১
সকাল থেকে একটা কাগজ খুঁজে পাচ্ছে না নওরীন। নিজের আলমারির ড্রয়ার খুঁজলো। ডেস্কের ড্রয়ার, পড়ার টেবিল এমনকি শাড়ি-কাপড়ের নিচে কোথাও বাদ দিলো না। কিন্তু, খুঁজেই পাচ্ছেনা! খুঁজতে খুঁজতে মাথা পাগল অবস্থা! কোথায় রেখেছে?!
মা বললেন, "যখন যেটা খুঁজতে চাও সেটা পাওয়া যায় না। চুপ করে বসে থাকো।"
“হ্যাঁ, ছাতার এক কথা পাইছো! যখন যা খুঁজো, তা পাবো না! আমারতো এখনি লাগবে।“ ...বলে নওরীন গজগজ করতে করতে মায়ের আলমারির ড্রয়ার খুলতে হাত দিলো।
“আমার ওইখানে অনেক জরুরী কাগজ আছে। তুমি উলটপালট করে ফেলবা!”- বলে উঠলেন মা।
“হু, উল্টাপাল্টা হলে গুছায় দিবোনে!” বলে নওরীন পুরো ড্রয়ারটাই খুলে নিয়ে বিছানায় বসলো আয়েশ করে। এই এক জায়গাতেই খোঁজা বাকি।
ড্রয়ারে অনেককিছু রেখেছে মা। টুকটাক গয়নার বাক্স। কলম। পেনসিল। টেলিফোনের বিলের কাগজ। পানির বিলের কাগজ। আর রেখেছে অনেকগুলো প্যাকেট। প্যাকেটগুলো সব বিছানার ওপরে পাশে পাশে রেখে একটা একটা করে খুলে দেখছে কাগজটা পাওয়া যায় কিনা। যদিও জানে বেকার খুঁজছে। মায়ের ড্রয়ারে ওর সেই কাগজ পাওয়া যাওয়ার কথাই না।
একটি মোটা প্যাকেট হাতে নিলো। চওড়া খাম আরকি। মোটামুটি অন্য খামগুলো থেকে ভারী। উঁকি দিতেই দেখে অনেক ছবিসহ কাগজ। “কি ব্যাপার? এগুলো আবার কি?” বিড়বিড় করতে করতে সবগুলো কাগজ খুলে দেখতে লাগলো। কিছু ছেলের বায়োডাটা। কিছু মেয়ের। “এগুলো আবার কবে কে আনলো? আমাকে তো কেউ জানায়নি!” এর পরে বাকি যে কয়টি বায়োডাটা ছিল সবই মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।
একটি বায়োডাটা হাতে নিয়ে নামটা দেখেই অবাক হয়ে গেলো নওরীন! “আরেহ, এই কাগজ কি করে এলো আমাদের বাসায়?” মাকে জিজ্ঞেস করার জন্য খুঁজলো। মাকে ঘরে পেলো না।
ঐ কাগজটি হাতে নিয়ে বাকি কাগজগুলো ড্রয়ারে খামে ভরে যেভাবে ছিল রেখে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। নাম থেকে শুরু করে ইমেইল এড্রেস, মোবাইল নাম্বার সবই একই। আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছুই মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে গেলো এই লোক আর তৌফিক আসিফ একই ব্যক্তি।
তৌফিক এর বায়োডাটা এখানে কিভাবে এলো? নিজের প্রয়োজনীয় কাগজটা তো খুঁজে পেলোই না তার উপর আরেক ভাবনা জুটেছে।
২
মাকে তৌফিক আসিফের কথা বলে জানতে পেরেছে, এর সাথে ওর বিয়ের কথা হয়েছিলো। প্রথমে খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলো। ওর ক্যামেরা ফেস ভালো নয় বলে মা প্রথমে ছবি দেখাতে আগ্রহী ছিলেন না। শুধু বায়োডাটা পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ওনাদের অনেক চাপাচাপিতে ছবি সহই ইমেইল করেন। কিন্তু- এর পরে আর কোন খবর আসেনি। যেহেতু ওরা ‘ওকে’ করেনি তাই মা আর মেয়েকে কিছু জানাননি।
কথাগুলো শুনে অনেকটা সময় নওরীন থম ধরে বসেই আছে। জীবনে এতখানি অপমান বোধহয় আর কোথাও হয়নি। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? যে ছেলেকে ও এত্ত পছন্দ করে নিজেই অনেক চেষ্টার পরে যোগাযোগের লাইন জোগাড় করে কথা বলেছে, তার নির্লিপ্ততার কারণটা এখন ক্লিয়ার হয়ে গেলো।
- “ধ্যেত! ছেলেটা আগে থেকেই আমাকে চিনতো! অথচ, বুঝতেই দেয়নি!”
- “আমি যখন বলেছিলাম, ‘ফেসবুক এ ঈশিতা নওরীন একজনই আছে’ তখনো লোকটা মনে মনে কি জোরে জোরে উচ্চস্বরে নিশ্চয়ই হেসেছে!”
- “উহ খোদা এত অপমান কেন রেখেছিলে আমার জন্যে! নাহয় লোকটাকে আমি পেলামই না এই জীবনে!”
“অথচ তৌফিক যখন আমার ছবি দেখতে চেয়েছিলো, আমিতো দেখাতে চাইনি। সে কি তখন ভেবেছিলো আমি ওর সাথে চিটিং করছি?” হয়তো ভেবেছিলো। ভাবাটাই তো স্বাভাবিক, তাইনা?” নিজেকে নানাভাবে আগের পরের সবকিছু নিয়ে নিজের মনে বিশ্লেষণ করতে লাগলো।
“ইস, আমি কেন আগে একবারও জানতে পারিনি?” নওরীন এর পরবর্তী সময়গুলো অসহ্য হয়ে উঠলো। একদিকে না পাওয়ার বেদনা। আরেকদিকে অপমান!
৩
নওরীন কয়েকদিন ধরে ইয়াহুতে বসলে তৌফিককে দেখেও কথা বলতো না। কথা বলা নিজে থেকেই ছেড়ে দিয়েছিলো। মাসখানেক কোন কথা হয়নি।
তৌফিকই নিজে থেকে একদিন কথা বলে “কেমন আছেন?” জানতে চাওয়ায় আবার শুরু হয়েছিলো কথা। তারপর থেকে দুজনের কেউ না কেউ প্রথমে কথা শুরু করেছে। এমনকি অফিসের কাজে ইউএসএ যাওয়ার পরেও নওরীনের সাথে যোগাযোগ করেছে। আর নওরীন ভেবে নিয়েছিলো তৌফিক হয়তো ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই ভাবনাও ভুল মনে হলো, একদিনের কথায়। ঠিক একদিন না! কয়েকদিন!
নওরীন কথা বলতে চায়। কেমন আছে জানতে চায়। কিন্তু উত্তর আসে, “ভালো আছি।“ পাল্টা কোন প্রশ্ন আসেনা, “ও কেমন আছে”। লোকটা এমন অদ্ভূত কেন?
একদিন ইয়াহুতে কথা জিজ্ঞেস করেছে নওরীন, “আচ্ছা আমার প্রশ্নের উত্তর এত দেরীতে দেন কেন?”
- “আমিতো আপনার সাথে চ্যাট করছিনা!”
- “ওহ, সরি!”
নওরীনের খুব গায়ে লেগেছিলো। তাইতো। আমিই তো সব সময়, অথবা বেশিরভাগ সময়ে তৌফিক এর সাথে কথা বলতে চাই। ও তো চায় না! আগ্রহ নেই বলেই চায়না। তবু ও কেন এত আগ্রহ দেখাতে চায়? আর করবেনা। এভাবে পায়ে পরে কারো ভালোবাসা কি আদায় করা যায়!
৪
- “আপনিতো বলেছিলেন, আপনার ছবি দেখে আমার আকর্ষণ হবেনা!” বললো তৌফিক।
নওরীন মুচকি হাসলো। “হ্যা, আমার মায়ের ধারনা, আমাকে সামনাসামনি ছবির চেয়ে দেখতে ভালো। তাই আমি ছবি না দেখিয়ে সামনাসামনি দেখা করতে আগ্রহী ছিলাম।“
- “‘আপনার প্রোফাইলে বেগুনী জামা পরা যে ছবিটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছেন ক্যামেরার দিকে’ সেই ছবিটা কে তুলেছে?”
- “আমিই। কেন?”
- “ভালোইতো ছবি তুলেন আপনি। ওখানে আপনাকে প্রিটি লাগছে।“
- “ও তাই? থ্যাংক্স!” (নওরীন জানে সে কথা! তবুও লজ্জা পেয়ে একথা বলে উঠলো।)
- “তো, বলুন কবে আপনার বাসায় আমরা আসবো?”
- “আমরা বলতে?” নওরীন অবাক!
- “আমার পরিবার তাদের ছেলের বউ দেখতে আসবে তো!”
- “ও রিয়েলি?” বলে নওরীন হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করে টেবিলের উপরে এগিয়ে দিলো।
- “কী এটা?”
- “খুলে দেখুন। আশা করি চিনতে পারবেন।“
হাত বাড়িয়ে তৌফিক খুলে নিয়ে বলে উঠলো, “এ তো আমার বায়োডাটা। আপনি কিভাবে পেলেন?”
- “ওহ আপনি অভিনয় ছাড়ুন না!”
- “কি বলছেন?”
- “এই কাগজটি ইমেইলে এসেছিলো আমার বাসায় গত মার্চ মাসে। আর, আপনার সাথে আমার কথা শুরু হয়েছিলো কোন মাসে? মে তে। তার মানে আপনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। তাই না?” – এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে থামলো একটু। “অথচ, আপনি এমন ভাব করেছেন, আমাকে মাত্র জানলেন!“
- “ঘটনা ঠিক এইরকম না!”
- “ঘটনা যেরকমই হোক মিস্টার তৌফিক, আপনি আমাকে অলরেডি অনেক আগেই রিজেক্ট করেছেন।“ এবার কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পেল নওরীনের। অথবা, অন্তর্জ্বালা! কষ্ট! ওর এত সাধের পুরুষ ওকে আপন করে নিতে রাজী। অথচ, ব্যাপারটাই কেমন হয়ে গেছে, যেন তৌফিক নিজে নয়, ওর নিজের জোরাজুরিতেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এতো এখন আর সম্ভব নয়।
তৌফিকের পরিবারের মানুষগুলোর কাছে ওর মাথা হেঁট হয়ে যাবে যে!
নওরীন উঠে দাঁড়ায়। ওর এই কাজটুকুই বাকি ছিল। এ জন্যেই ও দেখা করতে রাজী হয়েছিলো। নইলে মাস চারেক আগেই ও তো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো।
.
.
.
.
.
.
এরকম স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। প্রায়ই তাঁর মাঝ রাতে এই স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়! কিন্তু আসিফ আর ওর হয়তো বাস্তবে, কোনদিনই আর দেখা হবেনা।
৫
মাস চারেক পর...
আসিফের সাথে দেখা হবার জন্য, ওকে সবকিছু বলে ঝাড়ি দেবার প্রবল আকাঙ্ক্ষার সময়টাও এক সময় ফিকে হয়ে আসে। তারও...
এক মাস রোজার পরে আজ পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর।
ঈদ এর দুপুর বেলা। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। নওরীন বসে আছে নিজের ঘরে। এবার ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার সময় পায়নি। রোজার মধ্যে অনেক ব্যস্ততা গিয়েছে ওর। এখন বেড়ানো শেষ আপাতত। কি করা যায়? ইন্টারনেট কানেক্ট করবে?
কিন্তু ঘুম ঘুম পাচ্ছে যে! এখন অনলাইনে না বসে বরং ঘুমানোই ভালো। বিকেলে কেউ আসলে ওর চেহারায় ক্লান্তি থাকবেনা। দেখতে ভালো লাগবে।
ওর ভাবনায় ছেদ পরলো মোবাইলের ম্যাসেজ আসার টুনটুন আওয়াজে, “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা...তুমি আমার সাধেরও সাধনা...”
মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেলো নওরীন। তৌসিফ আসিফ এর নাম দেখাচ্ছে। ওয়াও!!! ও আবার কি লিখে পাঠালো?? ...ম্যাসেজটা ছোট্ট। ‘ঈদ মুবারাক’ লেখা। একটু স্টাইল করে। ম্যাসেজ এর শেষে নাম দেয়া আছে।
খুশিতে মোবাইলটা অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে বসে রইলো ও। কিন্তু, নাহ...কিছুক্ষণ পরে মনটা ততটা খুশি থাকতে পারলো না।
আসিফ যদি ওকে পছন্দ করতো যথেষ্ট; যদি ওকে বিয়ের জন্য পছন্দ করতো, ও নিশ্চয়ই নিজে থেকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতো। ওই ম্যাসেজটা নিশ্চয়ই অন্য কাউকে দিতে গিয়ে হতে পারে এক সাথে অনেকজনকে পাঠাতে গিয়ে ওর নাম্বারটাও ইনক্লুড হয়ে গেছে। আর তাই ওর নাম্বারে ম্যাসেজ এসে গেছে। নওরীন যদি পালটা শুভেচ্ছা জানাতে যায়, হয়তো দেখা যাবে ওপাশ থেকে কোন পাত্তা তো পাওয়া যাবেইনা। বরং ছেলেটা বিরক্ত হতে পারে। তৌফিক তো ওকে ইগনোর করতেই চায়।
সারাদিনে অনেকবার মনে হলো, শুভেচ্ছা জানাবে কি জানাবেনা। যে যোগাযোগ সে নিজে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলো তা আবার নতুন করে চালু করে লাভ কি!
শেষে অনেক রাতে ঘুমাতে যাবার সময়, অর্থাৎ ঈদের দিন পার হয়ে যাচ্ছে তখন ওর মনে হলো, একটা ম্যাসেজ কি পাঠাবে? কোন ম্যাসেজটা পাঠাবে ভাবতে ভাবতে ঈদের পরদিন চলে আসলো। তবু ম্যাসেজ পাঠালো ও।
কিন্তু, যে কারনে খুঁতখুঁত করছিলো মনটা, সেটাই হলো শেষ পর্যন্ত। মোবাইলে ম্যাসেজটা ডেলিভার্ড হলো ঠিকই। কিন্তু ওপাশ থেকে আর কোন প্রতি উত্তর এলো না। এমনকি তার পরের কয়েকদিনেও কোন খবর এলো না।