মেঘনাদবধ কাব্য তার দোহার পেল না বলে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ছিল। আমার আক্ষেপ বাংলা সাহিত্যের এই অমর কীর্তির পাঠ নিতে না পারার ব্যর্থতা। সৃষ্টির নতুন রূপটি এখনো ছুঁতে না পারার ব্যর্থতা হয়ত আমার পাঠযোগ্যতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু ঠাকুরের প্রয়াণের পর বাংলা সাহিত্য তার আক্ষেপকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তি দিয়ে ফেলল এটাও কম বেদনার নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় মাইকেল সাহিত্যের এই রূপটিকে চিরপ্রতিষ্ঠা দেন নি ঠিক, কিন্তু প্রতিভাবানদের জন্য রেখে গিয়েছেন সাহস ও উৎসাহের অফুরন্ত ভান্ডার। সচরাচর যে প্রবণতা তরুণদের প্রলুব্দ করে তা বোধকরি সমকালীন সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাণবান ধারাটি। রবীন্দ্রনাথ এটাকে আর্টের জগতে আদান-প্রদানের বাণিজ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওনার্স ইক্যুইটি নেহায়েৎ সামান্য হলেও সমস্যা নেই। ব্যাংকের টাকায় ব্যবসা শুরু করে দেয়া যায়। সাহিত্যের এ বাণিজ্যে লাভের ভাগটা যদি উল্ল্যেখযোগ্য হয় সেক্ষেত্রে ব্যাংকের মুলধন সমস্যা নয়। ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে কারোরই কিছু বলার থাকে না। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের সময়েরও অনেক আগে থেকে প্রায় সব মহাদেশে আর্টের আদর্শ আদান প্রদান হয়ে এসেছে। কিন্তু নীট লাভ যদি নেগেটিভ হয় সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে মুলধনটা তার নিজের নয়। নকল কী জিনিস তা ভালভাবে অনুভব করা যায়। বাদবাকি মহাদেশ তো বটেই এমনকি নিকট প্রতিবেশী এশিয়ার বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে এই বাণিজ্যে কে কত বেশী ঋণী এই প্রশ্ন এখন আর কেউ তোলে না। আখেরে মুনাফার হিসাবটাই সবাই মনে রেখেছে। যারা ব্যর্থ হয়েছে তারা সৃষ্টির ঋণ শোধবোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়েছে। অনেক মিডিওকার লেখক, যারা এককালে নিজেদের রাগব বোয়াল হয়ে ওঠার হুঙ্কার দিত, কালের ধুলোয় মিশে গেছে। চলতি সময়ের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ও এন্টি-প্রাতিষ্ঠানিক রাশভারি লেখকও এই ক্যাটাগরিতে পড়েন সন্দেহ নেই। চাপরাশ পড়া সাহিত্য চোখের সামনে উঁকি দিলে সেটাকে গোড়াতে অবিশ্বাস করার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। যারা এসব সাহিত্য ফেরি করে তাদের অন্তরের দৈন্য আচরণে ও সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলে গুরুতরভাবে। আবার বঙ্কিমের উদাহরণ টেনে রবীন্দ্রনাথ অনুকরণকে সম্মান দেখিয়েছিলেন। মাইকেল যেমন হোমার কিংবা মিল্টনের কাছ থেকে সাহস ও উৎসাহ পেয়েছিলেন, বঙ্কিমও তার সাহিত্যের রূপের আদর্শ পাশ্চাত্য লেখকের কাছ থেকে নিতে কসুর করেন নি। ঋণ করা পুঁজিতে ব্যবসা করে সফল হবার মত মেধা তাদের ছিল এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠক এখনো তাদের অর্জিত মুনাফায় জাবর কাটে সময় সুযোগ পেলে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের গতিপথ সব সময় ঠাকুরের কথা মাথায় রেখে এগুতে পারে নি। ফলত ঝাঁক বেঁধে মেধা এসেছে, ঝাঁক বেঁধে আত্মাহুতিও দিয়েছে। এমন উদাহরণ হয়ত বোদ্ধা পাঠকগণ বেশী করে উপলব্দি করেন। গদ্যের শুরুতে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রসঙ্গ তোলার কারণ বাংলা সাহিত্যের এই প্যারাডক্সকে চিহ্নিত করবার একটা প্রয়াস। অনেক চাপরাশ পরা সাহিত্যে আমাদের আঙিনা ভরে উঠল। কিন্তু মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক মাইকেল নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে রইল।
প্রকাশ: ঘুড়ি, সমালোচনা সাহিত্য সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩৪