মরিয়ম টাকা নিয়েছে । এই টাকা প্রতি সপ্তায় কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। কিস্তি অদায়কারীরা সপ্তায় একদিন এসে তার একচিলতে উঠোনে কিস্তি আদায়ের আড্ডা জমায়। মরিয়ম গ্রুপলিডার। যেন আসমান থেকে দেয়া কোন নতুন সনদ। ‘গ্রুপ লিডার’-এ কাল্পনিক অভিধা মরিয়ম শরীরে ঝুলিয়ে যেন গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়, স্বপ্নেও সাঁতার দেয়। মরিয়ম দ্বিতীয়বার ঋণ গ্রহণ করে। প্রথমবারের ঋণ পরিশোধ করতে করতে মরিয়ম আর রোকনের আনন্দে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু মরিয়ম দমে যায়নি। গ্রুপ লিডার তকমাটা তার ভেতরে তেজ সরবরাহ করে, ‘দেখি আরেকবার ঋণ নিয়ে...চেষ্টা করলে কি না করা যায়।’
তার ভেতরের এ বর্ণপাঠ রোকন ধরতে পারে, রোকন জানে মরিয়মকে বাধা দিলে সংসারে একটা অশান্তি আসবে। কোথা থেকে যেন এ রকম একটা তাড়া ছিল:‘ মরিয়ম তুমি গ্রুপ লিডার , তুমি যদি ভেঙ্গে পড়ো, ঋণ না নেও- তাহলে অন্যেরা নিরুৎসাহিত হবে।’ মরিয়ম হুবহু এমন কথা ভাবতে পারে না। তবে এমন কথার ভেতরের নির্যাসটুকু তার চেতনায় প্রবেশ করানো হয়েছে। এতে রোকন মিয়া খুব বিরক্ত। তবে সে মরিয়মকে কিছু বলে না, ভাবে- একদিন বলবে। চুড়ান্তভাবে যেদিন বলবে সেদিন মরিয়ম রেহাই পাবে না।
এর আগে রোকন অন্যরকম কথা বলে,‘ কি লাভ অইলো মরিয়ম এই এক বছরে?’ রোকনের প্রশ্ন শুনে মরিয়ম একবারে চুপ। রোকন মরিয়মের নিরবতা ভঙ্গ করতে চেষ্টা করে, আবার বলে, ‘কি লাভ আইলো মরিয়ম’...তবু কথা বলে না মরিয়ম। এবার উত্তরটা রোকন নিজেই দেয়, ‘ঘোড়ার আণ্ডা, তাই না মরিয়ম?’ রোকনের কথা শেষ হলে মরিয়ম হেসে উঠে। সেই হাসিতে রোকনও যোগ দেয়। এক বছর খাটুনির পর এই হাসিটুকু তো পাওয়া গেল।
রোকনের মতো মরদ বেটা- ঠিকঠাক মতো কাজ করলে মরিয়মকে কি ঋণ নিতে হয়? রোকন না হয় মরদ কিন্তু মরদের জন্য কাজটা কোথায়?
অনেক বড় একটা ঘোড়ার আণ্ডা রোকন প্রতিদিন দেখে, কিস্তিওয়ালারা কিস্তি আদায় করতে এলে রোকন ঘোড়ার অণ্ডা দেখতে পায়, যেন মরিয়ম সেই ঘোড়ার আণ্ডাতে একটু তা দেয় , দক্ষিণ পাড়ার হালিমা তা দেয়, রহিমা তা দেয়, উত্তর বাড়ির সোহেলের মা তা দেয়। বেলতৈল গ্রামের জরিমন থেকে শুরু করে জোবরা গ্রামের সমিরন পর্যন্ত কতজনে তা দেয়, যে তায়ের খবর হয়তো রোকন জানে না, এবং কবে এ ডিমের তা দেয়া শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। ঢাকায় বসে অনেক শিক্ষিত লোকেও তা দেয়। সবচেয়ে বেশি তা দেয় এমন একজন লোককে নাকি বিদেশ থেকে পুরস্কারও দেয়া হবে। রোকন জানে না কি পুরস্কার কাকে দেয়া হবে। তবে সেই পুরস্কার পেলে নাকি কিস্তির জন্য আসা এই শিক্ষিত লোকগুলো রাতে ঘুমাতে পারবে না। একসাথে কতো লোকের ঘুম হারাম হবে।
দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দিয়েও গরু কেনা যায় না। মরিয়মের স্বপ্ন, একটা গরু কিনবে। বেশি দুধ দেয় এমন গরু। মরিয়মের বাবার এমন একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন মাথা থেকে মাথায় যায়,শরীর থেকে শরীরে যায়।
তৃতীয় কিস্তির টাকা দিয়ে মরিয়ম একটা গরু কিনলে রোকন কিছুটা যেন সংসারের প্রতি অমনোযোগী হয়ে যায়। আর কতো, সেইতো ঘোড়ার ডিমে তা দেয়া। রিক্সা চালিয়ে এসে গরুর জন্য ঘাস বিচালীর ব্যবস্থা করতে গেলে রোকন শরীরে আর শক্তি পায় না। মরদ হলেও দম আটকে আসে । রাতে ঘুমাতে গিয়ে দু’জন দু’দিকে অঘোরে ঘুমায়। তখন তারা মৃত কি জীবিত বুঝা যায় না। দু’খাড়ি কলা গাছের ভেতর থেকে শ্বাস আসে আর যায়।
মরিয়ম ঘাসতোলা কোদাল, খুরপি, কাঁচি নিয়ে ঘাস তুলতে নেমে যায়। মরিয়ম একেক দিন একেক যন্ত্র দিয়ে ঘাস তোলে। ঘরে ফিরে রোকন প্রতিদিন মরিয়মকে ক্লান্ত দেখে। দুজনের ক্লান্তিতে সংসারটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে ওঠে। তাপ না পেলে ঘাসও মরে।
এসব সংবাদ বড় মেয়ের কানে যায়। বড় মেয়ে গরু কেনার সংবাদ পেয়ে খুশি হতে পারে না। একদিন সে শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে হাজির হয়। সে বলে, কী দরকার ছিল গরু কেনার? তোমরা জামাই বউ মেয়ে মিলে মাত্র তিন জন। তোমার এতো চিন্তা কিসের। তুমি তো গরু গরু করতে করতে শেষ হইয়া যাইবা। মরিয়ম ঘার বাঁকিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়,বলে, এতো বেদর বেদর করবি না। তোর ‘গেয়ানে’ আমরা চলি? মরিয়মের কথা শুনে মেয়ে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুঁসে। তার বাপ বাড়িতে এলে একেই কথা সে বাবাকেও বলে। তার বাবা বলে, এসব তোর মায়ের কারিগরি, সুদের টাকা ঠেইল্লা কয়জনে উপরে উঠতে পারছে। ...যেই মুণ্ড হেই মাথা/ র্ফিরা র্ফিরা ‘তালু’ হাতা...বালের বেংক। মাইনসেরে পাগল বানাইয়া ছাড়তাছে।
কিন্তু মরিয়ম এর মধ্যে সুসংবাদ পায়। এভাবে আরো কয়েক বছর পার করতে পারলে মরিয়ম ব্যাংক থেকে একটা দামী মোবাইল সেট পাবে। এ মোবাইলের কল রেট অন্য যে কোন মোবাইলের চেয়ে কম। মরিয়ম ঘরে বসে অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কল বিক্রি করে অনেক টাকা অর্জন করবে। শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। তখন মরিয়মকে কে পাবে। তখন অভাব হামাগুড়ি দিয়ে পৌরসভার সুয়ারেজ লাইনে ডুবে মরে যাবে। তারপর মরা অভাবটিকে সু্যারেজ থেকে টেনে তুলে মাটি দেবার আগে বিদেশ থেকে পূরস্কার পাওয়া ঘোড়ার ডিমে সর্বোচ্চ তাপ দেয়া লোকটি এসে জায়নামাজ পড়াবে। জায়নামাজ শেষে লোকটা বলবে, আজ থেকে এই এলাকার প্রত্যেক লোকের বুকের ছাতি বেড়ে যাবে, প্রত্যেকের উচ্চতা বেড়ে যাবে। আপনাদের প্রত্যেককে জরিমনের মত হতে হবে-মরিয়মের মত হতে হবে।
রাতে রোকন মরিয়মের বুকের ছাতিতে হাত রেখে দেখে ছাতির আকার ক্রমশ ছোট হচ্ছে। তারপর কোন এক রাতে গরুটা ডাকলে মরিয়মের ঘুম কেটে য়ায়। চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারে না সে। পরদিন গরুটাকে পাল দেয়াতে হবে। অথবা পশু হাসপাতালে নিয়ে ইনজাকসান দিতে হবে। এ চিন্তা থেকে মরিয়ম রোকনকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। ‘কি করবেন গরু তো ডাকছে।’ রোকন বলে গরু কি পেটের ভুখে ডাকে নাকি পাল নিতে ডাকে- তুই কি করে বুঝলি? মরিয়ম চুপ করে ভাবে গরুর খাওন দাওন কমতি করেনি সে। নিশ্চয় পাল নিতে ডাকছে। রোকন বলে, ঘুমা..., আর ভাল না লাগলে একখনি গরুডা লইয়া যাইয়া শেকু মিয়ার হাতে পঞ্চাশটা টাকা দিয়া-ক, তার বেড়েশটা দিয়া তোর গরুটারে যেন পাল দিয়া দেয়।
মরিয়ম রোকনের কথায় লজ্জা পায়। সে ঘুমাতে চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারে না। তার স্বপ্ন পুরণের জন্য গরুটা ডাকছে। এরপর সে পাবে মোবাইল। টাকা আর টাকা...। গরুর ডাকা ডাকিতে ছোট মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ছোট মেয়ে কয়, মা গরুডার কি হইছে? মরিয়ম বলে, গরুডার পেটে বাইচ্চা আইছে। ছোট মেয়ে হাসে। রোকন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে- ঘুমা...হুঁ...গরুর পেটে বাইচ্চা আইছে, কইলে অইলো।
পরদিন সকালে সেকু মিয়ার বেড়েশ পাল দিলে রোকন মিয়ার পঞ্চাশ টাকা খরচ হয়। এ জন্য রোকন মিয়ার শরীর পুড়তে থাকে। কিন্তু মরিয়মের মনে টাকার তুফান। টাকা আর টাকা...।
মরিয়ম গরুর প্রতি যত্নআত্তি বাড়িয়ে দেয়। মরিয়মের জান যাবে কিন্তু গরুর শইল যাতে একটুকু না কমে। মরিয়ম প্রতিদিন দুই ‘ঝুইন’ ঘাস উঠায়। ফজর আলী ব্যাপারীকে বলেছে মরিয়ম, ধান কাটা শেষ হলে এক মুড়ুইল খড় যেন তার কাছে বিক্রি করে। এ অঞ্চলে বর্ষায় ঘাস পাওয়া যায় না।
বর্ষা শুরুর আগে একদিন গরুটা পাশের বাড়ির আমিনের মা’র ব্লাউজ খেয়ে ফেলে। আমিনের মা দৌড়ে আসে, এসেই চিৎকার করে- বলে, মরিয়ম তোর গরু আমার ব্লাউজ খাইয়া ফেলছে। মরিয়ম তো শুনে অবাক। ‘ ওমা এইডা কোন কথা, এইডা কি কথা, এখন তো আমার জরিমানা দিতে হইবে।’ গ্রামে কখন কখন কোন কোন গরু এমন করে। কিন্তু মরিয়মের গরুই এমন করল! গরুটা যে ব্লাউজ খেয়েছে আর কে দেখেছে ? সাথে সাথে সাক্ষি মিলে গেল। রাহেলা আ: করিম, রসুর নানি বলল, ঘটনা সত্য। আ: করিম বলল, ব্যাংকের গরু তো, শিক্ষিত গরু। কয়েক দিন পর বিয়োন দিবে, ওলান নামবে, দুধ দিবে, গরু হলে কি হয়েছে , এরওতো প্রাণ আছে, একটা ব্লাউজ না হয় নিয়েছে।
আ: করিমের কথার ইঙ্গিত অনেকে বুঝতে পারে, মহিলারা মুখ লুকিয়ে হাসে। কোন কোন পূরুষ সশব্দে হাসে। মরিয়ম ঘর থেকে একটা আধ পুরান ব্লাউজ আমিনের মার হাতে দিয়ে কাতর হয়। আমিনের মা কোন কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।
মরিয়ম ভাবে গরুটা তো ভাল ভাবে বাঁধা ছিল, ছুটল কি করে। মরিয়ম একচালা ঘরে গিয়ে দেখে গরু রশি কামড়িয়ে ছুটেছে। এটা তো ভয়ানক, এ গরু রাখবে কি করে। এবার মরিয়ম গরুটাকে দু দড়িতে বাঁধে। আর ছুটতে পারবে না। কিন্তু এভাবে কতো দিন বেঁধে রাখা যাবে। একটু আলো বাতাসের প্রয়োজন আছে। গরুর পেট একটু একটু করে বড় হচ্ছে। একদিন মরিয়ম মইজুদ্দি মিয়ার ধানকাটা খেতের আলে লম্বা দড়ি দিয়ে গরুটাকে আলো বাতাসে রেখে আসে। আইলের উপর দু এক কামড় ঘাসের ব্যবস্থা আছে।
সেদিন আরেক বিপত্তি ঘটে। খুঁটি উপড়িয়ে গরুটা চলে যায় মইজুদ্দির বাড়ির চাতালে। সেখানে মইজুদ্দির ছোট মেয়ের হাফপেন্টসহ অনেক কাপড় চোপড় রোদে দেয়া ছিল। গরুটা মইজুদ্দি মিয়ার ছোট মেয়ের হাফপেন্ট খেয়ে ফেললে মইজুদ্দি মিয়া তেড়ে আসে। এবার কি মরিয়ম কাতর হলে রক্ষা পাবে? মইজুদ্দি মিয়ার চিৎকারে এখানেও আনেক লোক জমে । ঘটনাক্রমে সেখানেও আ: করিম উপস্থিত থাকে। আ: করিম বলে, আরে মইজ ভাই, কয়েক দিন পর গরুটা বিয়োন দিবো, ছোট বাচ্চার জন্য কাপড় চোপড় লাগবো না’ তাই তোমার মেয়ের হাফপেন্ট পছন্দ করছে।
মইজুদ্দি আ: করিমকে পেয়ে কথার বিনুনী দেয়, ‘এই মিয়া দেখো না, বালের ব্যাংক, মাইনষেরে কয়ডা টাকা ধরাইয়া দিয়া পাগল বানাইয়া ছাড়ছে।’ এ ফাঁকে মরিয়ম মইজুদ্দিকে বলে, কাকা মাপ করবেন। এই কইয়া গেলাম এইডারে আর বাড়ির বাইরে আনব না।
একদিকে মরিয়মের ঘাস তোলার কাজ অন্যদিকে রোকন মিয়ার রিক্সা চালানোর অমানুষিক পরিশ্রম, কিস্তির টাকা পরিশোধের জানপ্রাণ চেষ্টা, এই যখন অবস্থা- এমন একদিনে গরুটা একটা মৃত বাছুর প্রসব করে।
মৃত বাছুর দেখে রোকন মিয়া থ হয়ে যায়। কিন্তু নিজের দু:খটা সামলে নিয়ে মরিয়মকে খোঁচা দিয়ে বলে, মরিয়ম এবার তুই দুধের নহরে সাঁতার দিতে পারবি। আমি আর কিস্তির টাকা চালাইতে পারমু না।
মরিয়মের দু চোখে চেষ্টা করছিল একটা জীবিত গরু দেখতে। কি কারণে মৃত বাছুর হল মরিয়ম ভেবে পায় না। হয়তো গরুটা দড়ি ছিঁড়ে কোন একদিন মইজুদ্দির ধান খেয়েছিল। হয়তো সেদিন মইজুদ্দির কাজের লোকজন গরুটাকে ঠিকছে পিটিয়েছিল। সে দিন হয়তো মরিয়ম বাড়িতে ছিল না। রোকন মিয়া হয়তো গরুটাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে আবার রিক্সা নিয়ে বের হয়ে ছিল। হয়তো সে দিন রোকন মিয়া এ ঘটনা মরিয়মের কাছে বলেনি মন ভুলে। মরিয়ম ভেবে কূল পায় না।
মরিয়মের স্বপ্নে মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের ব্যবসা। ব্যাংকের মাঠ কর্মী সোহাগ বলেছিল, মরিয়ম আপনি পারবেন। আপনার প্রাণ শক্তি প্রচুর। আমাদের এম ডি সাহেবের মতই আপনি। আমাদের এম ডি সাহেব একদিন নোবেল পুরস্কার পাবে। আপনি গরু কেনার টাকাটা পরিশোধ করতে পারলেই এবং শেষ হওযা মাত্র মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা করা হবে। আই এস ডি মোবাইল, ভালো ইনকাম।
মরিয়ম আই এস ডি বুঝে না , নোবেলও বুঝে না।
মরিয়ম চেয়ে দেখে তার মোবাইল ফোন পাওয়াটা ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে। মরিয়মের চিন্তা একটাই গরুটা কেন মরা বাচুর প্রসব করল। তবে কি জামা কাপড় প্যাঁচিয়ে গরুটার পেটে ঝামেলা বেঁধেছিল। কিন্তু তা হলে তো গরুটা মরে যেত। মরিয়মের জ্ঞানে কুলায় না। তাই বলে মরিয়ম সহজে দমবার নয়। মরিয়ম সোজা উত্তর পাড়ার মুচি পট্টিতে গিয়ে হাজির হয়ে রবি দাসের সাথে কথা বলে। রবি দাসকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। রবি দাস বুঝতে পারে কিভাবে কি করতে হবে। দরদস্তুর হয়। রবিদাস বলে দু’শ টাকা লাগবে । মরিয়ম বলে, এতো টেকা দিতে পারব না। রবিদাস বলে, ভাল করে বানাইয়া দেমু। মরিয়ম বলে, ভাল করেই বানাইবা তবে ১০০ টাকা পাইবা । পরে ১৫০ টাকায় মিটমাট হয়। রবিদাস মরা গরুটার চামরা ছিলে হাড় মাংস নাড়ি ভুড়ি মাথা পৃথক করে কানবিহীন চোখবিহীন একটা ‘এম্বা’ চার ঘন্টাতে বানিয়ে দিলে মরিয়ম ভাবে এবার অন্তত দুধটা দোহন করা যাবে। ভেতরে খড় ভরে ভরে এম্বাটা বানানোর সময় মরিয়মের ছোট মেয়ে নীরব মনোযোগে লক্ষ্য করছিল। শেষে মরিয়মকে বলেছিল, মা এটাতো দুধ খাইতে পারবে না। মরিয়ম বলে, দুধ খাওয়ার জন্য না। আমি যখন দুধ দুয়ামু তুই তখন এম্বাডা দিয়া গাইডার ওলানে ‘ডুমা’ দিবি, তখন ওলান থইকা দুধ নামব, তা না হইলে কিস্তি চালাতে পারব না।
শুরু হয় পরদিন থেকে এম্বার সাহায্যে দুধ নামাবার কসরত। গরুটা বাছুর মনে করে এম্বাটাকে আদর করতে গেলে এম্বাটা চিৎপটাং হয়ে যায়। মরিয়মের ছোট মেয়ে তখন হেসে ওঠে। মরিয়ম মেয়েকে চোখ রাঙায়। মেয়ে বুঝতে পারে এম্বাটাকে একটু দূরে সরিযে রাখতে হবে। গরুটা তখন প্রাণপণ চেষ্টা করে এম্বাটাকে আদর করেতে। কিন্তু নাগাল পায় না। এই মধ্যবর্তী দূরত্বের কসরত মরিয়মের মোবাইল ধরতে না পারার মতই কষ্টকর।
এম্বা দিয়ে ওলানে যুৎসই ঢুস দিলে এম্বার ভেতরের খড় মচমচিয়ে ওঠে। কানহীন এম্বা মরিয়মের মেয়ের কাছে মেলার মাঠের খেলনা গরুর মতই মনে হয়। সে সুযোগ পেলেই এম্বাটাকে নিয়ে মেতে উঠলে মরিয়মের চোখ রাঙানী আরো বেড়ে যায়। এ ভাবে বহু কসরত করে দুধ নামিয়ে মরিয়ম বুঝতে পারে গরুটা সব দুধ ছাড়ে না। কিছু দুধ ওলানে তোলে রাখে। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টার সংবাদ স্থানীয় ঋণদাতা ব্যাংক আফিসে পৌঁছে গেলে ব্যাংকের লোকেরা মরিয়মের প্রশংসা শুরু করে। এক পর্যায়ে অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা দল বেঁধে মরিয়মের এ এম্বা খেলা দেখতে এসে মুখে খৈ ফুটায়। এতে গত কয়েক কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না টারার অনুযোগ বা অপরাধ থেকে মরিয়ম সাময়িক মুক্তি পাবে বলে মনে মনে আশা পোষণ করে এবং তখনও মরিয়ম শুনতে পায় এ ব্যাংকের মালিক বা এম ডি বলে খ্যাত লোকটির পরিশ্রম ও গুনজ্ঞানের কথা। এ লোকটিকে নোবেল নামের কি একটা দেবার জন্য আমরিকা থেকেও কে একজন সুপারিশ করবে বলে অনেকের মনে হচ্ছে। মরিয়ম নাকি সে রকম প্রাণ শক্তির অধিকারী। অন্যদিকে রোকন মিয়া এসব দেখে আর ফুলে। ব্যাংকের লোকগুলোকে তার খুব চালাক মনে হয়। তার মনে হয় তারা জামাই বউ দুজন দুটি এম্বা, আর ব্যাংকের লোকগুলো তারা দুই এম্বাকে দেখতে এসে খুব প্রশংসা করছে। তখন রোকন বর্ষার শুরুতে স্বল্প পানিতে গেঙর গেং করা একটি কোলা বেঙের অবিরাম লাফ দেখে।
এর মধ্যে একদিন বর্ষা শরু হল। কথা নেই বার্তা নেই বৃষ্টি। মরিয়ম ঘাস তুলতে গিয়ে ফিরে এলো। মাঠ কাদা হয়ে আছে। দু একদিন অপেক্ষা করতে হবে। আবার জমানো খড়ও শেষ। শুধু ফেন দিয়ে গরু রাখা যাবে না। গরুটা রাক্ষসের মতো খায়। অন্যদিকে দুধ বিক্রির টাকায় মরয়িম কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। আবার রোকন মিয়া দু হাত তুলে রেখেছে। আনেক করেছে আর পারবে না। কিস্তি আদায়কারী লোকজন প্রতিদিন চাপ দিচ্ছে। মরিযম দিশেহারা, কী করবে।
সকাল বেলা গ্রুপের অন্যান্য মহিলারা মরিয়মের বাড়িতে ভিড় করেছে। সকলে কিস্তি পরিশোধ করতে এসেছে। দুজন কিস্তি আদায়কারী দু’টি চেয়ারে বসে আছে। তাদের কথাবার্তায় রোকন মিয়ার ঘুম ভাঙে। একজন আদায়কারী বলে, মরিয়ম আপনি তো গত চার সপ্তাহ টাকা দিচ্ছেন না।
রোকন মিয়া ঘরের বাইরে আসে, দু পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে। ঋণ আদায়কারীর কথায় রোকন মিয়া মরিয়মের দিকে তাকায়। মরিয়ম পরিস্কার বলে, আমি কিস্তি পরিশোধ করতে পারমু না। কিস্তিওয়ালা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। মরিয়মের কথা শুনেলে গ্রুপের অন্যান্য মহিলারা বিগড়ে যেতে পারে। তাই কিস্তিওয়ালারা চুপ থাকে। তারা চুপচাপ অন্যদের কিস্তির টাকা গ্রহণ করে। কিস্তি আদায়ের পর তারা আবার বলে, মরিয়ম কি করবেন? আপনিতো ই-রেগুলার হয়ে গেলেন। মরিয়ম সোজাসাপ্টা বলে, আমি কিস্তি চালাতে পারমু না। তারা বলে, তাহলে আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। মরিয়ম বলে, দিয়া দেমু।
কিস্তি আদায়কারীরা চলে গেলে রোকন গলা খাকর দিয়ে মরিয়মের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । মরিয়ম বুঝতে পারে রোকন কিছু বলবে। মরিয়ম একটা প্রস্তুতি নিয়ে রোকনের দিকে তাকায়। রোকন বলে কি করবি এখন? মরিয়ম কথা বলে না। রোকন এখন তাকে খোঁচাবে, মরিয়ম আঁচ করে।
‘মরিয়ম এখন তা হইলে তুই মোবাইল ফোন পাইবি। আমরা বড় লোম হইয়া যামু। বড়লোম ... অনেক বড় লোম... আমি পায়ের উপর ঠেং তুইল্লা পোলাও কোরমা খামু। তুই রঙিন শাড়ি পইড়া পাকা লেট্টিনে হাগু কইরা পানি না লইয়া কাগজে... মুছবি। তোর শইলের খুশবাই নেয়ার জন্য আমি পায়ের থাইক্কা ঠেং নামাইয়া ‘আউর’ করতে থাকুম। তুই যেদিকে যাইবি আমিও সেই দিকে...তুই যেই দিকে যাইবি আমিও সেই দিকে...। লোকে কইবো...। কী কইবো মরিয়ম? ও মরিয়ম কী কইব?’ আর টিকতে না পেরে মরিয়ম বলে, ‘ লোকে কইবো আমার বাপ দাদার মাথা, আমারে না ঘাটলে আপনার ভাল লাগে না, আপনের মুখ বন্ধ হয় না, আল্লার গজব পড়ে না আপনার মুখে। আপনের মুখে কত শক্তি। এইজন্য আল্লা আমারে মরা বাছুর দিছে।
আল্লাহর গজবের কথা শুনে রোকন মিয়া তিড়িং করে ওঠে। তার মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। কিস্তি পরিশোধে রোকনও কম পরিশ্রম করেনি। রোকনের মনে হয় মরিয়ম সব ভুলে গেছে। তা না হলে আল্লাহর গজবের কথা মুখে আনলো কেন।
রোকন মিয়া কি যেন খুঁজে। হঠাৎ তার চোখ যায় ঘরের দক্ষিণ দিকের মোটা লম্বা কয়েকটা বুড়া মোটা আমন ডাটার দিকে। পাতাহীন ডাটা, শুধু আগায় কয়েকটা পাতা আছে। একবারে যেন বাদশাহী চাবুক। রোকন তড়িৎটানে ডাটা দুটি তুলে নিয়ে আগার পাতা ফেলে দেয়। তারপর মরিয়মের পিট বরাবর চার ঘা। মরিয়মের সমস্ত শরীর রোদে পোড়া বাইং মাছের মত কিড়বিড়িয়ে ওঠে। মরিয়মের জলহীন চোখের তীব্র আক্রোশ রোকন মিয়াকে বিদ্ধ করতে থাকলে রোকন মিয়া আরেকটু এগিয়ে মরিয়মের দু গালে দুটি চড় বসিয়ে দেয়। এবার মরিয়ম কেঁদে ফেলে।
মরিয়ম চোখ তোলে আর রোকনের দিকে তাকায় না। কিন্তু রোকন মিয়া অপেক্ষা করে, মরিয়ম তার দিকে আবার একই দৃষ্টিতে তাকালে আবার চড় মারবে। কিন্তু মরিয়ম আর বাড়ে না।
অনেক বছর পর মরিয়ম এমন দ্বিতীয় পিটুনি খেলো। সেবার আ: করিমের বাড়ি থেকে টেলিভিশন দেখে ফিরে এসে মরিয়ম শুধু হাসছিল। কোন এক লোক কী এক পুরস্কারে বিশাল বোরকা পরে মাথায় চৌকাধরনের টুপি লাগিয়ে কেমন যেন করেছিলস। মরিয়মের কাছে বোরকাটা বেশ ভাল লেগেছিল। সেই দৃশ্য মরিয়ম মুছতে পারে না। কেবল হাসে আর হাসে। কেন এত হাসি তাও বলতে পারে না। হাসির ঠেলায় আধাছাদা বলে। সেদিন রোকন মিয়া এমন পিটুনি দিয়েছিল। কয়েকদিন পর রোকন মরিয়মকে চেষ্টা করেও হাসাতে পারেনি। রোকন মিয়া মজা করতে চেয়েছিল, ‘লোকটার গায়ে বোরকা ছিল মরিয়ম? ঠিক এমন না? রোকন মিয়া লুঙ্গির গিট কোমর থেকে খুলে বুক পর্যন্ত তুলে ঢোল আকৃতি করে, আবার দৌড়ে গিয়ে একটা কালো স্লেট মাথায় রেখে হাসে আর বলে টুপিটা কি এমন ছিল মরিয়ম। মরিয়ম হাসে না। তবে লোকটা চা দোকানে বসে একই সময় টিভিতে এই দৃশ্য দেখেছে তাতে কোন ভুল নেই। রোকন সব কসরত থামিয়ে বলে, তাতে হাসনের কি আছে? তুই এত ফিগির ফিগির করবি কেন?
মরিয়মের পিঠে চারটি গুন চিহ্ণ ক্রমশ মোট হতে লাগলো। বিকালের আগেই মরিয়মের শরীরে জ্বর এসে গেলো। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর আরো বাড়ল। মরিয়ম ওম খোঁজা বিড়ালের মত একটা কাঁথার মধ্যে আশ্রয় নিল। রোকন মিয়া বাড়িতে ফিরে দেখে গরু ঘরের দরজাটা হা করা।
মরিয়মের মন থেকে গরুর যত্নআত্তি সব উবে গেছে। রোকন মিয়া ঘরে ঢুকে কয়েকবার ...মরিয়ম...অ-মরিয়ম ডাক ছাড়লে ছোট মেয়েটা বলে, মা’র শইল খারাপ করেছে। রোকন মিয়ার তখন শরীরে রাগ। রিক্সা চালানোর টাকায় কিস্তি পরিশোধ একথা ভেবে তার রক্ত আরো গরম হয়ে ওঠে। ‘কিস্তির ব্যবসায়ী শালারা সুদখোর, শিক্ষিত পোলা মাইয়ারা কিস্তির চাকরি করে। বালের ব্যাংক, মোডা মোডা কথা কয়, মোবাইল দিব, আরে শালা শুয়রের দল...।
মরিয়মের অসুস্থতার সংবাদ শুনে পরদিন বিকালে বিভিন্ন গ্রুপের মহিলারা মরিয়মকে দেখতে আসে। সকলের এক কথা- তিন চার বছর ঋণ নিচ্ছে, কিস্তি চালাচ্ছে কিন্তু উন্নতি দেখতে পাচ্ছে না। অনেকটা সময় পার করে তারা যে যার বাড়িতে চলে যায়।
রাতে মরিয়ম অসুস্থ শরীরে তার অসমাপ্ত স্বপ্নে পতিত হয়।
‘মরিয়ম আপনার কী হয়েছে।’ ‘ ছাড় আমারে আমার স্বামী মেরেছে।’ ‘এ বেটা কাজটা ঠিক করেনি।’ ‘ ছাড় এই কথাটা কওনের কেউ নাই।’ ‘আপনি মামলা করবেন ? আমরা সহযোগিতা করব।’ ‘ আরে ছাড় আপনে কি কথা কন? হে আমার স্বামী। আমার দুইডা মাইয়া আছে। আপনে আমার সংসার ভাঙ্গনের বুদ্ধি দিতাছেন। আমি আপনাদের কিস্তি টিস্তি দিতে পারমু না। আপনাদের আসল টাকা দিতে পারলে বাঁচি।’ ’ বলেন কি মরিয়ম আপনি তো প্রচণ্ড প্রাণ শক্তির অধিকারী। আমাদের ব্যাংকের মালিকের মতো। আপনি জানেন না তিনি আপনার মতো কতো মরিয়মকে ঋণের আওতায় এনেছেন, তারা সবাই ঋণের সুবিধাভোগী। একারণে তিনি নোবেল পাবেন।’ ‘ ছাড় আপনাদের কথা আমি কিছু বুঝি না। লেবেল জিনিসট কী? হেইডা কি মলম? হেইডা আমার পিডে মাখা যাইব? হেইডা মাখলে কি আমার পিডের বেথা সারব? দাগ যাইব?’
মরিয়ম দেখে লোকগুলোর মুখ কেমন হয়ে যাচ্ছে। তারা সরে যাচ্ছে। তারপর একটা মোটা তাজা গরু তার ঘরে প্রবেশ করে, ঘরের মাটির ব্যাঙটা নিয়ে গব গব খেয়ে ফেলে। মাটির ব্যাংকের টাকাগুলো খেয়ে ফেললে কারা যেন বলতে থাকে, মরিয়ম তোর কিসমত বালা, তুই মোবাইল পাইবি। আবার কারা যেন বলে, এই গরুডা ১৯৮৩ সাল থাইক্কা গ্রামের জমা খাইতাছে। এইডা নাকি সোনার বাছুর দিবে। বাছুর দিতে কতদিন লাগে? একটা গরু কতদিন গাভীন থাকে? এইডা গাভীন নাকি বাঁজা?
মরিয়ম ঘুমের মধ্যে স্বপ্নক্লান্তি এবং শরীরের ব্যাথার কারণে ভয়ার্ত রিড়ালের মত গড় গড় শব্দ করতে থাকলে রোকন তার গলার নীচের অংশে হাত ঢুকিয়ে কাছে টানলে মরিয়মের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
পরবর্তী দু’দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। মরিয়মের কোন কাজে মন বসে না। ঘাস উঠানো কিংবা কারো বাড়ি থেকে সামান্য খড় এনে গরুটাকে দেয়ার চিন্তা তার মাথায় খেলে না। গরুটা পেটের ভুখে রাতদিন বিরাম দিয়ে ডাকে। মরিয়মের মনে গরুটা আবার ডাকে। আবার একে পাল দিবে শেকু মিয়ার বেড়েশ। গরুটা আবার গাভীন হবে। বিয়োন দিবে। দুধ দিবে। কিস্তি চলবে। কিস্তি পরিশোধ হবে। মোবাইল আসবে। টাকা আসবে, টাকা...। পায়ের উপর ঠেং তুলে বসে থাকবে রোকন মিয়া। পাকা ল্যাট্রিনে মরিয়ম। শরীরের খুশবোতে পাগল রোকন মিয়া, হামাগুড়িতে রোকন মিয়া... তারপর? তারপর কী ? তারপর কিস্তিগ্রহণকারীদের হাসাহাস।... ইস্ মরিয়ম আপনি যেভাবে আমাদেরকে স্যার না বলে ছাড় ছাড় বলছিলেন, আমরা কি আপনাকে ধরে রেখেছিলাম? এই যে দেখেন আপনি কত স্বাধীন।
এরপর মরিয়ম আর কিছু বুঝে না। স্যার বা ছাড়ের পার্থক্যও করতে পারে না। তখন রোকন মরিয়মকে আরো কাছে টানে। ‘লোকটা আসলে বজ্জাত, শইলে জোর আছে। রিক্সা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে অহিদ মিয়ার চা দোকানে বসে আড্ডা মারে। টেলিভিশন দেখে। শেষে বাড়িতে আইয়া নিজের মাথায় যা আইয়ে তা বানাইয়া বানাইয়া কয় আর আমারে হাসাতে চেষ্টা করে।’
দু’দিন তাদের মধ্যে কথাবার্তা নেই বললেই চলে। সংসারের প্রায় কাজ ছোট মেয়েটা করে। মরিয়ম শুধু ভাত তরকারি রান্না করে সুরুৎ করে ঘরে ঢুকতে পারলে বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। মেয়েটা ভাতের ফেনটুকু দিয়ে গরুটার চিৎকার থামাতে চেষ্টা করে । সে রাতে গরুটা এর দুদিকের বাঁধের একটি রশি ছিঁড়ে ফেললে কমপক্ষে দু’হাত স্বাধীনতা পায়। দু’হাতের মধ্যে কিভাবে যেন চলে এসেছিল চোখহীন কানহীন এবং মুখের হা- বিহীন এম্বাটি। এক কামড়ে গরুটা এম্বাটিকে কাছে নিয়ে এলে এম্বাটি চিৎপাত হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত গরুটার মুখের অবিরাম এদিক সেদিক আন্দোলনে এবং কয়েক ঘা পায়ের চাপ এম্বাটির পেট বরাবর পড়লে এর কোন এক অংশের সেলাই ছিঁড়ে যায়। এম্বার পেটে থাকা মচমচে খড়ের শব্দ গরুটার কানে গেলে আরো পাগল হয়ে ওঠ। গরুটা ধীরে ধীরে এম্বার পেটের খড় কমাতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে গরুটার পক্ষে খড় কমানো আর সম্ভব হয় না। ফলে একসময় এর পেছনের পা আথবা সামনের পায়ের আঘাতে এম্বাটি ঘরের খোলা দরজা অতিক্রম করে অন্ধকারাচ্ছন্ন উঠানে এসে পড়ে। তখন রাত জাগা আথবা রাতে ঘোরা শিয়াল বা কুকুর এমন একটি প্রাণীকে দেখে ভয় পায়। ভীত কুকুর বা শিয়াল নিজেদের মধ্যে সংখ্যা বৃদ্ধি করে ভয়কে কাটিয়ে তুললে এদের মধ্যে একধরনের খেলা সংগঠিত হয়। এই খেলার আংশিক অনুপ্রেরণা আসে এম্বার চামরায় লুকায়িত সামাণ্য গন্ধ থেকে। নিশাচর প্রাণীসমূহের খেলা যখন রাতকে আরো গভীর করে তোলে তখন এম্বাটির শরীরে চামড়া অদ্ভুতভাবে ঝুলে যায়। এম্বাটির বাঁশের তৈরি চারটি পায়ের মধ্যে পেছনের দু’টি ঠিক থাকলেও সামনের পা দু’টি কিঞ্চিৎ ভেঙ্গে গেলে খেলার সময় শেষ হয়ে আসে। তখন মরিয়মের কানে খেলা থেকে সৃষ্ট শব্দ পৌঁছলে মরিয়ম অপেক্ষায় থাকে কখন রাত শেষ হবে। রাত পোহাবার পর পূব আকাশে সবেমাত্র সুর্য উঠেছে, মরিয়ম দরজা খুলে দেখে উঠানের মাঝখানে এম্বাটি নমস্কার দিয়ে যেন তার দিকে উবু হয়ে আছে। হয়তো তার মনে হয় টিভিতে দেখা সেই লোকটির মতো এম্বাটিরও মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে । অথবা মরিয়ম হয়তো এম্বাটির গলায় মেডেল পড়িয়ে দিবে। অথবা তার মনে হয় এম্বাটির ঝুলে যাওয়া সেলাই ছেঁড়া চামড়ার সাথে সেই লোকটার বোরকাটারও কি অদ্ভুত মিল। আজকের দিনটা তার জন্য কী অমঙ্গল নিয়ে আসবে কে জানে।
অসুস্থ শরীর নিয়ে মরিয়ম ঘর থেকে নেমে এম্বাটির কাছে আসে। ঘুরে ঘুরে এম্বাটিকে দেখতে থাকে। একজন পর্যবেক্ষকের মত দেখে । একজন গবেষকের মত দেখে । মরিয়মের চোখে মুখে বিস্ময় আর দু:খ। একসময় মরিয়ম হাঁটুমুড়ে এম্বাটির কাছে বসে। এম্বাটির চামড়ার কয়েকটি ছিদ্রপথে কিছু আলো মরিয়মের চোখের উপর পড়লে মরিয়ম দেখে দিগন্ত বিস্তৃত গ্রামটির দীর্ঘ প্রান্তরে অসংখ্য এম্বা নেমে পড়েছে। এম্বা আর এম্বা । অযুত নিযুত এম্বা।