যে সব স্বপ্ন তখনো জীবন্ত ছিল তাও যেন তার ীণ দৃষ্টিশক্তিকে হঠিয়ে আড়ালে চলে যায়। স্বপ্নগুলো দৃষ্টির অগোচরে যেতে যেতে তাকে একেবারে বেদিশায় ফেলে দিলে মরিয়া হয়ে সে পুনরায় চেষ্টা চালায়। কিšতু জলের স্রোতে দৃষ্টি আরও বেশি ঝাপসা হয়ে ওঠে! মরা আলোয় কেবল জলের সরসর পতনই সে ঠাহর করতে পারে। যে বিভ্রাšিত গতরাতের ভাঙাগড়া শেষে, শেষপ্রহরের চূড়াšত চোখরাঙানিতে তাকে মাতাল করেছিল, তাতে হতাশা ও ভয় যদি আগবাড়িয়ে বাগড়া না দিত, কিংবা অশুভ চিšতাটাকে যদি প্রায় আনকোড়া ও অপরিচিত শাশুড়ির হামানদি¯তার নিচে থ্যাঁতলা করে ফেলতে পারত, তবে হয়ত স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের তলানিটুকু দেখে নিশ্চিšেত হাঁফ ছাড়তে পারত! তীব্র গোঙানি ও উতালপাতাল আছাড়ের তোড়ে জাঁই জালে আটকে পড়া মসজিদপুকুরের মাছগুলোর মতো নয়া শয্যায় যেভাবে লাফিয়েছিল, উদ্বিগ্ন মুখগুলোর সন্দেহ ও শংকাপূর্ণ চেহারায় দুশ্চিšতার রেখা শুধু বাড়িয়েছিল তা নয়, তার অসংখ্য স্বপ্নের অসহায় মুখ আরো বেশি অনাথ হয়ে ওঠেছিল।
কিšতু তার আত্মচিৎকারকে আগ্রাহ্য করে মোয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি ঠিকই রাত বিদায়ের ঘোষনা স¤পন্ন করে। তখন সোয়া তের কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেঁচে থাকার মরিয়া প্রয়াস অসম্ভব ঠেকেছিল বলে এমন ভাবার কারন নেই যে, অসংখ্যবার সে তার স্ফীত উদরের ভাংচুরকে দাঁতে দাঁত চেপে বশে আনার চেষ্টায় মো দিয়েছিল। একেবারে অসহ্য হয়ে উঠলে বাম বাহুতে কামড় বসিয়ে আজাবটা কোনো রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিল, যদিও তুষারের পোশাক জড়িয়ে রাখা এই নগর হাসপাতালের আধো আলো আর নিবুনিবু কোলাহলের দুগ্ধফেননিভ শয্যায় রক্তের স্রোত ঠেকানোর বিদ্যা অনাত্মীয় ডাক্তাররা আয়ত্তে আনতে পারেনা। তখন স্বগোত্রীয় পড়শিরা, মূলত তার নিকটাত্মীয়রা, বেকূল হয়ে ছোটাছুটি করে। তারা ব্লাড ব্যাংকে ছুটে যায়, বিনত হয়ে লাল টকটকে রক্ত চায়। তাদের অপুষ্ট শরীলের রক্ত অদলবদল হয়। সে কেবলই রক্ত খায় আর লাল রঙে নেয়ে ওঠে। রক্তের গন্ধে তার ম¯িতষ্কে বিভ্রাšিত ভিড় করে। শৈশবের সেই মোহগ্র¯ত সময় তাকে চপলা কিশোরী বানিয়ে ফেলে। স্বপ্ন, শৈশবের মতো, তাকে সুড়সুড়ি দেয়, আর সে খিলখিল করে হেসে স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে। সে বলে তেঁতুল বিচি কুড়িয়ে এনে হাতগুটি খেলায় মেতে ওঠার সময় কত হৈ- হুল্লোড় ও হাসাহাসি হত! তেঁতুলগাছটি মসজিদপুকুরের উত্তর পাড়ে বিশাল এক ছায়া নিয়ে এখনো দাাঁড়য়ে আছে। যে ডালে চড়ে বাঁদর ছেলেদের সাথে সমান তালে লুকোচুরি খেলত কিংবা সবাইকে ছাড়িয়ে নিজের জামার আঁজায় তেঁতুলে ভারী করত, সে ডালে এখনো ছেলেরা ওঠে। তখন সে বিভ্রাšত দৃষ্টি নিয়ে তেঁতুলগাছটি দেখিয়ে দেয়। তর্জনী অনুসরন করে দৃষ্টি ছাদের দিকে সরিয়ে নেয়, আর বলে যে গাছটি ঘোমটাটানা লাজুক বউয়ের মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়ত দূর থেকে দেখার কারনে দৈর্ঘ্যপ্র¯েহর আগাগোড়া সঠিকভাবে খেয়াল করা যায়না, আরেকটু এগুতে পারলে অতিকায় দৈত্যটির ম¯ত শেকড়গুলো চোখে পড়বে এবং হলদেটে পাতাগুলোর ঝুরঝুর করে পড়ার দৃশ্য মন কাড়বে। রা¯তায় মান্দার গাছের অনাগত ফুলগুলো কুঁড়ি মেলতে মেলতে ময়না আর মৌসুমী পাখিদের ব্য¯ততা যখন বাড়াত, তখন হয়ত তেঁতুলগাছটা খানিকটা মলিন মনে হতো। মেঠোরা¯তার কিনারায় বেড়ে ওঠা হিজল গাছের ফুলও পাতার ভেতর আটকে থেকে হাঁসফাঁস করত। ভোরের পবিত্র আলোয় সবার আগে এসে রাতের রহস্যে ঝরে পড়া ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সবার অল্েয লূফে নিত প্রভাতের প্রথম সুখ। কুড়িয়ে নেয়া ফুলগুলো আঁজাকরে ধরা জামার জিম্মায় রেখে দূর্বা ঘাসের মসৃন গতরে দুহাঁটু গুঁজে টুপ করে বসে পড়ত। তারপর তারা অদূরে মসজিদের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিত। সে সময় চেহারায় রাজ্যের মেঘ জমা হয়ে তাদের মুখগুলো মলিন করে ফেলত। মসজিদের পাশে খুঁটি পুঁতে আর বেড়া দিয়ে ঘিরে যে ঘরটা বানানো হয়েছে সেখানে ছেলেমেয়েদের ধীরে ধীরে জড়ো হতে দেখে তারা খুব দ্রুত পায়ে বাড়িতে ছুটে যেত। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে, হাতে আমপাড়া নিয়ে হাজির হতো মক্তবে, মূলত অনিচছায়। মক্তবের কোনায় পেঁপে গাছগুলোতে হরহামেশা ফুল ফুটত। হুজুর প্রায়শ গলা খাকারি দিয়ে সতর্ক করলেও তার ঢুলঢুলু চোখের চাহনিতে থাকত রাজ্যের ঘুম। সুযোগ পেয়ে থুথু ফেলার ওছিলায় তারা পুকুর ঘাটে ভীড় জমাত। তেলাপিয়া মাছগুলো রাতের ঘুমে সতেজ হয়ে ঘাটের গায়ে জমে ওঠা শ্যাওলাতে ঠোঁট ঘষত। মুজিবদ্দৌলত নামের যে লোকটি পুকুরের ইজারা নিয়েছিল, হয়ত তারই দেয়া শান বাঁধানো ঘাটের শ্যাওলাতে তেলাপিয়া মাছেরা এখনো ঠোঁট ঘষতে আসে। শুধু মক্তবের বেড়া আর টিনের ছালা পাল্টে মাঝারি আকারের দালান ওঠেছে। পাটিবেতের মাদুরায় বসে, হাতে জায়তবেত নিয়ে হুজুর এখনো অলস চোখে ছেলে-ছোকরাদের আমপারা ও সেপারায় ব্য¯ত রাখে। স্বপ্ন সেখানে নেই, তারা সেখানে নেই। বিশাল সাইজের দুয়েকটা পেঁপে গাছ দালানের সামনে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো স্বপ্নের হদিশ তাদের কাছে থাকে না! তবু সে স্বপ্নের কথা বলে যেতে থাকে। ছাদের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেয় আর মাঝেমধ্যেই যšত্রনায় কঁকিয়ে ওঠে । তার স্বপ্ন বয়ানে ছেদ পড়ে এবং এলোমেলো অসংযত স্বপ্নের কথা এলোপাথারি ছুঁড়তে থাকে।
তারপর জনৈক সরকারালির কথা বলতে শুরু করে যে কিনা আনমনা হয়ে প্রতিনিয়ত হাতের কড়িতে কিসব বিড়বিড় করে গুনত। কৌতূহলী কেউ জানতে চাইলে বিগত সময়ের পূণ্য ও অভিশাপের কথা বলত। সে পুরো তিনকানি জমির শশাতে পাহাড়া দিত এবং শশােেতর মাচাঙে লটকে থাকা শশাগুলোর দিকে থাকিয়ে এ কাজটা করত। তার দেহ ছিল কাঠমি¯িত্রর মতো মজবুত, আর গায়ের রঙ ছিল সেগুন গাছের তক্তার মতো বাদামি। অনেকেই তাকে পাগল বলতো, যদিও পাগলের মতো কোনো কাণ্ড তাকে কেউ ঘটাতে দেখেনি। পাগল কি আলাভোলা যাইহোক, মূলত সবাই তাকে ভালবাসত। যদিও স্বপ্নের পরিসরে সে যেভাবে ঢুকে পড়ে, কাগতিয়া হাট লাগুয়া বিনাজুরি গ্রামের ছৈয়দ পাড়ার লোকের কাছে তা বেশ কৌতুককর মনে হতে পারে। চায়ের দোকানে বসে ডান পা’টা বাম পায়ের উপর তুলে যে লোকটি সারাণ ক্যাশে বসে বসে খোশগল্পে মশগুল খদ্দেরদের সরব উপ¯িহতি উপভোগ করে সেও হয়তবা খানিকটা চমকাতে পারে। গ্রীষ্মবর্ষাশরৎ এমনকি মাঘ মাসের শীতের থাবায় পর্যšত সরকারালি বরফ জমা পুকুরের পানিতে ঝুপ করে শব্দ তুলে রাতের বাসি শরীরটা পবিত্র করতে কখনো খামখেয়ালি করেনা। তারপর কুঁেজা হয়ে সে যখন জনাকীর্ন চায়ের দোকানে গরম গরম নানরুটির লোভে ঢু মারে বেশ খানিকটা স্ব¯িতও তার সাথে ঢুকে পড়ে। যদিও স্বস্তির রেশটুকু ধরে রাখা তার জন্য বেশ খাটুনির হয়ে দাঁড়ায়। কেননা ছয়সাতটি বেঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে ক’জন লোক চ’ায়ে নানরুটি ভেজায় তারা তাকে দেখে মুচকি হাসে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ লোকটি, যার বয়স আশি ছাড়িয়েছে বলে সবাই ধারনা করে, সরকারালিকে দেখে সামনের পাটির দাঁতশূণ্য মাড়িটা দেখিয়ে পুরনো কাসুন্দি নতুন করে ঘাঁটে। বুড়ো হয়ত সরল লোক, সরল মনে সরল কথা সবিনয়ে বলে। কিন্তু সরকারালি বুড়ো খায়রুলের এই কুশল বিনিময়ে বিরক্ত হয়। পিরিচে শব্দ তুলে কাপটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ করে গরম চা গিলে বিরক্তি প্রকাশ করে। লোকে ধারনা করে এ আর এমন কি, তাই বুড়োর সাথে তারাও যোগ দেয়। কুশলে উসকানির খসখসানি টের পেয়ে তাকে বিরস মুখে চায়ের দোকান ছেড়ে তেমুখো হতে হয়। শশােেতর বি¯তৃত মাচাঙের এককোনায় ধান গাছের ‘নাড়া’ দিয়ে তৈরী খুপড়িতে বসে চায়ের দোকানের বিরক্তিকে সে ভুলে যাবার চেষ্টা করে। সরকারালিকে গাঁয়ের লোকেরা লঘুতর কারণেও খুঁচিয়ে মজা পায়। সেটি হয়ত তার সুঠাম শরীরের সাথে বেমানান হাতের কড়ি গননার কারণে কিংবা বিশাল মুখটার ছায়ায় ঠাঁই না পেয়ে ঠোঁটের উপরে অতি অল্প পরিমান জায়গায় জড়োসরো হয়ে থাকা গোঁফগুলোর জন্যে হতে পারে। এমনকি তেজী গতরে সে যখন আড়াই বছর বয়সী ষাঁড়টা বিলে চরাতে নিয়ে যায়, সে দৃশ্যও কৌতূহলোদ্দীপক ঠেকে।
একদা সরকারালির পিতা এসকান্দরালি সবাইকে ধোঁকা দিয়ে ভিন গাঁয়ের এক দরিদ্র ঘরে সম্বন্ধ করে। সে বাপ-মা’র অমতে কাজটি করে এবং সে কারণে তার পিতা আজগরালি মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেও ছেলের মুখ দেখা থেকে বিরত ছিল। যদিও মুখ দেখার মতো সšতানের অভাব আজগরালির ছিলনা, কেননা তার চৌদ্দ কি ষোল জন ওয়ারিশের মধ্যে এসকান্দরালি ছিল সর্ব কনিষ্ট। বাপের অমতে বউকে ঘরে আনলেও তার মনে সুখ ছিলনা। তার মনে হতো বাপের কলজেতে হয়তবা সে ভয়ানক দাগা দিয়েছে, আর এ কারণে বাপের মৃত্যুর পরও অভিশাপ তার নিয়তিতে বিষ ঢালছে প্রতিনিয়ত। বাপের প্রতি এসকান্দরালিরও ােভের অন্ত ছিলনা। পাঁচ-সাত বছর বয়সে বাপের ঘাড়ে চড়ার এক দুর্নিবার টান ছিল তার, অথচ সেটা সম্ভবপর ছিলনা। এটুকুই কেবল এসকান্দরালি মনে করতে পারত শৈশবেই আজগরালি চোখের ীণ দৃষ্টি নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল। আশ্চর্যের বিষয়, যখন সে মাথায় টুপি আর গলায় জরির মালা পরে বাপের অবাধ্য হয়েছিল তখনও তার লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা থামেনি। কেবল চোখের ীণ দৃষ্টিতে আরো বেশি বার্ধক্য ভর করেছিল এবং প্রায় অন্ধের মতো হাতড়াতে শুরু করেছিল, যদিও তাকে অন্ধ বলার সাহস তার বংশধরদের কারও ছিলনা। তারপরও তাকে অন্ধ হতে হয়েছিল এবং সৌভাগ্যের বিষয় কিনা কে জানে, শেষকালে এসে দৃষ্টি খোয়ানোয় তার বরং বেশ সুবিধা হয়। বারবার নাউজুবিল্লাহ বলার পরও তার মনে একটি ীণ আশা উঁকিঝুঁকি মারত। হায়াত-মউত আল্লাহ পাকের মর্জি তথাপি জান কবরের ভয়ংকর আজাবের সময় তাকে হয়ত এই জগৎ সংসারের মায়াখেলা আর চাুস করতে হবেনা! তার অšিতম ধারনা সত্য হয়েছিল কিনা কেউ জানতে পারেনি, কিন্তু জানকবচের কাজটা সমাধা করতে হযরত আজরাইল আলাইহিস সালামের উপ¯িহত হতে ঠিকই বিলম্ব হয়নি।
ততদিনে সরকারালি এই পৃথিবীর মুখ দেখে ফেলে এবং তার জন্মের পর থেকেই অভিশাপের বিষ ঢালা শুরু হয় বলে পিতা এসকান্দরালি ভাবতে শুরু করে। সরকারালি তার প্রথম সšতান এবং অকল্পনীয়ভাবে একমাত্র সšতান হয়ে যায়। বেলুন-ফোতানার জারিজুরি ছাড়া এই রকম কাণ্ড পিতার অভিশাপ ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা। জন্মের প্রথম ক’বছরে সে অভিশাপ কেবলই দীর্ঘ হয়। তখন এসকান্দরালি খানিকটা বেদিশা দশায় পতিত হয়। সে কেবল বউয়ের গর্ভ অভিশাপটির আপাদম¯তকজুড়ে চোখ বোলাত আর থেকে থেকে হাঁপিয়ে ওঠত। কেননা তার চল্লিশ দিনের পুত্রের ঘাড়ে বারোমাস বয়েসি শিশুর মাথা ঝুলে থাকতে দেখে তার দেহে শীত নামত। সরকারালি এভাবেই একদিন বাবা ডাকতে শেখে এবং বেশ বড়সড় মাথার সাথে তাল মিলিয়ে বড় হতে শুরু করে। কিন্তু কি করে এ অভিশাপের কথা ঘরছাড়া হলো এসকান্দরালি কিছুতেই বুঝে কুলিয়ে ওঠতে পারতনা। তখন তার মনে হতো ¯ত্রী ঝুনাবিবির কোলজুড়ে পুত্র সšতান আসার পর থেকে পাড়ার মহিলারা দিনকতক ঘুরঘুর শেষে, বিনে পয়সার আশীর্বাদ দিয়ে যাবার পর তাদের চোখেমুখে সে করুনা ও সান্ত্বনার ঢল নামতে দেখত। সে ঢল পরে রূপ বদলিয়ে এই কুকর্ম করে থাকতে পারে বলে তার সন্দেহ হয়। সে সন্দেহ পরে তাকেও সংশয়গ্র¯ত করেছিল বলেই হয়ত ভাণ্ডার শরীফের অন্দর-উঠানের অনেক ধুলো ওড়িয়ে সে যখন কাšত হয়ে যায়, ততদিনে পাড়াগাঁয়ের শিশু-কিশোর কিংবা আইবুড়ো থেকে শুরু করে মরিবান্দা বেহে¯েত যাওয়া অনেক ময়মুরুব্বি পর্যšত বালক সরকারালিকে পোতে শুরু করে। নিদেনপে লুঙির গিঁটটা খুলে দিয়ে তারা যখন তাকে পোতে চাইত, আশেপাশের দু’চারটা গাছ-গাছড়া বাদে ব্যথিত হবার মতো আর কেউ থাকতনা।
তারও অনেক আগে একবার, যখন সরকারালির বয়স বছরও পেরোয়নি, এসকান্দররালি ােভ ও বিরক্তিতে আকণ্ঠ ডুবে একটি কঠিন সিদ্ধাšত নিয়ে ফেলে। কেননা নিরীহ বউয়ের কোলে একটা জ্যাšত বোজা চাপিয়ে দিয়ে খোদাতালা তাকে সর্বশাšত করার যে ফাঁদ পাতে তাতে নিজের দীর্ঘশ্বাসকে প্রলম্বিত করা ছাড়া কিইবা করার থাকে! বুকের ভারে বউ ব্লাউজের বোতাম লাগাতে পারতনা, ফোঁটা ফোঁটা দুধ ঝরে পড়ে জামায় দাগ লাগিয়ে ফেলে, অথচ মায়ের ¯তনের বাটে হতভাগ্য ছেলের ঠোঁট আটকায়না। ডিমে তা দেয়া মুরগীর মতো মা যখন তাকে নিজের সমৃদ্ধ বুকে আগলে ধরে ঘুম পাড়াত, তখনো আশা ও স্বপ্ন তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখত। পাড়া-মহল্লা ছাড়িয়ে এই স্বপ্ন গাঁয়ের দাঁড়কাকগুলো কতটুকু টেনে নিয়েছিল তাদের জানা ছিলনা। তবু বউয়ের অমতে এসকান্দরালি যে সিদ্ধাšত নিয়ে ফেলে তাতে ঝুনাবিবির সায় পায়না। তাই স্বামীর উপর আপনা ােভে গজগজ করতে করতে একসময় সে মুখে খৈ ফুটাতে শুরু করে। আর তা এমন বেহায়া হয়ে ওঠত যে এসকান্দরালি খানিকটা বিষ্মিত না হয়ে পারতনা। তারপর তার মেজাজ ভয়ংকরভাবে বিগড়ে যেত এবং চিৎকার-চ্যাঁচানিতে সারা বাড়ি মাথায় তুলত। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সে বউয়ের গায়ে হাত তুলে ফেলত, হাতে কাšিত আসলে পা চালিয়ে মেজাজ ঠাণ্ডা করত। তাদের এ ধরনের খেলাটা চলত প্রায়শ দুপুরের দিকে যখন এসকান্দরালি কাšত হয়ে বিল থেকে ফিরত। আর ঝুনাবিবি গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে গোবরগুলো শুকাতে দিয়ে, ফিরে এসে রাতের বাসি হাঁড়িপাতিলগুলো ধুতে পুকুরে চলে যেত। পুকুরে যাবার আগে সšতানের ঠোঁটটা অনেকণ ধরে ¯তনের বাটে ঘঁষাঘঁষি করে ভাতের হাঁড়িটাও উনুনে বসিয়ে দিয়ে যেত। এসব করতে-সারতে সকালটা গড়িয়ে যেত। তার শরীরে কাšিত আসলে সে চাইত খানিকটা সময় বিছানায় গড়িয়ে নিতে, কিন্তু তার সে অবসর থাকতনা। এতে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যেত। উনুন থেকে হাঁড়ি নামাতে যেয়ে ছলকে পড়া ভাতের ফ্যানে বুড়ো আঙুলটা পুড়ে ফেলত কিংবা‘ বঠকিতে আলু চিলতে কিংবা বেগুন কাটতে গিয়ে রক্ত ঝরাত! তখন রাগটা ঝারত ভাতের হাঁড়ির উপর। সজোরে পৈচছার উপর হাঁড়িটা রাখতে গেলে পোড়ামাটির বরুনাটা ভেঙে গুড়ো হয়ে যেত। আচমকা কেউ দেখলে ভাবত ভাতগুলো হয়ত ছাড়খার হল। কিন্তু তা না হয়ে ফ্যানে জবুথবু হয়ে থাকা ভাতগুলো আরো বেশি লেপ্টে যেত, আর তার রাগের উচিছষ্টটা বাড়ি ফেরতা এসকান্দরালির জন্য মজুত হয়ে থাকত। এসকান্দরালি হয়রানপেরেশান হয়ে বিল থেকে ফিরে আসত। পুকুরে ডুব দিয়ে ঘরে ফিরতে কিংবা ঘরে ফিরে খাবার পিঁঁড়িতে বসার ফাঁকে হাঁড়িতে লেপ্টে থাকা ভাতগুলো হয়ত খানিকটা শক্ত হয়ে ওঠত। বেগুন কিংব আলুর তরকারিও ততণে রান্না হয়ে যেত। তবু সে পিঁড়িতে অলসভাবে আরো খানিকটা সময় অপো করত। ইত্যবসরে তার খিটখিটে হয়ে থাকা মেজাজটা বশে আসত। ঠিক সে সময়েই বউকে নিজের সিদ্ধাšেতর কথা জানাত। সরকারালির মা ঝুনাবিবি পরিশ্রমী ছিল, কিন্তু শীতল ছিলনা। রাতের আড়ালে যেমন পতি সেবায় অকাšত থাকত, তেমনি দিনের কাজেও সমান পারদর্শী ছিল। আর মুখটাও ছিল সমান পটু। এসকান্দরালির বেশিরভাগ সীদ্ধাšতই তার মনঃপুত হতন। তার ধারনা ছিল স্বামী মূলত কোনো কাজেই ভুলচুককে সামলাতে পারেনা। বিয়ের তিন কলেমায় যেভাবে তাকে কব্জায় এনেছিল হয়ত তা থেকেই এমন ধারনা পোক্ত হয়েছিল। তার পোক্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার সামর্থও সম্ভবত এসকান্দরালির ছিলনা। কিন্তু তার সে তেজ ছিল যা থাকলে হাত-পা চালানো রপ্ত করা যায়। এমনই একদিনে নিজের সিদ্ধাšেতর কথা সে সবাইকে জানিয়ে দেয়। হয়ত সবাইকে জানানোর ইচেছ তার ছিলনা। তার চিৎকার শুনেই সবাই তা জেনে যায়। ঝুনাবিবি তখন চুপ হয়ে যেত। প্রহারে কাšত হয়ে পড়ায় কিংবা দু’চার জন বেগানা প্রতিবেশি উঠোনে জড়ো হওয়ায় ঘরেরবউ হিসেবে তার মুখটা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যেত। এসকান্দরালির মুখটাও তখন কাšত হয়ে পড়ত। পড়শিদের অযাচিত কৌতূহলে সে বিরক্ত হয়ে ভরদুপুরে বিলে চলে যেত। কিন্তু পড়শিরা ঠিকই আরও খানিকটা সময় নিজেদের উদ্বেগ ভাগাভাগি করত। পুরুষদের পাশাপাশি যেসব মহিলা জড়ো হতো তাদের কেউকেউ ঝুনাবিবিকে সাšতনা দিতে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ত। তাদের সাšতনা ঝুনাবিবিকে আরও বেশি ুদ্ধ করত। এসব শুভাকাঙীদের এড়ানোর জন্যে সে অনিচছা সত্ত্বেও শিশু সরকারালিকে বুকের দুধ দিতে ব্লাউজের বোতামটা খুলে দিত আর ঘুম পাড়ানোর জন্য অদ্ভুত সুরে শোলক গাইত। মহিলাদের মধ্যে যারা ঘরের বাইরে জড়ো হওয়া পুরুষদের সাথে থেকে যেত, তারা এসকান্দরালির সিদ্ধাšেতর নিন্দা করত। আলাভোলা কিসিমের শিশুটিকে এতিমখানায় রেখে আসার সিদ্ধাšতকে তারা মেনে নিতে পারতনা। এসকান্দরালির এ ধরনের হম্বিতম্বি তাদের কাছে নিষ্টুর ও অমানবিক মনে হতো। এরপর তারা ধীরে ধীরে যে যার ঘরে ফিরে যেত, কিšতু এসকান্দরালির ফিরে আসতে বেজায় দেরি হয়ে যেত। ভরদুপুরে েেতর মধ্যে সে এলোমেলো হাঁটত এবং মাথায় সূর্যের আলো নিয়ে মাচাঙের নিচে শুয়ে পড়ত। বিকেল গড়িয়ে যাবার পর মাগরিবের আযানের শব্দ শুনে তার ঘুম ভাঙত। চোখ কচলিয়ে পিঁচুটিগুলো লুঙ্গি দিয়ে মুছে নিয়ে খানিকটা সময় ঝিম মেরে বসে থাকত। আসরের ওয়াক্ত ফসকে যাবার জন্যে তার আফসোস হতো এবং আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াত। অলস ও হতাশ ভঙিতে শশাতেটায় একনজর চোখ বুলিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিত। হয়ত সে বাড়ির পথেই রওনা দিত, কিšতু ঘরে ফিরতনা। ঘরে ফিরে না গিয়ে মসজিদের দিকে দ্রুত হেঁটে যেত। তড়িঘড়ি করে ওজু সেরে যখন সে আল্লাহুম্মাফতাহলি আবওয়াবা রাহমাতিক বলে মসজিদে ঢুকত ততণে প্রথম রাকাতের নামাজ শেষ হয়ে যেত কিংবা মুসল্লিরা সিজদারত অব¯হায় থাকত। সে কাত হয়ে লুঙ্গি দিয়ে ওজুর পানি মুছার ছলে অপো করত। মুসল্লিরা সেজদা থেকে ওঠে দাঁড়ালে সে একেবারে পেছনের কাতারের একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াত। তিনরাকাত ফরজ নামাজ সেরে সবাই কেরামান ও কাতেবিন ফেরে¯তাকে মুখ বাঁকিয়ে সালাম জানাতে গিয়ে এসকান্দরালিকে নামাজরত অব¯হায় দেখত। সবার পরে মসজিদ থেকে বের হয়ে তার ঘরে ফিরতে ইচেছ করত। কিšতু ঘরে না ফিরে দোকানের পথে রওনা দিত। পকেটে বিড়ি খুঁজে না পেয়ে সে দোকান থেকে এক প্যাকেট আবুলবিড়ি কিনত।তারপর আরো কিছুণ ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরত। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত। ঝুনাবিবি ছেলেকে দুধের বাট চুষিয়ে ঘুম পাড়িয়ে, রান্নাঘরের এককোনায় পিঁড়িতে বসে ঢুলত। বউকে গুঁজো হয়ে বসে থাকতে দেখে তার বুকে মায়া জাগত। দুপুরের দুর্ব্যবহারের জন্য মনেমনে অনুতপ্ত হতো। ঝুনাবিবি স্বামীর পাতে ভাত-তরকারি বেড়ে দিত, তখনো তার মুখটা ভারি হয়ে থাকত। স্বামীর খাওয়া শেষ হলে সে খেতে বসত। খাবার-দাবাড় শেষ করে উনুনের আগুন নিভিয়ে, পাকঘরের ঝাপ লাগিয়ে ফিরে আসতে তার আরও অনেক সময় লেগে যেত। ততণ এসকান্দররালি জেগে থাকত। ছেলেকে আদর করার জন্য বামহাতের কনুইটা বালিশে রেখে হাতের তালুতে মাথাটা রাখত, আর ডানহাত ঘুমন্ত শিশুর মাথায়, নাকে ও বুকে বুলিয়ে নিত। তখন সে দুপুরের সিদ্ধাšতটা বদলে ফেলত। ঠিক সে সময় ঝুনাবিবি হাতের কাজ চুকেবুকে ছেলের পাশে গা এলিয়ে দিত। এসকান্দরালি বউকে তার রাগের মাথায় নেয়া সিদ্ধাšতটি বদলে ফেলার কথা জানাত। কিšতু বউ তার কথায় সায় না দিয়ে ঘুমšত ছেলেকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর কসরত করত। এসকান্দরালি খুব অসহায় বোধ করত। দীর্ঘণ এপাশওপাশ করে একসময় ছেলেকে টপকিয়ে ওপাশে চলে যেত, আর মাথাটা ঠিক বউয়ের বালিশেই আলতো করে রাখত। ছোট বালিশটাতে তাদের দুজনের মাথা ঠিকমত রাখা যেতনা, মাথার সাথে ঠোকা লাগলে বউ বিরক্তি প্রকাশ করত। এসকান্দরালির নাকটা একগোছা মেয়েলি চুলের ভেতর ডুবে থাকত। তখন বছর কয়েক আগের কথা মনে করে আপনমনে এলোমেলো সুর তুলত। সে স্মৃতিাড়িত হয়ে পড়ত। তার অবাধ্য নাক ও লোভাতুর ঠোঁটদুটো অ¯িহর হয়ে বউয়ের ঘাড়ে নেমে আসত। নাকের ফুটো দিয়ে তীব্র বেগে গরম গরম বাতাস বের হতো আর দুঠোঁটের পায়চারি ঘাড় ছাড়িয়ে ক্রমশ পিঠে , বগলে ও বুকে বি¯তৃত হয়ে যেত। ঝুনাবিবির ক্রোধ আ¯েত আ¯েত বাতাসের তোড়ে গলতে শুরু করত। তার ভেতরে খানিকটা অ¯িহরতা নামত এবং নিঃশ্বাসের পরিমান বেড়ে যেত। কোন ফাঁকে বজ্জাত লোকটা তাকে চিত করে শুইয়ে দিত সে খেয়াল করতে পারতনা। লোকটা নিমেষে তার আব্র“টা বেহায়ার মতো খসিয়ে ফেলত। তারপর যখন সে অবচেতন দশা কাটিয়ে ওঠত ততণে একটা নির্মোহ তৃপ্তি তার তামাম গতরে ছড়িয়ে পড়ত। তার দুচোখে জলের ঢল নামত এবং কাšত স্বামীর বুকে মুখটা গুঁজে দিত।
হয়ত এভাবেই সে স্বামীর সিদ্ধাšত পাল্টাতে সমর্থ হয়েছিল, যদিও তাদের একমাত্র সšতানের নিয়তি তারা পাল্টাতে পারেনি। ভাণ্ডার শরীফের অন্দর-ওঠোনের অনেক পবিত্র ধুলো তাদের চৌচালা ঘরের মাটিতে মিশেছে, অনেক ধুলো বাতাসে ওড়েছে, তবু তাদের দীর্ঘশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি। এভাবে ধীরে ধীরে সরকারালি বেড়ে ওঠে, শৈশব পেরিয়ে পরিণত হয়। আর যুবক হয়ে ওঠার আগে ও পরে রশিহাতে আড়াই বছর বয়েসি ষাঁড় কিংবা দুধাল গাই মাঠে নিতে কোনো ব্যতিক্রম হয়না। যৌবন তাকে পরিপূর্ণ করে। অথচ যৌবনের আয়েসে বুদ হবার ভাগ্যকে সে আয়ত্তে আনতে পারেনি। ভাগ্যবিড়ম্বিত সরকারালিকে ডানপিটে ছেলেরা পোয়। ময়মুরুব্বিরাও তার বিরক্তি বাড়ায়। বর্গা জমিতে শশাতে করার পৈতৃক স্বভাবে ত্র“টি হয়না, তবু তার ােভে ঘা দিতে শিশুকিশোরের কান্তি আসেনা।
এরূপ একটি তাৎপর্যহীন জীবনে একদিন হঠাৎ করে সরকারালি সকলের কৌতূহলী মনোযোগ পায়। সৌভাগ্যবশত পিতা এসকান্দরালিকে দাদা আজগরালির মতো ীণ দৃষ্টিশক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়নি। বার্ধক্য তাদের কাবু করতে পারেনি, তারা হয়ত আদৌ বুড়ো হয়নি কিংবা সরকারালি তখনো হয়ত যুবক হয়নি। এমনো হতে পারে সে যুবক হলেও তার পিতামাত ফুরিয়ে যায়নি। এমনকি তখনো তারা এক পাটিতে ঘুমাত, আর যৌবনের কামার্ত স্বামীর মতো স্ত্রীর বালিশে মাথা ঠেকিয়ে এসকান্দরালি সোহাগ ভাগাভাগি করত। হয়ত যৌবনের সেই কেশরাশি ভেবে বউয়ের মাথায় নাক গুঁজতে যেয়ে হতাশ হয়, পুরনো সেই তেজে লোভাতুর ঠোঁটদুটি ঘাড়ে, পিঠে কিংবা বুকে পায়চারি করতে যেয়ে ব্যর্থ হয়, তবু তখনো তারা দ্বিতীয় সন্তানের স্বপ্ন দেখা থামিয়ে দেয়নি। তারপর একদিন তাদেরকে চূড়ান্তভাবে হতাশ হতে হয়। তাদের সব স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়, যৌবনের রঙ ঔজ্জ্বল্য হারায়। তখন তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখে, সম্ভবত নতুন কোনো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তাদের স্বপ্নে অসংখ্য অনাগত সন্তানের মুখ ভিড় করে। অগুণতি সন্তানে তাদের সংসার ভরে ওঠবে এবং তারা নিজেদের অপ্রাপ্তির জ্বালা নিভাবে। প্রাথমিকভাবে তারা পুত্রকে কন্যা¯হ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্ভবত এক অলিক ইতিহাসের জন্ম দিয়ে কন্যার পিতামাতারা হাসিমুখে সে প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
মেয়েটি একের পর এক অসংখ্য প্রত্যাখ্যানের কথা বলে যেতে থাকে এবং একসময় গলার স্বর জড়িয়ে আসে, তার কথাগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে অস্পস্ট গোঙানিতে পরিণত হয়। সেমুহূর্তে নগর হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন ক থেকে স্ব ও স্বামীগোত্রের পড়শিদের, যারা তার জন্য ব্যকূল হয়ে রক্তের সন্ধানে ছোটাছুটি করেছে, সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারপর গুটিকয়েক অনাত্মীয় ডাক্তার তাকে রক্তের গন্ধে অবস করে এবং তার ভেতরে তক্কেতক্কে রক্ত চালান করে। এক সময় তারা রক্তচালান থামিয়ে দিলে তার গোঙানিও থেমে যায়। সে আর রক্ত প্রসব করে না। তার নিরেট সাদা হয়ে যাওয়া দেহটা বাদামি হতে শুরু করে এবং বাদামি রঙ ঘন হতে হতে ক্রমশ রঙ বদলাতে থাকে। তার দেহ ক্রমশ লাল হয় এবং মূলত তা টকটকে লাল রক্ত হয়ে ওঠে। সবাই ভেবে নেয় হয়ত মুহূর্তেই তার দেহ ফেটে পড়বে এবং রক্তে পুরো ক, হাসপাতাল ও মাঠঘাট নেয়ে ওঠবে। অনাত্মীয় ডাক্তাররা শংকিত হয়ে পড়ে। তারা একযোগে দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ করে। তখন সে ¯িহর, তবু তুমুল কম্পনে তার দেহটি তক্কেতক্কে দুলে ওঠে এবং ঠোঁটদুটো পুনরায় সচল হয়ে ওঠে।
সে তার অবশিষ্ট স্বপ্নের কথা, সম্ভবত জনৈক সরকালির কথা কিংবা তার পিতামাতার পবিত্র স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করে। সে বলে যে পরবর্তীতে সরকারালির পিতামাতা যখন একের পর এক প্রত্যাখ্যানে হতাশ হয়ে পড়ে তখন এক কন্যার পিতা তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তার পিতামাতা এই প্রস্তাবকে আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপা ভাবতে শুরু করে এবং তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় পুত্রবধু ঘরে আনার পর। নতুন কনে দেখতে এসে সবাই তাজ্জব বনে যায়! কেউকেউ কনের জন্য আফসোস করে। তারা কন্যাপরে মতিভ্রম হয়েছে বলে মন্তব্য করে। ইত্যবসরে বর-কনের ফুলশয্যার ঘনিয়ে আসে। পাড়ার অবিবাহিত মেয়ে ও ভাবীরা যতœ করে ঘর সাজায়, আর বেড়ার ফাঁক-ফোকড়গুলো বন্ধ করে দেয়। মাঝরাতে সরকারালি নববধুকে দেখার সুযোগ পায়। যদিও সে তেমন চমকে ওঠতে পারেনা, তবু একসময় তার জড়তা ভাঙে এবং এতদিন যা তারমধ্যে ঘুমন্ত ছিল, হয়ত সে নিজেও জানত না কতটা হিংস্র সে নেশা, তা জেগে ওঠে। সে এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে কিছুতেই মাংসনির্মিত বন্দুকের নল বশে আনতে পারেনা। তার কান্তি ও শান্তির ফাঁকে মাঝরাত গড়িয়ে যায় এবং শেষরাতের সুবেহ সাদিকের ওয়াক্তে নববধুর প্রসববেদনা শুরু হয়। পরিশ্রান্ত সরকারালি প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটা বুঝে ওঠতে পারেনা। সে খানিকটা বিষ্মিত হয়। বিষ্ময়কে ছাপিয়ে নববধুর গোঙানি ফুলশয্যার সাীগোপালদের কানেও পৌঁছে গেলে তার অনুশোচনা হয়। তখন সে ফুলশয্যার সোহাগে নিজের কোনো গলদ হল কিনা চিন্তা করে। তারপর শংকা ও শরম নিয়ে বেআব্র“ বউয়ের দিকে নজর ফেললে ঈষৎ ডিম্বাকৃতির পেটটা অসহায়ভাবে গুঁিড়য়ে যেতে দেখে। উরুর ভাঁজে ক্রমশ লাল জল ফেনিয়ে ওঠে। তখন সে ভাবে নববধুর পেট হয়ত এমনই হয়ে থাকে কিংবা তলপেটের নিচে এভাবেই লাল জল ফেনিয়ে ওঠে। খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে দু’চোখে ঘুম নামাতে তৎপর হলে দরজার ওপাশে কয়েকজোড়া হাতের সম্মিলিত ধাক্কার আওয়াজ তার কানে যায়না।
মেয়েটির বয়ানে ছেদ পড়ে। সে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেনা ভেবে ডাক্তারদের কেউ কেউ তাকে থামাতে চাইলে তার ভেতর শংকা ভর করে। তখন সে জানায় গল্পটি তার শেষ করা প্রয়োজন। কেননা এটি এমনই একটি গল্প যা ইতোপূর্বে কেউ তার কাছে জানতে চায় নি। সে তার অবশিষ্ট স্বপ্নের ব্যাখ্যা কারো না কারো জন্য রেখে যেতে চায়। কিন্তু ডাক্তাররা সে সুযোগ তাকে দিতে রাজি হয় না। তাদের ধারণা তার আরো অনেক স্বপ্ন তৈরী করার সুযোগ এখনো আছে এবং তা হাতছাড়া হতে দেয়া যায় না। ফলে সরকারালির সাথে তার সম্পর্ক কী তা খোলাসা হয় না। আমাদের কাছে বিষয়টা শেষমেশ অন্ধের হাতিদর্শনের গল্পের মতো বিভ্রম মনে হয়।
এপ্রিল,জুলাই ২০০৫
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:০১