সঞ্জয় আর কায়েস দুই বন্ধু ভীষণ দাবা পাগল। একটা সময় ছিল যখন সুযোগ পেলেই দাবা খেলতে বসে যেত তারা। কত রাত যে তারা না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে দাবা খেলতে বসে। মনে পড়ে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে দাবা খেলে সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছিল দুজন। পরদিন পরীক্ষার হলে অসহায় অবস্থার কথা মনে পড়লে আজো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে! ইদানিং দুজনই চাকরী করে। একজন শিক্ষক, অন্যজন ব্যাংকার। চাকরীর কারনেই হোক অথবা বয়েসের কারনেই হোক এখন আর দাবার চর্চা আগের মতো হয় না। খেলায় দুজনের শেষ মুখোমুখি হওয়ার পর এক বছর চলে গেল। তাই অনেক দিন পর যখন তারা ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে একসাথে শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠল এবং মুখোমুখি দুটি সিটে বসল, তখন তাদের দুজনের মন আকুলি বিকুলি করতে থাকল দাবা খেলার জন্য। দাবা খেলার এমন ইচ্ছে যে করবে তা আগেই টের পেয়েছিল সঞ্জয়, তাই ব্যাগের ভেতর একটা দাবা বোর্ড ঢুকাতে ভুল করেনি সে। দুজনেই দাবাতে তুখোড়, তাই যতবার দুজনের মুখোমুখি হয়েছে, ততবার তুমূল প্রতিযোগিতা হয়েছে দুজনের। আজ অনেকদিন পরে খেলত বসলেও দুজনই তাই রোমাঞ্চিত।
দাবা খেলা শুরু হল। d4. মানে, মন্ত্রীর সামনের বড়ে দুই ঘর এগিয়ে দেয়া। কায়েসের প্রিয় চাল এটি।
Nf6. একটু অন্যরকম খেলতে চাইছে সঞ্জয়।
২. c4 e6
৩. Nf3 Bb4+
৪. Bd2
এই পর্যায়ে এসে সঞ্জয় বলে উঠল, না দোস্ত, এভাবে কেমন জানি খেলাটি ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে। আগের মতো বাজি ধরবি? জোশ হবে। মজাও পাবি।
বাজি! শিহরিত গলায় বলল কায়েস। মজা হবে তবে। কিন্তু অনেকদিন পর খেলছিতো, বিশ টাকার বেশি বাজি রাখতে পারব না।
ওকে। I have no prbs. বলেই পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে টেবিলে রাখল সঞ্জয়।
কায়েসও বিশ টাকা বের করল।
কায়েসের পাশে বসা লোকটি এতক্ষণ পত্রিকা পড়ছিলেন। বাজির কথা শুনে তিনি যেন নড়েচড়ে বসলেন। পেপার থেকে তার চোখ এখন দাবা বোর্ডেও সাদা কালো ঘুঁটিগুলোর উপর।
সঞ্জয় চাল দিল। ৪. ... Qe7
কায়েসের পাশে বসা ভদ্রলোকটির বোধ করি এ চালটি পছন্দ হল না। ইস! অজান্তেই তার মুখ দিয়ে শব্দটি বের হয়ে গেলে, সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, কি ভাই, ভুল করলাম নাকি?
না, তবে আরো ভালো একটা চাল ছিল।
আপনি দাবা খেলা জানেন বুঝি?
এই একটু আধটু জানি আরকি। ছাত্রাবস্থায় কলেজে দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলাম।
তাই বুঝি? কোন চালটি দিলে ভাল হতো বলছেন? আমি তো দেখছি না।
সঞ্জয়, এটা বাজির খেলা। কোন ডিসকাশন চলবে না। কায়েস তাদেরকে চুপ করতে বলল।
বাজিতে আমিও খেলতাম। আসলে, বাজি ছাড়া খেললে সিরিয়াসনেস আসত না। যদি কিছু মনে না করেন, আমিও বাজি ধরতে চাই। ভদ্রলোকটি আবদার করল।
কায়েস কিংবা সঞ্জয় দুজনই অবাক হল খুব। নিজেরা অনেকবার বাজি খেলেছে, কিন্তু তৃতীয় পক্ষের বাজি তারা কখনো দেখেনি। আর তাও তাদের খেলা নিয়ে বাজি! ব্যাপারটা তাদের কাছে একেবারে নতুন।
কায়েস বলল, কিভাবে?
লোকটি কায়েসের কথার উত্তর না দিয়ে তাকালো সঞ্জয়ের পাশে বসা লোকটির দিকে। কি ব্যাপার ভাই সাহেব। আপনি খুব ভাল দাবা বুঝেন, তাই না? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি দাবা খেলা দেখছেন।
জ্বি। দাবা আমার খুব প্রিয় একটা খেলা।
কি মনে করেন, কে জিতবে?
লোকটি তার উল্টোদিকের সিটে বসা কায়েসের দিকে ইশারা করে বলল, আমার তো মনে হয় উনার ডিফেন্সটা খুব ভাল হয়েছে।
আমার কিন্তু মনে হয় সঞ্জয় সাহেব জিতবেন। বাজি হয়ে যাক তাহলে!
বাজি! আমি কিভাবে বাজি ধরব? খেলছেন তো তারা দুজন।
আরে মশাই! এ বাজি হবে তৃতীয় পক্ষের বাজি। এমন বাজির কথা কখনো শুনেননি বুঝি! ক্রিকেট ফুটবলে এমন বাজি ধরে কতলোক শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল।
না মশাই, বাজি আমার কখনো পছন্দ না।
আরে, না করছেন কেন? সময় কাটানোর জন্য বাজি ধরছি। আসুন তো, ধরেন বাজি। উনারা বিশ টাকায় খেলছেন। আমরা না হয় দশ টাকা বাজি ধরব। মাত্র দশ টাকা।
দশ টাকা? কিছুটা চিন্তিত দেখাল লোকটাকে। ঠিক আছে, বলে পকেটে হাত ঢুকালেন তিনি। এতো করে যখন বলছেন আর যেহেতু মাত্র দশ টাকার, ধরলাম বাজি। এই নেন দশ টাকা। প্রথম লোকটিও একটি দশ টাকার নোট নিয়ে টেবিলে রাখলেন। রাখতে রাখতে বলেনে, আমি আতাউর, ব্যবসায়ী।
অপরজন বললেন, আমি আজিজ। এডভোকেট।
খেলা আবার এগুতে থাকল।
৫. Nc3 d5
৬. c*d5 e*d5
৭. Bg2 0-0
খেলা চলতে থাকে, চলতে থাকে কথা। ইতোমধ্যেই একে অন্যের সাথে পরিচিত হয়ে গেছে সবাই। আতাউর জানেন যিনি সাদা নিয়ে খেলছেন তিনি কায়েস। পেশায় একজন ব্যাংকার। আজিজ জানেন যিনি কালো নিয়ে খেলছেন তিনি সঞ্জয়। পেশায় শিক্ষক।
খেলা জমে গেছে।
৮. 0-0 Re8
9. Qb3 Bg4
আড্ডাও জমজমাট হচ্ছে। আড্ডা যখন খেলাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, যখন সঞ্জয় আর কায়েস আড্ডার কারনে খেলায় মনোসংযোগ করা কঠিন মনে করছে তখন, দুজনই এক সাথে কোন ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই বলে উঠল, আহ!চুপ করুনতো!
অমন ধমক খেয়ে দুজন দর্শক চুপ মেরে গেলেন। সবার মনোযোগ আবার খেলার দিকে।
১০. e3 a5
হঠাৎ পাশ থেকে একটা প্রশ্ন সবার মনেযোগে বিঘ্ন ঘটাল। টেবিলে টাকা রাখা কেন? বাজি?
করিডোরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। জিন্স প্যান্ট, টি শার্ট আর চোখে কালো একটা গ্লাসে ছেলেটিকে মন্দ লাগছে না। বয়েস কত বুঝা না গেলেও ত্রিশ যে এখনো পেরোয়নি এটা বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছে না কারুরই।
আজিজ সাহেব ছেলেটিকে অবস্থার গুরুত্ব বুঝাতে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, চুপ। কথা বলবেন না। বাজি চলছে। তুমূল প্রতিযোগিতা।
বাজি! ছেলেটির গলায় উত্তেজনা।
জ্বি। বাজি। পাশ থেকে বললেন আতাউর সাহেব। আমি সাদায় বাজি ধরেছি। বিশ টাকা।
কি মজা! আমিও ধরলাম। সাদার পক্ষে। ১০০ টাকা। বলেই ছেলেটি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল।
ছেলেটির এহেন কাজে চারজনের সবাই হতবাক। আপনি দাবা জানেন? আজিজ সাহেব কোন রকমে প্রশ্ন করলেন।
না, জানি না। তবে আমার বাজির হাত খুব ভাল। দেখবেন কালো জিতবেই।
ছেলেটি কাযেসের সিটের পাশের হাতলটিতে বসে খেলা দেখতে থাকল আর আশেপাশের সবাইকে ডেকে ডেকে বাজির কথা বলতে থাকল।
জানেন আমি যেখানেই বাজি ধরি সেখানেই জিতি। আমার বাজি ভাগ্য খুব ভাল। লটারীও জিতেছি অনেকবার। একবার কি হল জানেন? ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে একটা পত্রিকায় ক্যুইজ দিল। কে চ্যাম্পিয়ন হইব, কে রানারআপ, কে গোল্ডেন বুট পাইব। এইসব মামুলি প্রশ্ন আরকি। আমি যা ভবিষ্যদ্বানী করছিলাম একেবারে অক্ষরে অক্ষরে তাই হল, বুঝলেন?
কায়েস বিরক্ত হয়ে বলল, ভাই দেখছেন না, খেলছি। এভাবে বকবক করলে তো খেলতে পারব না।
আরে ভাই, আপনি চিন্তা করেন ক্যান। আমি আছি না আপনার পক্ষে। আপনি এমনিতেই জিতবেন। নেন, আরো পাঁচশ টাকা ধরলাম। বলে ছেলেটি পাঁচশ টাকা বের করল পকেট থেকে। কত হইল? মোট ছয়শ টাকা।
আজিজ সাহেব চুপ থাকতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে ছয়শ টাকার বাজি কে ধরবে বলুন? শুধু শুধু পাগলামী করছেন। টাকাগুলা নেন। পকেটে রাখুন।
না, না, এই রায়হান পকেট থেকে একবার টাকা বের করলে আর টাকা ফেরত নেয় না। যদি না তা ডাবল টাকা হয়। বাজি ধরার লোক অবশ্যই পাওয়া যাবে। কি ভাই, পেছনের সিটে বসা ভদ্রলোকের দিকে রায়হান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। ধরবেন না ছয়শ টাকা বাজি?
ভদ্রলোক এতক্ষণ নিরবে কথাবার্তা শুনছিলেন। রায়হানের প্রশ্ন শুনে তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন, না না, অতো টাকা আমি বাজি ধরব না। আর, তাছাড়া আমি খেলা বুঝি না।
অতো টাকা কই? মাত্র ছয়শ টাকা। চিন্তা করে দেখেন, জিতলে ছয়শ টাকা ঢুকবে আপনার পকেটে। দেন তো, ছয়শ টাকা দেন, টেবিলে রাখি। বেশ জোর গলায় রায়হান জবাব দিল। এবং হাত বাড়িয়ে দিল কণ্ঠের চাইতেও বেশি আত্মবিশ্বাসের সাথে। অমন আত্মবিশ্বাসের হাত ফিরিয়ে দিতে বোধ করি স্বয়ং বিধাতাও পারবেন না। তাই ভদ্রলোকটি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে টাকাটা দিয়ে দিলেন আর ভাবতে থাকলেন, ঠিকই তো, জিতলে ছয়শ টাকা পাওয়া যাবে। আজকালকার দিনে ছয়শ টাকা এভাবে বসে বসে কে রোজগার করতে পারে?
টেবিলে টাকাটা রাখতে রাখতে রায়হানের মাথায় আরেকটি চিন্তা আসল। সে তার হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে বলল, আমি বরং বাজির হিসেবটা লিখে ফেলি ঠিকঠাক ভাবে। হিসেব রাখা সহজ হবে তবে। ওভাবেই, যেভাবে সিটে হেলান দিয়ে বসেছিল সে, লিখা শুরু করল তার নোটবুকে।
টিম জনাব কায়েস (সাদা) ড্র বাবু সঞ্জয় (কালো)
কৌটা ২ ১ ২
বাজির পরিমান:
১. মি. আতাউর ১০.০০ টাকা (কালো)
২. মি. আজিজ ১০.০০ টাকা (সাদা)
৩. মি. রায়হান ৬০০.০০ টাকা (সাদা)
৪. মি. এমদাদ ৬০০.০০ টাকা (কালো)
এইটুকু লিখে সে তার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিল সবাইকে। দেখুন আপনারা, আমি মোটামোটি একটা ফরমেট তৈরী করে ফেলেছি। যেহেতু আমরা কোন খেলোয়াড় সম্পর্কে জানিনা, তাই দুজনের পক্ষে কৌটা ধরলাম সমান সমান- ২। আর ড্র এর পক্ষে কৌটা- ১।
বুঝলাম না। আজিজ সাহেবের নির্লিপ্ত কণ্ঠ শুনা গেল।
রায়হান জবাব দিল, খুব সোজা। আজিজ সাহেব বাজি ধরেছেন সাদার পক্ষে। বাজির পরিমান ১০ টাকা। যদি সাদা জিতে, তবে তিনি পাবেন বিশ টাকা। আর আমার দল জিতলে আমি পাব ১২০০ টাকা।
আজিজ সাহেব বিস্মিত কনেঠ প্রশ্ন করলেন, কিন্তু অতো টাকা কোথা থেকে আসবে??
কেন? বাজিতে আসবে। আরো লোক বাজি ধরলে অনেক টাকা হবে।
আর কে বাজি ধরবে, শুনি? শ্রাগ করলেন এমদাদ সাহেব।
ধরবে না কেন? এতো সহজে টাকা রোজগার! শেয়ার বাজার, ইউনিপে টু থেকেও তো এটা দ্রততর। আর সহজ ও। আমরা লোক বাড়ানোর চেষ্টা করব।
আজিজ সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, খুব মজার দেখছি! আমি আমার বাজির পরিমান বাড়িয়ে দিলাম। ১০ টাকা কেটে ১০০০ টাকা লিখেন।
আতাউর সাহেব বললেন, আমার ১০ কেটে ২০০০ লিখেন। ৪০০০ টাকা পেলে মন্দ হয় না ব্যাপারটা।
এইতো চমৎকার। রায়হান বলল। দেখি আর লোক পাওয়া যায় কিনা। সে রেলের বগিটার ঠিক মাঝখানে গিয়ে ক্যানভাসারের মতো গলায় বলতে শুরু করল,
সম্মানিত যাত্রীগণ,আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখানে একটি মজার খেলা চলছে। দাবা খেলার চাইতে মজার ও লড়াকু খেলা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। তার চেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে আজকের এই দাবা খেলা হতে পারে আপনার জন্য এক টার্নিং পয়েন্ট। আজকের এ খেলায় আপনি যত টাকা বাজি ধরবেন ফিরে পাবেন তার দ্বিগুন। আপনার পাঁচ হাজার টাকা ফিরে আসবে দশ হাজার হয়ে। পঞ্চাশ হাজার, এক লক্ষ। এত কম সময়ে দ্বিগুন টাকা আপনাকে দেবে না কোন ব্যাংক, বীমা অথবা কোন এমএলএম কোম্পানী। ট্রেন জার্নি থেকে আপনি বাগিয়ে নিতে পারেন অনকে অনেক টাকা।আমরা এষানকার সবাই বাজি ধরেছি, তাই দেরী না করে আপনারাও বাজি ধরুন যার যার সামর্থ্য মতো। সাদা নিয়ে খেলছেন তুখোড় দাবা খেলোযাড় মি. কায়েস আর কালো নিয়ে খেলছেন আরেকজন তুখোড় খেলোয়াড় মি. সঞ্জয়। বাজি ধরুন, বাজি ধরুন, বাজি ধরুন। ১০০০ টাকা বাজি ধরলে ২০০০ টাকা আয়। এত অল্প সময়ে এত টাকা আয়ের সুযোগ আর কোথাও পাবেন না, কোথাও পাবেন না, কোথাও পাবেন না।
উফ! কি শুরু করলেন আপনারা। আমাদের খেলতে দিন তো! কায়েস চুড়ান্ত রকমের বিরক্ত।
আরে ভাই, আপনি খেলতে থাকেন। দেখেন আপনাদেরও কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করে দেব আমি। দাবা খেলে কয় টাকা রোজগার করসেন, শুনি? দেখবেন আজ এই দাবা আপনাদেরও অনেক টাকা দেবে। আমি ব্যবস্থা করব। রায়হান খেলোয়াড়দের আশ্বত্ম করল।
খেলা এতোক্ষনে এগিয়েছে অনেক খানি। দর্শক জমে যাওয়ায় দুজনই খুব সাবধানী চাল দিচ্ছে। কেউ কারে নাহি হারে সমানে সমান।
১১. a3 B*f3
১২. B*f3 a4
১৩. Qd1 B*c3
১৪. B*c3 Qd7
দর্শক আসলেই এতোক্ষনে অনেক জমেছে। গোটা বগিটার সবার লক্ষ্য এখন এই খেলার দিকে। বাজির টাকাও অনেক জমেছে। টাকা রাখতে এখন রায়হান একটা ব্যাগ ব্যবহার করছে। অতি উৎসাহি যারা, তারা সিট ছেড়ে উঠে এসে বাজি ধরছে। একটু বয়স্ক যারা তারা রায়হানকে তাদের কাছে ডেকে নাম লিখাচ্ছে। এতো সহজে টাকা রোজগারের উপায় পেয়ে দু- তিনজন মহিলাও বাজিতে তাদের নাম লিখিয়েছে। একজন আতি চালাক অথবা অতি লোভী যাই বলেন না কেন, বাজি ধরেছে ৩০ হাজার টাকার। আসন্ন ঈদে কোরবানীর গরুর দামটা সে এখান থেকেই তুলে নিতে চায়।
আজকের এই বিশেষ দিনে এই নির্দিষ্ট বগিটিতে সবচেয়ে ব্যস্ত রয়েছে রায়হান। বাজির হিসাব রাখতে রাখতে সে গলদঘর্ম হয়ে পড়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা যারা খেলা দেখছে তাদের অনেকেই দাবা খেলা জানেনা। তারা ঘুঁটির সংখ্যা গুনে বুঝে নিতে চাইছে বাজিতে ধরা খেলোয়াড়ের কি অবস্থা! যারা দাবা বুঝে তাদের গা দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে এই শীতের দিনেও। চরম উত্তেজনাময় পুরোটা বগি। আশেপাশের বগিতেও খবর চলে গেছে বাজির। কেউ কেউ এই বগিতে এসে বাজিতে নাম লিখিয়ে নিচ্ছে। চারিদিকে চরম উত্তেজনা, চরম উত্তেজনা।
এমন সময় খেলায় সাদার চাল,
১৫. Rc1 কায়েস চালটি দিয়েই বুঝতে পারল আরেকটি ভাল চাল মিস হয়ে গেছে। মুখেও উচ্চারণ করল ব্যাপারটা। সঞ্জয়কে বলল, উফ! আরেকটি ভাল চাল ছিল আমার। মিসটেক হয়ে গেল।
কথাটি শুনা মাত্রই পাশে দাঁড়ানো একটা কমবয়েসী ছোকরা বলে উঠল, মিসটেক হল কেন? দেখে শুনে খেলবেন না? এভাবে ভাল চাল মিস করলে হবে?
আরেকজন তার সাথে সুর মেলালো, ধীরে ধীরে চাল দেন। ধীরে ধীরে। অনেক টাকা বাজি ধরেছি।
১৫... Na5 চালটি দিয়ে সঞ্জয়কে বেশ সন্তুষ্ট মনে হল।
১৬. B*a5 কায়েসকে ঘুঁটি কাটতে দেখে কে কে জানি হাততালি শুরু করল।
১৬. ... R*a5 এবার হাততালির শব্দ আরো জোরালো।
এ পর্যায়ে এসে কায়েস বলল, খুব মাথা ধরেছে। খেলতে পারছি না।
সঞ্জয় বলল, খেলাটার পজিশন লিখে নিচ্ছি। পরে খেলা যাবে। তুই একটু র্যাস্ট নে।
বা বা বাহ! এটা চলবে না। চলবে না। খেলা শেষ করতে হবে। জনতা থেকে কথা ভেসে আসল।
কায়েস বিরক্ত কনেঠ বলে উঠল, আমাদের খেলা আমরা বন্ধ রেখেছি, তাতে আপনাদের কি?
হাহ! বললেই হল। আমাদের খেলা! খেলা এখন আমাদের সকলের। আমরা সবাই বাজি ধরেছি। এ খেলা শেষ করতে হবে। রেজাল্ট আসতে হবে। জনতা থেকে কেউ একজন বলে উঠল। সাথে সাথে সবাই চিৎকার শুরু করল, খেলতে হবে। খেলতে হবে। খেলতে হবে। জনতার চোখে উত্তেজনার ছায়া দেখে কায়েস পরবর্তী চাল দিতে দেরী করল না।
১৭. Rc8 চালটি দেখে আজিজ সাহেব জিভ দিয়ে চুকচুক করে উঠলেন। বললেন, ভুল চাল।
কায়েস উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনি কি করে বুঝলেন ভুল চাল। কথা বলবেন না।
পেছন থেকে কে জানি বলে উঠল, তুই চুপ ব্যাটা। ভাল করে খেল।
আরেকটা কণ্ঠ বলল, উল্টাপাল্টা খেলবি তোর খবর হয়ে যাবে। আমার কতগুলা টাকা তোর নামে লগ্নি করা।
কায়েস এবার হতভম্ব। আর কোন কথা বলার সাহস পেল না। একবার কেবল সঞ্জয়ের দিকে তাকাল। সঞ্জয়ের সাথে চোখাচোখি হল তার।
সঞ্জয় উঠে দাঁড়ালো। বলল, এ ম্যাচটা আমি আর পারব না। আমি হার স্বীকার করছি।
বলেন কি মশাইইই! খেলার তো কুল কিনারা এখনো হয়নি। এখনি হার মেনে নিচ্ছেন! আতাউর সাহেবকে খানিকটা বিস্মিত মনে হল।
তুই বস। খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেলবি। কোন ফন্দি ফিকির চলবে না। যারা সঞ্জয়ের পক্ষে ছিল তারা সবাই এবার উত্তেজিত।
কে জানি বলল, কোন চালাকি করলে এমুন মাইর দিমুনা, বাপের নাম ভুইলা যাবি।
অনন্যোপায় হয়ে সঞ্জয় খেলায় বসল। মজা করে শুরু করা খেলা এমন ভয়াবহ অবস্থার তৈরী করবে ভাবেনি সে।
১৭. ... Rea8
কায়েস পরবর্তী চাল দিতে সময় নিচ্ছে। ভাবছে, কি খেলা এখন কি খেলায় পরিণত হল। অশেপাশে যতোজনের দিকে তার চোখ যাচ্ছে সবাইকে তার কাছে একেকটা ভ্যাম্পায়ার বলে মনে হচ্ছে। সবার চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে লোভের লেলিহান শিখা। কাউকেই হার মেনে নিতে প্রস্ত্তত বলে মনে হচ্ছে না। সবাই জিততে চাচ্ছে। অথচ খেলায় তো হারজিত থাকবেই।
কি আর করা! ফেঁসে যখন গেছে, খেলতে তো হবেই। চাল দিল সে।
১৮. Qc2
এবার সঞ্জয়ের চাল। পাঁচ মিনটি হয়ে গেল চাল দিচ্ছে না সে। কায়েসের পক্ষের লোকজন ক্ষেপে গেল। এই চাল দে, চাল দে। এতো দেরী করলে হবে?
সঞ্জয়ের কাছে নিজেদের গিনিপিগের মতো মনে হচ্ছে। চাল দিবে কি করে সে? খেলায় কিছুতেই মনোযোগ আসছে না তার। এ বেড়াজাল থেকে বেরুবে কিভাবে তারা। সঞ্জয় যদি হেরে যায় তো তার পক্ষের লোকজন কি আস্ত রাখবে তাকে? ফুটবলার এসকোবারের কথা মনে পড়ল তার। তার আত্মঘাতি গোলে কলম্বিয়া বিশ্বকাপে হেরে যাওয়ার পরে নিজ দেশের মাটিতে খুন হয়েছিল এই ফুটবলার। তার দোষ নাকি তার জন্য খেলায় হেরেছে কলম্বিয়া। লস হয়েছে কোটি কোটি বাজিকরদের। তার ক্ষেত্রেও কি অমন হবে? নিজের উপর রাগ হল তার। কি দরকার ছিল বাজি ধরার!
১৮... c6
সময় নিচ্ছে কায়েসও। কোন রকমে যদি স্টেশন পৌছা পর্যমত্ম কাটিয়ে দেয়া যায় খেলাটি। চাল দেয়ার আগে চারদিকে তাকাল সে। একটা লাঠি দেখে অবাক হতে হল তাকে। যে লোকটি ৩০ হাজার বাজি ধরেছে তার হাতে একটা লাঠি। মারবে নাকি তাকে লোকটা? তার দিকে অমন ভঙ্গিতে তাকাতে দেখে লোকটা বলল, তোমার নামে বাজি ধরছি। তোমাকে জিততেই হবে। না জিতলে বুঝবা। কঠিন সমস্যা! কি করা যায় ভেবে পাচ্ছে না কায়েস। আপাতত চাল দিল।
১৯. Rc1
খেলাটি কেমন জানি এলোমেলো লাগছে সঞ্জয়ের। আর খেলতে ইচ্ছে করছে না। যে কোনো ভাবে খেলাটি শেষ হলেই ভাল হতো। এমনকি সে যদি হেরেও যায় তাও ভাল। তবু এ নাটক তো শেষ হোক। ফোন বেজে উঠল সঞ্জয়ের। পকেট থেকে ফোন বের করল সে। তার স্ত্রী রিমা কল করেছে। রিসিভ করে কানে নিতে যাবে ফোনটা, এমন সময় এক সমর্থক তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, না না, এখন ফোন চলবে না। আগে খেলা শেষ হোক। ফোনে কথা বললে আপনার কনসেনট্রেশান ব্র্যাক হয়ে যাবে। আপনার শুভাকাংখী হয়ে এ ভুল আপনাকে আমি করতে দিতে পারি না। সঞ্জয়ের মুখ থেকে খুব খারাপ একটা গালি বের হয়ে আসছিল, কায়েস এটা বুঝতে পেরে বলল, উনি ঠিকই বলেছেন। মনোযোগ দিয়ে খেল। এমনিতেই কবিরের ভাল্লাগছিল না এখন এ ঘটনায় তার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। কেন যে খেলতে বসেছিল। আর জীবনেও সে দাবা খেলবে না বলে মনে মনে পণ করে বসল সে!
১৯... g6
২০. Qd3 Kg7
২১. R1c3 h5
দুজন খেরোয়াড় এতোটাই ভাল খেলে যে খেলা কিন্তু তার নিজস্ব গতিতে চলছে এখনও। দর্শকরাও জটলা পাকিয়ে খেলা দেখছে। যে খেলা তাদের অনেকেই জীবনেও দেখেনি, দাবা শুনলেই নাক সিটকিয়েছে, তারাও আজ নিবিষ্ট দর্শক। আসন্ন অভাবিত প্রাপ্তি স্বপ্নে বিভোর সবাই। হঠাৎ আজিজ সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। খেয়াল করা মাত্রই চিৎকার করে উঠলেন, রায়হান কই? রায়হান? সবার টনক নড়ল। তাইতো! ব্যাগ ভর্তি টাকা হাতে যে রায়হান এতোক্ষণ হম্বিতম্বি করছিল তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? সবাই আশে পাশে তাকাল। নাহ! কোথাও নাই। এতক্ষনের চালাক চতুর দর্শকেরা হঠাৎ করে বুঝতে পারল তারা কতোটা বোকা। রায়হান যে টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে এটা বুঝতে কারো দেরী হল না তবু। সবাই আরো উত্তেজিত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। যার যা ছিল তাই দিয়ে বাজি ধরেছিল। হঠাৎ কপর্দকশূণ্য হয়ে পড়ায় কি করবে, কি করবে না বুঝে উঠতে পারল না। ট্রেন এখনো চলছে একই গতিতে। রায়হান যাবে কোথায়? এ ট্রেনের ভেতরেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে নিশ্চিত। সবাই আক্রোশ ভরে বগি থেকে ছুটে বের হয়ে গেল। ট্রেন পরবর্তী স্টেশনে থামবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। তাড়াতাড়ি রায়হানকে খুঁজে পেতে হবে। একটু আগের লোকারণ্য বগিটি একেবারেই নিরব হয়ে পড়ল মুহুর্তের মধ্যে। ট্রেনটিও থামল। আমাদের কায়েস আর সঞ্জয়ও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কোন কিছু না ভেবেই তারা ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। যদিও এ স্টেশন তাদের গন্তব্য ছিল না।