কবি
কবি হলেন সেই জন যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী। কবি তাঁর রচিত বা সৃষ্ট মৌলিক কবিতাকে লিখিত বা অলিখিত ভাবে প্রকাশ করেন। কবি একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতায় তুলে ধরেন। কার্যতঃ যিনি কবিতা লিখেন, তিনিই কবি। কিন্তু আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের কথায় ‘‘ সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’’। অর্থাৎ , কবিতা লিখলেই কবি নয়।
কবিদের উৎপত্তি রহস্য আজও অজ্ঞাত। সেই অনাদিকাল হতে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে আসছেন কবিতায়। প্রত্যেক সমাজ-সভ্যতা ও নির্দিষ্ট ভাষায় রচিত হওয়ায় কবিরা বহুমাত্রিক, বিচিত্র ভঙ্গিমা, সৃষ্টিশৈলী প্রয়োগ করেছেন তাঁদের কবিতায়। সাহিত্য ইতিহাসের এই বৈচিত্রময় শিল্প শৈলীই বর্তমান কাব্য সাহিত্যকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভ’তি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুন রূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম।
কবি সকল স্তরের ভালবাসা ,দুঃখ-বেদনা, উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান। অতঃপর এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে প্রকাশ করেন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। কবির বেদনা-বিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার সৃষ্টিক্ষেত্র। তাঁর আনন্দ-বেদনার প্রকাশের মাধ্যম কবিতায়। বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ আপন মনের ভাবনা-বেদনা-কল্পনায় ছন্দোবদ্ধ অবয়ব তুলে কবিতা লেখেন কবি।
কবিতা
কবি-হৃদয়-নিহিত ভাবের ছন্দোবদ্ধ ও শিল্পিত প্রকাশ হলো কবিতা। অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী-বিন্যাসকে কবিতা বলে। কবিতা নারীর ন্যায়। নারী যেমন সাজসজ্জায়, বিলাসে-প্রসাধনে, আকারে-ইঙ্গিতে নিজেকে মনোরমা করে তোলেন, কবিতাও তেমনি শব্দে, ছন্দে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভ’তির নিবিড়তায় নিজেকে প্রকাশিত করে। জীবনের সুখ-দঃখ, পাপ-পূণ্য, ধর্ম-অধর্ম, অর্থ-অনর্থ, কাম-ক্রোধ, মোক্ষ প্রভৃতি যে কোন বিষয়ই কবিতার উপাদান হতে পারে।
কবিতার চিরন্তন আবেদন আমাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য্যবোধের কাছে। কবিতা ভাব-সঞ্চারী বিধায় তা আমাদের মনে বিচিত্র রস উদ্দীপন করে। কবিতাকে প্রধানতঃ দুই প্রকারঃ
০১। মন্ময় কবিতা- কবি নিজের অন্তরগত অনুভ’তি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাবনা-চিন্তা ইত্যাদি কাব্য সামগ্রী হিসেবে গ্রহন করে কবিতা প্রকাশ করেন। অর্থাৎ ব্যক্তি-নিষ্ঠ কবিতাই মন্ময় কবিতা।
০২। তন্ময় কবিতা- কবি যখন বস্তুজগতকে যথাযথভাবে প্রকাশ করেন, তখন তাকে তন্ময় কবিতা নামে অভিহিত করি। অর্থাৎ তন্ময় কবিতায় বস্তু-সত্তাই প্রধান।
তবে, সম্পূর্ণরূপে মন্ময় বা সম্পূর্ণরূপে তন্ময় কবিতা লিখা অসম্ভব। একান্ত বস্তু-নিষ্ঠ কবিতার মাঝেও কবি প্রাণের শিহরণ সঞ্চারিত হয়ে থাকে। আবার ব্যক্তি-নিষ্ঠ কবিতায়ও বস্তু-সত্তার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
কবিতার প্রাণ হলো ছন্দ। বাংলা কবিতায় তিন প্রকার ছন্দ ব্যবহৃত হয়ে তাকে। স্বরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। কবি মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। আধুনিক কবিতায় ছন্দের অন্তঃমিল ব্যবহৃত না হলেও ছন্দিত স্পন্দন বিরাজমান।