কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে শুদ্ধ কোরান পাঠ। এক কথায় কোন কর্তা পর্যায়ের লোক হতে হলে পাক্কা মুমিন হতে হবে।
হুজুররা ওয়াজে অনেক সময়ই জোশের বশে অনেক কিছু বলে ফেলেন। এই বক্তব্যকে সেভাবে নেয়ার সুযোগ নাই । হুজুর খুব বেশি অলিক স্বপ্ন দেখছেন না হয়ত।
চারপাশে তাকালে এখন কেবলই হিজাব, দাঁড়ি, টুপি। আগে রাস্তায় বের হলে ১০০ জন মানুষের মধ্যে হয়ত ২০ জনকে পাওয়া যেত দাঁড়ি টুপিওয়ালা। তারাও নিজের মত নিজের ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাকি ৮০ জন যে নাস্তিক ছিলেন তা না, তারাও হয়ত মুসলমানই। কিন্তু বাস্তবতা বুঝে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আঁকড়ে ধরেছিলেন আধুনিকতা।
একটা এলাকায় এখন ৩০/৪০ টা করে মাদরাসা। বাড়িয়ে বলছি না একদম। সেদিন অন্য এক এলাকায় গিয়েছিলাম কাজে। একটু হাঁটতেই ৫০০ মিটার এলাকার মধ্যে অন্তত ২০ টা মাদরাসা চোখে পড়ল। একটা এলাকায় কতজন বাচ্চা থাকে? ৫০০? ১০০০? তাদের জন্য শিক্ষার স্থান ২০ টি মাদরাসা আর দুইটি স্কুল। তাহলে সে বাচ্চাগুলোর অধিকাংশই যাবে মাদরাসায়। মাদরাসায় যদি পড়ালেখা করেও তারা কি করতে পারবে ভবিষ্যতে, কি শিখবে? আচ্ছা সেদিকে পরে আসছি।
ইদানিং প্রচন্ড গরম পড়ছে। তীব্র তাবদাহে মানুষ হাসফাস করছে। ছোটবেলা থেকে দেখেছি এমন গরমে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কথা বলত, নিজের বাচ্চাকে সুস্থ রাখা, কেন আরো বেশি গাছ লাগানো উচিত এসব নিয়ে কথা বলত। কখনো শুনিনি মানুষ নামাজ পড়ছে বৃষ্টি নামানোর জন্য। ইস্তেস্কার নামাজ বলে যে কিছু আছে তাই জানতাম না। হ্যা, হয়ত গ্রামগঞ্জে কোথাও হত এই নামাজ। কিন্ত এখনকার মত জাতীয় টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করে কি হত এই নামাজ? কতজন জানত এর নাম?
ছোটবেলায় দেখতাম খরা হলে গ্রামে গ্রামে গায়েনরা "আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে" বলে গান করত, ব্যাঙ এর বিয়ে দিত। কুসংস্কার তো বটেই। কিন্তু এই যে তখন আর এখনের মনোজগতে যে বিরাট পরিবর্তন এটা একদম স্পষ্ট।
আজকের বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি যদি ইসলাম কে সামান্য সমালোচনা করেও কোন কিছু বলে তাহলে তাকে যেতে হয় জেলে। ইসলাম লাগে না, কোন হুজুরের ভন্ডামি তুলে ধরলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে আজকালের বাঙ্গালী মুসলমানের। কিন্তু ওয়াজের মাঠে অনবরত হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদী ধর্ম নিয়ে যাচ্ছেতাই ভাষায় কথা বললেও সেটা ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগতে পারেনা কারো। সেটা হয় ৯৫% মুসলমানের বাকস্বাধীনতা!
মোল্লা মুন্সিরা সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘন্টা ইসলাম প্রচার করলেও কোন সমস্যা নাই। কিন্তু যদি কোন খ্রিষ্টান মিশনারি তার ধর্ম প্রচার করে তাকে খেতে হয় গনধোলাই।
কিন্তু ধর্মান্তরিত পূর্বপুরুষের উত্তরসূরী বাঙ্গালীর মানসপটে কেন এমন পরিবর্তন? এই বাঙ্গালী কি জানে কয়েক পুরুষ পিছনে গেলেই সে দেখবে তার আদিপুরুষ ছিল হয় হিন্দু, নাহয় বৌদ্ধ? যাহোক, সে অন্য আলোচনা।
বাঙ্গালীর এই পরিবর্তনের পিছনে যে জিনিসটা সবচে বড় ভূমিকা রাখছে তা হল- "ওয়াজ"। হ্যা, ওয়াজ।
আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগেও ওয়াজ ছিল। সাইদী ওয়াজ করতে সে কিভাবে নাসায় গিয়ে কোরান শরিফ দেখেছে, সে কিভাবে নীল আর্মস্ট্রং এর সাথে কথা বলেছে। বলা বাহুল্য, এসবই ডাহা মিথ্যা। তবে এসব ওয়াজের একটা নির্দিষ্ট শ্রোতাকুল ছিল। তখন ওয়াজের ক্যাসেট, সিডি বিক্রি হত। এবং অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে একটা অংশ সাইদীর কাছ থেকে নাসার গল্প শুনত। তারা হয়ত কখনো নাসার নামই শুনেনি। শীতকালে গ্রামে গঞ্জে ওয়াজ হত। একদিকে ওয়াজ হত, উন্যদিকে গ্রামে যাত্রাপালা, জারি সারি গান, পালাগান এসবের আয়োজন হত। একই দিনে না হয়ত। কিন্তু কম বয়সী ছেলেপেলেদের টেনেটুনেও নেয়া যেত না ওয়াজে। তারা অপেক্ষা করত পরদিনের পালাগান, কবিগানের জন্য।
চিত্র বদলাতে শুরু করল যখন মেমরি কার্ডওয়ালা ফোন বের হল। ক্যাসেট থেকে সাইদি জায়গা করে নিল মেমরি কার্ডে। শ্রোতাকুল বাড়ল ঠিকই কিন্তু আহামরি বেশি না। ২০১৬/১৭ সালে সিম্ফনি বেশ কম খরচে স্মার্টফোন বিক্রি করতে লাগল, মোবাইল ইন্টারনেটের দাম কমল হু হু করে। পরের কয়েক বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারি বাড়তে থাকল জ্যামিতিক হারে। প্রথমদিকে ছাত্র, চাকরিজীবীরা ব্যবহার করা শুরু করলেও পরের কয়েক বছরে একদম প্রান্তিক মানুষের হাতে পৌছে গেল ইন্টারনেট। করোনার সময় এই ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছাল। এর সাথে সাথে সাইদীরা পৌছে গেল হাতে হাতে। আজহারীর নীল আর্মস্ট্রং এর ইসলাম গ্রহণ করার বানোয়াট গল্প পৌছে গেল হাতে হাতে। আর স্বল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ওয়াজ সীমাবদ্ধ থাকল না। ফেসবুক, ইউটিউবে ওয়াজ হয়ে উঠল প্রধান কন্টেন্ট। আগে গ্রামে শীতকালে একটা ওয়াজ হলে এখন প্রতিদিন ৩/৪ টা করে ওয়াজ হচ্ছে। সেগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউবে। ইউনিভারসিটির বাংলার ছাত্রও এখন হুজুরের ওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমায়।
একটু আগে বলছিলাম মাদরাসা শিক্ষার কথা। একটা ছেলে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে যদি কোন কোম্পানিতে যায়, তাকে হয়ত দারোয়ানের চাকরি দেয়া হবে সর্বোচ্চ। তাদের রুটিরুজির জন্য নির্দিষ্ট কিছু পথ আছে। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক কিংবা "বক্তা"। ব্যাস! বাস্তবতা, আধুনিকতা, বিজ্ঞান থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা "বক্তা" কথা বলতে থাকেন যাবতীয় সবকিছু নিয়ে। এমনকি বিজ্ঞান নিয়েও। আর তা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আমজনতা।
সবাই মিলে স্বপ্ন দেখছে এই দেশ হবে আফগানিস্থান। কায়েম হবে শরীয়া শাসন।
প্রথমে যে হুজুরের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই হুজুর মনে হয়না বাড়িয়ে বলেছেন। আর বিশ থেকে ত্রিশ বছর পর "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ" হবে "ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ"!
সেসব রাজনীতিবিদরা মানুষের চোখে ধর্মের পট্টি বেধে তাদের ভুলিয়ে রাখছেন জনগনের বাকস্বাধীনতার কথা, ভোট দেয়ার অধিকারের কথা, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা; আর নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মত ধান্ধাবাজ "প্রগতীশীল"রা নিয়মিত ইকো করে যাচ্ছেন সেসব রাজনিতিবীদদের কথা, আপনাদেরকে বলছি, সময় বেশি নাই, যেই সাপ আপনারা পুষছেন সেই সাপ সবার আগে ছোবল দিবে আপনাদেরকেই!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৫