আমার প্রিয় ব্লগার বন্ধুদের জন্য একটি ঈদ বিষয়ক গল্পঃ
গল্পঃ “বোনাস”
তিম্পা চাকরি করতে পছন্দ করে না। একটা নির্দিষ্ট রুটিনে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ধোপদুরস্ত হয়ে কোথাও যেতে ওর কখনোই ভালো লাগে না। তাছাড়া অফিস ছুটির পর বাড়িতে ফেরত আসা আরো কষ্ট। বিশেষ করে সেটা যদি বিকেলের দিকে ছুটি হয়। ফিরতে ফিরতে হয়ে যায় সন্ধ্যে। নিজেকে রাতকানা রোগীর মত মনে হয়। অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে পথ চলতে হয় ওকে।
বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগের সময় যা বেতন দেবে বলে প্রকৃতপক্ষে তা কেটে ছেটে মাস শেষে অনেক কম পরিমাণ প্রার্থীর হাতে তুলে দেয়। এমন ধারনা বানোয়াট নয়। বা কারো কাছে শুনে নয়। তিন তিনটে চাকরীর অভিজ্ঞতা থেকে ওর ধারনা হয়ে গেছে এইরকম। ফলে চাকরির প্রতি একেবারে বিতৃষ্ণা এসে পরেছে।
প্রতিদিনের পথ চলার কষ্ট। আরামের ঘুম নষ্ট করার কষ্ট। সারা মাস পরিশ্রম করে যথাযথ পারিশ্রমিক না পাওয়ার কষ্ট। সব বাদ দিয়ে এখন কিছুদিন ও বাসায় বসে আছে।
অবশ্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই ও হাঁপিয়ে উঠেছিলো। নিজের আয় করা অর্থের আলাদা একটা জোর আছে। মানসিক তৃপ্তি আছে। কি করবে ভাবছিলো। কি করা যায়। বুটিকের ব্যবসা করবে! হ্যাঁ এটা একটা চলমান ও লাভবান ব্যবসা। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে তার পোশাকের প্রয়োজন পরবেই। আর একটু ভিন্নতা দিতে পারলে সেটা সবাই লুফে নেবে। বিশেষ করে যারা আশেপাশেই থাকে। মার্কেটের ভিড়ভাট্টা একেবারেই পছন্দ করে না। তেমনটা হলে ও আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বাড়ি ভালো সাপ্লাই দিতে পারবে।
বুটিক খোলার পরামর্শ নিতেই রেশমা ভাবীর বাসায় গিয়েছিলো তিম্পা। তিন তলাতে থাকেন। বড় বোনের মতন। সময়ে অসময়ে অনেক সুপরামর্শ পাওয়া যায় ওনার কাছ থেকে।
তখন সন্ধ্যার একটু পরে। ওই সময়ে যদিও ভাবীর কথা বলার সময় থাকে না। বাচ্চাদের পড়াশুনা করান। কিন্তু, এছাড়া আর কখনই বা যাবে। প্রতিদিন তো আর যাবে না। দিনের বেলা প্রায় দুপুর পর্যন্ত বাচ্চার স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়া তখন সবারই রান্নাবান্নার সময়। অনেক ভেবে তারপর সন্ধ্যাবেলাতেই গেলো।
রেশমা ভাবীর বাচ্চা দুটো তিম্পাকে খুব পছন্দ করে। সবসময় হাসিমুখে সামনে আসে। সেদিন মিনিট দশেক পেরিয়ে গিয়েছিলো তবু কাছে এলো না দেখে ও জিজ্ঞেস করলো, “ রিশা, দিশা বাসায় নেই নাকি ভাবী?” “হ্যাঁ, আছে তো! ক্লাস টেস্ট আছে তো। পড়তে বসিয়েছি।”
তিম্পা গলা বাড়িয়ে ও ঘরে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো রিশা একটা টেবিলে পেছন ফিরে কিছু পড়ছে। ও এই বছর এ-লেভেল দিচ্ছে। আর বিছানায় ঘাঁড় গুজ হয়ে কান্না কান্না মুখ করে বসে রয়েছে দিশা।
রিশা চেঁচিয়ে বলছে, “কি হলো, পড়ো না?”
তিম্পা খেয়াল করে দেখলো, দিশা সম্ভবত পড়তে পারছে না। আর সে ওটা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না। ওকে ধমকে ধমকে পড়ানো হচ্ছে। দেখে ওর খুব মায়া লাগলো। ও পাশে গিয়ে আদর দিয়ে শান্ত করে বুঝিয়ে দিলো যখন তখন দিশার কাছে ওটা খুব সহজ হয়ে গেলো। তবু কান্না থামে না।
রেশমা ভাবীও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিম্পা হঠাত বলে ফেলেছিলো, “তোমার যখন কঠিন মনে হবে আমার কাছে নিয়ে এসো। বুঝিয়ে দেব।”
ভাবী বাচ্চাকে বলে উঠলেন, “তুমি ফুপিটার কাছে পড়বা?”
দিশা ঘাড় কাত করে সম্মতি প্রকাশ করলো। ভাবী মাস হিসেবে ওকে পাক্কা মাস্টারনী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দিলো। কথায় আছে না ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তেমনি তিম্পার ক্ষেত্রেও যেন সেটাই প্রযোজ্য। ও অনেক বছর টিউশনি করেছে। তাই মাঝে মাঝে ওটা ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও ফিরে ফিরে আসে। ভাবীর বাসায় গেলো কি উদ্দেশ্য নিয়ে। আর ফিরলো কি কম্ম করে।
তিম্পার মা শুনে প্রথমটায় একটু বিরক্ত হলো। “যা দুষ্টু! পড়বে তো নাকি জিনিসপত্র তছনছ করবে!”
পরদিন থেকে পড়া শুরু হয়ে গেলো। এটা ছিলো মাস তিনেক আগের ঘটনা।
রোজার মাস শুরু হয়েছে। জুলাই মাস পেরিয়ে আগস্ট মাস শুরু হয়ে গেছে। পাঁচ তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পরে তিম্পার মা বলে উঠলেন, “কি যে করে সব! ঈদের মাস। একটু তাড়াতাড়ি বেতনটা দিলে নিজের মত করে পছন্দের জিনিস কেনাকাটা করা যায়! না তা দেবে না!”
তিম্পা কিছু বললো না। কি বলবে!
মা বাসায় ছিলো না। রেশমা ভাবী এলেন সন্ধ্যার পরে। ইফতারীর পরে নামাজ পড়া শেষ। একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো তিম্পা। আজকে পড়ানো ছিলো না।
তিম্পাকেই দরজা খুলতে যেতে হলো। ভাবী ঘরে ঢুকেও বসলেন না। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই মিষ্টি হাসি হেসে বলে উঠলেন, “কেনাকাটার কি অবস্থা তোমার?”
“এইতো ভাবী। লাল জামদানী শাড়ির সাথে সবুজ রঙের কাতান ব্লাউজ বানাতে দিয়েছি।”
“ও মা, তাই! পড়ে কিন্তু দেখাবে আমাকে। তোমাকে শাড়ি পরে যা সুন্দর লাগে!”
কথাটা শুনে তিম্পার খুব লজ্জা লাগলো। “কি যে বলেন ভাবী! দাঁড়িয়েই থাকবেন? বসেন না!”
“এখন আর বসার সময় নেই।”
বলে হাত বাড়িয়ে পাঁচশত টাকার চারটি নোট বাড়িয়ে দিলেন। আর বললেন, “গুণে নাও।”
তিম্পা গুনে দেখতে দেখতে ভাবী আরো দুটি পাঁচশত টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে বললেন, “এটা দিয়ে ড্রেস কিনবে।”
তিম্পা অবাক হলো। মজাও পেলো। ঝকঝকে দাঁতের সারিতে এক ঝলক হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো, “বোনাস?”
ভাবী জবাব দিলো, “হুম! বোনাস!”
“আল্লা কি সুইট! এভাবে যদি সবাই ভাবতো!”
“এখন যাই কেমন? চুলায় তরকারী বসিয়ে রেখে এসেছি।” বলে ভাবী চলে গেলো।
তিম্পার ঈদের শপিং করা শেষ। এই বাড়তি এক হাজার টাকা দিয়ে ও কি করবে ভাবছে। এই বাড়তি হাজার টাকা যেন স্বপ্নের মত। টিউশনিতে কে কবে ভাবতে পেরেছে বোনাস পাবে। এরকম করে চিন্তা করতো যদি সবাই তাহলে বেকারত্ব নিয়ে কারো কষ্ট থাকতো না!
রেশমা ভাবির দেখাদেখি তিম্পার মায়ের মধ্যেও ব্যাপারটা সংক্রমিত হলো। তিনি রোজার মাসে শুদ্ধভাবে কোরআন শরীফ শিক্ষার জন্য আগে থেকেই হুজুর রেখেছিলেন। রোজা আসার আগেই ওনার পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বেতন মিটিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তবুও হুজুর মেয়েটিকে ফোন করে ডাকিয়ে আনলেন। পাড়ার পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের মেয়ে ঐ হুজুর। নাম ফাতেমা। ফাতেমা এসে বসতেই তিম্পার মা হাতে সাতশ টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, “ঈদে পছন্দের কিছু কিনবে, কেমন?”
“আল্লাহ, ফুপি এটা কি?” ফাতেমা লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ, এটা তোমার বোনাস।”
শুধু তাই নয়। কাজের বুয়ার জন্যও ঈদের মাসের বেতনের সাথে বাড়তি টাকা যোগ করে দিলো। বুয়া তো ভাবতে পারেনি যে ঐ টাকা পাবে। তাই ওর আনন্দটাও যাকাত ফেতরার চেয়ে বাড়তি টাকার মতই। চার সন্তানকে নিয়ে এবারের ঈদটা যেন আল্লাহর রহমত।
গরীবের মুখের ঝকঝকে হাসিটা তিম্পার মায়ের মনে এক অন্যরকম স্বর্গীয় প্রশান্তি ছড়িয়ে দিলো। এই প্রশান্তির সুযোগ যেন মহান আল্লাহপাক তাকে পরের বারেও দেন।
------