ইনোভেশন। এটা মাপার কোন পরিমাপক নেই। এটা হতে পারে নতুন কোন আইডিয়ার মাধ্যমে, হতে পারে পুরোনো আইডিয়া নতুন কোন কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে অথবা অন্য কিছু যাতে আমাদের জীবন-যাপন সহজ হয় বা ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। মূলত ইনোভেশনে দু’টি জিনিস প্রয়োজন:
১. বিস্তৃত চিন্তাশক্তি বা চিন্তাকে বড় ক্যানভাসে ভিজুয়ালাইজ করার ক্ষমতা ।
২. এবং সেই চিন্তাকে বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের পরিবর্তনের সাথে যাচাই করার ক্ষমতা।
ইনোভেশন বই-পত্র পড়ে আসে না। ভেতরে থাকতে হয়। তবে, কিছু পড়াশোনা থাকলে ইনোভেশনটাকে ছাঁচে ফেলতে সুবিধা হয়। বিচ্ছিন্ন বিন্দুগুলোকে একটি সুঁতোয় গাঁথা সম্ভব হয়। ইনোভেশনের কার্যকারিতা বা কোয়ালিটি নির্ভর করে মানুষের জন্য সেটি কতটা সহজ হচ্ছে তার উপর। যতসহজ ব্যবহার, যত মানুষ এবং বিস্তৃত এরিয়া কাভার করে, তত ভালো কোয়ালিটি। আমি বলতে চাইছি, ইনোভেশন প্রসেসটা জটিলও হতে পারে। কিন্তু, এটার প্রয়োগ এবং ফলাফলটা এমন হয় যাতে কেউ চট করে সেটি বুঝে ফেলতে পারে যে এই ইনোভেশনের ফলে রেজাল্ট কি আসলো এবং এই কারণে আগের অবস্থার চেয়ে কি কি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলো।
ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি উচ্চমানের ইনোভেটিভ ফোরামে অংশ নেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। ঐসব ফোরামে আমি বহু ইনোভেটিভদের প্রেজেন্টেশন দেখার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু ঐ আইডিয়া নিয়ে আমি একজনকেও ভালোভাবে সাসটেইন করতে দেখি নি। এসব ফোরাম থেকে আমি বেসিক আইডিয়া এখনো দেখি নি, যেখানে একদম বেসিক কোন সমস্যা সমাধানের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দেয়া গেছে। প্রতিটি আইডিয়ার প্রেজেন্টেশন অনেক চমৎকার। অনেক আইডিয়াই তাৎক্ষণাত ভালো লেগেছে, কিন্তু সেটি টিকে থাকতে দেখি নি। বরং সেইসব প্রেজেন্টেশনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো ভালো পদে চাকরি হয়ে যেতে দেখেছি ঐ ইনোভেটিভদের। আর সেই চাকুরির সাথে সাথে অপমৃত্যু ঘটতে দেখেছি সেইসব আইডিয়ার। দ্যাটস্ ইট! নিজের স্বপ্ন তো নিজের সন্তানের মতো, সেটার অপমৃত্যু কেন মেনে নেবে মানুষ? তাহলে বলা যায়, আইডিয়াই শর্ট টার্ম উদ্দেশ্যে ছিলো।
বিভিন্ন ফোরামে গিয়ে আমি যেসব ইনোভেটিভদের দেখেছি তাদের অধিকাংশই ইয়াম্মি। ইয়াম্মি বলতে বুঝাচ্ছি এরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশী স্বচ্ছন্দ্য। ঐসব সেশনগুলিতে এরকম বাঙালি ইনোভেটিভদের তরুণদের আমি পাইনি যিনি তার নিজের ভাষায় শ্রোতাদের তার আইডিয়া সম্পর্কে বলবে। আমি দেখেছি কোন এক বিচিত্র কারণে আমাদের এখানকার মানুষরা (অধিকাংশই) ‘ওয়েল’, ‘ইউ নো’ ‘ব্যাসিকালি’ বলা ইয়াম্মি সিরিজের পোলাপানদেরকে সবচেয়ে ইনোভেটিভ বলে মনে করে। ইংরেজিতে ভালো প্রেজেন্টেশন স্কিল এখানে এখানে ইনোভেশন পরিমাপের অন্যতম ইন্ডিকেটর। সমাজের এলিট শ্রেণী ছাড়া এদের ওঠা-বসার অভ্যেস নাই। গ্রামে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। দেশের ফসল, ঋতু, আবহাওয়া, মানুষ, তার বেসিক প্রয়োজন সম্পর্কে ধারণার অভাব। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবে এদের ইনোভেশনেও এসব গলদ থাকবে সেটা স্বাভাবিক।
আমার ঐখানকার আরো অভিজ্ঞতা হলো সবাই জবস, সের্গেই ব্রিন, ল্যারি পেজ অথবা জাকারবার্গ হতে চায়, কিন্তু সেটা শুধু তাদের পোশাক-আশাক অণুকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে, মস্তিষ্ক দৌড়ানোতে না। কারণ, ঐ ক্যালিবার থাকা তো দূরে থাক, একটি আইডিয়া নিয়ে ঐ পরিমাণ পরিশ্রম ও একাগ্র থাকার ক্ষমতা আমাদের নেই। আইডিয়া একটা স্বপ্ন, নিজের সন্তানের মতো। ব্যাপারটা এমন না আপনার মাথায় একটি দুর্দান্ড আইডিয়া এলো আর আপনি এক সপ্তাহের মধ্যে সেটি নিয়ে দুর্দান্ত একটি প্রেজেন্টেশন দিলেন, এন্ড অফ দ্যা স্টোরি। আবার খাজকাটা খাজকাটা।
আমাদের প্রতিদিনকার কোটি কোটি আইডিয়ার এই অকাল মৃত্যুর কারণ কি হতে পারে? আমি কয়েকটি কারণ আইডেনটিফাই করেছি। মিলিয়ে দেখতে পারেনঃ
১. ভবিষ্যতের সাথে খাপ খাওয়ানোর কথা চিন্তা না করে, হঠাৎ করে কোন কোন আইডিয়া আসলে ঐটা নিয়ে লাফালাফি করা, এবং দ্রুতই নিস্তেজ হয়ে যাওয়া।
২. নিজের আইডিয়াকেই শ্রেষ্ঠ মনে করা।
৩. রেফারেন্সের অভাবে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া।
(আমি একজনকে চিনি যে ২০০৫-‘০৬ এর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় মোবাইল ব্যাংকিং এর আইডিয়া নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে দৌড়াদৌড়ি করেছিলো। কিন্তু, হাস্যকর আইডিয়া বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই প্রতিষ্ঠানকেই আমাদের হাস্যকর মনে হচ্ছে!)
৪. মাটির সাথে সংযোগের অভাবে মানুষের সঠিক প্রয়োজনটা অনুধাবন করতে না পারার ক্ষমতা।
৫. আবার যারা মাটির সন্তান যারা একদম সঠিকভাবে সমস্যাটা আইডেনটিফাই করতে পারবে তারা আবার প্রেজেন্টেশন দূর্বল। যদিও প্রেজেন্টেশন একটি অনুষঙ্গমাত্র। কিন্তু, আপনার কথাটা তো আপনাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করে অন্যদের দেখাতে হবে।
৬. বিভিন্ন ইনোভেশন প্রতিযোগীতায় মানুষ কেন জানি খুব বেশী আগ্রহ বোধ করে না। প্রমাণ নাই, তবুও অনেকে মনে করে এখানে ঘাপলা আছে। (অনেকেই মনে করে তার মাথায় ভয়াবহ আইডিয়া আছে, প্রতিযোগিতায় দিলে সেটি চুরি হয়ে যাওয়ার চান্স আছে!)
৭. বিদেশে যেসব বাঙালিরা আছেন এদের অনেকেরই গ্রাম-বাংলা সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে আবার উচ্চ শিক্ষাও আছে কিন্তু দেশে তাদের উপযোগী কাজের ক্ষেত্র নেই। বাইরে থেকে ভালো কিছু করলে সেটার স্বীকৃতি দিতেও আমরা কার্পণ্য করি।
আরেকটা গ্রুপ আছে পাগলা। যাদের মাটি ও মানুষ সম্পর্কে আইডিয়া আছে, আইডিয়াটা ভালোভাবে বলার দক্ষতাও আছে এবং এদের সংখ্যা নেহায়েত কম। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যত বেশী ইনোভেশন হয়েছে; তার অধিকাংশই এই গ্রুপের হাত ধরে এসেছে।
“আমাদের দেশে আইডিয়া ভাত দেয় না, অন্য কিছু করতে হয় তাই সময় দিতে পারি না।“
“এই দেশে আইডিয়ার দাম নাই, ফাইল আটকায় থাকবে দিনের পর দিন।“
উপরের কথাগুলোকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু, এসবই এড়িয়ে চলা সম্ভব যদি আমরা ঠিকঠাক প্রস্তুতি নেই।
আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে কার্যকর উক্তি হলো” Lack of preparation can never be an excuse” আমাকে যিনি এটি শিখিয়েছিলেন তার নাম বলছি না। কিন্তু, এই বাণীটাই আমার জীবনের জন্য একটি ইনোভেশন হয়ে এসেছে।
ইনোভেশন আমাদের অন্য যেকারো চেয়ে বেশী দরকার। এতটুকু আয়তন, আর এত্তোগুলা মানুষ। মানুষের তুলনায় সার্ভিস প্রোভাইডারের সংখ্যা অনেক কম। পদে পদে স্তরে স্তরে অপচয় আর টাকা খরচ। একটি কাজ সম্পন্ন করতে যতো বেশী মুখ দেখা লাগে তত খরচা বাড়ে।
খুব সহজ কথা, দেশের সত্যিকার ইতিবাচক পরিবর্তন চাইলে এই পাগলা টাইপের মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেটা তিনভাবে সম্ভব।
১. শহুরে ইনোভেটিভদের গ্রামের সাথে, বাংলাদেশে সত্যিকার পরিস্থিতি, সত্যিকার সমস্যার সাথে পরিচিত করানো।
২. সম্ভাবনাময় গ্রামের অথবা গ্রাম থেকে আসা তরুণদের প্রশিক্ষিত করা কিভাবে নিজের আইডিয়াকে প্রজেন্ট করতে হয়। বিচ্ছিন্ন বিন্দুগুলো জোড়া লাগাতে হয়।
৩. বিদেশে থেকে যারা বাংলাদেশের জন্য কাজ করছেন বা করতে চান, তাদের দেশে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, কর্মক্ষেত্র তৈরী এবং কাজের স্বীকৃতি দেয়া। এক্ষেত্রে উভয়পক্ষের আন্তরিকতা প্রয়োজন।
কিভাবে এই তিনটি কাজ সম্ভব সেটাও কিন্তু নতুন একটি ইনোভেশনের খোরাক হতে পারে।
(এই লেখায় যেসব ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি বক্তব্যকে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৬