এক চামচ লবন দেয়া যাবে?
এতোটাই অবাক হলাম যে ওয়েইটার লবন এনে কফিতে তা মিশিয়ে দেয়া পর্যন্ত গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না।
কী ব্যাপার, আপনার কি ডায়াবেটিস নাকি? অবশ্য ডায়াবেটিস হলেও কেউ কফিতে লবন খায় বলে আমার জানা নাই।
উত্তর না দিয়ে সে প্রথমে কফির কাপে চুমুক দিল। তারপর বলল, এটা আমাকে আমার ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
লবন মেশানো কফি আপনাকে আপনার ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়! কিন্তু কিভাবে?
আমি আসলে সমুদ্র তীরে বড় হয়েছি। প্রতিদিন বাবার সাথে সমুদ্রে স্নান করতে যেতাম। সেখানে ঘন্টা দুই সাঁতার কাটতাম। সাতার শেষে আমরা যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন আমাদের রক্ত-মাংসে লবন মিশে থাকতো। তারপর বাবা যখন কফি বানিয়ে দিতো, সেই কফির লবনাক্ত স্বাদ ও গন্ধ আমার শ্রান্ত দেহে অবারিত শান্তি এনে দিতো। ওটা ছিল পৃথিবীর সুন্দরতম গন্ধ। লবন মেশানো কফি আমাকে আমার দেশের কথা, আমার বাবা-মার কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমি মুগ্ধ হলাম। যে ছেলেটি এতো বছর পরেও বাড়ির কথা মনে করতে চায়, বাবার সাথে সময় কাটানোর কথা বলে, সে নির্ঘাত একজন ভালো মানুষ। হ্যা, আমার সেদিনকার সে ধারনা সঠিক ছিল। আমাদের বিবাহিত জীবনের বিশটি বছর খুবই আনন্দে কেটেছিল। তার মতো একজন সৎ-সজ্জন ব্যক্তি খুব কম আছে। সে আমাকে ভালোও বাসতো ভীষণ। আমিও চাইতাম তাকে সবসময় সুখে রাখতে, আনন্দে রাখতে। তার প্রিয় সব কাজ করতে পারলে আমার আনন্দ আর ধরতো না। প্রতিদিন ভোরে সে ঘুমে থাকতেই কম্পিউটারে তার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গিত ধরিয়ে দেয়া, ঘুম ভাঙতেই তার সামনে তার প্রিয় লোনা জলের কফি ধরিয়ে দেয়া, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে তার সাথে তার বই-পাঠ শুনা- সবগুলো কাজই করতাম খুব আনন্দের সাথে। তার জন্য কিছু একটা করতে পারার সে আনন্দ। সে আনন্দ, তাকে খুশি করতে পারার। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ এমন একটা মানুষকে আমার জীবনসঙ্গী করে দিয়েছিলেন বলে।
সৃষ্টিকর্তার উপর রাগও আছে বটে। ক্যান্সার নামক এক মরন ঘাতক তাকে আক্রমন করে বসলো তার বয়েস যখন মাত্র ৫০। তাকে সুস্থ করে তোলার কম চেষ্টা করিনি। জায়গা জমি বিক্রি করে দেশের সবচে নামী মেডিকেলে তার চিকিৎসা করাচ্ছিলাম। তারপর একদিন, হুট করে একদিন সে আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেল। আমার জন্য রেখে গেল সুখের অজস্র টুকরো টুকরো স্মৃতি আর একটা চিঠি- যা তার মৃত্যুর পর ডাক্তারের কাছ থেকে পেয়েছিলাম।
হাতে পাওয়া মাত্রই চিঠিটি পড়লাম।
‘ক্ষমা করো আমায়। তোমার সাথে আমার শুরুটাই ছিল মিথ্যা দিয়ে। সারা জীবন সেই মিথ্যা লালন করেছি বলেও ক্ষমা চাই। তোমার কি মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হবার কথা? সেদিন এতোটাই নার্ভাস ছিলাম যে চিনি বলতে গিয়ে বলে ফেলেছিলাম লবন। ভুলটা করার পরই বুঝতে পারি ব্যাপারটা। কিন্তু তখন হঠাৎ মনে হল ঠিক ঐ মুহুর্তে ভুলটা স্বীকার করে নেয়াটা হাস্যকর শুনাবে। আর কেইবা চায় প্রিয় মানুষটার কাছে নিজেকে হাস্যকর প্রতিপন্ন করতে। তাই ভুলটাকে শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত করতে তোমাকে নিজের সম্পর্কে এক গাদা মিথ্যে বলেছিলাম। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি সত্যিটা জানানোর। কিন্তু পারিনি, তুমি কষ্ট পাবে ভেবে। আজ আমি যখন মারা যাচ্ছি, তখন নিজেকে ভীষন অপরাধী মনে হচ্ছে। তাই বলছি, সত্যি কথাটা হলো, আমি লবন মেশানো কফি মোটেও পছন্দ করি না। কী যে এক অদ্ভুত বাজে স্বাদ! কিন্তু সারা জীবন সেই বিদঘুটে তেতো স্বাদের কফিটাই পান করতে হয়েছে। তুমি যদি আমায় জিজ্ঞেস করো, তোমার মুখের মিষ্টি হাসি দেখার জন্য এক বসাতে লক্ষবার ওমন কফি খেতে পারবো।
তোমার কাছে আমার একমাত্র সেই মিথ্যেটির জন্য ক্ষমা করো আমায়...’
পরদিন আমি নিজে সেই কফি বানালাম যা আমার স্বামীকে খেতে দিতাম। অ্যাহ! প্রথম চুমুকেই বমি বমি ভাবের সৃষ্টি হল। চাইলাম, তবু কাপটা শেষ করতে পারলাম না। অথচ তাকে কিনা দেখেছি মুখে প্রশান্তির ভাব নিয়ে কফিটা খেতে!