সে অনেক অনেক আগের কথা। আমাদের রাজ্য শাসন করতো চার-চারটা রাক্ষস। তাদের কথাতে আমরা মানুষেরা উঠতাম, বসতাম। সত্যি কথা বলতে কী, শক্তিহীন, বলহীন আমাদের এছাড়া আর করার কিছুই ছিল না। তারা আমাদের খাবার দিত, পোশাক দিত, ঘর বানিয়ে থাকতে দিত, আমাদের আনন্দ- বিনোদনের জন্য যা যা দরকার, সব দিত। তারপর একসময় কারো বয়স পঞ্চাশ হলেই তাকে ধরে গিলে খেতো।
চার রাক্ষসের মধ্যে আবার প্রতিনয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকতো। এই সংঘাতের কারণে প্রায়ই পঞ্চাশে উপনীত হবার আগেই আমাদের অকাল মৃত্যু হত। পঞ্চাশ হলে খেয়ে ফেলুক- এটা আমরা আমাদের ভবিতব্য হিসেবেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু যখন তখন যুদ্ধের কারণে তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুটা কেউই মানতে পারতাম না। এই চরম দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে সবাই খুব চিন্তার মধ্যে ছিলাম। কিছু একটা করা উচিত সবাই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু মনোবলহীন, আত্মবিশ্বাসহীন, ভীতুর ডিমেরা সব করার কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই এভাবেই আমাদের চরম নিষ্পেষিত পরাধীন জীবন কাটাতে হচ্ছিল।
একসময় রাক্ষসেরা আমাদের জন্য পড়াশুনার আবিষ্কার করল। বাধ্যতামূলক করে দিল পড়াশুনা। কোন বিষয়ই চারটি রাক্ষসের ঐকমত্য না হলেও এই ব্যাপারটাতে তারা চারজনই একমত হয়েছিল যে একজন অশিক্ষিতের চাইতে শিক্ষত কাউকে গিলে খাওয়া নাকি অধিকতর আনন্দদায়ক। এই উদ্ভট মতামতের কারণটা আমাদের অজানা ছিল। তাছাড়া মানুষ হয়ে রাক্ষসের মানসিক অবস্থা বুঝার উপায়ও ছিল না আমাদের।
তো রাক্ষসদের প্রণয়ন করা সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম পাবলিক পরীক্ষা ছিল রা.পূ.শি পরীক্ষা। মানে রাক্ষস পূজা শিক্ষা পরীক্ষা। একবার এমনই এক পরীক্ষার প্রথম দিন চারটা রাক্ষস তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসল। আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল পুরো রাজ্য জুড়ে। আবার তবে অকালে প্রাণ হারাবে নির্দোষ কিছু মানুষ। আবার কতো মায়ের বুক খালি হবে। হাহাকার ছড়িয়ে পড়বে রাজ্য জুড়ে। কী করা যায়? কী করা যায়? কিছুই করার নেই। সবাই যে তখন খামখেয়ালী রাক্ষস দেবতার হাতের পুতুল। একটা কাজই করার ছিল কেবল। সেটা হল পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দেয়া। পরীক্ষা পরিচালনাকারীরা তাই তড়িঘড়ি পরীক্ষার তারিখ পেছানোর মিটিঙে বসলেন। আর যাই হোক পরীক্ষা দিতে গিয়ে কোমলমতি শিশুরা সব মারা যাক- এটা কেউ ভাবতেও পারছিল না। আর তখনই বেঁকে বসল পরীক্ষার্থী শিশুরা। তারা ঘোষণা করল, পরীক্ষা পেছালেও কোন লাভ হবে না। তারা ঠিক করেছে এহেন হানাহানি, সংঘর্ষ বাতিল ঘোষণা না করা হলে তারা কখনই পরীক্ষায় বসবে না। রাজ্যের শাসকদের মধ্যে এহেন ঘনঘন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে, এভাবে প্রতিনিয়ত গ্রাম জনপদ ধ্বংস হতে থাকলে পরীক্ষা দিয়ে পড়াশুনা করেই বা কি লাভ? তাই তারা সবাই ঠিক করল আগে হোক চার রাক্ষসের মধ্যে শান্তি চুক্তি। তারপর তাদের পরীক্ষা।
১০ বছরের ছোট মনুষ্য বাচ্চাদের কাছ থেকে এমন প্রতিবাদ মানুষ বড়রা তো বটেই রাক্ষসরাও আশা করেনি। ছোটদের মুখে শান্তি প্রতিষ্ঠার এমন বক্তব্য শুনে, শান্তিময় রাজ্যের আকাঙ্খার কথা শুনে রাক্ষস চতুষ্টয় বেশ লজ্জা পেল। তারা যুদ্ধের দিন শান্তির জন্য আলোচনায় বসতে বাধ্য হল।