উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে ছাত্র ভর্তির নামে মহা নৈরাজ্য চলছে। এ নিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে একশ্রেণীর বেনিয়া। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন শহরে ওই প্রতারক চক্র ছড়িয়ে আছে। বিদেশের নামি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স বা মাস্টার্সে ভর্তির নামে ফি বছর ওই চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রতিদিনই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে শত শত প্রতিষ্ঠান অনেকটা নির্বিঘে এ কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এগুলো কতটা সঠিক এবং দুর্নীতিমুক্ত তা যেন দেখার কেউ নেই। বিদেশী ডিগ্রি আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে অনেকেই ভিটেবাড়ি, মায়ের অলংকার, হালের বলদ থেকে শুরু করে মূল্যবান সম্পদ ও সম্পত্তি বিক্রি করে প্রতারক চক্রের হাতে অর্থ তুলে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যে জোটে প্রতারণা। বিদেশে যাওয়া তো দূরের কথা, দেয়া অর্থও ফেরত পায় না তারা। শেষ পর্যন্ত মামলাসহ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অনেকে হয়রানির শিকার হন। র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে ওই চক্রের হাতে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী প্রতারিত হয়েছে। তবে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ বলে জানান সংশি¬ষ্টরা। প্রতারণার রয়েছে নানা কৌশল। এর মধ্যে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ওভারসিজ এডুকেশন কাউন্সিলিং ফার্ম স্থাপন, সঠিক তথ্য আড়াল করে মনগড়া তথ্য দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ, ওয়ার্ক পারমিটের কথা বলা, আইএলটিএস ছাড়া ভর্তি হওয়ার সুযোগ না থাকলেও তারা কৌশলে ভর্তি করে পরবর্তীকালে আইএলটিএসের স্কোরের শর্ত আরোপ করে ছাত্রদের হয়রানি করা, অনেক সময় ইউনিভার্সিটির একটি অফার লেটার অনুকরণ করে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর নামে অফার লেটার নিজেরাই কম্পিউটার স্ক্যানিং করে তৈরি করে এবং কখনও টিউশন ফির নামে বা ভর্তি ভিসার নিশ্চয়তার প্যাকেজ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পুলিশ সদর দফতরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কয়েকজন সংশ্লি¬ষ্ট ব্যবসায়ী জানান, ওই সব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করার পর শত শত কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তারা শুধু একটি ব্যবসায়িক লাইসেন্স (ট্রেড) নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে, না বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফলে ওই সব প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, মানুষ ঠকানোর এ ব্যবসা লাগামহীন ও অবাধে আর কতদিন চলতে থাকবে। সংশ্লি¬ষ্টরা জানিয়েছেন, বিদেশে যেমন এদেশের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ও পড়াশোনার অবারিত সুযোগ রয়েছে, আরও রয়েছে বিনা খরচে, নিজ অর্থে বা বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ, তেমনি রয়েছে ভালো প্রতিষ্ঠানে আসন সংকটের বিবেচনায় বিদেশে ভর্তির চাহিদাও। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ্যে যেখানে প্রতারণা চলে সেখানে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নাকের ডগায় এভাবে দিনের পর দিন প্রতারণা চলে কিভাবে? জানা গেছে, ফি বছর উচ্চ মাধ্যমিক ফল প্রকাশের পর থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ারও তিন মাস পর পর্যন্ত থাকে বিদেশে ভর্তি করার নামে প্রতারণার মৌসুম। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে নজরে পড়ে ভর্তির লোভনীয় সব বিজ্ঞাপন। বর্তমানে ওই ধরনের বিজ্ঞাপনে প্রথম শ্রেণীর সব জাতীয় দৈনিকের পাতা থাকে ভরা। একটি জাতীয় দৈনিকের ৫ আগস্টের সংখ্যায়ই এ ধরনের ২০টি বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এসব বিজ্ঞাপন এমনভাবে দেয়া হয়, শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞাপন দাতাদের অফিসে গেলেই যেন ইউরোপ-আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাক্সিক্ষত ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিমান যেন ওড়ার অপেক্ষায়। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো। বিদেশে ভর্তির ব্যাপারে পরামর্শ দেয় খোদ এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা বলেছেন, যত সহজে ভর্তির কথা বলা হয়, বিষয়টি তত সহজ নয়। এক্ষেত্রে প্রতারণা, নানা খাতে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, ভিসার নামে মোটা অংকের অর্থ লোপাট ইত্যাদিই ওই সব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য থাকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে ভর্তির নামে ‘স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি’ করে এ ধরনের কেবল ঢাকা শহরেই ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অথচ এ ধরনের সেবাদাতাদের ‘অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (এফএসিডিক্যাব) নামে যে সংগঠন রয়েছে, তার সদস্য মাত্র ৬৩টি। ওই প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি এসএস বিজনেস কর্পোরেশন লিমিটেডের কর্ণধার সুমন তালুকদার জানান, পত্রিকায় প্রতিদিন যেসব বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, তার মধ্যে ৯০ ভাগ প্রতিষ্ঠানই ভুয়া। ওই সব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের কারণে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নাম হচ্ছে। এ কারণে স্টুডেন্ট ভিসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি আইনের অধীনে আনা জরুরি। বিশেষ করে কোন প্রতিষ্ঠান যদি কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতারণা করে সেক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হওয়া প্রয়োজন। শুধু লাইসেন্স গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি মোটা অংকের জামানত থাকলেই চলবে না। কারণ তাতে করে পেশী শক্তি বা কালো টাকাধারী ব্যক্তি এসব স্টুডেন্ট ভিসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় চলে আসতে পারে। এর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই সব প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, স্টুডেন্ট ভিসা সম্পর্কে তিনি টেলিভিশনের সরাসরি প্রোগ্রামে তথ্য ফাঁস করেন। এ কারণে তাকে প্রতারকরা জীবননাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়। তিনি শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ না হয়ে ভালোভাবে খোঁজখবর নিতে হবে। প্রয়োজনে দূতাবাসের ওয়েবসাইট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট দেখতে হবে। এফএসিডিক্যাব সভাপতি বিএসবি গে¬াবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান লায়ন এমকে বাশার এ ব্যাপারে বলেন, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান উধাও হয়। এরপর ভুক্তভোগীরা যে মামলা করে তা ৪২০ আর ৪০৬ ধারায়। অর্থাৎ প্রতারণা আর অর্থ আত্মসাতের মতো ছোটখাটো মামলা হয়। তিনি জানান, দেশে শত শত প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যবসা করলেও তাদের জন্য সরকারের কোন আইন বা বিধিবিধান নেই। ফলে প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। তিনি বলেন, এ ধরনের সেবাদাতা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের বিপরীতে একটি মোটা অংকের জামানত থাকবে যা থেকে প্রতারিত শিক্ষার্থী প্রতারণার অর্থ ফেরত পেতে পারেন। জনশক্তি ব্যুরো কর্তৃক অনুমোদন ছাড়া কোন বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে না। এছাড়া টিউশন ফি সংশি¬ষ্ট বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের বিপরীতে শুধু ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমাদানের ব্যবস্থা করা, সার্ভিস চার্জ ছাড়া কোনক্রমেই নগদ টাকায় লেনদেন করা যাবে না, এসব প্রতিষ্ঠান খোলার আগে সংশি¬ষ্ট ব্যক্তির নামে স্থানীয় থানায় পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করা এবং প্রতি ৬ মাস পর প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা। একই কথা জানিয়েছেন র্যাবের মিডিয়া অ্যান্ড লিগ্যাল শাখার পরিচালক কমান্ডার মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, স্টুডেন্ট ভিসা কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন শিক্ষার্থী প্রতারিত হলে সংশি¬ষ্ট ব্যক্তি থানায় আর্থিক প্রতারণার মামলা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে ওই সব প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হলেও কোন নীতিমালা না থাকায় পরে আইনের ফাঁকফোকর গলে তারা বের হয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ ও র্যাব সদর দফতরের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১০ বছরে রাজধানীতে স্টুডেন্ট ভিসা কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী প্রতারণার শিকার হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারিত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরবর্তীকালে তেমন কোন উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে পারেনি, বরং কিছুদিন মিছিল-সমাবেশ করে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, ফার্মগেট, মহাখালী ও কাকরাইল এলাকায়ই এ ধরনের অন্তত দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব এলাকার মোড়ে দাঁড়িয়ে নজর বুলালেই ওই সব প্রতিষ্ঠানের বড়-ছোট সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। এফএসিডিক্যাব নেতারা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরকারকে অবশ্যই আইন প্রণয়ন করতে হবে। সংগঠনটির সহসভাপতি ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এসএসবিসিএলের কর্ণধার সুমন তালুকদার বলেন, স্টুডেন্ট ভিসা কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানকে নীতিমালায় আনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই বড় ভ‚মিকা পালন করতে হবে। এছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো শাখায় ‘ফরেন স্টাডি লাইসেন্স’ ইস্যু করা এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সেখান থেকে এনওসি (ছাড়পত্র) গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
https://digitallnews.com/education/2-98/
তথ্যসুত্র : ডিজিটালনিউজডটকম
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:৪০