খুব ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম শিক্ষক হবো। স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। ঐ মাস থেকেই প্রাথমিক শিক্ষার সাথে জড়িত আছি। বিগত চার বছরে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে থেকে অনেক কিছুই জানলাম যা আগে জানতাম না। সবচেয়ে অবাক হলাম এই জেনে যে, আমরা সহকারি শিক্ষকগণ যে পদে আছি তথা সহকারি শিক্ষক নামক কোনো পদ প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসনিক কাঠামোতে নাই। হায়রে আমার স্বপ্ন! এ যেন দূর থেকে দেখা মরিচীকার মতোই। সহকারি শিক্ষকের ব্যাখ্যা যদি হয় শিক্ষকের সহকারি তবে আমি যে কোন মহান শিক্ষকের সহকারি তা আমার আজও জানা হলো না। আমাদের চাকরিটা হলো অবকাশ বিভাগে তাই ছুটির ক্ষেত্রেও আমরা বৈষম্যের শিকার হই। সরকারি মতে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন হলেও আমরা পাই একদিন। বিভিন্ন উৎসবে লম্বা ছুটি থাকলেও তাও আবার পঞ্চম শ্রেণির সমাপনীর অজুহাতে অনেক সহকারি শিক্ষকের কপালে তা জুটেনা। বিগত চার বছরে প্রধান শিক্ষকের হাতে সংরক্ষিত ছুটি তিনদিনের একদিনও আমরা পাইনি। মনে প্রশ্ন জাগে ঐ তিন দিনের ছুটি আসলেই কি প্রধান শিক্ষকের হাতে সংরক্ষিত নাকি শুভংকরের ফাঁকি? প্রতিদিন সাত থেকে আটটি ক্লাস একজন সহকারি শিক্ষককে নিতে হয়। এরপর প্রধান শিক্ষককে অফিশিয়াল কাজেও অনেক সহকারির সহযোগিতা করতে হয়। সুতরাং সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটার আগে বিদ্যালয় ত্যাগ করা কোনো সহকারি শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এরপর আবার উপরের বড় কর্মকর্তাদের নির্দেশ পাঠ পরিকল্পনা ছাড়া ক্লাসে যাওয়া যাবে না। যারা এসি কক্ষে বসে এমন সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা দয়া করে বলবেন কি, যদি বাড়িতে বসে কোনো শিক্ষক কম করে হলেও ছয়টা বিষয়ের উপর পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করেন তবে তার কত সময় লাগবে? আপনাদের ভাষায় তবে কী আমরা সহকারি শিক্ষক সবাই রোবট নামক যন্ত্র? আমাদের কোনো পরিবার থাকতে পারবে না, পরিবারের পিছনে আমরা কোনো সময় ব্যয় করতে পারবো না। চব্বিশ ঘন্টার পুরোটাই শিক্ষকতার মহান পেশায় ব্যয় করতে হবে? আমাদের উপরের কর্মকর্তরা সহকারি শিক্ষকদের ভুলত্র“টি ভালোই চোখে দেখতে পান, কিন্তু তাদের অফিসের অফিস সহকারিরা যে তাদের নাকের ডোগায় বসে অনিয়ম করেন তা তারা মোটেও চোখে দেখেন না। প্রায় প্রতিটি অফিসেই অফিস সহকারিরা নিরীহ সহকারি শিক্ষকদের সার্ভিস বুক খোলা, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট যুক্ত করা, উন্নিত বেতন, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, বকেয়া বিল, টাইম স্কেল, জিপিএফ একাউন্ট খোলা, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে অনুমতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জিম্মি করে উৎকোচ আদায় করে থাকেন। প্রতিটি অফিসের সিস্টেমটা এমন যে, অফিসের বড় কর্মকর্তারা অফিস সহকারিদের অনুস্বাক্ষর ছাড়া কোনো ফাইলেই স্বাক্ষর করেন না। আর এই সুযোগটাই অফিস সহকারিরা হাত ছাড়া করেন না। ইদানিং বিভিন্ন চ্যানেলে কয়েকজন ডক্টোরেট ডিগ্রিধারি প্রথম শ্রেণির কর্মকতারা টক শোতে অতি আবেগি হয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রতিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের কোনো দরকার হয় না। তাদের জীবন মান উন্নয়নের কেনো প্রয়োজন নাই। আসলে ওনারা এতো উঁচুতে উঠে গেছেন যে, নিচের শ্রেণির মানুষদের তাঁরা দেখতে পান না। আমি তাদের বলবো যদি তাই মনে করেন অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার বর্ণমালাগুলো ছাড়া আপনারা চলতে পারবেন তবে আমাদের বর্ণমালাগুলো দয়া করে আর ব্যবহার করবেন না, যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভুলবশতঃ বর্ণমালা গুলো শিখেছিলেন সেখানেই রেখে আসুন। হে ডক্টোরেট ডিগ্রিধারিরা একটা কথা মনে রাখবেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে ফসলের বীজ উৎপাদনের মত শিক্ষিত জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। যে শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে পাটদান করার সময় চিন্তা করতে হয় আজ ঘরে ভাত রান্না হবে কিনা, দোকানের দেনা পরিশোধ করতে পারবে কিনা, তার কাছ থেকে কখনোই ভালো পাঠ আশা করা যায় না। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে রাখতে হবে। আপনাদের ডক্টোরেট করা বড় বড় মাথায় এসব বিষয়গুলো না আসলেও প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যারফলে তিনি স্বাধীনতার পরে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। একবিংশ শতাব্দিতে এসে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বেই বর্তমান সরকারের আমলেই ২০১০ সালে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় নিয়োগ এই প্রাথমিক শিক্ষাতেই হয়েছে। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধুর মত তিনিও সকল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছেন। সহকারি শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষদের বেতন ভাতাদি বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু আপনারা সেটা বোঝেন না। আর বোঝেন না বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা স্বত্তেও ৯ মার্চ চলে গেল, নতুন বাজেট ঘোষণা হলো, কিন্তু আমরা এখনো নতুন উন্নিত স্কেলে বেতন ভাতাদি পাইনি। জানি না কবে পাবো। এত বৈরিতার মাঝেও শান্তি এক জায়গায়। গাঁয়ের পথ দিয়ে যখন হেঁটে যাই, আমার স্কুলের কোন অবুঝ শিশু যখন আমাকে দেখে সালাম দেয়। তখনই মনটা ভরে যায়। কারণ আমার বিস্বাস এই সালামটিতে কোনো কৃত্রিমতা নাই। এই আবুঝ শিশুদের দোয়ায় আমরা সহকারি শিক্ষকরা সকল দুঃখ কষ্টকে বরণ করে হয়তো আজ সমাজে টিকে আছি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:২১