ছি্লেন এক বিদগ্ধ কবি। দীর্ঘ পাঁচ-পাঁচটি বছর সাধনা করে অভিধান সদৃশ একটি পান্ডুলিপি রচনা করলেন । কিন্তু হায়!! ঠিক, আরো পাঁচটি বছর ঘোরাঘুরি করেও তিনি সে পান্ডুলিপি কোথাও প্রকাশ করেতে পারলেন না। মুলতঃ কেউই তার পান্ডুলিপি পড়ে দেখে না। কাউকে জোর করে পড়ে শোনাতে গেলেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। একবার তো এক প্রকাশক তাকে দারোয়ান দিয়ে অফিস থেকে বেরই করে দিল! অতএব, এ কাব্য দিয়ে তার আর খ্যাতি অর্জন তো দুরের কথা, কারো দ্বারা একবারের জন্য হলেও পূর্ণাংগ পাঠ পর্যন্ত হল না!! প্রবল অভিমান হল কবির।
একদিন সকালে প্রবল রাগের মাথায়, পান্ডুলিপিখানা ঝোলায় ফেলে, হাতে এক গোছা কাছি নিয়ে কবি বের হয়ে পড়লেন। চোখে উদ্ভ্রান্ত ভাব...মনে ছোট্ট এবং একটি মাত্র আশা। সেই আশা নিয়ে তিনি খুঁজতে বেড় হলেন। হাঁটছেন তো হাঁটছেন। হাঁটছেন আর খুঁজছেন। বাজারে, পার্কে, মসজিদে, মন্দীরে সবজায়গায়। কি যেন খুঁজছেন। কাকে যেন খুঁজছেন। এভাবে পরদিন এবং দিনের পর দিন খুঁজেই চললেন। হঠাৎ ই একদিন খুঁজতে খুঁজতে একটা পার্কের গাছের তলায় এসে কাকে যেন দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন কবি! ভিতরে ভিতরে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছেন। যাকে তিনি খুঁজছেন ঠিক পেয়ে গেছেন। একটু রোগা-পটকা, আউলা-ঝাউলা ধরনের। হ্যাঁ, ঠিক আছে। একধরনের ক্রুর আনন্দে তার চোখের মনি চকচক করছে। মনে মনে একটা অট্টহাসি দিয়ে, এদিক ওদিক তাকিয়ে, ধীর ও সতর্ক পদক্ষেপে শিকারের দিকে আগ্রসর হলেন। কাঁধের ঝোলা থেকে মুহুর্তে বের করে ফেললেন কাছি। শিকারের ঠিক পিছন দিক থেকে আক্রমন রচনা করবেন বলে ঠিক করলেন। শিকার আর মাত্র দশ হাত সামনে। বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোনমতেই এ শিকার হাতছাড়া করা যাবে না। তার শেষ ইচ্ছাটা পূরণের এই যেন শেষ সুযোগ! তাই,কোমর ভেংগে, মাথা নামিয়ে অনেকটা শিম্পাঞ্জি স্টাইলে এগিয়ে এসে দুই হাত দূর থেকেই আকাশ পাতাল হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কবি, শিকারের উপর।
বেচারা শিকার! ঘটনার আকস্মিকতায় আত্নারাম খাঁচা ছাড়া। এমনিতেই দুদিন ধরে খাওয়া নেই। পথে পথে ঘুরে ক্লান্ত, শ্রান্ত। কবি তাকে মুহূর্তের মধ্যে বেঁধে ফেললেন। সইতে না পেরে শিকার কোন মতে প্রশ্ন করলঃ “ কি ভাই, কি হয়েছে? আমি কি করেছি? আমাকে এভাবে বেঁধে ফেলার কারণ কি?” কবি তার দ্বিগুনতর হুংকারের সহিত বললেনঃ “চোপ, কোন কথা নাই। দীর্ঘ পাঁচটি বছর ধরে ঘুরেছি আমি, কেউ শোনে না।” এই বলেই তিনি রহস্যময় এক হাসি দিলেন। অতঃপর বললেনঃ “এখন আমি আমার স্বরচিত পান্ডুলিপি পাঠ করব। তুই সেটা শুনবি । মু হা হা হা”- বলেই ঝোলা থেকে বেড় করলেন তার সেই ছোট-খাটো পান্ডুলিপিটি !! অতঃপর তাকে আর দ্বিরুক্তির সুযোগ না দিয়ে পান্ডুলিপির শিরোনাম হতে শুরু করে সূচীত’পত্রম সহকারে আগা ছে গোড়া উচ্চৈ স্বরে আবৃত্তি শুরু করে দিলেন।
কি অদ্ভুত সে দৃশ্য। একজন সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে আর একজন তাকে উচ্চ স্বরে কাব্য পাঠ করে শোনাচ্ছে। বাধিত ব্যাক্তির কিছু বলার চেষ্ট সম্পূর্ন বৃথা গেল। কে শোনে কার কথা? কবি যে তার পান্ডুলিপি পড়া শুরু করেছেন- আর থামাথামি নাই। বেচারির কি আর করা। অমনি ঘাপটি মেরে দাঁতে দাঁত চেপে, কোন রকমে পড়ে রইল টানা তিনদিন এবং তিনরাত । কবির শেষ ইচ্ছাটি অবশেষে পূরণ হল।
আহ! এবার শান্তি। কাব্য পাঠ শেষে কবি অতিশয় উৎফুল্ল । শিকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ কি হে! আমার পান্ডুলিপি খানা কেমন হয়েছে? যাক, যেমনই হোক না কেন। কমপক্ষে একজন কে তো শোনাতে পেরেছি!! এতেই আমার শান্তি! আহ্ ,এতেই আমার শান্তি! এবার তুমি মুক্ত! এবার তুমি মুক্ত!” এই বলে তিনি শিকারের বাঁধন খুলে দিলেন।
কিন্তু একি! বাধন খোলা হতে না হতেই যেন মৃতপ্রায় শিকারের শরীরে তুমুল প্রান ফিরে এল! যেই না ছাড়া অমনি ধরা।তড়াক করে উঠে পাল্টা আক্রমনে কবিকে ধরাশায়ি করে ফেলল শিকার। এহেন আক্রমনের জন্য কবিও প্রস্তুত ছিলেন কি ছিলেন না ঠিক বোঝা গেল না। শিকারকে ঠিক যেমনটি করে বাধা হয়েছিল, ঠিক তেমনটি করেই কবিকেও বেঁধে ফেলল শিকার। সে এবার আয়েশ করে বসে একটা রহস্যময় হাসি দিলঃ মু হা হা হা। এবার সে নিজস্ব ঝোলা থেকে বের করল একই রকম দেখতে আর একটি পান্ডুলিপি! বললঃ “ বাছাধন, তুমি পাঁচ বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছ ভালো কথা। আমি যে সাতটি বছর ধরে এই পান্ডুলিপি খানা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি সে খবর রাখ? এবার তবে আমার পান্ডুলিপি শোন !! মু হা হা”!!
আমাদের কবিও অনুরূপ তিন দিন তিন রাত পড়ে রইলেন!