এয়াকুবের শ্বশুর জাহান আলির দৃষ্টি শূন্যতার দিকে। হঠাৎ করে এয়াকুবের মূল্যায়ন করতে জাহান আলির ভাবনার অন্ত নেই। কিন্তু কোনো বাক্য জাহান আলির মুখ থেকে বের হচ্ছে না। অথচ তাকে কেউ মূল্যায়ন করতে বলেনি। মেয়ে বিয়ে দিলে হয়তো এমন ভাবনা আপন গরজে তৈরি হয়।
অনেক চিন্তার পর একটা বাজারি শব্দ তার মুখ ফস্কে বের হয়ে যায়... বোদাই।
এ শব্দ বাতাসে মিলিয়ে গেল। তাতে বাতাস দূষিত হলো না। আর বাতাস তো কত কারণে দূষিত হচ্ছে। জাহান আলি সামান্য একটি শব্দ ছেড়েছে মাত্র, তাও তিন অক্ষরের...বোদাই।
এ শব্দ কেউ শুনলো না। আর শুনলেও তার মেয়ে মায়মুনা শুনেছে। এয়াকুব শুনেছে কিনা সন্দেহ আছে।...‘আর শুনলেই বা আমার কী। আমি বোদাইকে বোদাই বলেছি। এ কারণে যদি মুনার সংসারে ঝড় উঠে সে ঝড় আমি সামাল দেব। আমার মন বলছে আমার জামাই এয়াকুব একটা আস্ত বোদাই, রাম বোদাই, কাতলা বোদাই।’
জাহান আলির ঠোঁট কিছুটা কাঁপলো। বোদাই শব্দটি তার ঠোঁটের উপর হাওয়ার নাচন তুললো। মায়মুনা কাছে দাঁড়িয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামান্য দূরত্বে এয়াকুব। এয়াকুব উপার্জন করতে পারে না অথবা যুত করতে পারছে না। মানুষ তো প্রতিদিন কতকিছু উপার্জন করছে কিন্তু মৈষাণ বাড়ির আইনুদ্দিন বলে, জ্ঞান- বল- মান যা কিছু অর্জন করেন অর্থ না থাকলে টিকতে পারবেন না মিয়া ভাই। তার ‘মিয়া ভাই’ সম্বোধনের ভেতর একটা চাপ আছে। যা পেরেকের মতো বিদ্ধ করে।
তখন জাহান আলি বলে,আমি তোমার জন্য পটুয়াখালিতে গাছ কিনে রেখেছি। গাছের ব্যবসা। তুমিও এ লাইনে কাজ করতে পারো। পাঁচ হাজার টাকার গাছ পাঁচ বছরে পঁচিশ হাজার টাকা হয়ে যাবে। ধরো তুমি রহিমকে পাঁট হাজার টাকার গাছ ক্রয় করে দিলে পাঁচ বছর পর সে পাবে পঁচিশ হাজার টাকা, আবার করিমকে পাঁচ হাজার টাকার গাছ ক্রয় করে দিলে করিম পাঁচ বছর পর পাবে পঁচিশ হাজার টাকা। তারা যখন লাভের টাকা গুনবে তখন তুমিও এর একটা অংশ পাবে। আর বর্তমানে তোমার সংসারে টানাপোড়েন চলছে, মুনা এখন আমার এখানে থাকবে। আমি এই সাব্যস্ত করছি।
মায়মুনা ছলছল চোখে তার বাবার দিকে তাকলো আর এয়াকুব তাকালো মায়মুনার দিকে।
এয়াকুব অনেক বার বলেছে আমি সব করতে পারব কিন্তু মানুষকে ঠকাতে পারব না। জাহান আলি বলেছিল, তুমি মিয়া ঠকানোর কথা তুলছো কেন। লাভ মানে কী? লাভ মানে কোনো এক পরে লোকসান । বাজারে গিয়ে আমরা প্রতিদিন ঠকে আসি। জেনে শুনে ঠকি। গা সওয়া হয়ে গেছে তাই উচ্চবাচ্য করি না। আর তোমার এসব ভালো না লাগলে আমার দোকানে সরকারগিরি করো। এসব শুনে এয়াকুব চুপ।
জাহান আলি আবার বলে─বোদাই। মায়মুনা তার বাবার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই অপমান তার গায়েও লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। তার স্বামী এয়াকুবের মুখে বিশাল একটা অদৃশ্য তালা ঝুলানো। সেই তালার চাবি এখন গাছ বিক্রেতাদের কাছে। মায়মুনাকে উদ্ধার করতে হলে সেই চাবি তার হাতের মুঠোয় আনতে হবে।
তাকে এই উপজেলা থেকে জেলা শহরে যেতে হবে। যাবার আগে মায়মুনার সঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে এয়াকুব উল্টো কথা শুনলো। অনেক মূল্যবান কথা।
গাছ বিক্রেতারা শুধু গাছ বিক্রি করে না। তারা তেলও বিক্রি করে। সেই তেল আবার যেন-তেন তেল নয়, কালিজিরার তেল।
আর একটা কথা বলার জন্য বা বিষয়টি জানার জন্য মায়মুনার মন ছটফট ছটফট করে। এক সুযোগে বলে ফেলে─বাবা যে তোমারে বোদাই বলছে তুমি কি রাগ করছো?
─কী বলেছে? এয়াকুব জানতে চায়
─ও থাক। তোমাকে বলেনি। আমিই ভুল শুনেছি।
...তুমি শহরে খালুর বাসায় উঠো। মায়মুনার শেষ বাক্য।
এয়াকুব একদিন দূর সম্পর্কের খালুর বাসায় উঠে। দূর সম্পর্কের খালু চাকরিজীবী মানুষ। প্রথম দিন বলল─কী করো? এয়াকুব কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলল─কাঠ এবং তেলের ব্যবসা করে। কাঠ এবং তেলের ব্যবসা যে করবে সে কেন অন্যের বাসায় উঠবে। কোথাও ঘাপলা আছে নিশ্চয়। দূর সম্পর্কের খালুও তখন বাজারি শব্দ দ্বারা আক্রান্ত হয়। তার মুখ ফসকে মৃদু কন্ঠে বের হয়─ বোদাই (হয়তো কাকতালীয়)। একই শব্দ। এয়াকুব বুঝতে পারে তাকে দূর সম্পর্কের খালু পছন্দ করেনি। কিন্তু লোকটার মায়মুনার বাবার কাছে কিছু টাকা ঋণ আছে। সে অনুরোধের ঢেঁকি গিলছে।
কয়েকদিনের মধ্যে এয়াকুব গাছ এবং তেল বিক্রির সেন্টারটা আবিষ্কার করে। এবং কলেজ রোডে নানার দোকান নামে একটা চা দোকানে তার এক বাল্যবন্ধুর খোঁজ পায়। সেই আড্ডাতে এয়াকুব প্রতিদিন যায়। কিন্তু সে যে তেল এবং গাছ বিক্রির সাথে জড়িত তাদেরকে এ সম্পর্কে কোনো কথা বলে না।
কিন্তু দূর সম্পর্কের খালুর আগ্রহ বাড়তে থাকে। দূর সম্পর্কের খালুর মনে পড়ে শহরে কিছু লোক সত্যি গাছ ও তেল বিক্রির নতুন ফন্দি করছে। এই এয়াকুবও নিশ্চয় তাদের একজন।
তারপর একদিন দূর সম্পর্কের খালু তাকে নিয়ে বাজারে যায়। বাজারে গিয়ে আলু, পটল, ঢেঁড়শ, টমেটোর সাথে তেলাপিয়া মাছও কিনে। পথে আসতে আসতে তখন দু’জনের কথা হয়।
─খালু আপনি যখন তেলাপিয়া মাছ কিনছিলেন ঠিক তখন পাশের মাছ বিক্রেতা বলছিল─নিয়া যান ভাইয়েরা, নিয়া যান, তেলাপোকার কেজি ৯০টাকা। সব শুনে খালু বলে, লোকটার কাছ থেকে আমি আগে মাছ কিনতাম। একদিন মাপে কম দিল। ব্যস যায় কোথায়। অপমান করলাম। লোকটা এখন অপমানের সুদ নিচ্ছে। আমার মাথায় সে তেলাপোকা ঢুকাচ্ছে। এর নাম বাজার। তুমি নিশ্চই কালিজিরার তেল বেচে এমন একটা কম্পানিতে যোগ দিয়েছো?
─জ্বি, তারা আবার গাছও বেচে।
─বেশ ভালো। আগে বাজার বুঝ। বাজার বুঝলে পাবলিকের পালস্ ধরতে পারলে ছাগলের লেদিও বেচতে অসুবিধা হবে না। আমি ব্যবসা বুঝি না তাই চাকরি করছি। চাকরি মানে চাকরগিরি। বাজার না-বুঝলে বোদাই থেকে যাবা।
এয়াকুবের মনে হয় তার শরীর থেকে জ্বর সরে গেছে। একটা শব্দের গোপনীয়তার ভেতর এয়াকুব যেন অসুস্থ হচ্ছিল। ...যাক ভালোই হলো প্রকাশ্যে ‘বোদাই’ শব্দটা শুনতে খারাপ লাগে না।
তখন দূর সম্পর্কের খালু আরো অগ্রসর হয়।
...শুনো এয়াকুব। একবার আমার ঘরের সিলিং ফ্যান শব্দ করে ঘুরছিল। আমি তিনজনকে জিজ্ঞেস করলাম শব্দটা কেমন লাগছে তাদের কানে।
প্রথম জন বলল─বিয়া বিয়া বিয়া।
দ্বিতীয় জন বলল─টিয়া টিয়া টিয়া।
তৃতীয় জন বলল─হিয়া হিয়া হিয়া।
বুঝতে পারছো তিন জনের কান ও মনের বা চিন্তার জগৎ তিন রকম। এসব মন বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়ে এক কাতারে আনতে হয়। যারা শরীরের গোপন লোম কাটতে ফেদার ব্লেড ব্যবহার করে, বিজ্ঞাপন দিতে পারলে ঠিকভাবে, তুমি তার কাছে ভোঁতা কোদাল বিক্রি করতে পারবে। লজ্জা পেয়ো না। বাজার বুঝতে হলে এবং বুঝাতে হলে প্রথমে লজ্জা ছাড়তে হবে। আচ্ছা তুমি আমার কাছে কী বিক্রি করতে পারো বলতো। ভালো করে লক্ষ করে বলো। এয়াকুব এবার দূর সম্পর্কের খালুকে ভালো করে লক্ষ করে। লোকটার কী দরকার? গাছ এবং তেল,এর কোনটা? এয়াকুব বলতে চাচ্ছিল তেল কিন্তু লোকটা বলল, আমার মাথায় কিন্তু একটাও চুল নেই। তোমার কম্পানির তেলে যদি চুল গজানোর কথা থাকে তাহলে তুমি আমাকে এককৌটা কালিজিরার তেল দিতে পারো। তার মানে এই না আমি তোমার কাছে তেল খুঁজেছি।
আমি বলি কি - সত্যি যদি কোনো কম্পানির তেলে কারো মাথায় চুল গজায়, এমন গ্যারান্টি দেওয়ার আগে আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ আছে যাদের উপর পরীক্ষা করা যায়।
এয়াকুব বলে এমন অনেক মন্ত্রী আছেন। কিন্তু চুল গজানোর জন্য সম্ভাব্য কোষ যদি আগেই মরে থাকে। তাহলে এই পরীক্ষা ব্যর্থ হবে।
...ঠিক বলেছো। সবচেয়ে ভালো পাবলিকের মাথা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
তাই তো?
এয়াকুব চুপ করে আছে। কিন্তু দূর সম্পর্কের খালু বলেই যাচ্ছে।...আমার বাসায় তুমি থাকবে বেশ ভালো কথা কিন্তু আমার মেয়েটার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তাহলে তুমি বিপদে পড়বে।
এক সপ্তাহের মধ্যে এয়াকুবের পরিবর্তনটা দূর সম্পর্কের খালুর চোখে পরে। এয়াকুব হকার্স মার্কেট থেকে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, এবং কালো রঙের জুতা কিনে ফিটফাট হয়ে উঠে। তখন একদিন মায়মুনা এয়াকুবের সাথে মোবাইলে কথা বলে। মায়মুনা জানতে চায়, আয় রোজগারের কোনো খবর আছে কি না। এয়াকুব তাকে জানায় শহরে কত রকমের ব্যবসা। এখানে কিছু মানুষ টাকা বেচাকেনাও করে। মায়মুনা বলে আমি বাবার মুখে এসব কথা শুনেছি। বাবা বলেছে এ ব্যবসার নাম ‘লেমলেম’ ব্যবসা। তখন এয়াকুব মায়মুনার ভুল সুধরে দিতে বলে, লেমলেম ব্যবসা নয় এমএলএম ব্যবসা। মায়মুনা বলে তুমি নাকি টাইও পরো? এয়াকুব জানতে চায় এসব কথা তাকে কে বলেছে। মায়মুনা তখন দূর সম্পর্কের খালুর একমাত্র মেয়ের নাম বলে। কথা প্রসঙ্গে এয়াকুব কলেজ রোডের নানার দোকানের আড্ডার কথা বললে মায়মুনা বলে- কেমন আড্ডা হয়।
─আড্ডায় ছেলেরা বলে, গর্বাচেবের মাথায় যদি কালিজিরার তেলে নতুন করে চুল গজায় সে চুল কী সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের হবে নাকি পুঁজিবাদী বিশ্বের হবে। মায়মুনা বলে, বুঝলাম না।
এয়াকুব বলে আমিও সমস্তটা বুঝি নাই। তবে শুনতে ভালোই লাগে।
দু’দিন পর দূর সম্পর্কের খালু এয়াকুবকে তার এক বন্ধুর ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দূর সম্পর্কের খালুর মনে হয়েছে এয়াকুব যে কাজে শহরে এসেছে এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত তার বন্ধুর ছেলে বরকত। লোকে বলে কদমছাট বরকত। কদমের পাপড়ির মতন তার মাথার চুল। কেউ কেউ বলে- তার মগজের ভেতরটাও এমনই।
তখন বরকতের সাথে এয়াকুবের কথা হয়। বরকত বলে। এয়াকুব শুনে। আর প্রশ্ন করে, হাঁ-হু উত্তর দেয়। বরকত বলে─চালাক হলে এ শহরে ‘গু’ও বিক্রি করতে পারবেন। গু বিক্রির কথা শুনে এয়াকুব নড়ে উঠে। তারপর বরকত তার ডান ও বাম হাত দিয়ে বাতাসের শরীরে বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরি করে। সবশেষ তৈরি করে কয়েকটি আয়তত্রে। এবং বলে এগুলো হলো গোল্ড। স্বর্ণের বার।...কখনো দেখেছেন?
...এয়াকুব বলে টিভি’ তে দেখছি।
─না দেখলে ক্ষতি নেই। কল্পনা করতে পারেন তো?
─হ্যাঁ পারি।
─শুধু পারলে হবে না। ভালো করে পারতে হবে।...এই কল্পনাটা বিক্রি করতে পারবেন তো?
─এটা কীভাবে?
─ক্রেতা যেভাবে কিনতে চায় সেভাবে।
এয়াকুব চুপ করে থাকে। সে তার দৃষ্টির ভেতর অথবা হয়তো চিন্তার ভেতর অসংখ্য চেনা-অচেনা ক্রেতা দেখতে পায়। এরা ঠেলাঠেলি করছে, লাফালাফি করছে। এরা সকলে সামনে আসতে চায়। কিন্তু একসঙ্গে সকলে কি করে সামনে আসবে? এর কি কোনো ব্যবন্থা আছে? বরকতকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়।
(প্রশ্ন করার সময় এয়াকুব প্রশ্ন থেকে সরে যায়)
─এটা শুরু হয়েছে কি না জানি না। আমার এক মামা, একমাত্র মামা এটা প্রথম প্রয়োগ করে। পুরাতন পায়খানার মল তুলে সূর্যের তাপে শুকিয়ে নেয়। শুকনো মলচূর্ণ শশা খেতের মাটিতে মেশায়। কিন্তু তিনি পরিমাণ ঠিক রাখতে পারেন নি। ফলে শশা লতা ‘জোরাইয়া’ যায় বেশি। ফল হয় কম। পরিমাণটা বুঝতে পারলে বা ধরতে পারলে গু-হবে শ্রেষ্ঠ জৈব সার। এই আইডিয়াটা আমি প্রয়োগ করব। এখন বলেন আপনি কী করতে পারবেন?
─আমি তো জানি না কী করতে পারব।
─বেশ ভালো, না-জানাটা একটা গুণ। জানা মানুষ নিয়ে সমস্যা।
এয়াকুব বরকতের কথা শুনে আর তার গলার টাই ধরে একটু একটু টানে। এই সময় টাই গলায় শক্তভাবে এঁটে উঠার উপক্রম হলে তার চোখে জল এসে যায়। তখন সে আবার টাই-এর নট আলগা করে। কিন্তু আবার টাইট করে। এবারে তার টাই নিয়ে খেলতে থাকলে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লে সে ঐ অবস্থাকে ত্বড়িৎ আড়াল করে।
বরকত যেন তাকে ধাক্কা দিতে দিতে একটি শহরের মাঝখানে এনে ছেড়ে দেয়। এ শহরে থাকতে হবে তার নিজের যোগ্যতায়।
...কিন্তু এসবের নাম কি যোগ্যতা? আমি কিছু ঝুঝতে পারছি না।
এভাবে এয়াকুব ক্রমশ ধার হতে থাকে। সেই সঙ্গে তার ঘুম কমে যায়। গভীর রাতে মায়মুমাকে ফোন করলে মায়মুনা ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে─তুমি এখনোও ঘুমাওনি? এত রাতে তুমি কি করছো। দেখ কিন্তু নিনু আপার সঙ্গে বেশি কথা বলো না। আপা খুব সোজা। বাবা বলেছে, নিনু আপা খুব সহজে মানুষ বিশ্বাস করে ঠকেছে অনেক বার। এয়াকুব বলে তোমার নিনু আপার সঙ্গে আমার কোনো কথা এখনো হয়নি।
তখন এয়াকুব মায়মুনার সঙ্গে কথা বলা শেষ করলে আবার অনেক মুখ দেখতে পায়। এরা সকলে এমএলএম ব্যবসার সাথে জড়িত। এদের একজন পলি। এয়াকুব পলির সাথে ফোনে কথা বলা শুরু করে।
─মিস পলি।
─জ্বি স্যার। (এয়াকুবের নিকট ‘স্যার’ শব্দটি খুব সম্মানজনক মনে হয়)
─আপনি তাহলে বিলম্ব করেছেন কেন?
─স্যার বিলম্ব কোথায়? টাকাটা এইমাত্র যোগাড় হলো।
─আপনি এখনি চলে আসেন।
─স্যার কি বলেছেন! এখন রাত তিনটা বাজে।
(দু’জনের চোখে ঘুম নেই)
─ঠিক আছে খুব ভোরে নিয়ে আসবেন? আর..., মিস পলি যেন কি কিনতে চান?
─স্যার আমি তো কিছু কিনতে চাই না। আমি কিছু কিনতে চাইলে আমার লোক আছে। ...আমি বিক্রি করতে চাই। কেন, আপনি তো বলেছেন আমরা ক্রেতা নই। আমরা বিক্রেতা। আমি টাকাগুলো বিক্রি করতে চাই। যে বেশি দামে কিনবে তার কাছে বিক্রি করবো।
─বেশ আপনি বিষয়টা খুব ভালো ভাবে বুঝেছেন। এয়াকুব তখনও তার গলার টাই খুলেনি। টাই ধরে টানছে। টাই শক্ত হয়ে হচ্ছে। আবার ঢিল করছে। আবার টানছে। আবার শক্ত হচ্ছে। এবার সে অনিলকে ফোন করে।
─হ্যালো অনিল।
─জী স্যার।
─শুনো, মিস পলির কাছে ৫লক্ষ টাকা আছে। আমি সকাল বেলা এ টাকা ৪লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা বিক্রি করবে কি না বলবে মিস পলি রাজি হবে না। তখন আমি তোমাকে পরপর তিনটি মিস কল দিলে তুমি মিস পলির টাকাগুলো ৫লক্ষ টাকায় কিনে নিতে প্রস্তাব দিবে। যদি মিস পলি রাজি হয়ে যায় তাহলে মিস পলিকে এক লক্ষ টাকা দিবা। বাকি টাকা তিন মাস পরপর সুনির্দিষ্ট কিস্তিতে দিবে। ঠিক আছে তো।
─জি স্যার।
─আর শুনো, মিস পলিকে এক কৌটা কালিজিরার তেল ফাও দিবা।
─জ্বি স্যার। স্যার একটা কথা বলি, পলি তো বিবাহিত। তাকে আপনি মিস বলছেন কেন। ওর স্বামী তো বিদেশ থাকে।
─ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
এমন সময় এয়াকুবের ফোনে মিসেস সারিহা প্রবেশ করে─হ্যালো মি.এয়াকুব। এয়াকুবের টাই টানাটানি বন্ধ হয়নি। টাই টানতে টানতে তার গলাটা কেমন ঘেসো হয়ে গেছে। খড়খড়ে কন্ঠে সে জবাব দেয়।
─জী মিসেস সারিহা...।
─মি. এয়াকুব আমি গাছগুলো কিনলাম, তা কী গাছ আমার স্বামী জানতে চেয়েছে।
─পিল পিল গাছ।
─কী গাছ? আবার বলুন।
─পিল পিল গাছ।
কট করে মিসেস সারিহা ফোন কেটে দিল। এয়াকুব আবার টাই টানতে থাকে।...আমি গাছের নামটা ঠিক বলিনি। মনে যা এসেছে তা বলে দিয়েছি। রাতের ৪টা বাজে। কোনো গাছের নাম আমার মনে পড়ছে না। আগামী দিন মিসেস সারিহার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু আমার এ কর্মকান্ডের জন্য কার কাছে ক্ষমা চাইব। এ লোকগুলো যখন আটকে যাবে তখন আমি কী করব। আসলে তোমার কী কিছু করার আছে? না তো আমার কিছু করার নেই। আমি মায়মুনার জন্য একটু বেশি রোজগার করতে চাইছি। তাতে অপরাধ কোথায়। আমার বস মি. , ...। তিনি কী সাবলিলভাবে এসব বলেন।এসব হলো নতুন সতাব্দীর আইডিয়া। যারা এসব বুঝে না তারা জীর্ণ, তারা প্রাচীন। এবার ইয়াকুব টাইটা গলা থেকে খুলে। লম্বা বিছানাটায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। তখন সে বুঝতে পারে তাকে আরো সামনে যেতে হবে। সবার সামনে। সবার সামনে না গেলে তাকে দেখা যাবে না। আর সামনে দেখা না গেলে এ লাইনে দাম নেই। তার ডানে বামে কত মানুষ─করিম, রহিম, যদু, মধু, সফিক, রফিক, মেজবা, রেজবা, অপু, দিপু,যোগেন, খগেন, পপি , লিপি, সিপি ইত্যাদি ইত্যাদি -তারাও সামনে যেতে আগ্রহী। কেউ পেছনে থাকতে চায় না। পেছন সম্পর্কে শাস্ত্রেও নিষেধ আছে। পেছন থেকে সঙ্গম করাও ঠিক না, খুন করাও ঠিক না। কিন্তু এগিয়ে যেতে হলে কাউকে না কাউকে পেছন থেকে টেনে ধরে পেছনে ফেলে তারপর সামনে যেতে হয়।
তারপর একদিন দূর সম্পর্কের খালু এয়াকুবকে ডেকে বলে─তোমার ব্যবসাপাতি কেমন চলছে?
এয়াকুব চুপ করে থাকে।
দূর সম্পর্কের খালু আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার ব্যবসাপাতি কেমন চলছে? এয়াকুব বোকার মতো দূর সম্পর্কের খালুর দিকে চেয়ে থাকে।
খালু বলে─এই মিয়া তুমি কি কালা হইয়া গেছো?
এয়াকুব তখনো নিশ্চুপ।
দূর সম্পর্কের খালু এয়াকুবের এ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে গজগজ করতে থাকলে তার একমাত্র মেয়ে বলে─বাবা এ জাতীয় ব্যবসা সম্ভবত বন্ধ হয়ে যাবে।
দূর সম্পর্কের খালু মেয়ের দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলে তার মেয়েটি লজ্জা পায়। দূর সম্পর্কের খালু বলে─তোকে কে বলেছে? মেয়েটি তখন কোনো জবাব দিতে পারে না।
এর কিছুদিন পর এয়াকুব কাউকে কিছু না বলে নিজ উপজেলায় চলে যায়। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে দূর সম্পর্কের খালুর কাছে খবর আসে এয়াকুব মারা গেছে।
এয়াকুবের মৃত্যুর কারণ কী তা জানার জন্য তার পরিচিতজনেরা উদগ্রীব হয়ে উঠলে তাদের কাছে কয়েকটি কারণ পৌঁছে যায়:
১. এয়াকুব নাকি গলায় টাই পরার অভ্যাসটি ত্যাগ করতে পারেনি। আবার টাই পরার পর টাই টানাটানিও সে ভুলতে পারেনি। ফলে এয়াকুবের গলায় সম্ভবত টাই আটকে গিয়েছিল।
২. এয়াকুব বলেছে আমি মানুষ ঠকাতে পারব না। এ জাতীয় মনোযন্ত্রণা থেকে তার হার্ট এ্যাটাক হতে পারে।
৩. ছোট বেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়া ইপিল ইপিল ঘাসের নাম ভুলবশত পিল পিল গাছ বলে কোনো ক্রেতাকে গভীর রাতে বুঝ দেয়া নিয়ে নাকি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল─এয়াকুবকে এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে, অনিচ্ছাকৃত ভুলকে কেন্দ্র করে নাকি এয়াকুবের মনে গভীর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
৪. অথবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও একটি কারণ হতে পারে।
বিঃদ্রঃ শুধুমাত্র দূর সম্পর্কের খালুর মেয়েটি নাকি বলে সবগুলো কারণই সত্য তবে আরো একটি কারণ আছে।
(গল্পটি ২০১২ ফেব্রুয়ারি-শুদ্ধস্বর লিটল ম্যাগে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৫:২০