প্রীতিকে আজ দেখতে আসবে। বাড়িতে আজ আনন্দের বন্যা। কথা ছিল ছেলের মা আর চাচী আসবেন। সকালে ঘটক জানিয়েছে ছেলেও নাকি আসবে। প্রীতির বাবা বাড়ি ছিলেন না। তিনি গিয়েছেন ওর ফুফাতো ভাই শফিকের বাসায়। ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার। থাকেন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়।
প্রীতির দুই খালা ব্যস্ত ঘর গুছাতে। বিছানায় প্রীতির নিজ হাতে সুতার কাজ করা বেড কভার , সোফার কুশন সবকিছু দয়ে ঘর সাজানো চলছিল।
কাজগুলো প্রতিদিন সে নিজেই করে। একমাত্র মেয়ে। ও ছাড়া কে করবে! যদিও কাজের লোক আছে। তবু ও ঘরের কাজ নিজের হাতেই করা পছন্দ করে। কিন্তু, আজ ওকে দেখতে আসবে বলে কেউ ওকে কোন কাজ করতে দিচ্ছেনা।
ও সোফায় বসে ঘর গুছানো দেখছে।আর দেখছে আয়োজন।আর বাবা মায়ের উপচে পড়া আনন্দ। খালাদের উচ্ছ্বাস। কাজের ছেমড়ির মুখ টেপা হাসি।
ও ঘর হতে মায়ের গলা শোনা গেলো।
-শোন, তুমি বাসায় চইলা আসো। ....ক্যান আবার? ছেলেও আসবে। আর দেখাদেখি এই বাসাতেই হবে। বাসায় আসো। তার সাথে কথা বলার জন্য তো একজন ব্যাটা মানুষ দরকার। আর আপেল, কমলা আইনো। আর ভাল দামী দুই কেজি মিষ্টি। ....ধ্যাত ! কানে শোননা ক্যান? ...এ্যাঁ ?--- হ্যাঁ!
কথার ধরনেই বোঝা গেলো বাবাকে ফোন করেছে। প্রীতির কোন ভাবান্তর নেই। আজ একটু অন্যমনস্ক সে। এইসব ছেলে দেখাদেখি বিরক্তিকর! কেউ কাউকে কোথাও দেখে পছন্দ করে পরে কথা পাকাপাকি হলেই ভালো। প্রত্যেকবার শাড়িটাড়ি পরে ছেলেপক্ষের সামনে গিয়ে জবুথবু হয়ে বসা; চুপচাপ শান্ত ভাব দেখানো খুবই অসস্তিকর। বরটি চুলচেরা বিশ্লেশন করতে পারবে ওর; কিন্তু ওরতো সরাসরি তাকানোই নিষেধ। চোখ নিচু করে বসে থাকা শুধু।
ঘটক খুব আশাবাদী। ওরা যেরকম মেয়ে চায় তাতে এ প্রস্তাব পছন্দ হবেই। তিন ছেলের মধ্যে এটা দ্বিতীয়। বড় ছেলের বউ এর বাপের বাড়ির অবস্থা খুবই করুণ। ওই মেয়ের ভাইরা বিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ওই বউ মফস্বল এলাকার; ঢাকায় তাদের কোন বাড়িও নেই। চেহারাও মোটামুটি। সুন্দরী বলা যাবেনা। মেয়ে দেখে আসার কিছুদিন পর মেয়ের বাবা মারা যায়। পরে ওই মেয়ের জন্য ভদ্রমহিলার খারাপ লাগতে থাকে। এবং ছেলের বউ করে ঘরে আনেন। তবে, ভদ্রমহিলা নিজের ফুটানি করতে খুব পছন্দ করেন।যদিও ভাব করেন খুব অমায়িক মানুষ তিনি! উনি নাকি নিজের ফ্যামিলিতে ওই বউয়ের মানসম্মান বাঁচানোর জন্য নিজেই উপায় বলে দিয়েছেন। আর তা হলো, বড় বউয়ের ভাইদেরকে বলেছেন "বোন জামাইয়ের জন্য একটা এসি দিতে, ওরাইতো ব্যবহার করবে। আমাদেরতো কাজে লাগবেনা। আবার আত্মীয়-স্বজনের চোখেও দেখা দিলো যে, বউয়ের বাড়ি থেকে এই জিনিস দিয়েছে!"
সেদিক থেকে প্রীতিরা অনেক খানি এগিয়ে। মাস্টার্স শেষ করে এখন ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট কোর্স করছে, তাও প্রায় শেষের দিকে। ওর ভাইরা নিজেরা প্রতিষ্ঠিত। ওর গয়নাগাটি সব তৈরী করাই আছে। ঢাকায় নিজেদের আধুনিক ফ্লাট। তাও আবার ধানমন্ডি এলাকায়। মেয়েও দেখতে একেবারে ফেলনা নয়। কেবল লম্বা ছেলে খুঁজতে খুঁজতেই এত দেরী। ঘটক আর একটি কাজ করেছেন। মেয়েদের বাড়িঘরের অবস্থা সম্পর্কে একটু কমিয়ে কমিয়ে বলেছেন। তিনি ছেলের মাকে ধারনা দিয়েছেন, মেয়েদের অবস্থা মোটামুটি। বড় বউয়ের অবস্থা থেকে একটু ভালো। সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি।
বায়োডাটা পাওয়ার পর ঘটকের কাছ থেকে প্রীতিরা জেনেছে, ছেলের মা বড় বউকে খুব আদর করেন। মেয়ের পড়াশুনা বেশি ছিলনা। তিনি নিজে বউকে কলেজে অনার্সে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন।ওই বউয়ের বাচ্চা হবে। তাকে কোন কাজ করতে হয়না। অবশ্য কোন বউকেই কাজ করতে হবেনা। বান্ধা কাজের লোক আছে! এই সব শুনে প্রীতির মা তো বেশ খুশি। মেয়েটা একটু দূর্বল। এই বাড়িতে বিয়ে হলেতো মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে। তাছাড়া ছেলেদের নিজেদের বাড়ি। গাড়িও আছে। প্রীতি গাড়ির গন্ধ সহ্য করতে পারেনা বলে নিজেদের গাড়ি কেনারও বিপক্ষে। ও রিকশাতে চলাফেরা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। তবে, ছেলের গাড়ি আছে শুনে তার এখন ভালই লাগলো।
ছেলেরা দেখতে আসার সময় হয়ে এসেছে। ঘটক পাশের বাসাতেই থাকে। ছেলে ঐ ঘটকেরই দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে। প্রথমে কথা হয়েছিল ওনার বাসাতেই দেখাবে। পরে ভাবা হলো ছেলেরা একবারে মেয়ের বাড়িও দেখুক, আর বাসায় মেয়ের হাতের কাজের অনেক কিছুর নিদর্শন রয়েছে সেগুলোও দেখতে পাবেন; তাতে যদি আকর্ষণটা বাড়ে। মেয়ের বাসায় আইপিএসও আছে। শুধু এসিটা এখনও তারা লাগায়নি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলে ছেলের মা আর খালাকে সাথে নিয়ে ঘটক আন্টি এলেন প্রীতিদের বাসায়। এদিকে প্রীতি সেজেগুজে রেডি হয়ে সেই কখন থেকে নিজের ঘরে বসে আছে। আর ঘামছে। ছেলে আসেনি। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে শুধু শুধু একটা মেয়েকে নাকি বিব্রত করা। সেই জন্য আসেনি। মাকে বলেছে, "তুমি দেখে এসো; ভাল লাগলে পরে দেখা যাবে"! ছেলের এই কথা শুনে প্রীতির ভালই লাগলো লোকটাকে। ছবিতেও লোকটা মন্দ নয়। জাস্ট বয়সটা একটু বেশি; সার্টিফিকেটেই চল্লিশ! এতদিন অপেক্ষা করে শেষকালে একটা বুড়া পেতে যাচ্ছে সে!
প্রীতির একটা স্বভাব হলো যে ছেলের প্রস্তাবই আসে ছবি দিক বা না দিক , ও সেই ছেলের নাম দিয়ে ইন্টারনেটে গুগল বা ফেসবুক এ সার্চ দিয়ে তার খোঁজখবর নেয়। সে যদি ইন্টারনেট ব্যাবহার করে তাহলে তার ব্যাপারে কিছু তথ্য পাওয়া যাবেই। এটা করে খুব মজা পায় সে। একবার এই একই ঘটক আরেকটি ছেলের বায়োডাটা এনে মাকে বলেছিলো খুব সুন্দর ছেলে। -আপনেরা দেখেন। ছেলেকেও আপনার একটা বায়োডাটা দিয়েন। দেখি আপনার মেয়ের জন্য কিছু করতে পারি কিনা।
তো্ প্রীতি তখন কম্পিউটারে বসে কাজ করছিলো। ও করলো কি, ফেসবুক এ সার্চ দিয়ে ওই লোককে খুঁজে বের করলো এবং দেখলো যাকে খুঁজছে সেই লোকই এই লোক। নিশ্চিত হলো ওই লোকের প্রোফাইলে যে জব এর কথা দেয়া ছিলো, বায়ো ডাটাতেও সেটাই দেয়া ছিল। তবে, প্রোফাইল ফটো দেখে খুব সুন্দরের ধারেকাছেও যেতে পারলোনা। মাকে ডেকে তখনি দেখালো। মাও একটু থতমত। লোকটির চেহারা কেবলু মার্কা!
এইবারও তার কোন দেরী হলোনা। ও ঠিকই এই ছেলের ব্যাপারেও খোঁজ নিতে শুরু করলো। ছেলের মা ছোট বোনকে সাথে নিয়ে এসে ওকে দেখেটেখে চলে গেল। ছেলের মায়ের একটা কথা ভাল লাগলোনা প্রীতির। ছেলের মা বলেছে , "আমারতো অনেক আছে। আমি আমার ছেলের জন্য মেয়ের বাড়ি থেকে কিছু আশা করিনা। বরং মেয়ের বাড়ির অবস্থা একটু কম অবস্থাসম্পন্ন হলেই ভালো। তাতে মেয়ে আমার ছেলের মাথার ওপর টিকটিক করতে পারবেনা। নইলে মেয়ের অহংকারের চোটে আমার ছেলের জীবনটা ছ্যাঁরাব্যাড়া হয়ে যাবে।"
প্রীতি এই কথা শুনে মাকে বললো, "মা, আমার কিন্তু, এই কথাটা পছন্দ হলোনা। তার মানে উনি বলেই দিলেন যে আমাদের অবস্থা তাদের চাইতে খারাপ। আর, ওনার কি ধারনা যে টাকা পয়সা আছে বলেই উনি আমাদের চেয়ে বড়? উনি ওনাদের বায়োডাটায় নিজের চাচাকে টেনে এনেছেন। কিন্তু, আমরাওতো পারতাম আমার মায়ের মামা-চাচাদের হিস্ট্রি তুলে আনতে! ওনার এক চাচা এম্পি বলে ওনার গর্বে পা পরছেনা মাটিতে!"
মা বললেন, থাক, "আগেই এত চ্যাঁচামেচি করিস না। দেখা যাক কি হয়!"
ও নিজের ঘরে এসে 'শফি শমসের' নামে সার্চ দিল ফেসবুক এ। ঠিক পেয়ে গেল লোকটাকে। প্রোফাইলে মিলে গেলো ঠিক ঠিক যা বলা আছে তার বায়োডাটাতে। কিন্তু, প্রোফাইল ফটোটা এক পিচ্চির। যাই হোক , add request পাঠিয়ে দিল। কারন , লোকটার বাকি তথ্যগুলো দেখা যাচ্ছেনা। আর, ছেলে যেন ওর ছবি আর ওর সম্বন্ধে আরো ভাল ধারণা পায় সেজন্য সে নিজেই আগ বাড়িয়ে ছেলেটাকে এই ব্যবস্থা করে দিল। তাছাড়া এইভাবে লোকটার সাথে সরাসরি কথা বলারও সুযোগ পাওয়া সম্ভব হতে পারে। দুদিন পর দেখলো, তাকে লোকটা একসেপ্ট করেছে। এইবার সে তার 'ফ্রেন্ড-গ্রুপ' দেখা শুরু করলো। আর তা দেখে ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কি সব ফ্রেন্ড! বেশিরভাগই মেয়ে বন্ধু! আর মেয়ে বন্ধুগুলোর প্রায় সবই বিদেশী। কিছু বাংলাদেশী থাকলেও দেশি-বিদেশি সব মেয়ে বন্ধুরই পোশাকের অবস্থা খুবই নেকেড। এই লোকের বন্ধু তালিকা দেখলে প্রথম দেখায় তার সম্পর্কে ভালো ধারনা করা যে কারো পক্ষেই মুশকিল।
প্রীতির নিজের ফেসবুক বন্ধু-গ্রুপেও ছেলে বন্ধু বেশি। কিন্তু, সে তার বন্ধু গ্রুপে এমন কাউকে জায়গা দেয়নি যাকে দেখা খারাপ ধারনা হয়।
বিষয়টা সে তার মায়ের সাথেও বলে ফেললো। এই মায়েদের একটা ব্যাপার প্রীতির খুব অসহ্য লাগে! চেনা নেই জানা নেই, নিজের পরিচিতের মধ্যে কেউ যদি বলে ছেলে ভালো , খুব ভালো। তখন নিজেও ওই মানুষের সুরে একই গান গাইতে থাকে। অথচ, সে নিজে কাউকে পছন্দ করলে তখন বলবে, চেনোনা জানোনা! বিশ্বাস করে বসে আছ! আজব!
মাকে বলার পর মা-ও বললো, "দাঁড়াও, তোমার আন্টিকে বলতেছি!"
আসলে ওই লোকের মায়ের দোষ। মা ছেলেগুলোর বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ে বাছতে বাছতে ছেলেগুলোরে বুড়া বানায়া ফেলে তখন ছেলেগুলো আর কি করবে! দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া! বড় ছেলেকেও বিয়ে দিয়েছেন ৪২ বছর বয়সে। এই ছেলেকেও সেই বয়সে তুলে তারপর বিয়ে দেবেন! বিয়ে করার কিছুদিন পর তার শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করবে। প্রীতি বুঝে পায়না এত বেশি বাছাবাছির কি আছে!
ওরা দেখে গেছে কয়েকদিন পার হয়ে গেছে। এখনও কোন খবর আসেনি। " ঘটক আন্টির হাসবেন্ড নাকি নিজেই সেধে একদিন ফোন করেছিল ওই বাসায়, "কি ব্যাপার! তোমরারে আমি নিয়া গ্যালাম, একটা কিছুতো কইবা!" উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, ওনারা নাকি প্রীতিকে নিয়ে আরও একটু ভেবে দেখছেন! পরে জানাবেন।
প্রীতির খুব অপমানবোধ হয়েছে! সে মাকে জানিয়ে দিয়েছে, এই বিয়েতে সে রাজী নয়! আর তাছাড়া, এটা ধরেই নেয়া যায় যে , ওদের পছন্দ হয়নি। নইলে যাওয়ার পর পরই ওরা ওদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতো। এখন পরে আবার জানালেও ও আর এই বিয়েতে মত দিবেনা! মায়েরও ছেলের মেয়ে-বন্ধুদের কথা শোনার পর আর এইখানে এগোতে ইচ্ছে করছেনা।
ঘটক আন্টির জামাইও নাকি বলেছে, "শমশের এর মা আবার ফোন করলে, এরপর ডেউয়া দিয়া মাথাত বারি দিয়া দিমু! আমাগো একটা সম্মান আছেনা? হে তো সেই সম্মানটাই রাখলোনা আমার!"