শেষ পর্ব[/sb
আতিককে যতটা না ছবি দেখিয়া পছন্দ হইয়াছিলো তাহার সাথে আজকের এই কথা হইবার পরে তরূণীর ভাবের পরিবর্তন হইয়াছে। তরুণী তাহা কাহাকেও বলিতে ইচ্ছা করিলেও কহিতে পারিতেছে না। দেখা যাউক তাহাদের পক্ষ হইতে কি জবাব আসে। পূর্বেই তাহার কিছু বলিবার আবশ্যকতা নাই।
দিন দুয়েক বাদে তাহার সহোদর টেলিফোন করিলে সে আপনার কেহ পাইলো যাহাকে এই কয়দিনে ঘটিয়া যাওয়া ঘটনাবলী প্রকাশ করিয়া মনের গুমোটভাবখান হালকা করিতে পারে। পলাশ! তাহার জমজ ভ্রাতা। কিয়দ সময়ের আগে পিছে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলো। দুটিতে নারী পুরুষের ভিন্নতা বাদে আর সকলই একই বোধ হয়; আকার আকৃতি, বিদ্যাবুদ্ধি হইতে শুরু করিয়া অন্তর অবধি।
পলাশ জানিত তাহার বহিনের দেখিতে আসিবার কথা। আতিকের। মাঝে যে আরেক ভদ্রমহিলা তাহাকে দেখিয়া গিয়াছে তাহা সে জানিতো না। তাহাকে কেহ জানায় নাই। উক্ত ঘটনার পরে, পারুলেরও মনের অবস্থা এমনতর নিশ্চুপ হইয়া গিয়াছিলো যে কারূ সহিত কথা কহিতে মনে চাহিতেছিলো না। বিবাহ দিবার অভিপ্রায়ে পিতামাতা ইহা কিরুপ ব্যবহার করিলেন বুঝিতে না পারিয়া তরুণী একেবারে বাকরুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। একমাত্র পলাশের সহিতই সে তাহার সমস্ত গোপন ব্যথা মোচন করিয়া শান্তি পায় বলিয়া এক্ষণে জবান খুলিল।
- ভ্রাতা তাহার বহিনের কন্ঠস্বর শুনিয়াই জিজ্ঞাসা করিলো, “মন ব্যথিত বোধ হইতেছে!”
- পিতা আমাকে মাপিয়াছিলো চারদিন পূর্বে। কহিয়াছে আমি নাকি পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।
- এরুপ করিবার আবশ্যকতা কি?
- দিন চারেক পূর্বে আমাকে এক ভদ্রমহিলা দেখিতে আসিয়াছিলো। মহিলার সহিত মাতার তিন বার কথা হইয়াছিলো। ইহার পূর্বে তাহার পুত্রের উচ্চতা সমান সমান দেখিয়া আমি আরো লম্বা সুপুরুষের অভিপ্রায়ে এইস্থলে কথা আগাইতে অনুমতি দেইনাই। এইবার মনে হইয়াছে, “বিবাহ এত পিছাইয়া যাইতেছে। দেখাই যাউক না!” এই বলিয়া তাহাকে অনুমতি দিয়াছিলাম। তিনি দেখিতে আসিবার পূর্বে মাতা মারফত যাহা যাহা শুনিলাম তাহাতে পাত্রকে অপছন্দ করিতে পারিলাম না।
কিন্তু ভাই, তাহার মাতা আসিয়া আমার সম্মুখেই সমস্ত বৃত্তান্ত কহিয়া হাটে হাড়ি ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন! মাতা এইসকল পূর্বেই জানিতেন!!
পাত্রের মাতা আমাকে আয়নার সম্মুখে পাশাপাশি দাঁড়া হইয়া নিজের সহিত আমার উচ্চতা অনুমান করিতে চেষ্টা করিলেন। বলিলেন, “আমার পুত্র আমার চাইতে উচ্চতায় চার আঙ্গুল উপরে। তোমাকে লাগিতেছে তাহার চাইতেও বেশি। তুমিকি সত্যই সাড়ে পাঁচ ফুট?” আমি কি কহিবো? আমি তো যাহা জানিয়া আসিয়াছি তাহা হইতে সরিতে পারিতেছি না! আমি কিছুই কহিলামনা; চুপ করিয়া রহিলাম।
মাতা ও খালামনির চেহারা দর্শন করিয়া মনে হইতে লাগিলো, ইহারা আমাকে তখনই উচ্চতা কমাইয়া বলিয়া এই মহিলার পুত্রের সহিত গছাইয়া দিতে পারিলে যারপরনাই খুশি হইয়া যান। পাত্রের মাতাকে আমারও ভালো লাগিয়াছে ততক্ষণে। তিনি আমার সমূহ প্রশংসা করিয়াছেন। ভাবিতেছিলাম, “হউক না জামাই বাইট্টা। তথাপি এইখানেই বিবাহ হইয়া যাউক। যদি তাহারা আমার উচ্চতা মানিয়া লইতে পারেন।“
মহিলা বার বার করিয়া বলিতেছেন, “আপনার কইন্যা তো ফরশার কাছাকাছি। বিবাহের পরে আরো উজ্জ্বল হইয়া যাইবে। শুধু লম্বায় আর কতক কম হইলে আমাদিগকেও আর কোনও স্থানে পাত্রী খুঁজিতে যাইতে হইতোনা!“
অতঃপর বহুক্ষণ কথাবার্তা বলিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিয়া ভদ্রমহিলা নিজের বাটী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। মাতাকে বার বার করিয়া তিনি শুধু একটা কথাই বলিয়াছেন, “আপনার কইন্যা কি আসলেই সাড়ে পাঁচ ফুট?” ভাবখানা এই যেন পারুলের উচ্চতা যাহাই হউক, মাতা যাহা বলিবেন তাহাই যেন সঠিক মানিয়া লইবেন। ঘটনা যদিপ এরুপ ঘটিয়াছে বলিয়া প্রতিয়মান হয়, তাহা হইলে মাতা যদি জানিতেনই যে পাত্র খাটো, তাহা হইলে ঐ সময় পাত্রের মাতাকে তো বলিলেই পারিতেন যে তাহার কইন্যার উচ্চতা আরো এক ইঞ্চিখানেক কম। তাহার জইন্যে রাত্রীতে কেন সকলে মিলিয়া মাপিয়া আমার উচ্চতাকে কাটিয়া ছাটিয়া আমাকে ভ্রম প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিবেন! তিলকে তাল বানাইতে যদি তাহাদের কোন সমস্যাই না থাকিয়া থাকে, তাহা হইলে তখনই তো পুত্রের মায়ের মন বদলাইয়া দিয়া কন্যা গছাইয়াই দিতে পারিতেন!“
তাহার পরদিন ঐ ভদ্রমহিলাকে আবারও ফোন করিয়া তাহার আসল অর্থাৎ মিথ্যা উচ্চতা অবহিত করান হইয়াছে। আর, কইন্যাকে উত্তম ঝাজা সহকারে বকাঝকা করিয়া বলা হইয়াছে, “তাহার মতন এই রকম নির্বুদ্ধিসম্পন্ন কইন্যা জগতসংসারে আর একখানও নাই যে নিজের উচ্চতা বাড়াইয়া বলিবার কারণেই তাহার উচ্চতা দেখিয়া ডরাইয়াই পাত্রপক্ষ এতদিন ধরিয়া দূরে চলিয়া গিয়াছে। তাহা না হইলে তাহার বিবাহ আরো আগেই ঘটিতো!“
তরুণীর নিজের ধারনা, যত যাহাই ওনাকে অবহিত করানো হউক, ভদ্রমহিলা নিজে পাশে দাঁড়াইয়া উচ্চতা বুঝিয়া গিয়াছেন। তাহার পুত্রের চাইতে উচ্চতায় পুত্র-পুত্রবধুর সামঞ্জস্যখান কিরুপ হইবে তাহার ধারনা তিনি পাইয়াছেন। সুতরাং যাহা উচিত বলিয়া প্রতীয়মান হইবে তাহাই উনারা করিবেন।
...অনেকক্ষণ ধরিয়া বলিতে বলিতে তরূণী থামিয়া রহিলো।
তরুণীর ভ্রাতা এতটা সময় ধরিয়া চুপ করিয়া শুধুই শুনিতেছিলো। কিছুই কহে নাই। এক্ষণে সে বলিয়া উঠিলো, “পাত্র-পাত্রী বিবাহের সময় পাশে দাঁড়াইলেই তো সমস্ত ধরা পরিয়া যাইবে।“ ...বলিয়া হাসিয়া উঠিলো। এই হাসি শুনিয়া তরুনীর মনের মেঘখানি কাটিয়া মনের গহীনে রোদ ঝলমল করিয়া উঠিলো।
ইহার পরে ভ্রাতা জিজ্ঞাসা করিলো, “আতিক আসিবার কথা ছিল...তাহার কি হইয়াছে?”
- আসিয়াছিলো। সে আরেক কাহিনী। মাতার তো যাহার সহিত কথা বলিয়া থাকে তাহাকেই উৎকৃষ্ট বলিয়া ভাবিতে থাকেন। মাতার ধারনা হইয়াছে আতিক আসিবে এইখানেই বিবাহ করিতে।
- সেতো সুখবর! কবে আসিবে তাহা কি জানাইয়াছে?
- না। মাতাকে কহিয়া গিয়াছে, তাহার পিতার সহিত কথা কহিয়া আমাদিগকে সিদ্ধান্ত জানাইবে। কিন্তু যেই ঘটক মারফত আমরা তাহাকে পাইয়াছি সে কহিয়াছে, তাহাকে নাকি বলিয়াছে, “পাত্রী যেমন তেমন; পরিবারটিকে তাহার ভালো লাগিয়াছে!“
- পাত্রী যেমন তেমন মানে কি? (ভ্রাতা রাগিয়া উঠিলো!)
- আমার যতদূর মনে হইয়াছে, আতিকের প্রফেশনাল পাত্রী পছন্দ। আমি কিছু করি না! শুধুই বাটীতে বসিয়া থাকিবো। তাহার উপরে আমি কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলামনা ইহাও তাহাকে বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে দেখিলাম। বাটীর সমস্ত কিছুতে আমার হস্তশিল্পের নিদর্শন তাহাকে এতখানি মুগ্ধ করিতে দেখিলামনা। এইসব লইয়া তাহাকে এতটুকুও আগ্রহ প্রকাশ করিতে দেখিলামনা! শুধুই একই জিজ্ঞাসা কিংবা বেদনা তাহার চোখেমুখে ফুটিয়া উঠিলো!! “যদি প্রফেশনাল হইতাম অথবা ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রী হইতাম!”...তরুণী মৃদুশ্বাস গোপন করিলো।
- এই সকল তো সে মাতার নিকটে শুনিয়াই আসিয়াছে। জীবন বৃত্তান্তে এইসকলই উল্লেখ রহিয়াছে!
- তাহাই। সকলই যদি জানিতই যাহা তাহার পছন্দের শর্তের মইধ্যে পরিবেনা তাহা হইলে মিষ্টান্ন লইয়া এই আগমণের কি হেতু!
ভ্রাতার সহিত কথা সমাপ্ত করিয়া তরুণীর অন্তরে দুই রকম ভাবের উদয় হইলো। একবার তাহার মনে হইতে লাগিলো আতিক ফিরিবে। আবার মনে হইতে লাগিলো ফিরিবার আবশ্যক নাই। তাহার পরে তাহার আরো একখান বোধ হইতে লাগিলো, উভয় বিবাহ প্রস্তাবের মধ্যে ভদ্রমহিলার প্রস্তাবখানাই উৎকৃষ্ট ঠেকিতেছে। একে তো তাহার প্রশংসা বাক্যসমুহ কানে বাজিতেছে। তাহার উপরে ভাবিবার বিষয়, একটি মাতার অনুরূপ মানুষ। ঢাকা শহরের কেন্দ্রে তাহার চতুর্থ তলা বিশিষ্ট নিজ বাটি। অপরপক্ষে, আতিকের মাতা নাই। সেইস্থানে কোন মহিলা প্রাণীরও উপস্থিতি নাই। তাহার বাটীটিও শুনিয়াছে অতিশয় পুরাতন! পিতার একমাত্র পুত্র হইলেও তাহাতে পারুল সন্তুষ্ট হইতে পারিতেছিলো না!
মাতা তাহাকে বলিতেছে, “বিবাহের সিদ্ধান্ত লইতে সময় আবশ্যক। এত নিকট সময়ে তাহারা খবর লইয়া আসিবেনা। আমাদের অপেক্ষা করিতে হইবে।“
তরুণী সেই দিন হইতে অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে। সপ্তাহ যাইয়া মাসও অতিক্রান্ত হইতেছে। অপেক্ষা করিতে করিতে সে ভুলিতে বসিয়াছে কাহারা তাহাকে দেখিতে আসিয়াছিল। ইদানিং তাহার মনে হইতেছে, “আদৌ কি আসিয়াছিলো কেহ তাহাকে দেখিতে!” সমস্ত ঘটনাই তাহার স্বপন বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিলো!
এতটা দীর্ঘসময় ধরিয়া সিদ্ধান্ত লইবার অথবা পাত্রীপক্ষকে অযথা ঝুলাইয়া রাখিবারই বা আবশক্যতা কি! কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার মানসিক অবস্থা যদি পাত্রপক্ষ সামান্যতম অনুমানও করিতে পারিতো তাহা হইলে তাহারা বোধকরি এইরূপ ব্যবহার করিতে পারিত না!
ইহার পরে মাসকয়েক অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। বাটীতে অদ্য লোকে লোকারণ্য। আত্মীয়স্বজনে পরিপূর্ণ। সমস্তবাটী ধরিয়া কনিষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠগণের কলকাকলিতে গমগম করিতেছে। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন স্থান হইতে সকল আত্মীয়স্বজন আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। সকলের হাস্যোজ্জ্বল মুখমন্ডলে তাহাদের বাটীর প্রথম কন্যা সন্তানের বিবাহের আনন্দ উদ্ভাসিত।
সপ্তাহ দুয়েক আগে তাহাকে দেখিতে আসিয়াই পছন্দ করিয়া কাবিন করিয়া ফেলিয়াছে। পাত্র তাহাদেরই এলাকার ব্যারিস্টার গোফরান উদ্দিন সাহেবের একমাত্র ভাতিজা। পেশায় কার্ডিওলোজিস্ট। বেশ নামকরা ডাক্তার।
তাহাদের কোনও ডিমান্ড নাই। তাহারা একটি ভালো কন্যা খুঁজিয়া হয়রান হইতেছিলেন। এতদিনে জুটি মিলাইতে পারিয়াছেন। তরুণীর মাতাপিতাও শত শত পাত্র হইতে সর্বাপেক্ষা নির্লোভজনকে খুঁজিয়া অস্থির হইয়া যাইতেছিলেন! অথচ, বাটীর নিকটেই পাত্র থাকিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ আরো কয়েক প্রকার ঘটক ধরিয়া কত কত অপেক্ষার ঘনঘটা ঘটিয়াছেন!
তরুণীকে উত্তমরুপে সাজাইবার জইন্যে সৌন্দর্য্যকেন্দ্রে লইয়া যাওয়া হইয়াছে। ইহার পরে সকলে মিলিয়া কমিউনিটিসেন্টারে গমণ করিবে। সেইস্থানে পাত্রপক্ষের সমস্ত আত্মীয়স্বজন অপেক্ষা করিতেছে।
(সমাপ্ত)
আগের পর্বগুলোঃ
৪র্থ পর্ব
৩য় পর্ব
২য় পর্ব
১ম পর্ব