০১
কয়েকদিন ধরে চড়া গরম পরেছে! মাঝে মাঝেই বিকেলের দিকে আকাশ লাল করে হঠাৎ দমকা বাতাস!!! ঝড়ের আবাহন!!! ঘরের জানালা খোলা থাকলে তো কথাই নেই। মুহুর্তে সবকিছু সাদা; টাইলসের মেঝেতে হাঁটতে পিছলে আছাড় খেতে হয়। বৈশাখ তার আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে বেশ তোড়েজোরেই।
দীপা ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। এক পাশে অনেকগুলো ডায়রী। আর হাতে তরমুজের বাটি। বড় করে টুকরো করা ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা তরমুজের টুকরোগুলোকে কাঁটা চামচে কেটে কেটে মুখে পুরছে আর ভাবছে। ভাবছে কিভাবে আশিককে জানাবে। ইমেইল করবে কিনা ভাবছে। ফোন করেই বলা যায়। কিন্তু, কেমন এক লজ্জা ভরা অস্বস্তিতে ও কুঁকরে যাচ্ছে সে কথা ভাবতেই। লাজুক হাসি এলো ঠোঁটের কোণে!! এক ঝলক!!! নাহ, ফোন করে সরাসরি কিছু বলা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। হতো একসাথে পড়ে বা অফিসের কলিগ, তাহলে ক্লাসের ফাঁকে বা অফিসে কাজের ব্যস্ততা বা কোনভাবে পাশাপাশি আসা-যাওয়া কথাবার্তার মাঝে হুট করে বলে ফেলা সহজ হতো।
- কি করছ তুমি এখন, আশিক? তরমুজ খাবে? এসো খাইয়ে দেই।
- উঁহু। তরমুজ খাবো না! (আশিকের চোখে মুখে দুষ্টুমি ভরা হাঁসি!) খাবো তোমার ঠোঁট। তরমুজের রসে ভেজা নরম টসটসে লাল ঠোঁট! যেমন করে তুমি ফলের রসাস্বাদন করছো, ঠিক তেমনিভাবে।
- ইস, বললেই হলো!!
- বাহ, তোমার বুঝি খুব অ-পছন্দ?
- “নাহ, অ-পছন্দ না মোটেই।“ খলখলিয়ে হেসে উঠে বলে “কিন্তু...”
“টুংটুং!! টুং টুং!!...” বাড়ির বেল বাজার শব্দে কল্পনা হতে বাস্তবে দীপা। “কে এলোরে আবার?” কাজের বুয়া! দরজা খুলে দিয়ে এসে আবার আয়েশ করে বিছানায় বসলো ও। আজ খুব আলসি লাগছে। শরীরে নেমেছে আয়েশী আমেজ। বিশেষ সময়ের বিশেষ বার্তা হিসেবে জানান দিয়ে যাচ্ছে ঘুম! আর টানছে বিছানা নিজের দিকে!
ইদানিং অসম্ভব ঘুমকাতুরে দীপার ঘুম হচ্ছেনা আগের মত। সারাদিনের ভাবনায় জেগে থাকলেও যেমন প্রতিটি মুহুর্তের সব কাজের সাথে একা একা নিরবে কথোপকথন চলতে থাকে। তেমনি বিছানায় শুয়েও ওর কেবলই মনে হতে থাকে বিছানাটা যেন ওর চিরচেনা বিছানা নয়; ওটা আশিকের লোমশ বুক! “আচ্ছা, আশিকের বুকে কি সত্যি লোম আছে?” আবারো লজ্জায় লাল!!! এমনিতেই একটু লাজুক প্রকৃতির কিন্তু দৃঢ়চেতা দীপার মধ্যে লজ্জা যেন টুবুটুবু হয়ে উঠেছে এই কয়দিনে! আশিকের কথা ভাবতে লজ্জা! ওকে এসএমএস করতে লজ্জা! ফোনও করতে পারছেনা কদিন ধরে।
ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছে করেনা ইদানিং। মনে হয় ওর বুকের ভেতর মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকে! কিন্তু, কোথায় কি! সারা রাত ভরে স্বপ্নে বিভোর দীপার ঘুম ভাঙ্গার পর বাস্তবে ফিরে এলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আশিক ওকে সামনে দেখে পছন্দ করবে তো!! সবাই বলে ওকে নাকি ছবিতে ভালো দেখায় না। ছবির চেয়ে সামনাসামনিই নাকি ওকে ভালো লাগে।
দীপার নিজের ধারনা এরকম ছিলো না। নিজের সারাদিনের সব মুহুর্তের ছবি তুলা ছিলো ওর দারুন একটা নেশা। মোবাইলে এবং ডিজিট্যাল ক্যামেরায় সারাক্ষণ শুধু নিজের ছবি তুলে দেখা ওর প্রিয় একটি কাজ। নিজেকে বিভিন্নভাবে দেখে আর মুগ্ধ হয়। কিন্তু, সে নিজে বা বন্ধু-বান্ধবী পরিচিতরা ওর ছবির ভূয়সী প্রশংসা করলেও ওর বাবা-মায়ের কাছে বরাবরই শুনে আসছে, “তোমার একটু ভালো করে ছবি তোলা উচিত।“ যেগুলো আছে এগুলোতে নাকি ওকে ভালো দেখায়না বলেই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়না। পাত্রপক্ষ ঠিক কি কারনে ওকে পছন্দ করছেনা তারও তো কিছু ঠিক নেই। কেউ নিজ বাড়ি-গাড়ি আছে কিনা! এমনি আরো কত কত শর্ত! “ছবিতে ভালো দেখায় না!” কথাটা শুনতে শুনতে ফেড-আপ একেবারে!!
আজকাল এই যুগে ছেলেদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, শপিং, ফ্যাশন নিয়ে এতটা ব্যস্ত নয় দীপা। খুবই ঘরোয়া মেয়ে। পড়াশুনার পাশাপাশি ঘরকন্যা, সুঁচিকর্ম, রান্নাবান্না আর শখেও শেখা হয়েছে ওর অনেক কিছুই। ভালো রেজাল্ট করা সত্বেও চাকরিবাকরিতে এখনো না ঢুকে বসে আছেই। তাও অনেকটা পারিবারিক চাপের কারনেই। “দূরে যেয়ে চাকরি করতে হবে এমন চাকরির দরকার নেই।“ অবসরে এখন শুধু লেখালিখিই করে ও।
দীপার নিজের ইচ্ছেটা ঠিক এইরকম নয়। কোন কিছুতে জড়িত থাকলে মনে হয়, পড়াশুনা শিখে কিছুতে নিয়োজিত আছি। নিজের পক্ষ থেকে অন্যের জন্য কিছু করার পাশাপাশি একেবারে নিরস আলস্যে দিন কাটবেনা।
বিয়ে তো সামাজিক প্রয়োজনে কাউকে করতেই হবে একসময়। কিন্তু, তেমন কাউকে যদি পাওয়া যেত যাকে ও ভালোবেসে বরণ করে নিতে পেরেছে! কে হবে ওর স্বপ্নের রাজপুত্তুর!! অপেক্ষায় আছে তারই। যদিও এর বাইরেও অনেক পাত্র দেখেছে ও। ওকেও দেখেছে অনেকে। কোনটাই ঠিক খাপে খাপে মিলছেনা!
বছর দুয়েক আগে নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার খুব জোশ চেপেছিলো। একদিন অডিশনও দিয়ে এসেছিলো বসুন্ধরা সিটির জবসএওয়ানডটকম এ। তখন আবার বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পরাতে কোর্স করার ধান্দা থাকলেও করা হয়ে উঠেনি। ইদানিং আবার সে ভূত মাথায় চেপেছে। কারন এতে নির্দিষ্ট বয়সের গন্ডী বাঁধা নেই। আর, আশিকেরও খুব পছন্দ!
০২
ঘুমে দু’চোখ বুজে যাচ্ছে! দীপা, আপনি এখন কি করছেন? ঘুমিয়ে পরেছেন কি? নাকি এত রাত অব্দি ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন? কি কাজ এত আপনার রাত জেগে জেগে?...আচ্ছা, কেন বলছেন না, কে আপনি! কেন আমাকে আপনার চেহারা দেখতে দিচ্ছেন না! কি মজা পাচ্ছেন বলুন তো!
“আমায় কি একটু চুলে হাত বুলিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন?” ...
“মেয়ে তুমি তো আমার নও চেনা/ পলক তবু কেন আর পরেনা/ জানিনা মরা যে কি হলো/ যেও না যেওনা কিছু তো বল/ যদি কথা না হয়, যদি দেখা না হয়/ হারিয়ে যাও এক ঝলকে/ মেয়ে কথা না কও, মেয়ে ফিরে না চাও/ সংগী করে নাও আমাকে!!!!/”
কাজ করতে করতে কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে মেসেঞ্জার চালু রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে আশিক!!!
ঘুমিয়ে স্বপ্নে ডুবে গেছে। স্বপ্নে গান বেজে চলেছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে। আর, ও হেঁটে বেড়াচ্ছে দীপার হাতে হাত রেখে।
ওদিকে দীপা অপেক্ষায় বসে আছে কখন লোকটা আসবে অনলাইনে! কথা বলবে!
“কি ব্যাপার? লোকটা কি আজকে আর অনলাইনে আসবে না? কি খালি ফুরুত ফুরুত আসে আর যায়!”
“তুমি হীনা দুপুরে/ নগরীর গতিময়তায়/ অশান্ত এ দু’চোখে...বলো তুমি এমন কেন/ একবার দেখে যাও”...ফুয়াদের গানটা শুনে যাচ্ছে বারে বারে।
ঘুমে চোখ বুজে যাচ্ছে দীপারও। লাইন অফ করে শুয়ে পরবে কি? আশিককে যদি আবারো লাইনে পাওয়া যায়! যদি আসে পরে অনেক রাতে!
০৩
এক মিষ্টি রোদেলা দিনের শুরু। “রাতে কি স্বপ্ন দেখলাম!!” স্বপ্ন না বাস্তবই যেন! মনে পরতেই আবার শিহরিত হলো! লজ্জায় লাল! “কোয়ি মিল গা...য়া!!”
দীপা আজ খুব ভালো মুডে। রংগীন প্রজাপতির মত এ ডাল হতে ও ডালে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। “তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হতো না!!” গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে!! চা নাশতা খেয়ে চটজলদি অনলাইনে বসে যায়। আশিকের সাথে কথা বলবে। ফোন করা যায়! “কিন্তু, কেমন অস্বস্তি লাগছে!”
ল্যাপটপ অন করে গানের এলবাম খুলে হেড ফোনটা কানে লাগিয়ে নেয়। কোন গান শুনি! “কাহো না পেয়ার হেয়” সিনেমার “দিল নে দিল সে পুকারা” ফুল ভলিউমে দিয়ে নেটের কানেকশন লাগাতে থাকে। “মাঝে মাঝে যে কি হয়, আমার লাইনটার! ইয়াহুতে কানেকশন হতেই চায় না!” কয়েকবার এর চেষ্টায় ইন করতে পারলো অবশেষে! কে কে অনলাইনে আছে চেক করতে করতে “আশিক ইস অনলাইন নাউ” দেখতে পেলো দীপা। একটা পালস মিস! আর কাউকে তো অনলাইনে চায়নি ও। যাকে চেয়েছে, সে হাজির!
মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই...
- হাই!
- (একটি পালস মিস) হাই!
- কেমন আছেন?
- হ্যাঁ। এই তো।
- কেমন মুডে আছেন আপনি?
- উম্ম...উম্মম...(দীপাকে আজ মাত্রাছাড়া দুষ্টুমিতে পেয়ে বসে! লজ্জার খোলস ছেড়ে কথা বলতে থাকে...)
- আপনার মুড কেমন আজকে এখন?
- মনে হচ্ছে ঘুম থেকে আরো এক ঘন্টা পরে উঠতে পারলে বেশ হতো। আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগে উঠে পরেছি। বিছানা ছাড়তে মন চায়নি। কিন্তু, উঠে পরতে হলো।
- উম্ম...উম্মম...টা একটু বুঝিয়ে বলুন তো।
- ইচ্ছে করছে আমার ...সারা বাড়িতে উড়ে বেড়াই; ঠিক যেভাবে ফিল্মি নায়িকারা শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌঁড়ে বেড়ায় না?...
- তার মানে আপনি এখন প্রেমে পরার মুডে?
আরেহ, সে জানলো কি করে!!! প্রেমে পরার মুডে নয়! প্রেমে তো পরেই গেছে! তবু, তা না বলে অল্প করে উত্তর দিলো...
- হুম্ম!!! (এদিকে মিটি মিটি হাসি!)
- আপনি এখন কোথায়?
- বাসায়। আমার রুমে।
- দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ?
“কি বলতে চায়?” অবাক ও রোমাঞ্চিত দীপা...”কেন, দরজা বন্ধ থাকতে হবে কেন?”
- কারণ এখন আপনি প্রেমে পরার মুডে! এই সময়ের কথা অন্যদের শুনার দরকার কি? সব কথা তো সব মানুষের শোনার দরকার নেই!
“কথা শুনা মানে?” হঠাৎ দীপা চ্যাটিং এর ফাঁকে চার্জে দেয়া মোবাইলটা হাতে নেয়। “একটা মিসকল!! আশিক!” আবারো একটা পালস মিস! এ সব কি হচ্ছে! স্বপ্ন নাকি বাস্তব!
মাস ছয়েকের অপেক্ষার প্রাপ্তি!! কোন এক রেস্টুরেন্টের এক চেয়ারে; সামনে কিছু খালি গ্লাস, চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী যুবকের মৃদু হাসিমুখের ছবিটা দেখে তখন থেকেই গেঁড়ে বসেছিলো ওর মনের ভেতর। ওখানে দেয়া তিনটি ছবিই ওর ল্যাপটপে সেভ করে রেখেছে! কিন্তু, কিভাবে তার সাথে কথা বলা যায়? যেখানে ছবি দেখেছিলো, সেখানে ইন্টারেস্ট পাঠিয়েও কোন সাড়া পায়নি। সেটা ২০১০ সালের কথা! অক্টোবর বা নভেম্বরের দিকে। এখনো প্রায়ই সেই প্রোফাইলে প্রায় প্রতিদিনই ঢুকে। যদিও সেই একই কথা লেখা। তবু কি যে এক তৃষ্ণা! ওর প্রোফাইলটা চুম্বকের মত টানে ওকে। আশিক সেখানে লগইন করেনি আর নতুন বছরে।
কোনভাবে যদি তার ইমেইল এড্রেসটাও পেতো! জিমেইল না হয়ে ইয়াহু হলেই বেশি সুবিধে। তারপর অবশেষে কত কাঠ খড় পুড়িয়ে যে পেল কথা বলার সুযোগ!!
কিন্তু, কথা বলার সুযোগ পেলে কি হবে! বেশিক্ষণ কথা বলাই তো হয়না। আশিক নিজে থেকেই কথা বলতে আসে প্রায়ই। বেশিরভাগ সময়েই। দীপা আগে থেকে দেখলেও কথা বলেনা। ডাকে না। বুঝতে চায় আশিকের আগ্রহ। আগ্রহ আছে লোকটার। কিন্তু, ...মাঝেমাঝে দীপা বুঝতে পারেনা। বারে বারে অফলাইন হয়ে যায়! বলা নেই, কওয়া নেই উধাও। খুব রাগ লাগে দীপার!!
গত রাতেই তো। কথা বলতে বলতে উধাও!!! কতক্ষণ বসে থাকলো ও। লোকটার ফেরার নামধাম নেই। ল্যাপটপে আবার নেট ব্যবহারের প্রবলেম থাকে নাকি! যত্তসব!!!
রাগ করেই ঘুমোবার প্রয়োজন থাকলেও বসেই থাকলো। বসে বসে হুমায়ূন আহমেদ এর ফাউন্টেন পেন বইটা পড়তে থাকলো। পড়ার নামে ছাই! শুধু পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়েই যাচ্ছে! মাথার ভেতরে গজিয়ে উঠলো কবিতার লাইন!!! কবিতা লিখতে শুরু করে দীপা।
- মেসেজ আসার শব্দের সাথে ফিরে চায় দীপা, “হ্যালো!”
- হুম!
- এখনো ঘুমান নি আপনি?
- কবিতা লিখছি!
- আপনি কবি-তা-ও লিখেন!!
- হুম! (লজ্জা পায় দীপা! যদিও বেশ মুড নিয়ে বলেছে!!)
- দেখা হলে শুনায়েন তো!
- আমি তো কবিতা আবৃত্তি করতে পারিনা। ও কাজটা আপনি কইরেন। (এই রে এখনি বোধহয় একটা বকা খেতে হয়!!)…
অনেকক্ষণ কোন কথা নেই। দীপা আবার চ্যাট মেইল পাঠালো।
- আপনি কবিতা পড়তে ভালোবাসেন?
কোন উত্তর নেই ওপাশ থেকে!
- হেয়???
“ধুর!!! এই লোকটাকে নিয়ে এক ঝামেলা!! মাঝেমাঝে কোথায় হাওয়া হয়ে যায়!!! “তোমার কি বউ আছে, আশিক? বউ থাকলে মেরেই ফেলবো কিন্তু!! “
অনেকক্ষন অপেক্ষা করে আশিককে কবিতাটি সেন্ড করে দিল দীপা।
মিলন স্বপ্ন
পাশ ফিরে শুয়ে মধ্যরাতে
আচমকার স্পর্শ যেন কাচুলিতে পিঠে;
আঁধারে শুয়ে অনুভব শিহরণ
দূরে থাকা তবু তোমাকে স্মরণ।
তোমার কল্পিত আদরে আন্দোলিত হই
লজ্জাবনত আমি পাশ ফিরে শুই,
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে,
তোমার শৃঙ্খলিত বাহু-পাশে।
আছো দিনরাত্রির প্রতিটি নিঃশ্বাসে
ও বাস্তবের অনুভবে মিশে;
কবে আসছো হতে আমার
বলো তো সিঁথির সিঁদূর!
কবিতাটি সেন্ড করে দিয়েই আবার লাল!!! এ-মা!!! এটা কি করলো ও। ওর ফিলিং এত তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিল!!! উচিত হয় নাই। একেবারেই উচিত হলো না কাজটা। ছি! ছি!! এরপরে আর থাকলো না অনলাইনে!!! লাইন অফ করে দিল। কি জানি আবার কি কমেন্ট শুনতে হয়!!! তারপরে তাড়াতাড়ি ঘুমের প্রস্তুতি! ঘুমোলো নাতো একটুও। স্বপ্নে স্বপ্নে রাত কাবার।
তারপরে আজ সকালে এই ...কথোপকথন!!
-মোবাইলের আওয়াজে ফিরে চেয়ে দেখে, আশিকের ফোন। রিসিভ করতেই ভরাট গলায় কথা বলে উঠলো যুবক! দীপার একেবারে বুকের মধ্যিখানে গিয়ে ছুঁইয়ে দিল। কথা বলতে বলতে দীপা ঘরের ভেতরে হাঁটতে থাকে।
- আপনার ঘরে কি কি আছে?
- কি কি আছে ? নাকি কে কে?
- কি কি?
- উম্ম...খাট, আলমারী, ডেস্কটপ পিসি, একটি টেবিল...এইতো।
- আয়না নেই?
- না, আয়না নেই। আয়না বসানোর জায়গা নেই।
- কোন আয়নাই নেই?
- এটাচ বাথ এ আছে অবশ্য।
- যান সেখানেই, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
- (লজ্জিত) খিলখিল হেসে দীপা বলে উঠলো, “কেন??”
- যানই না আগে।
দীপা ওয়াশ রুমে না গিয়ে আলমিরা থেকে গোল বড় গ্লাসের আয়নাটা বের করে স্ট্যান্ড দাঁড়া করালো। তারপরে, বললো, “হুঁ, এবারে বলুন!”
- আয়নার সামনে ৩০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকুন। চোখের পলক ফেলবেন না।
- “আচ্ছা!” বলে দীপা মুচকি মুচকি হাসতেই থাকে। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে! মজাও লাগছে। কয়েক পলক পরেই বলে উঠলো, “হু, তাকিয়েছি। এবার বলুন!”
- তাকানো শেষ?
- হু! (আবারো হাসি!)
- আপনি কি চশমা পড়েন?
- নাআআআ!! (লজ্জা হাসিতে মেশানো গদগদ কন্ঠস্বরে উত্তর!!)
- তাকিয়ে থাকার সময়ে কি মুচকি মুচকি হাসছিলেন?
- হুউউ!!! ( আবার হাসি!)
- হুম!!!
- হুম কি?
মা এসে দীপার রুমে ঢুকতেই দীপা বেরিয়ে চলে গেলো লিভিং রুমে।
- আচ্ছা, আপনাকে কেমন করে প্রস্তাব দিলে আপনি খুশি হবেন?
- আমাকে প্রস্তাব? মানে? আপনি? কিন্তু...
- কিন্তু, কি?
- কিন্তু, আপনি তো বলেছেন, লাবণ্যময়ী মেয়ে পছন্দ আপনার। আমিতো সেরকম কিছু নই। তাহলে কি করে?
- আমি সেরকম কিছু বলেছি নাকি?
- হুম, বলেছিলেন তো! আমি তো সেরকম কিছু নই।
- লাবন্যময়ী না হন, দেখতে কেমন সেটাইতো দেখতে চাইছি।
- আমাকে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে।
- ভালো লাগবে না কেন? কনফিডেন্স থাকা উচিত!
- কনফিডেন্স! তা তো আছে! কিন্তু, তবুও...নেগেটিভ ধরে রাখা ভালো না?!!
কিছু সময় দুজনেই চুপচাপ! দীপা আবারো আগের কথায় ফিরে আসে।
- আসলে এক সাথে পড়াশুনার সময়ে বা এক সাথে জব করা অবস্থায় কাউকে প্রপোজ করাটা সুবিধে। আয়োজনের একটা মজা আছে! কিন্তু, এর বাইরে আয়োজন করতে গেলে টের পেয়ে যায়!
- তা ঠিক!
- তবে, একটা কথা কি, আমি যদি কাউকে পছন্দ না করি, আয়োজন যত স্পেশাল বা আনন্দদায়কই হোক না, আমার ভালো লাগবে না। আমার মন টানবে না। কিন্তু, আমি যদি চাই মানুষটাকে, তাহলে আয়োজন যত তুচ্ছই হোক, আমার মন প্রাণ ভরিয়ে দিতে বাধ্য।
- হুম, ঠিক বলেছেন।
আরিহ, লাইন কেটে গেলো!! “কলব্যাক করবো? নাকি উনিই করবে?” ভাবতে ভাবতে নিজেই কলব্যাক করলো!!
- লাইন কেটে গেলো নাকি?
- হ্যাঁ, গ্রামীণের লাইনটা খুব ডিসটার্ব করছে।
- ওও!!
- আচ্ছা, আপনি এখন কোথায়?
- আমি? এইতো সোফায় বসে আছি।
- আপনি এখন নিজের ঘরে নয়?
- না। কেন?
- আপনি চ্যাট করছিলেন কোথায়?
- উম্ম, আমার ঘরে।
- দেখেন তো আপনাকে কেউ ইয়াহুতে খুঁজছে কিনা?
- আমাকে কে খুঁজবে? খুঁজুক না! না গেলেও প্রবলেম নেই।
- না! গিয়ে দেখুন না!!
- আচ্ছা! তাই?
নিজের ঘরে আবার ফিরে এলো দীপা। এসে দেখে আশিক কি সব লিখে রেখেছে!
- হেয়, হয়ার আর ইউ?
- কাহার সাথে মেতেছো অভিসারে?
- আমাকে বুঝি আর ভালো লাগে না!!
- আইএম অয়েটিং ফর ইউ।
- ইস, এইসব কে লিখেছে!!(দীপা তোতলাতে থাকে!!)
- কে আবার? যার সাথে চ্যাট করছিলেন!
- আহা, যার সাথে চ্যাট করছি, আর যে কথা বলছে দুজনা কি ভিন্ন?
- আপনি কাকে চাইবেন?
- যে কথা বলছে সে আর চ্যাটে যে সেতো একই তাইনা? (দীপা কেমন কনফিউজ হয়ে যায়!)
- কাকে চান আপনি?
- যে কথা বলছে তাকে। চ্যাটিং এর চেয়ে যার সাথে কথা বলছি সে বেশি বাস্তব। আমি বাস্তবের মানুষটিকে চাই।
হ্যালো...যাহ, গেছে লাইনটা!! দীপার ব্যালেন্স শেষ। ধ্যাত! লাইনটা কাটার আর টাইম পেলো না!
কয়েক সেকেন্ড পরেই এলো আবারো ফোন। আশিক!! কথোপকথন চলতে থাকে...
০৪
- আপনি কি বাসায়?
- হ্যাঁ। বাইরে গিয়েছিলাম। মাত্র ফিরলাম।
- ওহ, ঢুকে পরেছেন বাসায়?
- হ্যাঁ! কেন?
- আচ্ছা, আপনার বাসাটা কি রাইফেলস স্কোয়ার এর ওদিকে?
- নাহ, পান্থপথ! কেন?
- আমি বিকাল পর্যন্ত ঐদিকে থাকবো।
- আচ্ছা!
- আপনি দেখা করবেন? আপনি চাইলে দেখা করতে পারি।
দেখা!! হুম! দেখা তো করতেই ইচ্ছে করে দীপার। কিন্তু...
- উম্ম, আপনি কি জন্যে এইদিকে আসবেন?
- একটু কাজ আছে।
- আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে...বিকেলে জানাই?
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
ফোনটা আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখে আশিক। “দীপা কি আরো কিছু বললো? বাই জানালো?” “যাহ, লাইন তো নিজেই কেটে দিলাম! ওহ!”
ওদিকে দীপাও “বাই” বলে লাইন কেটে দেবার আগে আবার ফোনটা হাতে নিয়ে লাইট অন করে দেখে, লাইন এখনও আছে। “আশিক কি কিছু বলছে?” আবার কানে নিতে গিয়েই দেখে লাইনটা কেটে গেলো। “যাহ বাবা! লাইনটা কেটে দিয়েছে!”
যাহোক, যাবে কি যাবেনা ভাবতে ভাবতে দীপার কি যে হলো, ভাত খাবে না আগে শাওয়ার নিবে, না কোন ড্রেসটা পড়ে আশিকের সামনে যাবে, সব তালগোল পাকিয়ে কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলো। একটু তো আবার ঘুমোতেও হবে!! কনে দেখার ক্ষণ!! প্রথম দেখা বলে কথা!! ক্লান্তি ধরানো চেহারা দেখে যদি ওর পছন্দ না হয়!!
নিজে ভাত খেতে বসার আগে আবার ফোন দিল আশিককে, “ আপনি লাঞ্চ করেছেন?”
- হ্যাঁ , আমি তো লাঞ্চ করেছি।
- আচ্ছা, আমি বিকেলে আসরের নামাজের পরে আসি?
- নামাজের পর বলতে কয়টায়?
- এই...সাড়ে চারটার পর।
- আচ্ছা।
- আমাকে কোথায় থাকতে হবে?
- আমি আপনাকে বিকেলে সাড়ে চারটার দিকে ফোন করবো।
- ওকে!
ভাত খেতে বসে ভাত খেতেই পারলো না দীপা। পেট ভরে গেছে! ভাত কি বেশি নিয়ে ফেলেছে! নাকি শপিং এর সময় রোল খাবার কারণে! নাকি আশিকের সাথে দেখা করার উত্তেজনায়!
ভাত খেয়ে গোসল করলো। শ্যাম্পু করলো। চুল শুকোতে দিয়ে একটু রেস্ট নেয়ার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিল। টায়ার্ড লাগছে খুব। তার চেয়ে বেশি উত্তেজনা!! কি হবে আজ!!
- আজ কেমন করে ফোনটা এলো? আজ ওর মনে হচ্ছিলো যেন আজ আশিক এইদিকে আসবে। চুলে শ্যাম্পু করা জরুরী ছিলো। সকাল হতেই বেশ অস্থির লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো, আজ সারাদিন ও আশিকের ডাকের জন্য অপেক্ষা করছে। এইজন্যে দিনের বেলা বাইরে যেতে ইচ্ছে ছিলোনা।
ধারনাটা মিলে গেলো কি করে!!!
“আশিক, তুমি কেন আমাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ? কেন চেহারাটাই গুরুত্ব পাচ্ছে তোমার কাছে? দেখো, আমার হাত পা মাথা চোখ সবই তো আছে। তোমাকে ভালোবাসার জন্য একটি সুন্দর মন আছে। আরো আছে তোমার জন্য অনেক অনেক প্রেম! ভালবাসা!” ......
“তোমাকে আমি বুঝবো দেখো!... তুমি যা চাও, যেমনি চাও আমি হয়ে উঠবো তেমনই! তুমি তোমার নিজের মত করে গড়ে নিও আমাকে! ...মানুষের মন-মানসিকতাটাই তো প্রধান তাই না? তোমার দরকার একটি লক্ষ্যি বউ। আমি তো সেইরকমই কিছু হবো। তোমাকে পাশে পেলে। আমাকে নিয়ে তোমার টেন্সড হবার কোন দরকারই নেই। শুধু গড়ে নিও যতটা থাকবে ফাঁকি!” ..
“ইচ্ছে করলে প্রযুক্তির উন্নয়নে মানুষের সবকিছু পরিবর্তন করে নেয়া যায়। কেউ যদি মোটা হয়, তাকে পাতলা করে নেয়া যায়; তেমনি শুকনা হলে মোটা। নাক-মুখের গড়নের কোন কিছু যদি অ-পছন্দনীয় হয় সেটাও বদলে নেয়ার জন্য আছে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি! কিন্তু, মনমানসিকতা পরিবর্তন করা যায় না। তুমি চাইলে তোমার পছন্দনীয় কাজেই আমি জয়েন করবো। আবার তুমি না চাইলে, আমি তা ছেড়েও দিবো। ...মানুষ ভালোবাসার জন্য কত কিছু করে! কত কঠিন শর্ত মেনে নেয়। আর আমি তোমার জন্য এই এতটুকু করতে পারবনা?”… “আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। সবচেয়ে কাছের। হতে চাই তোমার সেবিকা। তোমার প্রেমিকা।“
“...তুমি বলেছিলে না, আমি চাইলে তুমি বন্ধু বা প্রেমিকা বা বয় ফ্রেন্ড বা বিশেষ কেউ হিসেবে ডিউটি দিতে পারবে? ...আশিক, আমি তোমাকে উক্ত সব সম্পর্কের অভিনেতা হিসেবে চাই না। সত্যিকার মানুষের ভূমিকায় চাই তোমাকে। সত্যি বলছি!”
“... সরাসরি বলতে পারবনা আমি? তোমাকে । আমার ভালোবাসার কথা! আমার চাওয়া পাওয়ার কথা! বলতে পারবো। কিন্তু, বলতে চাই না। শুনতে চাই। আমি নিশ্চিত হতে চাই। এতদিন ধরে যার জন্য অপেক্ষা আমার! তোমার কাছ থেকে প্রথমে শুনলে তাই আমার ভালো লাগবে। ... “
“আশিক, আমার স্বপ্ন ছিলো , কেউ আমাকে চাইবে যে শুধু মন থেকে ভালোবেসে আসবে আমার কাছে। কথা বলে কেমন মনে হয় তোমার আমাকে?”... চুল মেলে দিয়ে বিছানায় শুয়েছে দীপা। বুকের মধ্যে ধরাস ধরাস করছে!!! লজ্জায় হচ্ছে লাল বারে বারে! আর, মাঝে মাঝে চোখ বুজে, মাঝে মাঝে চোখ খুলে ঘুমোনো বাদ দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে আশিকের সাথে!!
ইশ, আজই কেন দেখা হতেই হবে!!! দেখাটা আরো দু-একদিন পরে হলে কি ভালো হতো? কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে!!
চোখ বুজে ঘুমানোর জোর চেষ্টাতেও কিছুই হচ্ছে না। হাত বারে বারে চলে যাচ্ছে বালিশের পাশে রাখা মোবাইলে। বারে বারে টাইম দেখছে। সাড়ে চারটা প্রায় বাজতে চলেছে। আর ঘুমিয়ে কি হবে! উঠে পরলো শোয়া থেকে।
তারপরে, আরো মিনিট চল্লিশের পরেও ফোন এলো না! লোকটা কি কাজে আটকে গেলো?
ফোন এলো আশিকের। রিসিভ করতে করতে কেটেও গেলো লাইনটা। দীপা নিজেই কলব্যাক করলো, “হ্যালো!”
- হ্যাঁ। আজকে মনে হচ্ছেনা কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হবে।
- ওও!
- মনে হয় আরো দেরী হবে!!
- আচ্ছা!
- তাহলে আজকে আর দেখা হচ্ছেনা। অন্য কোন দিন, কেমন?
- আচ্ছা, ঠিক আছে!!
যদিও অস্বস্তি ছিলো মনের ভেতর! তবু, দেখা করার একটা গতি চলে এসেছিলো। বোধহয় আজ দেখা হলেই ভালো হতো। অন্য কোন দিন হলে আবারো অস্বস্তিতে পেয়ে বসতে পারে!
----পরের পর্বে সমাপ্ত---
টেলিপ্যাথি- শেষ পর্ব