সকাল বেলা একটু হাটতে বের হয়েছিলাম। পথিমধ্যে হঠাৎ মাঝ বয়েসী এক ভদ্রলোক সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কবি সাহেব না?
সাধারণত সবাই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখালেখি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসাবে স্যার সম্বাধন করে। তাই হঠাৎ কবি সম্বোধনে বেশ তৃপ্তি বোধ করলাম এবং পাশেই তার বাড়িতে তাৎক্ষণিক চায়ের নিমন্ত্রণ না রেখে পারলাম না।
বাড়িতে ঢুকেই লোকটি হুলুস্থূল অবস্থা শুরু করে দিলেন। সবাইকে এতো উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করতে থাকলেন যে কর্তার এহেন উত্তেজনার পেছনের কারন জানার জন্য বাড়ির সবাই বিছানা ছেড়ে ড্রইংরুমে ছুটে আসতে বাধ্য হল।
এই যে দেখ, কে এসেছে। গতকাল রাতে তোমাদের ইনার কথাই বলেছিলাম। কবি সাহেব। খুব উঁচুদরের মানসম্পন্ন কবি। দেখেছো, সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকলে সবই সম্ভব। বলেছিলাম না, উনাকে যদি একবার পেতাম? সৃষ্টিকর্তা ঠিকই আজ সকালেই উনার দেখা পাইয়ে দিলেন। এতোদিন তো কেবল রেডিও টিভিতে দেখেছি। আজ সামনা সামনি দেখলাম। সালাম করো, সালাম করো।
ছোটরা যারা যারা সামনে ছিল সবাই দেখি পায়ে ধরে সালাম করতে এগিয়ে আসল।
এমন কবিভক্ত পরিবার পেয়ে বেশ ভাল লাগা শুরু হল।
বাড়ির সবার সাথে একে একে পরিচিত হলাম।
ভদ্রলোকের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে ডাক্তারি পড়ছে। মেজো মেয়ে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে এখন ভর্তির অপেক্ষায়। ছোট ছেলে ক্লাস নাইনে। স্ত্রী একটা এনজিওতে চাকরি করেন। আর ভদ্রলোক নিজে একটা ব্যবসার সাথে জড়িত। নিউমার্কেটে কসমেটিক্সের ছোটখাটো একটা দোকান আছে।
পরিচয় পর্ব শেষে গৃহিনী কাজের মেয়েকে নিয়ে চা বানানোর উদ্দেশ্যে ভেতরে চলে গেলেন। খুশীতে গৃহিনীর চোখগুলোর চকমক করা দৃশ্য চোখে পড়ল। বাড়ির গৃহিনীও কবি মানুষেদের এতো সম্মান করেন দেখতে পেয়ে আনন্দিত হলাম। অথচ একটা সময় ছিল একসময় যখন কবিকে কাকের সাথে তুলনা করা হতো।
কবিভক্ত ভদ্রলোকটি তারা বাচ্চা-কাচ্চা সহ আমাকে ঘিরে ধরে বসলেন।
কবি সাহেব, যে কারনে আপনাকে এভাবে নিয়ে আসলাম সে কথাই বলি সবার আগে, কী বলেন?
আমি অনুমান করলাম, নিশ্চয়ই তার পরিবারকে নিয়ে কবিতা লেখার আবদার হবে। আগে এক সময় এমন হতো। কবিদের তাৎক্ষণিকভাবে পরিচিতদের নিয়ে কবিতা লিখে দিতে হতো। সেই কবিতা আবার ফ্রেম করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। কালচারটা আবার ফিরে আসছে। এটা ভাল। বললাম, অবশ্যই বলেন।
আমার এই যে মেয়েটা, এরে আপনি একটু দেখবেন।
হু, দেখলাম। একটু কেন? চাইলে একটু বেশিও দেখতে পারি। কবিরা সুন্দরের পূজারী হয়। মেয়েটা দেখতে শুনতেও যথেষ্ট সুন্দরী।
না, কথাটা মনে মনে বললাম। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে এমন মন্তব্য করতে পারি না কখনো- এটা আমি খুব ভাল করে জানি।
কিছু না বলে তাকিয়ে আছি দেখে ভদ্রলোক বুঝিয়ে বললেন, সে আসলে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখালেখি সাবজেক্টে ভর্তি হতে চায়। মাত্র ২৫ টা সিটের জন্য যা কম্পিটিশন! বলেন, এতো কম্পিটিশন হলে চলবে? লেখালেখি বিষয়ে এখন তো সবাই ভর্তি হতে চাইবেই। আপনাদের সিট আরো বাড়ানো উচিত।
ভদ্রলোক ভুল বলেলনি। লেখকদের এতো রমরমা অবস্থা চারদিকে যে ভাল লেখক তৈরীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন লেখালেখি নামে একটা বিভাগ খুলতে বাধ্য হয়েছে। প্রথম প্রথম হওয়ায় সিট সংখ্যা খুব কম, তাই এতো কম্পিটিশন।
কবি হিসেবে এ বাড়িতে আমার মর্যাদার কারন বুঝতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোন রকমে বললাম, ঠিক আছে দেখা যাবে। ওকে বলেন ভাল করে পড়াশুনা করে ভাল করে পরীক্ষা দিতে।
জ্বি না, কবি সাহেব। এভাবে দেখলে হবে না। আপনি একটু ভাল করে দেখবেন প্লিজ। ওর খুব ইচ্ছা লেখক হবার। কিরে, তুইই বল না। ভদ্রলোক তার মেয়ের দিকে তাকালেন।
স্যার, স্যার, স্যার প্লিজ একটু হেল্প করেন। আমাকে আপনার সাবজেক্টে একটাবার ভর্তি করিয়ে দেন। দেখবেন আমি অনেক ভাল লেখক হবো। ঠিক আপনার মতো।
মা, তুমি পরীক্ষা দাও আগে। পরীক্ষায় ভাল করলে তো এমনিতেই সুযোগ পাবে। আর তাছাড়া এই বিষয়েই যে ভর্তি হতে হবে এমন তো কোন কথা নাই। দেখো না তোমার ভাইয়া ডাক্তারি পড়ছে। তুমিও চাইলে ডাক্তার হতে পারো।
থু! ডাক্তার এখন মানুষ হয় নাকি? ওটা একটা পঁচা প্রফেশন।
বল কী তুমি! তোমার ভাই তো ঠিকই পড়ছে।ও তো ঠিকই ডাক্তার হতে চায়।
এবার মেয়ের ভাই মুখ খলল, না স্যার। চাই না। এখন আমি মোটেও ডাক্তার হতে চাই না । আগে চেয়েছিলাম। ওটাই ভুল করেছিলাম। ডাক্তারি একটা প্রফেশন নাকি এখন!
কী বলছো তুমি বালক? ডাক্তারি মানে কি তুমি বুঝো না? কতো কতো মানুষের সেবা করতে পারছো তুমি। কতো কতো মানুষের জীবন বাঁচাবে।
সেবা করে কী হবে স্যার। এমবিবিএস পাশ করার পর তো কোন রোগীই আসবে না আমার কাছে। এমবিবিএসই কেন, কতো কতো এফসিপিএস পড়ে আছে আনাচে কানাচে। কয়জন রোগী তাদের খবর রাখে? কয় টাকাই বা তারা রোজগার করে? ডাক্তার হলে তো পাশাপাশি আমাকে ভিক্ষাবৃত্তি প্রফেশনটাকেও বেছে নিতে হবে বেঁচে থাকার জন্য।
ইশ! ছেলেটার পেছনে কতোগুলা টাকা শুধু শুধু খরচ হয়ে গেল। প্রাইভেট মেডিকেলের খরচ তো বুঝতেই পারছেন কবি সাহেব। এতো খরচ তুলতে গেলেও ছেলের সারা জীবন লেগে যাবে।
এদের কথা শুনে আমি অবাক হচ্ছি। আসলে সারাদিন কবিতা চর্চায় মগ্ন থাকলে আশেপাশের মানুষের চিন্তা ভাবনা থেকে কতোটা দূরে চলে যাওয়া হয় তা আমি অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারিছ। এরা তাহলে টাকা রোজগারের জন্য ডাক্তার হতে চায়!
গৃহিনী চা-নাস্তা নিয়ে এলেন। বললেন, এখনতো স্যার লেখকদের জয়জয়কার। একটা পত্রিকার পাতায় একটা গল্প লিখলেই পাঁচ হাজার টাকা সম্মানী। ব্লগে লিখলে তিন হাজার। একটা কবিতা লিখলেও পাঁচ-ছয় হাজার টাকা সম্মানী পাওয়া যায়।
পত্রিকায় কলাম লিখলে দেয় দশ হাজার টাকা। আপনি যদি সপ্তায় সাতটা পত্রিকায় লিখেন তবে আপনার সাপ্তাহিক আয় সত্তর হাজার টাকা! ভাবা যায়!
ছোট ছেলের অংকের হিসেবে আমিও কিছু ভেবে উঠতে পারলাম না।
তবু কিছুটা বুঝাবার চেষ্টা করলাম,
শুধু লিখলেই তো হবে না, ভাল মানসম্পন্ন লেখা লিখতে হবে। তবেই না পত্রিকায় প্রকাশ।
আলবৎ লিখলেই হবে স্যার। মেয়েটি যুক্তি দেখাতে চাইল। আপনি হিসেব করে দেখুন। বাংলাদেশে কয়টা পত্রিকা? গোটা বাংলদেশ জুড়ে অন্তত পঞ্চাশ হাজার পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এর সংখ্যা আরো বাড়ছে। ১০ হাজারটা বাংলা ব্লগ এখনি দাঁড়িয়ে গেছে। এতো সব পত্রিকা, ব্লগ লেখা কোথায় পাবে? সবগুলো লেখাই কি মানসম্পন্ন হবে?
কিন্তু লেখক কিংবা কবি তো জোর করে হওয়া যায় না। ভেতরগত প্রতিভাও থাকতে হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তো কেবল লেখালেখির কৌশলগলো শিখিয়ে দেই। যারা ভর্তি হচ্ছে তারা সবাই কি লেখক হতে পারবে?
পারবে স্যার, অবশ্যই পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখালেখি ডিগ্রি নিয়ে নিলেই নামের আগে লেখক শব্দটা লাগানো যাবে। ভদ্রলোক বুঝাতে চাইলেন।
আব্বু! দেখো না, সাকিব ভাইয়া থার্ড ইয়ারে উঠলো কেবল, তাতেই উনার বাসার সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে,
লেখক সাকিব হুসেন
বি. এ অনার্স (ঢাবি) (চলমান)।
উফ স্যার আমিও একদিন লেখবো, লেখক সামিনা চৌধুরী (বি.এ অনার্স, এম. এ, ঢাবি)। বাবা, আমিও কিন্তু বাসার সামনে সাইনবোর্ড ঝোলাবো। লোকে রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় পড়বে আর ভেবে অবাক হবে এ বাড়িতে একজন লেখক আছে! উফ! ভাবতেই মজা লাগছে।
ঝোলাস মা, ঝোলাস। ভর্তি হয়ে গেলেই তোর নামে একটা নেমপ্লেট বানিয়ে দেব সোনা। বাবা মেয়েকে আশ্বাস দিলেন।
প্লিজ স্যার, আমাকে ভর্তির সুযোগটা কেবল করে দিন। দেখবেন আমি কবি চে গুয়ভারাকেও হার মানিয়ে দেব।
চে গুয়েভারা তো মা কবি ছিলেন না। বিপ্লবী ছিলেন। মেয়ের ভুলটা ধরিয়ে দিলাম।
ওই হল স্যার। কবি আর বিপ্লবী কি আলাদা কিছু। কবিরাই বিপ্লব ঘটায়। মেয়ের সুন্দর যুক্তিতে আমি আনন্দিত হলাম।
প্লিজ কবি সাহেব, আমার মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমাদের মেয়ে তো এখন থেকেই লেখালেখি শুরু করে দিয়েছে। যা তো মা, গতকাল যে কবিতাটা লিখলি ওটা এনে একবার পড়া তো।
বাবার নির্দেশে মেয়ে দৌড়ে চলে গেলে খেয়াল হল চা এতোক্ষণে ঠান্ডা হতে চললো। অথচ বাড়ির কেউ আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল না কিংবা তুলে নিতে বললও না। অগত্যা নিজেই তুলে নিলাম সেটা। একটা বিস্কিটও নিলাম সাথে।
মেয়ে চলে এসেছে ততোক্ষণে।
স্যার পড়ে শুনাই?
শুনাবে? ঠিক আছে। শুনাও। আমি শুনি।
গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা
গরুদল বসে আছে নাহি ভরসা।
রাশি রাশি দা-রশি ঘরবাড়ি সারা
পালাবার পথ খুঁজে পায়নাতো তারা।
মেয়ের কবিতা পড়া শেষ হলে বাবা বললেন, দেখেছেন কবি সাহেব। কোরবানীর গরুর মানসিক অবস্থা আমার মেয়ে কিভাবে তার কবিতায় তুলে ধরেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকেও ভালই টুকলিফাই করেছে। প্রতিভা দেখেন! এই চরনগুলো যে কোন পরীক্ষায় ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে নিঃসন্দেহে।
হ্যা বাবা, চাইলে টুকলিফাই করে করেই অনেক কবিতা লেখা যায়। কবিতা লেখার জন্য নিয়মকানুন শিখতে হয় নাকি? খালি একটা সার্টিফিকেটের জন্যই স্যার আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ইচ্ছা। প্লিজ স্যার একটু দয়া দেখান। আমরা জানি আপনার হাতেই সবকিছু।
(মাঝখানেই শেষ করে দিলাম। আপনাদের মতামত জেনে পরের অংশ লেখার চেষ্টা করবো।)