শনিবার সন্ধ্যায় আকাশ অন্ধকার হওয়ার আগেই রাইমা কঁকিয়ে ওঠে। আকাশে যা মেঘ, কিন্তু কোথাও বৃষ্টি নেই। পথ ঘাটে থমধরা রঙিন ময়লা পানি। কোথাও গড়িয়ে যাবে টে- ফুঁ নেই। যেন প্রতিটি ঘরের লোকের সাথে তাদের কী একটা জরুরি কাজ আছে। যে দিন মর্জি হবে সেদিন যাবে। তাও শীতকাল ছাড়া যাবে না। একবারে নিজের রঙ্গে মাটি রাঙ্গিয়ে তবে বিদায় নেবে। একে অন্যকে রাঙিয়ে দিতে আয়োজনের কমতি নেই। তারউপরে মেয়িটি আজ যেন বৃষ্টি নামাবে। আর যদি বৃষ্টি নামে তাহলে জলের রঙটা কিছুটা ফিকে হবে।
রাইমার চিৎকারে তার বাবা দূরবর্তী এক অতীতে ডুব দিয়ে দেখে : কমপক্ষে ২২৫ শতকের বাড়ির ভেতরের অংশে পুকুর, কলা বাগান, বিশাল আকৃতির চারটি মাটির ঘর, গোয়াল ঘরের পেছন থেকে শুরু করে পুকুরের পশ্চিম- উত্তর পাড়ে অন্তত ৫০ -৬০ টি বিভিন্ন জাতের আম গাছ, উঁচু চারা ভূমিতে তামাক ভুট্টা, তিল, তিসি, সিমের ঝাড়, টমাটুর মাচা। পাশের জঙ্গলে নিম, নিশিন্দা, ডেউয়া, বনকাউস, তরুই, থানকুনি , শিয়ালমুথা- আর বাড়িতে প্রবেশের মুখে বেতশ লতা এবং আমকুরুচের সবুজ মিনার। প্রকৃতির তৈরি লতার তোড়ন। বাইর থেকে কোনভাবে বাড়িটাকে বুঝা যায় না। এটাকি বাড়ি না লতাপাতার গম্বুজ।
সব রাঙিয়ে দিতে কে তাদেরকে শিখিয়েছে? আলো আটকে দিয়ে আরেক সবুজ আলো তৈরিতে মসগুল এ বাড়িরণ্য। এর ভেতরে এক বুড়ো দেখার চোখ নিয়ে কি সমস্যায় না ডুবেন আর জেগে উঠেন। এ বাড়ির প্রসবের ঘরটা ধরতে গেলে আলদাই -তবে ‘রসুই’ ঘরের লগে, মাঝখানে মুলি বাঁশের বেড়া। এখানে মাঝে মধ্যে শুকনো বীজ রাখা হয়। বীজ আর নবজাতকের সহাবস্থানের ব্যাখ্যাটা বুড়ো লোকটা ভালো বলতে পারতেন। জাতক আর বীজকে তিনি দ্যোতক হিসাবে দেখতেন। তিনি বলতেন - দুটাই বীজ , বীজের যত্ন না করলে ঝাড়ে বংশে নাশ। মাইয়া যা পোলাও তা। বেড়েশে গাইয়ে কোন ফারাক নাই। দুইয়ের চাই নীরব আওন। জাতক শব্দ করেই আইয়ে। এইডা তার খাসালত। জাতকের কান্দন যেন বাইরে না যায়। জন্মাইবার কালের ছেঁড়াবেড়া অবস্থাটা যেন কেউ টের না পায়। ফুলডা লুকিয়ে ফেলবা। জাতকের মুখ দেখাইবা ঝরঝরে অবস্থায়। কিন্তু চিৎকার থামাবে কি করে? এ প্রশ্নে লোকটা হাসতো । তাদের বাড়ির নবজাতকদের চিৎকার শুষে নিতো বাড়ির উপর ঝুঁকে থাকা বিশাল সবুজ অসি-ত্ব।
রাইমার বাবা অতীত আশ্রিত সেই সবুজ বেষ্টনি থেকে চোখ ফেরালে মগজ থেকে সেই বুড়াটাও মুছে যায়, আর এই বুড়াটাই ছিল তার বাবা অর্থাৎ রাইমার দাদা। তখন সংবেদ আসে, কিন্তু সে সংবেদ কন্ঠে উচ্চারিত হয় না , তখন রাইমার স্বামীর কথা মনে পড়ে। রাইমার স্বামী বলেছিল, আব্বা আমারে জানাইবেন। কি জানাবে তাকে ? ছেলের সংবাদ? এ ছাড়া আর কী? মেয়ের জন্মসংবাদ কি মন থেকে জানতে চায় কেউ? দুনিয়াটা পুরুষ আর পুরুষে ভরে যাক,গজব... গজব আসুক- খোদাতালার দিক থেকে, তখন বুঝবে প্রকৃতির ফারাকে কী রহমত আছে। আমার বাবার সেই সব অসিয়ত শুনলে বেটা মাথামুন্ড কিছুই বুঝবে না। আমার বাবা ছোটখাটো একজন কবিরাজ ছিলেন। কবিরাজি করলেন আর অন্যদিকে সংসার ‘ছিত্তিছান’ হইয়া গেলো । তা’না হইলে এই ছেলের কাছে আমি মাইয়া বিয়া দেই। আমরা জমি বেচলাম জলের দরে। বিশাল সংসারে উপায়ও ছিল না। আমরা কেউ বৃক্ষের মতো হইলাম না। হইলাম লতার মতো। কেবল জড়াইয়া যাই। বাবাও পারলেন না আমরাও পারলাম না... বাবা বলতেন ধন আর মান একলগে থাকে না।।
এমন সময় ফরিদ আলি রাইমার চিৎকারে বের হয়ে আসে। এ চিৎকার থামার নয়। রাইমা যখন দ্বিতীয় চিৎকারটির প্রস্তুতি নেয় তখন রাইমার ফুফু এবং ফুফাতো বোন কথা বলে উঠে। অপ্রয়োজনীয় কথার ঝালর ভেদ করে রাইমার চিৎকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে রাইমার বাবা বুঝতে পারে মেয়েকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু তার কোন গরজ নেই। একজন দাই আছে, সঙ্গে ফুফু আর ফুফাতো বোন। শুরু হয় নতুন প্রতিযোগিতা: তাদের কথা বনাম রাইমার চিৎকার। কথার বেষ্টনি প্রতিটি চিৎকারে চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেলে ফরিদ আলি সহ অনেকে দেখে রাইমার বাবার পকেটটি শুন্য কবরের মত হা মুখো । তাদের কেউ কেউ রাইমার বাবার মগজে হানা দিয়ে দেখে বিশাল এক অরণ্যের জগতে লোকটি বুঁধ । কথা কী করে উদ্ভিদের বিকল্প হয়? কথা দিয়ে কি বেষ্টনি দেয়া যায়?
দাইবেটি ঘর থেকে মাথা বের করে বলে, বেটা তোমার মাইয়াডা এইপ্রথম..., এইডাতো ‘বয়ে’ মইরা যাইবো, তুমি আমারে আগে কইলে ‘বয়’ ভাঙাইয়া দিতাম। অহন তোমরা মাইয়ার চিল্লানির বেড়া দিতাছো ‘কতার’ ‘ঘেউ- ঘেউ’ দিয়া। দুনিয়ায় এমন কান্ড আমি দেহি নাই। হুইন্না রাখো, ফলে-বিরিক্ষে কিছু অইলে আমার দোষ দিতে পারবা না।
রাইমার বাবা চুপচাপ দাইবেটির কথা শুনে।
ফরিদ আলি ঘর থেকে বের হয়ে আধখানা ইটের উপর শরীরের ব্যালেন্স রক্ষা করে দ্বিতীয় আধখানাতে পা ফেলতে গিয়ে থিকথিকে ময়লা পানিতে পড়ে যায়। সরু নালা সমুহের রঙিন পানি কত কিছু উপহার হিসাবে হাজির রেখেছে। ফরিদ আলির পায়ের নিচে পড়ে একটা চিকন কঞ্চি মাথা তুলে দিলে ফরিদ আলি আগ্রহ নিয়ে উবু হয়ে দৃষ্টিকে স্থির করে দেখে, একটি ব্যবহৃত সিনথেটিক জন্ম নিরোধক কঞ্চির শরীরে লেগে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবিরাম অপ্রয়োজনীয় কথার দ্যোতক কি এ সিনথেটিক জন্ম নিরোধক? এ চিহ্ন কিসের সাথে মিলে ? রাইমার দাদা বেঁচে থাকলে এ প্রশ্ন সঙ্গত হত। উনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, উদ্ভিদ জাতক কি শব্দ করে আসে? তিনি বলেছিলেন, অঙ্কুরের সময় শীম বীজ- তেতুল- বীজ- ধান বীজ ফাটে, এই শব্দ দুনিয়া শোষে নেয়, বাবারা কান থাকলে তোমরাও শুনতে পাইবা। আমি কালাও শুনতে পাই। বুঝলা বাবারা, সব জায়গায় একটা মিল আছে। মানুষের শইল দীর্ঘ মোটা চিকন মাঝারি খাটো এবং উজ্জ্বল শ্যামলা কালা লাল রঙ্গের মিল, বৃক্ষ লতার মধ্যেও এ মিলের জ্ঞান আছে। বৃক্ষ লতার সুস'তা এবং প্রাণী দেহের সুস্থতার মধ্যে মিল আছে।
...প্রকৃতি অসুস্থ হলে? রাইমার দাদা এ প্রশ্নের উত্তর দিতো না, তিনি হাসতেন। তিনি বলতেন, বাবারা আমি হইলাম মুর্খ মানুষ এসব জ্ঞানীরা ভাল কইতে পারবেন। আমি কতো কিছু ভুল বলি, দেখো না আমি বলি- জাতকের মুখ দেখাও ঝরঝরে হইলে। আসল কথা কি জানো, আসল কথা হইলো, বাচ্চা কাচ্চা ঝরঝরে না হইলে আমি কোলে নিতে পারি না। আমার মনে হয় হাত ফসকাইয়া পইরা যাইবো। নিজের অভিজ্ঞতাকে আমি এইভাবে জাহির করি। আমার কথায় কান দিয়ো না।
ফরিদ আলি রাইমার দাদার অনেক কথা মনে রেখেছে। রঙিন পায়ে ফরিদ আলি এগিয়ে যায়। গিয়ে রাইমার বাবারে বলে, ভাইজান মেয়েটারে তো মেরে ফেলবেন।
রাইমাদের ঘর: সাত ফিট বাই দশ ফিট যেন মাছ ধরার ‘চাঁই’, এর সামনে মাথা গুঁজে বসে থাকা রাইমার বাপ চোখ তোলে ফরিদ আলিকে দেখে । এ এলাকার জমির প্রথম খরিদদার ফরিদ আলি। ফরিদ আলি আবার বলে, আপনি মেয়েটাকে মারার পাকা বন্দোবস- করে বসে আছেন। ... ফরিদ তুমি এইডা কি কথা কইলা। আমার মেয়েডা যদি হাসপাতালে গিয়া মরে। তখন কী কইবা?
মেয়ে হাসপাতালে গিয়ে কেন মরবে ফরিদ ভেবে পায় না। রাইমার বাবা বলে, ফরিদ তুমি আমার মেয়ের জন্য বৃষ্টি ‘পার্থনা’ কর । বৃষ্টি হইলো রহমত । এটা কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি। এভাবে চিৎকার , আমার সরমিন্দা বাড়ে। বৃষ্টির শব্দ ভেদ কইরা এ চিৎকার কারো কানে যাইতে পারবে না, তুমি আমার জন্য বৃষ্টি মাঙ্গো।
মাথার তাজটা লুটিয়ে যাবার পরও এর প্রতি মোহ থাকে ।
ফরিদ বলে, অপনার বাবা ছিল কবিরাজ আপনি হয়ে গেলেন দরবেশ। রাইমার বাবা চকিত বুঝতে পারে ফরিদ আলি কী ইঙ্গিত করছে । ...কথার প্যাঁচ থেকে তো নিজকে মুক্ত করতে হয়: দরবেশ হইতে পারলে তো ভালই হইতো, দরবেশ হওয়া কি কপালে আছে মিয়া । চেষ্টা করে দরবেশ হওয়া যায় না। দরবেশি হইলো নারকেলের শাসের মত, শাস হইলে নারকেল পঁচে যায়। আমার শইল থাইক্কা এখনও জন্ম বিজল মুছে নাই, লোভ সরে নাই, দেখ না মিয়া এখনো নিজে বাঁচতে চাই। মাইয়াডারে বাঁচানের মুরুদ নাই। আমার আবার দরবেশি!
...আপনার মেয়ে হাসপাতালে গেলে মারা যাবে এ কথা আপনাকে কে বলল?
... মেয়েই বলেছে। তা না হইলে মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাইতে অসুবিধা ছিল না। আমার বইনের সাথে আমার খুব একটা ‘বালা’ সম্পর্ক নাই। তার কথা শুনে আমার বইন চইলা আইলো, সঙ্গে তার মাইয়া, খুঁটে কইরা টাকা নিয়ে আইছে, রাইমা রাজি হইলে হাসপাতালে নিয়া যাইবে।
ফরিদ আলি বলে , আমি রাইমার সাথে কথা বলতে চাই।
রাইমার বাবা তাতে অসম্মতি জানায় না। ফরিদ আলি কথা বলে দেখে এই মেয়েকে হাসপাতালের দরজায় প্রবেশ করানো যাবে না। এর আগেই তার মৃত্যু হবে। সে যেন হাসপাতালাতঙ্কে ভুগছে। রাইমা বলে , কাকা- পেট কাটলে আমি মইরা যামো, কাকাগো আমারে আপনে বাঁচান। রাইমার ফুফু তাকে ঢং না করে হাসপাতালে যেতে শেষবারের মত রাইমাকে অনুরোধ করে। কিন' রাইমার কাতর দৃষ্টির কাছে ফুফুও নত হয়। ফুফু এবং ফুফাতো বোন আবার শুরু করে কথা । কথার 'আন্তা’ ‘চাঁই’ ‘জাল’ ছিঁড়ে একেকটা চিৎকার রাইমার বাবার অতীত জৌলসের তাজকে ফালি ফালি করে এলাকায় ছড়িয়ে দিলে রাইমার বাবা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনায় গলে যায়। কারণ এ চিৎকারে তার সরমিন্দা বাড়ে।
ফরিদ আলি জানে এ বাড়ির অনেকের জন্ম হাসপাতালে হয়েছে। আবার অনেকের বাড়িতেই হয়েছে , কিন্তু সেই বাড়ির অস্তিত্ব আজ নেই। এলাকার উঠতি ছেলেরা চিৎকারের উৎস স্থলে এগিয়ে এসে ফরিদ আলিকে দেখতে পায়, সেই সাথে চিৎকারের কারণ জানতে পায় এবং সাহায্য করতে চায় । কিন' রাইমার বাবা সাহায্য নিতে অপরাগ। তখন তাদের মেজাজও উত্তপ্ত হয়। অথবা তারা কোন প্রকার সুত্র খুঁজে না পেয়ে কৈতুরি জলার পুর্ব পাড় ধরে চৌরাস'ায় পৌঁছে যার যার মতো করে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায়। ‘রাইমার বাবার বৃষ্টির প্রয়োজন কেন?’ তারা উত্তর খুঁজে পায় না। তাদেরকেও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে বলেছিল রাইমার বাপ। বৃষ্টিতে পৃথিবী তার ধারনকৃত বীজকে অঙ্কুরিত করে, বৃষ্টি তার অঙ্কুরিত স্নেহকে তরতর করে বৃদ্ধি করে, ছেলেরা এসব জানে আবার জানেও না। হয়তো এমুহুর্তে ভুলে আছে। তখন বৃষ্টি শুরু হয়। একসময় সোঁ সোঁ শব্দে বৃষ্টি এগিয়ে আসতে থাকলে বিশাল বৃষ্টির ছাদের নিচে এলাকাটি ঝমঝম শব্দে বাজতে থাকে । যেনো রাইমার চিৎকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শব্দে ছড়িয়ে পড়ছে। আর সেই প্রাণের স্পন্দনে আনমনা হয়ে আছে ছেলেরা। এক সময় বৃষ্টি ও গাঢ় অন্ধকারে এলাকাটি ঢেকে যায়। সারা রাত বৃষ্টি হয়। আথবা সর্বশেষ মানুষটি ঘুমিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়।
২
পরদিন সকালে এলাকায় একটা কথা ছড়িয়ে পরে- রাইমা গত রাতে একটা মৃত ছেলে প্রসব করেছে। জৌলসহীন একটা পরিবারের মৃত ছেলের কাহিনী এলাকাতে ছড়বে কেন? শুনা যায়-ছেলেটি নাকি সম্পূর্ন সবুজ বর্ণের হয়েছিল। কেউ কেউ বলে- ‘ডিগি’ কলা পাতার মতো হয়েছিল। কেউ কেউ বলে - দেশি শীমের নিলাভ কান্ডের মতো।