১
নতুন নতুন বন্ধু যোগ করতে, তাদের সম্পর্কে জানতে শর্মীর খুব ভালো লাগে। তাই নিজের রিলেটিভ ছাড়াও ফেসবুক এর অন্য বন্ধুদের তালিকা থেকে বা হোম পেজ এ দেওয়া 'বন্ধু হিসেবে যোগ করতে পারেন' এমন কাউকে দেখলেই নাম কিংবা প্রোফাইল পিক দেখে পছন্দ হলে যোগ করে নেয় বা বন্ধুতার অনুরোধ পাঠায়। এমনি করে জানা অজানা অনেক বন্ধু ওর।
বড় আপা বলে, “তুই এতসব অচেনা লোককে কেন যোগ করিস? সবাই সমান নয়। আজেবাজে লোক দিয়ে এইসব জায়গা ভরা থাকে। ঝামেলা যখন বাঁধবে বুঝবি তখন ঠেলা!”
কিন্তু, শর্মী কখনো এসব কথায় পাত্তা দেয়না। এদের কারো কাছ থেকে কোন অপ্রীতিকর কিছু কখনোই সে পায়নি তো।
দেশে বিদেশে ওর বন্ধুতা লিস্টে থাকা বিভিন্ন বয়সী নানান নারী-পুরুষ বন্ধুদের কারনে ওর উপকারই বেশি হয়েছে। এইসব নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। একেক মানুষের একেক অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখা হয়।
তবে, সবাই'ই যে ভালো তা নয় অবশ্য। কিছু মানুষ আছে আজাইরা বকবক করে ওর মাথাটা খেয়ে নিতে চায়। এরকম হলে ও ফ্রেণ্ড লিস্ট থেকে ওদের বাতিল করে দেয়। তাও আবার জানিয়ে, “দেখুন ভাই, আপনাকে না আমি সহ্য করতে পারছিনা! মাফ করবেন। আপনাকে ডিলিট করে দিচ্ছি”- এই বলে। এরকম করে অবশ্য ওর বেশ হাসি পায় নিজের কান্ড দেখে!! মুছে দিবি দে, আবার জানানো কেন!!!
সেদিন রাতে এক অদ্ভূত কাণ্ড হয়েছে। ফেসবুক এর ম্যাসেজ ইনবক্সে দেখে এক তরুণ ওকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ওরই বয়সী হবে। ওকে বন্ধু হিসেবে যোগ করার অনুরোধ জানিয়েছে। শর্মী একটু অবাকই হয়ে গেলো, “বন্ধু হিসেবে যোগ করতে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিতে হয় নাকি? রিকোয়েস্ট পাঠালেই তো চলে।“ লোকটা সম্পর্কে কৌতূহল হলো। তবু, যোগ করার আগে লোকটার প্রোফাইল ঘেঁটে দেখে নিলো। যতটা দেখা গেলো তাতে সন্দেহজনক কিছুই নেই। যাহোক সে নিজেই বন্ধুতার রিকোয়েস্ট সেন্ড করে দিলো। দেখাই যাক না! খারাপ হলো পরে না হয় ডিলিট করে দেওয়া যাবে!
লোকটাকে ফ্রেন্ড লিস্টে নেয়া ও ভালো করে প্রোফাইল এর সবকিছু ঘেঁটেঘুঁটে দেখতে দেখতে বেশ রাত হয়ে গেলো। কিছু বাকি রয়ে গেছে। লোকটা কোত্থেকে ওর নাম পেয়েছে বার বার জিজ্ঞেস করেও ও এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। কিন্তু, রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় ঘুমোতে হবে। “থাক, সকালে উঠে দেখে নেবো বাকিটা বা কয়েকদিনের কথাতে নিশ্চয়ই লোকটা নিজেই জানাবে” ভেবে শর্মী ঘুমোতে চলে গেলো। কিন্তু, যা তার আর কোন সময়েই হয়নি। আজ কেন যেন শুয়েও শান্তি পেলোনা ও। মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো!
২
সকাল থেকে শর্মীর অনেক ব্যস্ততা। বোনের বাচ্চা দুটোকে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়। আবার নিয়েও আসতে হয়। বোন-দুলাভাই দুজনেই চাকুরী করে। অফিস সামলে এসব করাটা একটু কষ্টকর হয়ে উঠে। আর, শর্মীও পড়াশুনা শেষ করে অবসর বসে আছে। তাই এসবে তার কোন বিরক্তি হয়না।
কিন্তু, রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভোরবেলাতেই ও শোয়া থেকে উঠে পরেছে। অন্যান্য দিন যা সে কখনো করেনা, আজ সকালে নাশতা না খেয়েই আগে নেট কানেকশন লাগালো।
ফেসবুক লগ ইন করে দেখে, ইনবক্সে একটা ম্যাসেজ। মাউস ড্রাগ করে ম্যাসেজ ওপেন না করেই যতটূকু পড়লো, “আপনার অনুমতি ছাড়াই আপনার ছবি ব্যবহার করার জন্য দুঃখিত।“- সুজয় আহমেদ।
কাল রাতের সেই লোকটা। ম্যাসেজটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলোনা। “যাক্, রাতে অস্থিরভাবে না ঘুমনোর মত কোন কারণ ঘটেনি। অযথাই সন্দেহ করেছিলো!“
৩
লামিয়া ফোন করেছে। বেলা ১২টা বাজে।
- সিদ্ধেস্বরী কলেজের সার্কুলার হয়েছে। গণিতে টিচার নেবে। সার্কুলারটার বিস্তারিত তুই ইন্টারনেট থেকে দেখে নিস। ফোনে তো এত ডিটেইল বলা যায়না। আর, বললেও সবটা তুই বুঝবিনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে, দেখবো। বলে মিষ্টি করে হাসলো শর্মী।
নেট কানেকশন লাগিয়ে ফেসবুক, ব্লগ সব জায়গাতেই লগইন করে আগে জরুরী কাজ কমপ্লিট করলো। সার্কুলার দেখলো।
তারপরে, ফেসবুক এর ওয়ালে চোখ পরলো। দেখে কে যেনো একটা ভিডিওতে ট্যাগ করেছে ওকে। এরকম হরহামেশাই কেউ না কেউ ফটোগ্রাফিক ছবি , কবিতা বা নোটস এ ওকে ট্যাগ করে। এসবের সবই সময়মত ওর দেখাও হয়না। কমেন্ট ও করা হয়না।
কিন্তু, আজই হঠাৎ ওর এই ভিডিওটা দেখার শখ হলো। কারণ ওটা গানের ভিডিও। গান তো শর্মীর ভীষণ পছন্দ! "কেন দূরে থাকো, কেন আড়াল রাখো/ কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো..." গানটা লোড করে কানে হেড ফোন লাগিয়ে ও শুনতে শুনতে ভাবলো- “নাহ্, গানটা মন্দ লাগছে। ভিডিও গান!! বাহ! ভালোই। “ শুনতে শুনতে ও ভিডিওটি দেখতে দেখতে... ভিডিওটার মাঝ বরাবর এসে ওর মাথা গরম! “ওওওহ, নো!!!” ভাগ্যিস খেয়াল করেছিলো! এতক্ষণে ইনবক্সের ওই ম্যাসেজটার অর্থ পুরোপুরি বোধগম্য হলো। লোকটা এই রোম্যান্টিক গানের মধ্যে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের ছবি এটাচ করেছে। গানের সুরে সুরে মেয়ের ও ছেলেটার ছবি মাঝে মাঝে পর্দায় ভেসে উঠছে। ছেলের ছবিটা ওই লোকের। আর, মেয়েটা অন্য কেউ নয়। শর্মীর! এই ভিডিও দেখে মনে হয়, প্রেমিক প্রেমিকার ভূমিকায় যেন ওই তরুন-তরুনী! তার উপর ওই ভিডিও এর নিচে যাদের ট্যাগ করা হয়েছে তাদের কয়েকজনের কমেন্ট।
- মৃন্ময় হাসানঃ কি রে সুজয়, এতদিনে মনে হয় ভালোবাসার রাণী পেয়েছিস?
- লোপা হায়দারঃ গানের সাথে ভিডিওটা বেশ লাগছে!
- সুজয় আহমেদঃ হ্যারে মৃন্ময়, তুই ঠিক ধরেছিস! @ধন্যবাদ, লোপা।
- পিঙ্কিঃ ভালো লাগলো। কংগ্র্যাটস্ সুজয়!
- সুজয় আহমেদঃ থ্যাংক্স পিঙ্কি।
এই দৃশ্য যদি পরিবারের কারো চোখে পরে তাহলে কি হবে ভাবতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো ও। এখন কি করবে ও? ওই লোকটাকে এখন সামনে পেলে ও কাঁচা খেয়ে ফেলতো!!! শয়তান!! এই ছেলেগুলোর হয়েছে এক স্বভাব, এদের বসতে দিলে মাথায় চড়ে বসে!!! “এরকম একটা কাজ কিভাবে করতে পারলো?” “ওওহ, আমি এখন কি করবো??”
পরবর্তী কয়েকটা ঘন্টা ও'র অন্য সব কাজ মাথায় উঠলো। ‘কিভাবে এই ভিডিও ডিলিট করা যায়’ সেরকম কোন অপশন পেলোনা। তাতে মাথা গরম হয়ে উঠলো আরো। কি করা যায়! কি করা যায়!
‘ফেসবুক অথরিটি’ বলে একটা বিষয় আছে এই ব্যাপারে ওর একটা ক্ষীণ ধারণা থাকলেও সেটা কিভাবে করতে হয় তা জানা নেই।
দুপুরের দিকে সুজয় আহমেদকে অনলাইনে পাওয়া গেল। ও রিকোয়েস্ট করলো ভদ্রভাবে। কারণ মা বলে, শত্রুর সাথে খারাপ ব্যবহার না করে মোলায়েম ভাবে কথা বলতে হয়। নইলে শত্রু ক্ষতি করে। যাহোক মিস্টার সুজয় ওটা ডিলিট করে দিবে বলে আশ্বস্ত করলো।
বিকেলে সে আবার চেক করে দেখে, কিসের কি। ঐটা তো বহাল তবিয়তেই আছে!
এবার আর ও চুপ করে থাকতে পারলোনা। লোকটাকে হাজার ভাবে বুঝালো, “ভাইয়া প্লিজ, ওটা মুছে দিন।“
রাতে আপু ও দুলাভাই অনলাইনে বসে। তাছাড়া দেশে বিদেশে ওর আরো কত আত্মীয় থাকে। ওদের কেউ যদি দেখে ফেলে ভিডিওটা, তারপরে বাসায় জানিয়ে দিলে কেয়ামত হয়ে যাবে। কারন- ঐটা ওর ওয়ালে একেবারে প্রথমেই অবস্থান করছে।
৪
লোকটাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে যখন কিছুতেই ক্ষ্যান্ত করতে পারলোনা, ও তখন ফেসবুক ওয়ালে একটা নোটিশ দিয়ে দিলো,
“বন্ধুরা, আমি একটি বিপদে পরেছি। আমার অনুমতি ছাড়া একটি ভিডিওতে সুজয় আহমেদ নামের এক তরুন আমার ছবি এটাচ করেছে, কিভাবে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়? সাহায্য করুন, প্লিজ!”
একই ধরনের ম্যাসেজ ঐ ভিডিওটির নিচে অন্য যারা কমেন্ট করেছে সেখানেও সে দিয়ে দিলো যাতে অন্য ট্যাগধারীরাও জেনে যায় বিষয়টা।
ফেসবুক একাউন্টে ‘হেল্প’ অপশনে গিয়েও একটা ডায়রী করলো। এর মধ্যে সুজয় আবার অফলাইনে। যখন অনলাইনে আবার তাকে দেখা গেলো, শর্মী বুঝে গেলো এই লোককে শায়েস্তা করতে অন্য পথ ধরতে হবে! তাতে কাজ হলে হতেও পারে! লোকটা যা করেছে তা একধরনের প্রপোজালই বলা যায়! অদ্ভূত ভিন্নতা সে আবেদনে!
সে ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ম্যাসেজ দিলো সুজয়কে,
“আপনি যে কাজটা করেছেন, একটু ভেবে দেখুন তো, আমার হাজবেন্ড দেখলে সে কি মনে করবে?”
অনেকক্ষণ কোন উত্তর নেই। এর আগে বেশ কিছুক্ষণ মেসেজ-পাল্টা মেসেজ দেওয়া-দেওয়ি চলছিলো।
এর মধ্যে সে আবার চেক করে দেখলো ভিডিওটা। দেখে, সারাদিনের তীব্র মাথার যন্ত্রণাটা দূর হয়ে গেলো। হাসিতে ঝলমল করে উঠলো ওর সুন্দর মুখটা। শেষ ট্রিকসটা কাজে লাগলো তাহলে! ওকে ম্যারিড ভেবে সুজয়ের প্রেম উধাও!
সারাদিন অনেক কড়া কথা শুনিয়ে ফেলেছে সুজয়কে। রাগে। তা না করেই ওর উপায় কি ছিলো! লোকটা অন্য কোনভাবে প্রস্তাব দিতে পারতো। তা না করে যেটা করেছে তা খুবই অবিবেচকের কাজ! একটা ভদ্র ঘরের মেয়ের সম্মান জড়িয়ে আছে এটা সে বুঝবেনা? ও তো আর কোন মডেল বাঁ সেলিব্রেটি নয়, ওর ছবি কেন একজন অচেনা ছেলের সাথে ভিডিওতে থাকবে!!
এখন বিপদ কেটে যেতেই লোকটাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করলো। হাজার হোক, ও তো অভদ্র নয়। ওর ম্যাসেজ এর উত্তর এলো, “উফ্, আপনি একটা অসহ্য! ক্যানো জ্বালাচ্ছেন?”
কয়েক সেকেন্ড পর ফেসবুক এর অন্যান্য জায়গা ঘুরে এসে ওর বলতে ইচ্ছে হলো, “আমি কি আপনাকে জ্বালিয়েছি নাকি আপনি সারাদিন আমাকে জ্বালালেন?” কিন্তু, ওই লোকের নামে ক্লিক করে মেসেজ দিতে চেয়ে দেখা গেলো, লোকটা ওর ফ্রেন্ড লিস্টে নেই। লিস্ট থেকে নিজেই ওকে মুছে দিয়েছে।
শর্মীর মুখের কোণে মুচকি হাসি দেখা গেলো। “যাক, বাঁচা গেলো! জঞ্জাল নিজেই পথ পরিস্কার করে বিদায় নিয়েছে।“
পরিশেষঃ
এই ঘটনার পর শর্মীর একটা উচিত শিক্ষাও হয়েছে। “লোকটার অবশ্যই কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিলোই। নইলে নিজে বন্ধুতার অনুরোধ না পাঠিয়ে কেন ওকে দিয়েই সেটা করিয়েছে? আর, এক রাতের মধ্যেই এমন একটা অঘটন কেন ঘটিয়েছিলো?” অনেক ভেবেও এর কোন সদুত্তর পায়নি ও। তবে, এর পর থেকে ও আর অচেনা কাউকে ওর ফ্রেণ্ড লিস্টে যোগ করেনা। এমনকি ওর ফেসবুক এর সমস্ত কিছুতে ও রেস্ট্রিকশনও দিয়ে দিলো যেন ইচ্ছে করলেই কেউ আর ওকে দেখতে না পায় বা ওর সম্বন্ধে বেশি কিছু তথ্য না পায়। আর নিজের অনেক ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্যও ও সেখান থেকে সরিয়ে ফেলে বাস্তব জীবনের সাথে একটা সীমারেখা টেনে নিলো।
একটি ঘটনা ওর সরল সাধারণত্ব পালটে ওকে অনেক কঠিন করে দিয়েছে।
[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বাস্তবতার আলোকে এটি একটি কল্পচিত্র; স্থান, কাল, পাত্র কারো সাথে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতালমাত্র]