রবীন্দ্রনাথের কথায় আবার আসা যাক। ঔপনিবেশিকতার ঔরসে জন্ম নেয়া বাংলা গদ্যকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন নি কেন? বাংলা গদ্যের বিকাশের গোড়ায় সংস্কৃত ভাষাকে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করানোর সাহেব ও সংস্কৃত পণ্ডিতের হীন অভিসন্ধিই কী এর কারণ? যদি এটাই অন্যতম কারণ হয়ে থাকে তবে বাংলা গদ্যের সংস্কৃতায়ণের গোড়ার ইতিহাসটার দিকে খানিকটা নজর দেয়া জরুরী। ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর ছড়ানো রক্ত এই অঞ্চলে পোক্ত হবার অব্যবহিত পরেও বাংলা গদ্যের কাঠামো মূলত আরবী-ফারসী প্রধান ব্যবহারিক ভাষা ও তৎসম-তদ্ভব প্রধান ধর্মীয় ভাষা এমন মোটা দাগে প্রচলিত ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যুগে ধীরে ধীরে এই পার্থক্যটাকে বিলীন করার চেষ্টা করা হয় এবং বাংলা গদ্যকে সজ্ঞানে সংস্কৃত-প্রভাবিত করার প্রয়াস চালানো হয়।
বাংলা ভাষায় আরবী-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশের ফলে এ ভাষা বিশুদ্ধতা হারিয়েছে এ ধরণের ধারণা প্রথম আসে হ্যালহেডের কাছ থেকে। হ্যালহেড তার বিখ্যাত ব্যাকরণে আরবি-ফারসি শব্দ যতœসহকারে বর্জন করেন। এই হেলহ্যাড আবার তার বাংলা শিক্ষা রপ্ত করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গীয় ব্রাম্মন পণ্ডিতের কাছে। এই ব্রাম্মন পণ্ডিতের সংস্কৃতধর্মী বাংলার দ্বারাই মূলত প্রভাবিত হন হ্যালহেড। পরবর্তীকালে হ্যালহেডের এ ধারণাকেই যেন পোক্ত করতে নেমে পড়েছিলেন হেনরী পিটস ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরী।
সাহেবদের নিয়ে আরো বিশদ কিছু আলোচনা করার আগে রবীন্দ্রানাথের বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনাটি হুবহু তুলে দেবার লোভ সামলানো সম্ভব নয়:
... বিলাত হইতে জাহাজে করিয়া যখন দেশে ফিরিতেছিলাম দুই জন মিশনারি আমার পিছু ধরিয়াছিল। তাহাদের মুখ হইতে আমার দেশের নিন্দায় সমুদ্রের হাওয়া পর্যন্ত দূষিয়া উঠিল। কিন্তু তাহারা নিজের স্বার্থ ভুলিয়া আমার দেশের যে কত অবিশ্রাম উপকার করিতেছে তাহার লম্বা ফর্দ আমার কাছে দাখিল করিত। তাহাদের ফর্দটি জাল ফর্দ নয়, অঙ্কেও ভুল নাই। তাহারা সত্যই আমাদের উপকার করে কিন্তু সেটার মতো নিষ্ঠুর অন্যায় আমাদের প্রতি আর-কিছুই হইতে পারে না। তার চেয়ে আমাদের পাড়ায় গুর্খাফৌজ লাগাইয়া দেওয়াই ভালো। আমি এই কথা বলি, কর্তব্যনীতি যেখানে কর্তব্যের মধ্যেই বদ্ধ, অর্থাৎ যেখানে তাহা অ্যাবস্ট্র্যাক্শন, সেখানে সজীব প্রাণীর প্রতি তাহার প্রয়োগ অপরাধ। এই জন্যই আমাদের শাস্ত্রে বলে, শ্রদ্ধয়া দেয়ং। কেননা দানের সঙ্গে শ্রদ্ধা বা প্রেম মিলিলে তবেই তাহা সুন্দর ও সমগ্র হয়।... (কবির কৈফিয়ত)
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃতগন্ধী বাংলা ভাষা তৈরীর প্রকল্পের প্রেরণা আসে মূলত এক কালে ইস্টইন্ডিয়ান কোম্পানীর রাইটারগণের সহকারী হিসেবে কলকাতায় আসা হেনরি পিটস ফরস্টার এর কাছ থেকে। ফরস্টার কলকাতায় আসেন এমন এক সময়ে যখন ঔপনিবেশ স্থাপনকারী ইংরেজদের মধ্যে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার একটা জোয়ার বইছিল। তার সাথে আরো অনেক বাবু সে সময় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত চর্চায় নিজেদের পারদর্শী করে তুলতে ব্যস্ত ছিল। গবেষক গোলাম মুরশিদের ব্যাখ্যায় এর মূল কারণ যতটা না অধিকৃত ভুমির প্রতি প্রেম ও ভালবাসা তারও অধিক কারণ নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্ত ও মজবুত করা। এমনকি দেশী ভাষা শেখা বাবদ মাসিক যে ভাতা পাওয়া যেত সেটার মূল্যও সে সময় অনেক লোভনীয় ছিল। বাংলা ভাষার স্পষ্ট দুটো ধারা সম্পর্কে ফরস্টারের মতও একেবারে সরাসরি ছিল। ভদ্রজনের ভাষা ও ইতরজনের ভাষায় তিনি বাংলাভাষাকে আলাদা করার প্রয়াস পান। স্বাভাবিকভাবেই ভদ্রজনের ভাষার প্রতি তার স্পষ্ট পপাত ছিল এবং ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে দুর্বল বিবেচনা করে ইতরজনের ভাষা তথা প্রাকৃত ভাষাটির বিপে যান। প্রচলিত দেশী ভাষাগুলোকে তার বিবেচনায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারজনিত কারণে বিকারগ্রস্থ বলে রায় দেন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ঢাকা ও কলকাতার মতো বাংলাভাষী প্রধান শহরদুটোকে তার অনুমিত তথাকথিত অবিকৃত বাংলা ভাষা প্রচলিত বলে ধরে নেন। এ ধরনের অনুমান থেকে স্পষ্ট হয় ফরস্টার বা অন্যান্য ইংরেজ পণ্ডিতদের গড়পড়তা বিবেচনাবোধ সম্পর্কে। কেননা ঢাকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার সাথে তার কোনোরকমের সরাসরি যোগাযোগ থাকলে এ ধরনের মত দেয়া তার পে সম্ভব হতোনা। সম্ভবত চারপাশে ঘিরে থাকা সংস্কৃত পণ্ডিতদের লিখিত ভাষার উপর ভিত্তি করে এ ধরণের মন্তুব্য করে থাকতে পারেন বলে ধরে নেয়া যায়। সে সময় মুসলিম শাসনাধীনের রাজধানী মুরশিদাবাদের মতো ঢাকার ভাষাতেও যথেষ্ট পরিমানে মুসলমানি শব্দ ব্যবহার হয়ে আসছিল এবং সেটা কোনোমতেই ফরস্টার কথিত বিশুদ্ধ ভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক সাফল্য সম্ভবত এখানেই যে তিনিই প্রথম ফরস্টারদের এই গলদটা ধরতে পেরেছিলেন এবং সেই মোতাবেক মাঠে নেমে পড়েছিলেন। এমনকি বাংলা গদ্যের গতিপথটাই তিনি ফিরিয়ে নিতে চাইলেন ফরস্টার কথিত ইতরজনের ভাষার দিকে!