পর্ব-০১
পর্ব-০২
পর্ব-০৩
পর্ব-০৪
তরুণী ব্যাংকে গিয়াছিলো টাকা তুলিতে। কর্ম সমাপ্ত করিয়া বাহিরে আসিলো। “বস্ত্রের দোকানে যাওয়া আবশ্যক বোধ হইতেছে। কিন্তুক, বস্ত্রের নমুনা তো আনা হয় নাই। অন্য আরেকদিন কিনিলেই চলিবে।” ভাবিতে ভাবিতে ভাড়া ঠিক করিয়া রিকশাযানে চড়িয়া বসিলো। অদ্য নিজ বাটীর অভিমুখে রিকশাযান চলিতেছে।
হঠাৎ সুর করিয়া তাহার মুঠোফোনখানি গান গাহিয়া উঠিলো। তরুণী ব্যস্ত হইয়া ব্যাগ হাতড়াইয়া উহা খুঁজিয়া বাহির করিয়া কানে লাগাইয়া কিছু কহিবার পূর্বেই শুনিতে পাইলো তাহার মাতার ব্যস্ত কন্ঠস্বর, “শুনো, আতিক আসিতেছে!” তরুণীর মনে পরিলো, “আতিক! সেই লম্বা সুদর্শন!”...
মাতা পুনরায় কহিলেন, “তুমি কোনস্থানে রহিয়াছো? অন্য কোন স্থানে আজগে যাইবার আবশ্যক নাই। বাটীতে ফিরিয়া আসো।“ তরুণী তখন মাতাকে আস্বস্ত করিয়া কহিলো, “বাটীতে ফিরিতে আমার আর মিনিট কয়েক লাগিবে। তুমি উতলা হইয়ো না।“ মাতা আস্বস্ত হইয়া টেলিফোন সংযোগ কাটিয়া দিলেন।
তরূণী বাসায় ফিরিতে ফিরিতে ভাবিতে লাগিলো, “আমাকে কিরুপ দেখিতে লাগিতেছে!” যুবকের বহুত উচ্চাশা রহিয়াছে পাত্রীকে লইয়া। ‘ফরসা হইতে হইবে। লম্বা হইতে হইবে’ ইত্যাকার নানাবিধ শর্ত! বাহির হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় উপস্থিত হইলে তরুণীর চেহারায় রাজ্যের তৈল ভিড় জমায়! আজ যদিও অতি বেশিক্ষণ সময় সে বাহিরে অবস্থান করে নাই; রৌদ্রে ঘুরাঘুরিও করে নাই তাহাতে তৈল জমিবারও অবকাশ পায় নাই।
পাত্র খবর দিয়াছে সে আসিতেছে। অদ্যাবধি আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। তাহার মানে তো এইরুপও হইতে পারে যে, পাত্রকে তরুণীরই আবাস চিনাইয়া গৃহে প্রবেশ করাইতে হইতে পারে। এহেন ভাবনায় তাহার অতিশয় হাস্য আসিলো।
গৃহের নিকটে পৌঁছাইয়া গিয়াছে প্রায় এমন সময় তরূণী দেখিতে পাইলো, কে জানি এক যুবা একটুখানি ঘাড় গুজ করিয়া দাঁড়াইয়া! খয়েরী বর্ণের টি-শার্ট পরিয়া। এক হস্তে একখান চওড়া মিষ্টান্নের প্যাকেট। তাহার অতি নিকটেই তরুণীর নিজের বাটীর কাজের বুয়াও রহিয়াছে। তাহারা কি জানি আলাপচারিতা করিতেছে। এই কি তবে সেই যুবক! আতিক! কবে হইতে আসিবে আসিবে করিতে করিতে মাতার মুখে শুনিতে শুনিতে তাহার নামখানি হৃদয়ে গাঁথিয়া গিয়াছে।
তাহার দিকে পেছনে ফিরিয়া যুবক বাটীর সদর দরজায় না ঢুকিয়া আরো সামনের দিকে অগ্রসর হইয়াছে। এই সুযোগে তরূণী তাহার বাহনের ভাড়া মিটাইয়া দ্রুত পদে বাটীর ভিতরে প্রবেশ করিলো।
মাতা তাহার বাটীতে অস্থির হইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। তিনি এই অকস্মাৎ আগমণের অতিথিকে প্রায় দ্বি-প্রহর হইয়া আসিতেছে এরুপ সময়ে কি করিয়া আপ্যায়ন করিবেন তাহা ভাবিয়া না পাইয়া উতলা হইয়া যাইতেছেন বারংবার। তরুণীর পিতাও বাটীতে উপস্থিত নাই।
তরূণী তাহার নিজের কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইলো, সেইস্থানে তাহার দুই খালা তাহার বিছানার দুই পার্শ্বে বসিয়া তাহারই অপেক্ষা করিতেছেন। তাহাদের মইধ্যে কনিষ্ঠজন রন্ধনকক্ষে যাইয়া মাতার সহিত খাদ্য দ্রব্যাদির ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। আর বাকি জন তাহার রুপচর্চা ও কোন পোশাক পরিধান করা আবশ্যক হইবে তাহা বাতলাইয়া দিতে লাগিলেন।
তরূণী বাহির হইতে আসিয়াছে বলিয়া তাহার মুখমন্ডল ধৌত করিতে চাহিলো। তাহার খালা তাহাকে তাহা করিতে নিবৃত্ত রাখিলো এই বলিয়া যে, মুখ ধৌত করিলে চেহারার লাবন্যখান চলিয়া যাইবে, তাহার চাইতে যেরুপ আছে সেরুপই থাকা উত্তম হইবে।
ইতোমধ্যে কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হইয়াছে। মাতা তাহাকে পাত্রের সহিত দেখা করাইবার জন্যে ডাকিতে আসিলেন। আসিয়া তিনি দেখিলেন, কইন্যা তাহার যেরুপ ছিলো সেরুপই রহিয়াছে। পোশাক বা রুপের কোন ব্যত্যয় ঘটায়নাই। তাহাতে মাতা বিরক্ত হইলেন। তথাপি, দুই বহিনের সম্মুখে কিছুই কহিতে না পারিয়া তাহাকে ডাকিয়া সাথে লইয়া বাহিরের কক্ষে যেইস্থানে আতিক বসিয়া রহিয়াছে সেই স্থানে যাইয়া ঢুকিলেন।
মাতার পেছন দিয়া প্রবেশ করিয়া দেখিলো তাহার ভবিষ্যৎ পুরুষ হইতে যিনি আসিয়াছেন, অতি নিকটেই সোফায় বসিয়া। তরূণী তাহাকে দেখিয়াই সালাম জানাইলো।
আতিকও সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া সালামের উত্তর কহিলো। আতিকের এহেন দাঁড়াইয়া সালামের উত্তর প্রদানের প্রক্রিয়ায় তরুণীর ভিতরকার সমস্ত ভয় ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুহুর্তেই উড়িয়া চলিয়া গেলো। “উনি কি তাহার নিজের পার্শ্বে তরুণীর উচ্চতা মাপিতেই এরুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন?” ভাবিতে ভাবিতে তরুণী আতিকের সম্মুখে টেবিলের অপর পার্শ্বে সোফায় উপবেশন করিলো।
মাতা পাশে বসিয়া নিজ বাটী, তাহার সংসার ও সন্তানাদির সমূহ বর্ণনা প্রদান করিতে লাগিলেন। তরুণী বসিয়া বসিয়া কি করিবে? সে বসিয়া বসিয়া সম্মুখে বসা পাত্রটিকেই পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলো। কয়েকবার পাত্রের সহিত চোখাচোখিও হইয়া গেলো।
কিছুক্ষণ পরে মাতা তাহার কন্যার সহিত পাত্রের একান্ত কথা বলিবার সুযোগ করিয়া দিয়া সেখান হইতে সরিয়া গেলেন। তাহাকে তো দুপুরের খাবারেরও বন্দোবস্ত করিতে হইবে। খবর প্রদান না করিয়া এরূপ মধ্যাহ্নেই কেহ আসে নাকি পাত্রী দেখিতে! তাও খালি হাতে আগমণ করে নাই তাই রক্ষা!
পারুল ও আতিকের বহুক্ষণ কথাবার্তা চলিল। কিছুক্ষণ পরে তাহার মাতাও আসিয়া তাহাদের সাথে একত্রিত হইলেন। মাতার দুই বহিন বার বার করিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন, “পাত্রের সম্মুখে যেন পারুলকে বেশিক্ষণ রাখিও না। তাহা হইলে অযথা ক্ষুত বাহির করিতে সুযোগ খুঁজিবে।“ এদিকে কাজের দোহাই দিয়াও মাতা ও পাত্রের সম্মুখ হইতে পারুল অত সহজে ছাড়া পাইলো না। পাত্র তাহাকে জোর করিয়া বসাইয়া দিল এই কহিয়া, “উঠিতেছেন কেন? বসিয়া থাকুন না!” এহেন কথা বলিবার পর পারুল আর সে জায়গা ছাড়িয়া উঠিতে পারিল না। বসিয়া বসিয়া কথা শুনিতে লাগিলো। তাহাতে লাভ হইবার বলিতে যাহা হইলো তাহা এই, মাতা তাহাকে অনেক কথা যাহা বলিতে চাহেন নাই ইতিপূর্বে, অথবা খুশির আতিশয্যে মাতার কর্ণকুহরে আতিকের সমস্ত কথা প্রবেশ করিলেও মর্মভেদ করিতে পারিতেছিলো না। এই আতিক আসিবে আসিবে করিয়া, কতদিন ধরিয়া অপেক্ষা করিতে করিতে সকলের নিকটে হেনস্থা হইতেছিলো, “আতিক আর আসিবেনা” শুনিয়া। সেই আতিক আসিয়াছে! তাহার কথাই সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। এই খুশি তিনি কোথায় রাখিবেন ভাবিয়া পাইতেছেন না। তাহার ইচ্ছা করিতেছে বাটীশুদ্ধ সমস্ত লোকজনকে ডাকিয়া খবরখান এখনি জানাইতে।
আরও কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পরে, মাতা তাহাকে ভেতরে তাহার নিজের কক্ষে যাইতে আদেশ করিলেন। এক্ষণে পাত্রের সম্মুখ হইতে সরিতে ইচ্ছা করিতেছিলো না যদিও। তথাপি যাইলো। নিজের কক্ষে আসিতেই খালামনিদ্বয়কে দেখিল তাহার রসমালাই খাইতেছেন। তাহাকে দেখিয়া হাসিয়া বলিয়া উঠিলো, “তোমার বিবাহের মিষ্টি খাইতেছি!” তরুণী ভাবিলো, উহা নিশ্চয়ই পাশের দোকান হইতে তাহার মাতাই কিনিয়া লইয়া আসিয়াছিলো। পরে শুনিলো উহা আতিকই আনিয়াছে।
পাত্র আরো কিছুক্ষণ তাহার মাতার সহিত কথা বলিয়া বিদায় লইলো। মাতার নানী আসিয়া কহিলো, “কিরুপ দেখিলি তোর জামাইরে?” পারুল কহিল স্বলজ্জ হাসিয়া, “লোকটা খুবই সর্মিন্দা আছে। মিনমিন করিয়া কথা কহে!“ মাতার দিকে তাকাইয়া কহিলো, “ছবিতে তাহাকে আরো অধিক সুদর্শন দেখিতে লাগিয়াছে। সামনাসামনি তাহাকে খানিকটা নির্বুদ্ধির বলিয়া ঠেকিলো।“ মাতা তাহাতে একমত হইতে পারিলেন না। আতিককে তাহার কন্যার জামাতা হিসাবে অতিশয় পছন্দ হইয়াছে। এখন, শুভকাজটা সম্পন্ন হইলেই হয়। তাহার মন বলিতেছে এইস্থানেই কথা পাকাপাকি হইবে!
(চলিবে...)