নেয়ামতউল্যাহ, ভোলা | ১৪ মে, ২০১৬
গ্রামের মেঠোপথে এভােবই চলে ভাইবোনদের দৌড়ের নিয়মিত চর্চা। ছবি: প্রথম আলোভোলা শহর থেকে পশ্চিমে প্রায় ১৬ কিলোমিটার গেলে ব্যাংকের হাট কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তারই উত্তরে পাকা রাস্তা থেকে গুটি গুটি পায়ে নেমে গেছে মেঠোপথ। এই পথে প্রায়ই দেখা যায় ছয়জন ছেলেমেয়ে ধীরে ধীরে দৌড়াচ্ছে। কখনো রাস্তার ওপরই হালকা ব্যায়াম করে নিচ্ছে। এই ছয়জন সম্পর্কে ভাইবোন। স্কুল-কলেজে পড়ে। বড় কথা হলো, এই ভাইবোনেরা প্রত্যেকেই ক্রীড়াবিদ। অ্যাথলেটিকসের নানা ইভেন্টে এরই মধ্যে তারা দেখিয়েছে দক্ষতা। ছয় ভাইবোনের অর্জন ৭২০টি পুরস্কার।
যে মেঠোপথের কথা বলা হলো, সেটা গেছে চর রমেশ গ্রামে। ভোলা সদরের ভেদুরিয়া ইউনিয়নে এই গ্রাম। পথঘাট এখন শুকনো মসৃণ থাকলেও বর্ষায় কোমরসমান পানি পার হতে হয় নৌকায়। এ রাস্তা ধরে এক কিলোমিটারের মতো গেলে জহুরুল ইসলামের বাড়ি। লোকে তাঁকে জহুর কোম্পানি বলে ডাকে। জহুরুল ইসলাম ওই ছয় ক্রীড়াবিদ ভাইবোনের বাবা।
স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ওমর ফারুকের ছোট ভাই জহুরুল ইসলাম। ওমর ফারুক বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। জহুরুলেরও ইচ্ছা তাঁর সন্তানেরা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিক। ‘তাই সন্তানদের গড়ে তুলছি অ্যাথলেট হিসেবে।’ বললেন তিনি। তবে সন্তানদের এখনো কোনো প্রশিক্ষণ দিতে পারেননি। তারপরও ৬ সন্তান এ পর্যন্ত দৌড় ও লং জাম্প প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৭২০টি পুরস্কার পেয়েছে। এ পুরস্কারের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে রৌপ্যপদকও রয়েছে।
জহুরুল ইসলামের বাড়িটা সবুজ। বাড়িতে ফুল, কাঠ ও ফল-ফলাদির গাছপালা প্রচুর; সেসব গাছে পাখির ডাক। বাড়ির সামনে পুকুর, পেছনে খাল। এর মধ্যে একতলা পাকা দালান। একসময় ব্যবসা করতেন। এখন সেটি নেই। জহুরুলের আট সন্তান। তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ে। বড় ছয়জন খেলাধুলা করে নিয়মিত। বাকি দুই ছেলে সাড়ে চার বছর বয়সী শাহাবুদ্দিন এবং এক বছরের জাহানউদ্দিন। জহুরুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ছেলেমেয়েদের পুরস্কারগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে। এগুলো সাজিয়ে রাখার শোকেস বা আলমারিও নেই তাঁদের বাসায়। ছবি তোলার সময় পুরস্কারগুলো খাটের ওপর একত্র করা হলো, নানা জায়গা থেকে খুঁজে এনে।
জহুরুলের বড় মেয়ে রাবেয়া আক্তার। ভোলা সরকারি ফজিলাতুননেসা মহিলা কলেজে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। দশম শ্রেণি পর্যন্ত দৌড়, লং জাম্প, স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা, গোলক, চাকতি ও বর্শা নিক্ষেপে ৫৫টি পুরস্কার পেয়েছেন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি, এসএসসিতে জিপিএ-৫ ও এইচএসসিতে জিপিএ-৪.৯০ পেয়েছেন। ছোট ভাইবোনদের কোচ এই রাবেয়াই, ‘আমি যা খেলাধুলা পারি, তা-ই শেখাচ্ছি ওদের।’
ছয় ভাইবোনের পুরস্কারের সংখ্যা ৭২০!রাবেয়ার ছোট মর্জিনা আক্তার। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে আলতাজের রহমান ডিগ্রি কলেজে। মর্জিনা পেয়েছে ১৭৩টি পুরস্কার। রাবেয়া ও মর্জিনা বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত পুরস্কার পেলেও তাঁদের ছোট দুই বোন মাহিনুর আক্তার ও আমেনা আক্তার জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার লড়াই করে জিতেছে। এ দুজনই ব্যাংকের হাট কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। আমেনা ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক ও মাহিনুর আক্তার ব্রোঞ্জপদক এনেছে। তারা বিকেএসপিতে এক মাসের ক্যাম্পেও যোগ দিয়েছিল। মাহিনুর ১৬৯টি ও আমেনা আক্তার ১৬৪টি পুরস্কার পেয়েছে। বড় বোনদের মতো এ দুজনও পড়াশোনায় ভালো। আরেক বোন সুমাইয়্যা আক্তার ব্যাংকের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। সে পেয়েছে ৪৯টি পুরস্কার। ভোলা শহরে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবসের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনটি ইভেন্টে পেয়েছে প্রথম পুরস্কার। বোনদের ভাই মাহিদুল ইসলাম ব্যাংকের হাট কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে এ বছর জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা ২০১৬-তে ১০০ মিটার দৌড় ও লং জাম্পে জাতীয় পর্যায়ে জিতেছে রৌপ্যপদক। পুরস্কার গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। মাহিদুলের ঝুলিতে এখন পর্যন্ত জমা পড়েছে ১১০টি পুরস্কার। ভোলা জেলা শিশু একাডেমীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার হোসেন জানালেন অল্পের জন্য মাহিদুল ইসলাম স্বর্ণপদক পায়নি। ওরা সবাই খেলাধুলায় খুব ভালো।
জহুরুল ইসলামের ছেলেমেয়েদের প্রশংসা তাদের শিক্ষকদের মুখে। ব্যাংকের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম বললেন, ‘প্রথম শ্রেণি থেকেই এরা খেলাধুলা ও লেখাপড়ায় ভালো। সবকিছুতেই ওরা প্রথম পুরস্কার পেয়ে আসছে।’ ব্যাংকের হাট কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ইসমাইল জানালেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই জহুরুল ইসলামের ছেলেমেয়েরা দৌড়, দীর্ঘ লাফ, উচ্চ লাফে পুরস্কার পেয়ে আসছে। বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ পেলে এরা জাতীয় মানের অ্যাথলেট হতে পারবে।
জহুরুল ইসলাম ও হোসনেয়ারা বেগম দম্পতি খেলাধুলায় ছেলেমেয়েদের সব সময়ই উৎসাহ দিয়ে আসছেন। তাঁরা জানালেন, সন্তানদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে পারেন না। তবে তাদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত করেন এই মা-বাবা। মনের জোরেই দৌড়ের মাঠে এগিয়ে চলেছে এই ভাইবোনেরা।
অ্যাথলেট ভাইবোনদের ঝুলিতে যত পুরস্কার
রাবেয়া আক্তার ৫৫
মর্জিনা আক্তার ১৭৩
মাহিনুর আক্তার ১৬৯
আমেনা আক্তার ১৬৪
মাহিদুল ইসলাম ১১০
সুমাইয়্যা আক্তার ৪৯