somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমালোচনার খরচাপাতি ও বাংলা গদ্যরে ওম: র্পব ৩

০৪ ঠা মে, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবীন্দ্রনাথের কথায় আবার আসা যাক। ঔপনিবেশিকতার ঔরসে জন্ম নেয়া বাংলা গদ্যকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন নি কেন? বাংলা গদ্যের বিকাশের গোড়ায় সংস্কৃত ভাষাকে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করানোর সাহেব ও সংস্কৃত পণ্ডিতের হীন অভিসন্ধিই কী এর কারণ? যদি এটাই অন্যতম কারণ হয়ে থাকে তবে বাংলা গদ্যের সংস্কৃতায়ণের গোড়ার ইতিহাসটার দিকে খানিকটা নজর দেয়া জরুরী। ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর ছড়ানো রক্ত এই অঞ্চলে পোক্ত হবার অব্যবহিত পরেও বাংলা গদ্যের কাঠামো মূলত আরবী-ফারসী প্রধান ব্যবহারিক ভাষা ও তৎসম-তদ্ভব প্রধান ধর্মীয় ভাষা এমন মোটা দাগে প্রচলিত ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যুগে ধীরে ধীরে এই পার্থক্যটাকে বিলীন করার চেষ্টা করা হয় এবং বাংলা গদ্যকে সজ্ঞানে সংস্কৃত-প্রভাবিত করার প্রয়াস চালানো হয়।
বাংলা ভাষায় আরবী-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশের ফলে এ ভাষা বিশুদ্ধতা হারিয়েছে এ ধরণের ধারণা প্রথম আসে হ্যালহেডের কাছ থেকে। হ্যালহেড তার বিখ্যাত ব্যাকরণে আরবি-ফারসি শব্দ যতœসহকারে বর্জন করেন। এই হেলহ্যাড আবার তার বাংলা শিক্ষা রপ্ত করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গীয় ব্রাম্মন পণ্ডিতের কাছে। এই ব্রাম্মন পণ্ডিতের সংস্কৃতধর্মী বাংলার দ্বারাই মূলত প্রভাবিত হন হ্যালহেড। পরবর্তীকালে হ্যালহেডের এ ধারণাকেই যেন পোক্ত করতে নেমে পড়েছিলেন হেনরী পিটস ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরী।
সাহেবদের নিয়ে আরো বিশদ কিছু আলোচনা করার আগে রবীন্দ্রানাথের বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনাটি হুবহু তুলে দেবার লোভ সামলানো সম্ভব নয়:

... বিলাত হইতে জাহাজে করিয়া যখন দেশে ফিরিতেছিলাম দুই জন মিশনারি আমার পিছু ধরিয়াছিল। তাহাদের মুখ হইতে আমার দেশের নিন্দায় সমুদ্রের হাওয়া পর্যন্ত দূষিয়া উঠিল। কিন্তু তাহারা নিজের স্বার্থ ভুলিয়া আমার দেশের যে কত অবিশ্রাম উপকার করিতেছে তাহার লম্বা ফর্দ আমার কাছে দাখিল করিত। তাহাদের ফর্দটি জাল ফর্দ নয়, অঙ্কেও ভুল নাই। তাহারা সত্যই আমাদের উপকার করে কিন্তু সেটার মতো নিষ্ঠুর অন্যায় আমাদের প্রতি আর-কিছুই হইতে পারে না। তার চেয়ে আমাদের পাড়ায় গুর্খাফৌজ লাগাইয়া দেওয়াই ভালো। আমি এই কথা বলি, কর্তব্যনীতি যেখানে কর্তব্যের মধ্যেই বদ্ধ, অর্থাৎ যেখানে তাহা অ্যাবস্ট্র্যাক্শন, সেখানে সজীব প্রাণীর প্রতি তাহার প্রয়োগ অপরাধ। এই জন্যই আমাদের শাস্ত্রে বলে, শ্রদ্ধয়া দেয়ং। কেননা দানের সঙ্গে শ্রদ্ধা বা প্রেম মিলিলে তবেই তাহা সুন্দর ও সমগ্র হয়।... (কবির কৈফিয়ত)

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃতগন্ধী বাংলা ভাষা তৈরীর প্রকল্পের প্রেরণা আসে মূলত এক কালে ইস্টইন্ডিয়ান কোম্পানীর রাইটারগণের সহকারী হিসেবে কলকাতায় আসা হেনরি পিটস ফরস্টার এর কাছ থেকে। ফরস্টার কলকাতায় আসেন এমন এক সময়ে যখন ঔপনিবেশ স্থাপনকারী ইংরেজদের মধ্যে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার একটা জোয়ার বইছিল। তার সাথে আরো অনেক বাবু সে সময় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত চর্চায় নিজেদের পারদর্শী করে তুলতে ব্যস্ত ছিল। গবেষক গোলাম মুরশিদের ব্যাখ্যায় এর মূল কারণ যতটা না অধিকৃত ভুমির প্রতি প্রেম ও ভালবাসা তারও অধিক কারণ নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্ত ও মজবুত করা। এমনকি দেশী ভাষা শেখা বাবদ মাসিক যে ভাতা পাওয়া যেত সেটার মূল্যও সে সময় অনেক লোভনীয় ছিল। বাংলা ভাষার স্পষ্ট দুটো ধারা সম্পর্কে ফরস্টারের মতও একেবারে সরাসরি ছিল। ভদ্রজনের ভাষা ও ইতরজনের ভাষায় তিনি বাংলাভাষাকে আলাদা করার প্রয়াস পান। স্বাভাবিকভাবেই ভদ্রজনের ভাষার প্রতি তার স্পষ্ট পপাত ছিল এবং ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে দুর্বল বিবেচনা করে ইতরজনের ভাষা তথা প্রাকৃত ভাষাটির বিপে যান। প্রচলিত দেশী ভাষাগুলোকে তার বিবেচনায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারজনিত কারণে বিকারগ্রস্থ বলে রায় দেন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ঢাকা ও কলকাতার মতো বাংলাভাষী প্রধান শহরদুটোকে তার অনুমিত তথাকথিত অবিকৃত বাংলা ভাষা প্রচলিত বলে ধরে নেন। এ ধরনের অনুমান থেকে স্পষ্ট হয় ফরস্টার বা অন্যান্য ইংরেজ পণ্ডিতদের গড়পড়তা বিবেচনাবোধ সম্পর্কে। কেননা ঢাকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার সাথে তার কোনোরকমের সরাসরি যোগাযোগ থাকলে এ ধরনের মত দেয়া তার পে সম্ভব হতোনা। সম্ভবত চারপাশে ঘিরে থাকা সংস্কৃত পণ্ডিতদের লিখিত ভাষার উপর ভিত্তি করে এ ধরণের মন্তুব্য করে থাকতে পারেন বলে ধরে নেয়া যায়। সে সময় মুসলিম শাসনাধীনের রাজধানী মুরশিদাবাদের মতো ঢাকার ভাষাতেও যথেষ্ট পরিমানে মুসলমানি শব্দ ব্যবহার হয়ে আসছিল এবং সেটা কোনোমতেই ফরস্টার কথিত বিশুদ্ধ ভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক সাফল্য সম্ভবত এখানেই যে তিনিই প্রথম ফরস্টারদের এই গলদটা ধরতে পেরেছিলেন এবং সেই মোতাবেক মাঠে নেমে পড়েছিলেন। এমনকি বাংলা গদ্যের গতিপথটাই তিনি ফিরিয়ে নিতে চাইলেন ফরস্টার কথিত ইতরজনের ভাষার দিকে!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×