রাত্রি বেলায় সবাই ঘুমাইয়া পরিলে চুপি চুপি আমার অবাধ্য ছাত্রটি আসিয়া আমাকে কহিল ”স্যার আমি যুদ্ধে যাইতে চাই”। আমি ভুল শুনিলাম কিনা ভাবিয়া লইলাম। আজ পর্যন্ত সে যাহাই করিয়াছে তার সব কাজের জন্য সকলেরই বিরক্তের কারন হইয়া দাড়াইয়াছে। পড়ালেখায় অমনোযোগী আর সব বিপরীত মুখী কাজকর্মের দুরুন তার কোন কথাই আমার কানে যাইতোনা। কিন্তু আজ তার কথাটি আমার কানে ঢুকিয়ায় সমস্থ অঙ্গ জুড়িয়া একটা শিহরন সৃষ্টি করিল।
কহিলাম তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করিলেই পারো। উত্তরে সে কহিল, আজ পর্যন্ত বাবা আমার কোন কথাই রাখেনাই। বলিলে রাগান্বিত হইয়া পিঠুনি দিবে নিশ্চিত। আমি আপনার অনুমতি পাইলেই হয়। আপনি আমাকে বকাবকি করেন, মারেন ভালর জন্যই পুনঃরায় তো আদরও করেন। আমি না বলিয়াও যাইতে পারিতাম কিন্তু আপনার আশির্বাদ না নিয়া যাইতে মন সায় দিলোনা।
ভাবনায় পরিয়া গেলাম। অন্যের সন্তানকে এভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে যাইবার কি করিয়া অনুমতি দিই? আমার তো ছাত্র মাত্র। তার বাবার সহিত পরামর্শ করিতেই হয়। তার কথায় এসব ভাবনায় ছেদ পরিল। আপনি বাবাকে বলিতে গেলে আমার যাওয়া আর হইবেনা। আমি অপদার্থ, নিজের পায়ে দাড়াইয়া কোন উন্নতি করিয়া পরিবার, দেশের তো কোন উপকার করিতে পারিবো না। অন্তুত যুদ্ধে যাইয়া দেশের জন্য নাহয় কিছু করিতে পারি কিনা।
সেইদিন পড়ালেখায় অমনোযোগী অপ্রিয় ছাত্রটিকে অশ্রুস্বজল চোখে অনুমতি দিতে বুকটা আমার ফাঠিয়া গেলেও তার এহেন সিদ্ধান্তে গর্বে আমার বুকখানা ভরিয়া গেল। কহিলাম, যা।
পরদিন সকাল হইয়া বিকেল গড়িয়ে রাত্রি আসিয়া পরিল। তাদের বড় ছেলের কোন খোঁজ নেই। ছেলে হারাইয়অছে সেই দুঃখে যে একটু চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া বুক ভাষাইয়া চারিদিকে খোঁজ খবর লইবে তাও করিতে পারেনা। কারন, তখন কোন জোয়ান ছেলে যুদ্ধে গেলেই সবাই চালাকি করিয়া বলিত ছেলে হারিয়ে গিয়াছে। প্রায় প্রত্যেকের ঘরেই যখন ছেলে হারানোর হিড়িক পরিতে লাগিল, তখন এটাতে সেই হায়েনাদের সন্দেহ ঢুকিয়াছে বলিয়া কেহ আর ছেলে হারাইয়াছে বলিয়া বিলাপ করিতে সাহস পাইনা।
একদিকে ছেলে হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে হায়েনাদের ভয়। কি আর করিবে? নিরবে, নিভৃতে কাদিঁয়া চোখের জলে বুক ভাসায়। তাদের তো আর ছেলে যুদ্ধে যায়নাই যে মিলিটারীদের সামনে মায়া কান্না করিয়া তাদের চোখে ধুল ছিটাইবে। কিন্তু তাহারা সত্যিকারের কান্নাই করিতেছে। তাদের যে সন্তান হারাইয়াছে সত্যি সত্যিই। সত্যিই কি ছেলে হারাইয়াছে সেটার সত্যিটা তো আমিই জানিতাম। কিন্তু সেই সত্যি গোপন করিয়া আমিকি ভুল করিতেছি??
কিভাবে জানি মিলিটারী হায়েনারা খবর পাইয়া গেল তাদের ছেলে হারাইয়া গিয়াছে। তার মানে যুদ্ধে গিয়াছে। আসলেই যে ছেলে হারাইয়াছে সেই কষ্টের কথা মিলিটারীদের কে বুঝাইবে ? যাহাই সন্দেহ করিলাম তাহাই হইলো। ছেলের পিতাকে ক্যাম্পে তলব করা হইলো। পরদিন সকাল বেলা নিশ্চিত হাজিরা না দিলে মরন নিশ্চিত। হাজিরা দিলেও ছেলে যুদ্ধে গিয়াছে অপরাধে তাহাকে সাজা (নিশ্চিত মৃত্যু) ভোগ করিতেই হইবে দেখিয়া আমি আগপিছ না ভাবিয়া কহিলাম, আপনাদের এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই উত্তম হইবে।
উনি কহিলেন, কিন্তু কোথায় যাইবো এতগুলো মানুষ??
কহিলাম, সে আমার উপর ছাড়িয়া দিন। যা করার আজ রাতেই করিতে হইবে। সবাইকে বলেন, রাত্রিবেলায় যেন সবাই তৈরী থাকে। আপনি ছোটজনকে (ছাত্রের চাচা) বলিয়া দুইটা নৌকা ঠিক করিতে বলেন। কোথায় যাইবো সে কথাও আপাতত কাউকেই বলিবার প্রয়োজন নাই। কে কোন চাপের মুখে সত্যিটা বমি করিয়া দেয় তার কোন নিশ্চয়তা নাই।
মাঝ রাত্রিতে সবাইকে লইয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। তিন পরিবারের প্রায় ২৫ জনের মতো সদস্য সংখ্যা নিয়া দুইটি নৌকায় বোঝাই হইয়া অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করিলাম। গন্তব্য তাহাদের অজানা হইলেও আমার কিন্ত অজানা নয়। আমাদের বাড়িতে নেয়াটা ঠিক হইবেনা। কারন, পাশের গ্রামেই নাকি পাকিস্তানী হায়েনা মিলিটারীরা ক্যাম্প বসাইয়াছে। রাজাকারের বাচ্চারা তাদের দোলাভাইদের নিকট নিশ্চিত খবর পাঠাইয়া দিবে। তাই আমার শ্বশর বাড়িতেই যাইবো বলিয়া মনস্থির করিলাম। একা বিশাল বাড়ি। চারিদিকে গাছপালায় ঢাকা নির্জন বাড়িটিতে যে এতগুলো মানুষ আসিয়া অবস্থান করিতেছেন আশপাশের লোকজনও জানিবেনা । খানাপিনারও তো একটা বিষয় আছে। এতগুলো মানুষের খাবার দাবারের আয়োজনইবা আমি স্বল্প আয়ের মানুষ কি করিয়া করি?
হঠাৎ ঘটনাটা ঘটিয়া যাওয়ায় শ্বশুর মশাইকেও জানানোর সুযোগ হইলো না। না জানি কি মনে করেন উনি আবার। যাক আল্লাহ ভরসা। দীর্ঘ তিন ঘন্টা চলিবার পর নাউ ভিরাইলো মুন্সির হাট বাজারে। আগেই বলা ছিলোযে, সবাই যেন এক সাথে দল বাধিঁয়া হাঁটা না করে। তাতে কেউ সন্দেহ করিতেও পারে। তিন চার জন করিয়া আমাকে অনুসরন করিলেই হয়। খেয়া ঘাটে কতো মানুষ আসে যায়, তাতে কেউ আর সন্দেহ করিতে সক্ষম হইলোনা। সবাইকে নিয়ে আমি ভোর বেলায় শ্বশুরালয়ের দরজায় কড়া নাড়িলাম।
শ্বশুর মশাই দরজা খুলিয়া আমাকে দেখিয়া কহিলেন আপনি আসিয়াছেন ? কহিলাম, আমার সাথে কিছু মেহমান ও আছেন। শ্বশুর মশাই এমন ভাব করিলেন যেন তিনি সব আগে থেকেই জানিতেন। কহিলেন, আরে সবাইকে বাহিরে দাড়ঁ করিয়ে রাখিয়াছেন কেন? ভিতরে নিয়া আসেন। এতগুলো মানুষ সবাই যে যে দিকে পারিল গাদাগাদি করিয়া কেউ দাঁড়িয়ে কেইবা বসিয়া পরিল। সারা রাত নির্ঘুম সবাই ঘুমে কাতার। ঘুমে কাতর মায়েদের কোলেই বাবুরা সবাই ঘুমাইয়া পরিয়াছে সেই কখন।
ক্লান্ত মনে ভাবিতে লাগিলাম, আমরা না হয় মৃত্যু ভয়ে হায়েনার কাছ হইতে পালাইয়া নিরাপদে আশ্রয় লইলাম। কিন্তু যাহারা যুদ্ধ করিতেছে তাহারা? তাহারাতো মৃত্যুটাকেই আলিঙ্গন করিয়াই দেশমাতাকে রক্ষা করিতেই শত্রুর মোকাবেলা করিতেছে প্রতিটি মুহুর্ত। কোথায় তাহাদের ঘুম, কোথায় তাহাদের খাওন। তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার চোখের কোণ হইতে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরিল ।
শ্বশুর মশাই এক মুহুর্ত দেরী না করিয়া শাশুড়ীকে সবাইকে চা পানি দিতে আদেশ করিয়াই কাজের লোকটাকে সঙ্গে লইয়া সাত সকালেই বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করিলেন। আমি ছাত্রের বাবাকে কহিলাম এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। আর উনিই আমার শ্বশুর মশাই। নিরাপদ জায়গা, তাই এখানেই আপনাদের নিয়া আসিলাম। উনি দাঁতে জিব কাটিয়া কহিলেন, হঠাৎ এতগুলো মানুষ কোন প্রকার খবর না দিয়াই হুট করিয়া আসিয়া উনাকে কস্টে ফেলাটা কি উচিত হইয়াছে?
কহিলাম না, উচিত হয়নাই। কিন্তু এই অনুচীত কাজটাকে উনি কখনোই অন্যায় জ্ঞান করিবেন না। উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমিযে কোন অন্যায় কাজ করিতে পারিবনা তা উনি ভাল করিয়ায় জানেন।
ঘন্টা দুয়েক পরে শ্বশুর মশাই পুরা দুইটা ভ্যান ভরিয়া বাজার সদাই লইয়া হাজির। সাথে বাবুর্চি ও। পিছনে একজন গরু টানিতে টানিতে আসিতেছে। এত সাত সকালে এত কিছু কোথায় পাইলেন ভাবিয়া কুল কিনারা পাইলামনা। বাবুর্চিকে বলা হইলো কাচারী ঘরের সামনেই চুলা বসাইতে। মেহমানরা যতদিন থাকিবেন ততদিন এখানেই রান্না হইবে।
শ্বশুর মশাইয়ের এসব কান্ড দেখিয়া ছাত্রের বাবা পুরাই বেকুব বনিয়া গেলেন। মেয়ে জামাইর ছাত্রের পরিবারের জন্য এত কিছু কেউ করিতে পারে তাহা তিনি কোন ভাবেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। আমাকে কহিলেন মাষ্টার তুমি বড়ই ভাগ্যবান, এমন মানুষের মেয়ের সাথেই তোমার বিবাহ হইয়াছে। তুমি উনার মেয়েকে কখনো কষ্ট দেয়াতো দুরে থাক, চিন্তাও করিবেনা। উনার মেয়ে সুখে থাকিলেই উনি শান্তি পাইবেন। উনি মানুষ না, সাক্ষাত একটা ফেরেশ্তা।
সেই রাত্রে শ্বশুর মশাইর সাথে আলাপ করিলাম। আসল ঘটনাটি তাঁহাকে খুলিয়া বলিলাম। এও কহিলাম, ছেলের আসল কথা পিতা জানেন না। শ্বশুর মশাই কহিলেন তুমি উত্তম কাজই করিয়াছো উনাদের কৌশলে এখানে নিয়া আসিয়া। কিন্তু আসল কথাটি উনাদের বলিয়া দেওয়াই মনে হয় উত্তম হইবে। কারন, ছেলে হারানো দুঃখ ব্যথা বইয়ে বেড়ানোর চাইতে ছেলে যুদ্ধে যাইবার বিষয়টি গর্বে বুকে ধারন করিয়া দিনাতিপাত করাটাই সুখের হইবে। ছেলে না ফিরিলেও তাহার দুঃখবোধ হইবেনা।
তাই উনাকে ডাকিয়া শশুর মশাই সমস্থটি খুলিয়া কহিলেন। শুনিয়া উনি স্থব্ধ হইয়া গেলেন। মুখে কোন সাড়া শব্ধও নাই। পরক্ষনে কহিলেন, যে ছেলেকে আমি অপদার্ত ভাবিতাম, যে ছেলেকে আমি দুচোখেই দেখিতে পারিতামনা তার পড়ালেখায় অমনোযোগী আর নষ্টামীর কারনে, সেই কি না এতবড় মহৎ কাজ করিয়া ফেলিলো। দেশ রক্ষায় নিজের ছেলে যুদ্ধ করিতেছে সেটার চাইতে গৌরবের আর কি হইতে পারে? বলিয়াই তিনি শশুরমশাইকে জড়িয়ে ধরে কাদিঁতে লাগিলেন। ছেলে ভয়ে উনাকে না বলিয়া যাওয়ায় এখন নিজেকেই অপরাধী মনে করিতে লাগিলেন।
এখানে কয়দিন থাকিতে হইবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই ছেলের বাবা আমার শ্বশুরের হাতে হাজার দুয়েক টাকা গুজিয়া দিয়া কহিলেন এটা রাখুন। শশুর মশাই কহিলেন, আরে আরে করেন কি?? এসবের কোন দরকার নেই। এমনাবস্থায় টাকা পয়সার হিসেবটা খুবই নগন্য। আপনাদের সেবা করিতে পারিতেছি সেটাইতো সৌভাগ্যের। এভাবে টাকা পয়সা সাধিয়া আমাকে লজ্জা দিবার কোন কারন দেখিতেছিনা। আর জামাই বাবু জানিলে আমার উপর রাগ করিবেন।
দীর্ঘ সারে তিন মাস পর চারিদিকে রব উঠিল, আমাদের সোনার বাংলার জয় হইয়াছে, দেশ স্বাধীন হইয়াছে। পাকিস্তানী হায়েনারা সব লেজ গুটাইয়া পালাইয়াছে। চারিদিকে খুশির ঢেউ খেলিতেছে। যাহারা ঘর বাড়ি ছাড়িয়া দুর দুরান্তে লুকাইয়াছিলো তাহারা সকলেই একে একে ফিরিয়া আসিতে লাগিল। আমার ছাত্রে পরিবারও শশুর মশাইয়ের কাছ হইতে বিদায় লইয়া শহরে ফিরিয়া গেল।
একে একে সেই হারানো ছেলেরা বীর বেসে ফিরিয়া আসিতে লাগিল। সকলের ঘরে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগিল। এক দিকে দেশ স্বাধীন হইবার আনন্দ আরেক দিকে ছেলে ফিরিয়া পাইবার আনন্দ। এ আনন্দ যে দেখেনাই তাহাকে তাহা বুঝাইয়া কি বলিব। এরকম আনন্দেওযে মানুষ ভেঁউ ভেঁউ করিয়া কাঁদিয়া চোখের জলে বুক ভাসাইতে পারে আমি সেই দিনই দেখিয়াছিলাম। আমার ছাত্রের পরিবার সেই আনন্দ হইতে কিঞ্চিত বঞ্চিত হইলো। সকলের সন্তান ফিরিয়া আসিলেও তাহাদের সন্তান ফিরিয়া আসিলনা। এইতো আসবে আসবে করিয়া দীর্ঘ চার যুগ পেরিয়ে গেলেও সেই বীর সেনা আর ফিরিয়া আসিলনা মা বাবার কোলে। না জানি বাংলা মা তাহাকে বুকের কোন স্থানে আগলে রাখিয়াছে।
পোষ্টটি ৭১এর সেই সব শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করা হইলো।