নাহ! খবরটি কারও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবু বিশ্বাস করতে হচ্ছে। টুইটার, বিবিসি নিউজসহ পৃথিবী বিখ্যাত নিউজ পোর্টালগুলো, এমনকি খোদ নোবেল.অর্গ ওয়েবসাইট সহ আরো নামী দামী সব ওয়েবসাইট ফলাও করে নিউজ ছেপেছে, এবারের শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছে ছোট্ট বাংলাদেশের ছোট্ট এক মফস্বল শহরের বাসিন্দা জনাব কুদ্দুস। একবার নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ছাত্র লীগের মধ্যে ভয়াবহ একটা যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তির বারতা নিয়ে এসেছিল সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন সবার হাতে হাতে ছিল কাঁটা রাইফেল, দা, ছুরি, কিরিচ, চাপাতি ইত্যাদি ভয়াবহ সব অস্ত্রশস্ত্র। কুদ্দুসের একক চেষ্টায় পুরো ক্যাম্পাসময় ছড়িয়ে পড়েছিল শান্তির সুবাতাস। সবাই অস্ত্র ফেলে একে অন্যকে মিষ্টিমুখ করাতে বাধ্য হয়েছিল সেবার। শান্তির পথে এতো বড় চেষ্টা এর আগে নাকি কোথাও কেউ করেনি। তাই নোবেল কমিটি কুদ্দুসকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু না দিয়ে পারেনি।
সকাল আটটায় বিবিসি ওয়েবসাইটে খবরটি দেখেই কুদ্দুসের বন্ধু রহিম তাকে কল দিল। কুদ্দুস তখন কেবল ঘুমুতে গেছে।
হ্যালো। কুদ্দুইচ্চ্যা?
হ। কি অইসে।
তুই তো ব্যাটা মাইরা লাইছস।
ক্যা। কি অইসে। কুদ্দুস নির্বিকারভাবে জানতে চায়।
তুইতো ব্যাটা নোবেল পাইয়া ফালাইছস।
হ। পাইসি। তো কী অইছে? আমারে ঘুমাবার দিবি না? কুদ্দুসের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।
কী কস্ ব্যাটা। এতো বড় একটা খবর দিলাম। আর তুই আমারে ঝাড়ি দিস?
হ। দিসি। তো কী অইছে? আমি ঘুমামু। গুড নাইট।
হালায় কয় কি! লাইন কেটে যাওয়া ফোনের দিকে রহিম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
কল কেটে দেয়ার একটু পরেই কুদ্দুসের ছোট্ট মেস রুমের দরজায় টোকা পড়ে।
কুদ্দুস বিছানা থেকে নেমে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দেয়। সামনে একদল সাংবাদিক দেখে সে চোখ রগড়ে বিছানায় গিয়ে বসে। এদের সবাই কুদ্দুসের এলাকার। লোকাল পত্রিকার সাংবাদিক।
কুদ্দুস ভাই!! আপনি তো নোবেল পেয়ে গেছেন! সব সাংবাদিক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে।
হ। পাইসি। এটা কোন ব্যাপার হল। ১৭ বছরের মালালা পায়া যায়গা আর আমার বয়স তো ৩৪ পেরিয়ে ৩৮ হতে চলল। মালালার ডাবল। ঐ হিসাবে তো আমার দুইটা নোবেল পাওয়ার কথা ছিল।
কুদ্দুস ভাই, আপনি এমন কী করলেন যে নোবেল পেয়ে গেলেন? তাও আবার শান্তিতে!
ওয়েবসাইটে লেখসে। পইড়া দেখো গা। আমার ঘুম পাইসে।
এমন সময় বাইরে গাড়ির আওয়াজ। দরজা দিয়ে দেখা গেল চ্যানেল আই এর লোগো লাগানো একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে ক্যামেরা নিয়ে লোকজন নামছে।
এরই মধ্যে চ্যানেল নাইনের এক সাংবাদিক (হাতের মাইক্রোফোন দেখে বুঝা গেল) প্রশ্ন করল, আপনি সেবার কিভাবে মারামারি থামালেন কুদ্দুস ভাই?
কুদ্দুস বেশ মজা পেলেও ভাবে ভঙ্গিতে সেটা বুঝতে দিল না। বিছানার উপর আসন পেতে জিজ্ঞেস করল, লাইভ দেখাচ্ছেন?
হ্যা কুদ্দুস ভাই, নিউজটা লাইভ যাচ্ছে।
ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কুদ্দুস বলা শুরু করল,
আসলে আমি তেমন কিছুই করি নাই। ভার্সিটিতে সেদিন যখন প্রায় যুদ্ধ লাগে লাগে ভাব, তখন বিশ্ববিদ্যারয়ের টিভি রুমে গিয়ে টিভির সামনে মাইক লাগিয়ে দিলাম। তখন মিলার ডিসকো বান্দর গানটা চলছিল। সবাই গান শুনে দৌড়ে টিভির সামনে চলে আসল। মিলার নাচ আর গান একসাথে দেখে সবাই মারামারির কথা ভুলে গেল। এই আর কি।
বক্তব্য শেষ হতে না হতেই কুদ্দুসের মোবাইল বেজে উঠল।
হ্যালো এটা কি কুদ্দুস সাহেব?
হ আমি কুদ্দুস।
আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছি। আপনি ভাল আছেন? আপনাকে অভিনন্দন। আপনার এই নোবেল জয়ে আমি নিজেই আপনাকে কল দিলাম। খুশিতে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে!
কুদ্দুস কোন রকমে কেবল বলতে পারল, আপনাকেও ধন্যবাদ।
আচ্ছা কুদ্দুস সাহেব, আমি নিজে কতো চেষ্টা করলাম নোবেল জিততে কতো টাকা খরচ করলাম। কিন্তু পারলাম না। আমাকে বলেন তো, আপনি কিভাবে নোবেলটা ম্যানেজ করলেন। ঠিক কতো টাকা ডোনেশন দিতে হয়েছে আপনাকে? আসলে এটা জানতেই আমি কল করলাম।
স্যার, এটা তো আপনাকে এখন বলা যাবে না। আমার সামনে সব সাংবাদিক ভায়েরা আছেন। তবে এটা জেনে রাখেন এটা ছোট্ট একটা ট্রিক। আপনি যখন জানতে চাইছেন, জানাবো। চিন্তা করবেন না। আপনিও নোবেল পাবেন।
ইঁশ! আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে! ওকে কুদ্দস সাহেব। আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনার এলাকার ডিসি সাহেবকে বলে দিচ্ছি। উনি কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে পৌছে যাবেন আপনার ওখানে। আপনি চলে আসবেন উনার সাথে। আমরা না হয় প্রাইভেটলি কথা বলব।
প্রাইভেটলি? ঠিক আছে ম্যাডাম।
কলটি কেটে গেলে আবার সাংবাদিকরা ঝাপিয়ে পড়ল কুদ্দসের উপর। এবার তারা কুদ্দস সাহেবের জন্ম বৃত্তান্ত, ঠিকানা, পড়াশুনা এইসব বিষয় টুঁকে নিতে থাকল। যে যার মতো করে নিউজ লেখার ব্রেইন স্টর্মিংও করে ফেলছে একই সাথে। ইন্টার্ভিউ পর্ব শেষ হবার আগেই ডিসি সাহেব এসে কুদ্দুসকে তার গাড়িতে তুলে নিলেন।
কুদ্দুস গাড়িতে উঠতে উঠতেই আবারো মোবাইলে কল। নিজের হঠাৎ করে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাওয়াকে বেশ এনজয় করা শুরু করেছে কুদ্দুস। সে কলটি ধরতেই ওপাশ থেকে-
হ্যালো, দিস ইজ অনারেবল বিরোধীদলীয় নেতা। আপনি কুদ্দুস বলছেন।
জ্বি, জ্বি আমিই কুদ্দুস।
আপনাকে আমরা আমাদের পার্টি থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ স্যার। অনেক ধন্যবাদ।
ওয়েলকাম। আপনার সাথে আমার একটা দরকার ছিল। মানে, আপনি কিভাবে নোবেল পেলেন এটা যদি আমাকে জানাতেন। আপনি কি একবার আমার মহলে আসতে পারবেন?
এ আর এমন কিছু না স্যার। ছোট্ট একটা তেলেশমাতি। ব্যাপারটা পরে খুলে বলব। এখন আমাদের ডিসি সাহেবের গাড়িতে করে প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছেন? নেতা চিৎকার করে উঠলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ইনভাইট করেছেন। উনিও বিষয়টা জানতে চাচ্ছেন কি না।
খবরদার আপনি ওখানে যাবেন না। এমনিতেই বাঁচি না। নোবেল পেয়ে গেলে তো কান ঝালাপালা করে ফেলবে।
কিন্তু স্যার, আমি তো অলরেডি ডিসির গাড়িতে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। রাখেন। দেখি কী করা যায়।
কলটি কেটেই নেতা তার দীর্ঘদিনের সাগরেদ কাল্লু মাস্তানকে কল দিলেন।
এই কাল্লু, শোন। ওই কুদ্দুস হারামজাদাটাকে প্রধানমন্ত্রী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওকে কিছুতেই ওখানে যেতে দেয়া যাবে না। ওকে আগে আমার এখানে নিয়ে আয়। যদি না পারিস তাহলে একেবারে শেষ করে দে। কিন্তু খবরদার কোনভাবে যেন ও প্রধানমন্ত্রীর মহল পর্যন্ত না পৌছাতে পারে।
ঠিক আছে স্যার। ও কিছুতেই ওখানে পৌছাবে না। এটা আপনার কাছে কাল্লু মাস্তানের ওয়াদা।
নেতা হাঁফ ছেড়ে কলটি কেটে দিলেন। কাল্লু মাস্তানের ওয়াদা মানে তা ১০০ ভাগ নিশ্চিত কথা।
কিছুক্ষনের মধ্যেই রাস্তার মানুষজন একটা বিভৎস দৃশ্য অবলোকন করল। কোথা থেকে পনের বিশ জনের মুখোশ পরিহিত একটা দল এসে ডিসি সাহেবের গাড়ি আটকে বন্দুক উঁচিয়ে পেট্রোল ঢেলে তাতে আগুন লাগিয়ে দিল। গাড়ির ভেতরের জলজ্ব্যান্ত চারজন মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
বাংলাদেশের রাস্তায় যখন একটা গাড়ি পুড়ছিল, তখন আমেরিকার হোয়াইট হাউসের অবস্থাও ছিল তুলকালাম। প্রেসিডেন্ট সাহেব নোবেল কমিটির উপর ভীষণ চটেছেন। জরুরী বৈঠক ডেকেছেন অবস্থা পর্যালোচনার জন্য। এত সুষ্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও নোবেল কমিটি এটা কী করল! ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্স আইডিএফকে এবার নোবেল পুরস্কার দেয়ার আদেশ থাকা সত্ত্বেও নোবেল কমিটি কী করে এত বড় স্পর্ধা দেখালো কোথাকার কোন কুডুসকে নোবেল দিয়ে? তাও আবার পুরস্কার ঘোষনা দেয়ার নির্দিষ্ট দিনের একদিন আগেই! এটা নিশ্চয়ই লাদেনের ষড়যন্ত্র।
লাদেন অনেক আগেই মারা গেছে স্যার! মিটিঙে উপস্থিত কেউ একজন প্রেসিডেন্টের ভুল ধরিয়ে দিলেন।
প্রেসিডেন্ট ওদিকে কর্ণপাত না করে বললেন নোবেল কমিটির প্রধানের সাথে টেলিফোনে আলাপ করিয়ে দিতে। তার আগে নির্দেশ দিলেন কুডুসকে একটা অভিনন্দন বার্তা পাঠাতে। আফটার অল সে তো পুরস্কারটি পেয়েই গেছে। অভিনন্দন না জানালে সবাই তার সমালোচনা করতে পারে।
অভিনন্দন জানানো শেষ হলে প্রেসিডেন্ট কথা বলা শুরু করলেন নোবেল কমিটির প্রধানের সাথে।
এটা তুমি কি করলে গর্দভের বাচ্চা গর্দভ। আমার নির্দেশ অমান্য করে তুমি কুডুসকে কি করে নোবেল দিলে? এতো সাহস তুমি কোথায় পেলে!
প্রেসিডেন্টের ধমক শুনেই প্রধানের প্যান্ট ভিজে গেল। তিনি কাঁপতে থাকলেন। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন,
না না না স্যা...আআর! আআপনি ভু..ভু..ভুল বুঝেছেন। ওই হা...হা...হারামজাদাটা আ..আ..আমাদের ওয়েবসাইট কয়েক ঘন্টার জন্য হ্যাক করেছিল স্যার.. সবগুলো ওয়েবসাইটই সে হ্যাক করেছিল! আপনি একদম চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা ব্যাপারটা কারেকশন করে দিয়েছি। ওয়েবসাইট এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে।