমা ছিল রাত একটা। কারণ প্রেসিডেন্ট তখনও আলোচনার নামে ঢকায় অবস্থান করছে। মধ্যরাতে শুরু করলে এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতাকামী বাঙালী ছাত্র-জনতা আগে থেকেই রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলো, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় গাছের গুড়ি ও ইট ইত্যাদ্দি দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এ রাতেই (২৫ মার্চ) বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হল, বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার অপারেশনটির নাম ছিল “অপারেশন বিগ বার্ড”। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ ঘটনার নায়ক ছিল ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খান। একাত্তরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থার্ড কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দায়িত্বে ছিলেন মিঃ জহির। ২৩ মার্চ তিনি ঢাকায় আসেন এবং চীফ অব স্টাফ অফিসে দেখা করে জানতে পারেন ২৪ কিংবা ২৫ মার্চ শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে তাকে। ২৪ তারিখ সকাল ১১টায় এক সাক্ষাতকারে চীফ অব জেনারেল স্টাফ জহিরকে নিশ্চিত করেন ২৫ মার্চ রাতেই মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হবে। সে মত বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে, শুরু হলো বাঙালী নিধনের অপারেশন সার্চলাইট। নয় মাস ধরে নির্বিচারে হত্যা করা হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের।
এই গণহত্যার থেকে বাদ যায়নি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলা। দেশের উত্তর অঞ্চলের নওগাঁ জেলায় এ পর্যন্ত অন্ততঃ ৪০ টির মত গণকবর বা বদ্ধভভূমি গণহত্যার স্বাক্ষী হিসেবে প্রমান দিচ্ছে। কত অগুনিত মানুষ এই “অপারেশন সার্চলাইট” নামক গণহত্যার স্বীকার হয়ে ছিল তা ঐ রক্ত হিসাবেই শুধু লিখা। নওগাঁ জেলার উপজেলা ভিত্তিক গণকবর বা বদ্ধভূমি গুলো হচ্ছেঃ- নওগাঁ সদর উপজেলা ১০টি : (এক) ধামকুড়ি, (দুই) দোগাছি, (তিন) ফতেপুর, (চার) পার-বোয়ালীয়া, (পাঁচ) মোহনপুর, (ছয়) বলিহার, (সাত) আরজি-নওগাঁ, (আট) হাট-নওগাঁ, (নয়) খাস-নওগাঁ ও (দশ) পার-নওগাঁ। আত্রাই উপজেলা ০৯টি : (এক) বান্দাইখাড়া, (দুই) সিংসাড়া, (তিন) মিরাপুর, (চার) বেঠাখালি, (পাঁচ) পাইকড়া, (ছয়) আহসানগঞ্জ পুরাতন রেল স্টেশন, (সাত) বাউল্লাহ পাড়া, (আট) গোয়ালবাড়ী ও (নয়) তাড়াটিয়া। রানীনগর উপজেলায় ০১টি : (এক) আতাইকুলা। মান্দা উপজেলায় ০৪টি : (এক) পাকুড়িয়া, (দুই) মনোহরপুর, (তিন) কবুলপুর ও(চার) কিত্তলী। মহাদেবপুর উপজেলায় ০২টি : (এক) বাজিতপুর-চকদৌলত, (দুই) মহিষবাথান। সাপাহার উপজেলায় ০৩টি : (এক) সাপাহার, (দুই) আসড়ন্দ (তিন) কল্যাণপুর। পোরসা উপজেলায় ০১টি : (এক) শিশাহাট। পত্নীতলা উপজেলায় ০১টি : (এক) নিরমইল-হালিমনগর।
ধামইরহাট উপজেলায় ০৩টি : (এক) ফার্শিপাড়া (গ্রামের দক্ষিনে দুটি, উত্তরে একটি), (দুই) কুলফৎপুর, (তিন) পাগল দেওয়ান (২০০ মিটারের মধ্যে দু’টি, একটি নওগাঁ জেলায়, অন্যটি জয়পুরহাট জেলায়)। বদলগাছি উপজেলাঃ ০৫টিঃ (এক) গয়েশপুর, (দুই) পাহাড়পুর (বৌদ্ধ বিহার) (তিন) ডাঙ্গিসারা, (চার) চক-বোয়ালী, (পাঁচ) কোলাহাট। নিয়ামতপুরঃ ০১টিঃ (এক) ভাবিচা। উল্লেখ্য ধামইরহাট উপজেলার পাগল দেওয়ান গণকবরটি জেলা সবচাইতে বড় গণকবর বলে বিবেচিত। কারণ এখানে পাকিস্তান আর্মি যুদ্ধকালিন ক্যাম্প ছিল এবং মেজর আফজাল বেগ এই গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়ে ছিল । এই গণহত্যায় সহযোগী হিসেবে প্রমানিত হওয়ায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জয়পুরহাটের প্রবীণ রাজনীতিক বিএনপি নেতা আব্দুল আলিম (আলিম সাহেব) এর আমৃত্যু কারাদন্ড হয়।
সমর কৌশল ও রাজনৈতিক এই দু’টো কারণে পাকিস্তান হানাদার কতৃর্ক ধামইরহাট উপজেলা বেশি নির্যাতিত্ব ও গণহত্যার স্বীকার হয়। এক. ধামইরহাটের ভৌগলিক অবস্থান মিত্রবাহিনী বা ভারত ভুখন্ডের অনেকটা পেটের মধ্যে যার তিন দিক ভারতীয় সীমান্ত এবং হিলি ল্যান্ডপোর্ট ও ভারতীয় জেলা শহর বালুরঘাট (দক্ষিন দিনাজপুর, তৎকালে মহকুমা) এর খুব কাছাকাছি। বাংলাদেশের অভন্তরে অপারেশন করে মুক্তি বাহিনী খুব সহজেই ও দ্রুত ভারতে ফিরে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারত। দুই. ধামইরহাটের ফার্শিপাড়ায় পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাফ্ফর রহমান চৌধুরীর (এমএলএ) বাড়ী। এপ্রিল কি মে মাসে(?) মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে নিজ বাড়ীর সামনেই চৌধুরী সাহেব নিহত হলে ফার্শিপাড়ায় পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করে এবং নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ফার্শিপাড়া চৌধুরী বাড়ীর পার্শেই প্রাথমিক বিদালয়টি (বর্তমানে পরিত্যাক্ত) রক্তের স্বাক্ষী হয়ে আজও আমাদের দ্রোহ চেতনাকে নাড়া দেয়। এছাড়াও কুলফৎপুর গ্রামে পুকুর পড়ের বটগাছের নীচে এক রাতেই ১৪ জনকে ব্রাস ফায়র করে গণহত্যা করে ছিল পাকিস্তান দানাদার বাহিনী। দুঃখের সাথে বলতে হয়, বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের এই রক্ত স্মৃতিগুলোকে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পরেও সংরক্ষনের তেমন কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০১৫ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার “ওয়ার্ল্ড জেনোসাইট ডে” পালন উপলক্ষ্যে ফার্শিপাড়া গণকবরটি সংষ্কার করতে গেলে কোন এক মহলের বাধার সম্মুক্ষিন হয়ে নির্ধারিত প্রোগ্রাম পরিবর্তণ করতে বাধ্য হন এবং কুলফৎপুর গিয়ে মমবাতি প্রজ্জলনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। সেই কুলফৎপুরে সেদিনের শহীদদের নামাংকিত একটি অরক্ষিক ফলক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। অপর পক্ষে পাগল দেওয়ান গণকবর বা বদ্ধভুমিটি মাত্র কয়েক বছর আগে দু’হাত উচুঁ পাচঁ ইঞ্চি ইটের প্রচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে মাত্র। হালে এসে পাগল দেওয়ান সিদ্দিকীয়া ফজিল মাদ্রাসা তাদের নিজ উদ্যোগে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে শিক্ষক শিক্ষার্থী এলাকাবসী সমন্বয়ে একটা র্যালী বের করে গণকবর পর্যন্ত যায় ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু আমাদের দ্রোহ-প্রতীক ধামইরহাটের গণকবর গুলোর যথাযথ সংরক্ষণ না করলে নিকট ভবিষতে তা ভুমিদস্যুদের হাতে বিলিন হয়ে যাবে এবং নতুন প্রজন্ম খুজেঁ পাবেনা তাদের পূর্বপুরুষ বাঙালীদের উপর চালানো পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পরিচালিত “অপারেশন সার্চলাইট” নামের বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃণতম গণত্যার ঘৃণতম ইতিহাস। আজ জাতীয় ভাবে পালিত গণহত্যা দিবসে (প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসে) সরকারের কাছে আবেদন এই গণহত্যার জীবন্ত প্রামান গুলো আগামী প্রজন্মের জন্ম সংরক্ষনের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৯:৫০