ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার (১৯৭৯); এই ক্ল্যাসিক মুভির রিভিউ লিখা একটি দু;সাহসের কাজ, বিশেষ করে আমার মত একজন আনকোরা লেখকের। মুভিটি দেখার পর এত অদ্ভুত এক ভাললাগায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম যে খুব ইচ্ছা করছিল আমার ভাললাগাটা অন্য কারো সাথে শেয়ার করার। সেই অর্বাচীন ইচ্ছা থেকেই এই দু;সাহস।
ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার (১৯৭৯)
ডাইরেক্টর : রবার্ট বেনটন।
স্টারিং : ডাস্টিন হফম্যান, মেরিল স্ট্রিপ, জাস্টিন হেনরী।
আইএমডিবি রেটিং – ৭.৭।
আমার পারসোনাল রেটিং – ৮.০।
আইএমডিবি লিঙ্ক - Kramer vs. Kramer (1979)
ছেলেকে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছে জোয়ানা। মমতার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে বিলি’র সোনালী এলোমেলো চুলে, তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে গভীর ভাবে। প্রতিদিনের মত আজো বলে, আমি তোমাকে ভালবাসি বিলি। ছেলের অভ্যস্ত উত্তর – তোমাকেও ভালবাসি মা। ঘুম ঘোরে সে টের পেল না, মায়ের আজকের বলাটা ছিল অন্যরকম; কিসের যেন আকুলতায় পূর্ণ!
সেই সময় স্বামী টেড অফিসেই বসে, কোম্পানীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত আর এর সাথে নিজের সাফল্যের সুখছবি আঁকায় ব্যস্ত সে।
ক্যরিয়ার কেন্দ্রিক স্বামীর অমনোযোগ আর ব্যস্ততায়; স্ত্রী জোয়ানা ভুগতে শুরু করে ভালবাসাহীণতায়, হীণমন্যতায়। চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে হতাশার । নিজের সাথে প্রবল দ্বন্দ্ব শেষে একসময় সিদ্ধান্ত নেয়; ছেড়ে যাবে স্বামী টেড আর একমাত্র সন্তান ৫ বছরের বিলি'কে। বুকে পাথর চেপে নাড়ীছেড়া ধন ঘুমন্ত সন্তানের কাছ থেকে বিদায় নেয়, চোখ মুছে বেড়িয়ে পড়ে অনিশ্চিত যাত্রায়।
জোয়ানার এই আকস্মিক চলে যাওয়া আবিশ্বাস্য ঠেকে টেড এর কাছে। সে মেনে নিতে পারেনা যেই কারণে সে মূল্যহীন হয়ে পড়ল স্ত্রীর কাছে।
টেড আবিস্কার করে নিজেকে এক নতুন অবস্থানে। যেখানে সে ব্যস্ত ক্যরিয়ার নিয়ে উন্নতির চূড়ায় ওঠার দ্বারপ্রান্তে এবং একি সাথে তার ভূমিকা নিতে হচ্ছে সন্তানের বাবা ও মায়ের। সংসারধর্মে অনভ্যস্ত টেড সবকিছু সামলে উঠে শুধু বিলির প্রতি অন্ধ ভালবাসার শক্তিতে। সে নিজেকে বদলে ফেলে এক আদর্শ বাবা হিসেবে, যার কাছে ক্যারিয়ার নয়, সন্তানের মংগলই সবার আগে। ছোট্ট বিলির পৃথিবীও গড়ে উঠে এই বাবাকে ঘিরেই। একদিন পার্কে খেলতে খেলতে হঠাত পড়ে গিয়ে গুরুতর ব্যথা পায় বিলি, ব্যকুল হয়ে ছেলেকে নিয়ে দৌড়াতে থাকে সে হাসপাতালের দিকে; ব্যস্ত ট্রাফিকে গাড়িতে ওঠার সময় নেই তার। উদ্বিগ্ন বাবাকে ডাক্তার আশ্বস্ত করে। কপালে সেলাই করার সময় সে এমনভাবে ধরে রাখে সন্তানকে যেনো তার সব যন্ত্রণা সেই শুষে নিবে!
এদিকে ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়ায় জোয়ানা, প্রতিষ্ঠীত হয় চাকরিক্ষেত্রে। ফিরে পায় হারানো আত্ম বিশ্বাস, আত্মমর্যাদা...আর অনুভব করতে থাকে মাতৃত্বের টান, নিজের সন্তান কে ফিরে পাবার অদম্য আকাঙ্খা। একদিন টেডের সাথে দেখা করে নিজের এই ইচ্ছার কথা জানায় সে। আঘাত লাগে টেডের ইগো’তে; তীব্র অভিমান থেকে জেগে উঠে ক্রোধ। এতদিন পর এসেছো, সন্তানের দাবী নিয়ে? যে এ কটি বছর মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে শুধু পোস্টকার্ড পাঠিয়ে? এক সময়ের ভালবাসার মানুষের সাথে এত বছর পর দেখা হওয়ার হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশটি উবে যায় মূহুর্তেই।
দেড় বছর পর হারানো সন্তানের প্রতি ভালোবাসার দাবী প্রতিষ্ঠা করতে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয় জোয়ানা। আর সেই সময় বিলিকে বেশি সময় দেবার “করপোরেট” অপরাধে টেড চাকরি হারায় । ২৪ ঘন্টার ভেতর নিজের মর্যাদার নিচু পদে চাকরি খুজে নেয় টেড, যাতে আইনের চোখে বেকারত্বের কারণে সে সন্তানের ভরন পোষনে অযোগ্য বলে বিবেচিত না হয়।
সন্তান বিলির অধিকারের দাবীতে বাবা, মায়ের আইনজীবিরা একে অপরের মুখোমুখী হয় কোর্টে।রায় কে নিজের পক্ষে আনার জন্য তারা পিছুপা হয়না এক সময়ের ভালবাসার মানুষটির মুখে কাদা ছুড়ে মারতে।সন্তানের দাবীতে তারা যেনো ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে থাকে একজন আরেকজনের হৃদয়।
যুক্তি তর্ক আর নিষ্ঠুর জেরায় জর্জরিত জোয়ানা। বড় বড় করুণ চোখ দুটো তার ভেসে যেতে থাকে জলে আর সন্তানের দাবীতে অস্ফুট স্বরে বলে তার একটাই যুক্তি – “ আমি তার মা……আমি যে তার মা। ”
দিশেহারা টেড সন্তানকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় অসহায় ভাবে যুক্তি দেখায়, বলে তার বদলে যাবার কথা, এক অমনোযোগি মানুষ থেকে দায়িত্বশীল এক পিতায় রূপান্তরিত হবার কথা।
আধুনিক নগর জীবন আর উচ্চাশার বলি হয়ে নিষ্পাপ শিশু বিলিকে চলে যেতে হবে প্রিয় বাবা কিমবা মা, যেকোন একজনের কাছে। সে অধিকার হারিয়েছে একটি সুখী পরিবারের একজন হবার।
মানবিক অমানবিক সব যুক্তিতর্ক শেষে এবার কোর্টের রায় দেবার পালা। কার পক্ষে যাবে এই রায়? চিরন্তন মাতৃসত্যের পক্ষে নাকি দায়িত্বশীল পিতৃত্বের পক্ষে?
ছবিটি অনন্য সাধারন হয়ে উঠেছে ফিনিশিং’এ একটি ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব সুন্দর হৃদয় ছুয়ে যাওয়া টুইস্টের কারনে।
ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার; ডাস্টিন হফম্যান আর মেরিল স্ট্রিপ, দুই ক্ল্যাসিক অভিনয় শিল্পীর একটি ক্ল্যাসিক মুভি। আর ছোট্ট বিলির চরিত্রে জাস্টিন হেনরী কি যে অসাধারন অভিনয় করেছে বলার মত না। ওর মন ছুয়ে যাওয়া অভিনয় পাল্লা দিয়েছে দুই লিজেন্ডের সাথে।
একটি মাস্ট ওয়াচ মুভি। যে ছবি না দেখলে আপনার মুভি জীবন ষোল আনাই ব্যার্থ।
ধন্যবাদ সবাইকে।