আজ পঁচিশে বৈশাখ। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিস্ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সার্ধশততম (দেড়শততম) জন্ম বার্ষিকী। একজন মানুষের জীবন ও কর্ম-পরিধির আলোকে বাঙালী সংস্কৃতির সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তাঁর ভেতর সর্বাধিক পরিমানে প্রকাশ ঘটেছে বাঙালীর সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহ। রবীন্দ্রনাথ নিজেই রবির ন্যায় উজ্জ্বলতম। তাঁকে বাংলা ভাষা-ভাষীদের মাঝে পরিচয় করে দেয়ার প্রচেষ্টা মূর্খতা বা দৃষ্টতার সামীল। তবুও তাঁর পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে সবকিছু ছাপিয়ে একটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য বিশেষনকেই আমরা বেশী ব্যবহার করি - ‘কবিগুরু’। কবিগুরুর জন্ম ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে আর মৃত্যু ১৯৪১ এ। এই প্রায় আশি বছরের জীবনের সময়কালে বাংলাদেশ, বাঙ্গালী সমাজ, বাংলা সাহিত্য তাঁর অবদানে এতো ব্যাপকতম বিস্তৃত ; তা পরিমাপের কোনো মাপকাঠি অদ্যাবধি কোন বাঙ্গালী লেখক, সাহিত্যিক, কবি, সমালোচক, বা বাংলা সাহিত্যে বিদ্বদজনেরা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হননি। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন ক্ষেত্র নেই - কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান ইত্যাদি যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সফল পদচারনা পরিলক্ষিত হয় না। গুনগত ও পরিমানগত উভয়দিকে তিনি অপ্রতিদ্বন্ধী ও অনতিক্রম্য। বাংলা সাহিত্যের সূচনা লগ্ন হতে আজ পর্যন্ত কেহই তাঁর কর্ম পরিধিকে স্পর্শ করতে পারেনি। রবীন্দ্রোত্তর কবি সাািহত্যিকবৃন্দ কমবেশি সকলেই রবীন্দ্রনাথের আলোকচ্ছটায় প্রভাবিত। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্ব সাহিত্যের মর্যাদা এনে দিয়েছেন।
বৈশ্বিক সমাজে বাংলা ভাষাকে স্বকীয় প্রভায় উচ্চাসনে আসীন করেছেন ‘গীতাঞ্জলি’ এর নোভেল প্রাপ্তির মাধ্যমে। এর পূর্বে বাংলা ভাষায় রচনা - সেই চর্যাপদ হতে রবীন্দ্র-পূর্ব সাহিত্য , বাংলা ভাষায় চিন্তা-চেতনার প্রকাশ যতই বলিষ্ঠ ও সম্মৃদ্ধশালী হোক না কেনো , বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে বাংলা ভাষা ও বাঙালীদের স্বকীয় মর্যাদায় পরিচিতি পায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য কর্মে , চিন্তা-চেতনায়, নিজস্বতায় বৈশ্বিক পরিমন্ডলে অনন্য হয়ে। গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অনন্য রচনা। যার প্রকাশ রবীন্দ্রনাথকে এনে দিয়েছে ১৯১৩ সালে নোভেল পুরস্কার প্রাপ্তির সম্মান ও মর্যাদা। বাংলা সাহিত্যকে এনে দিয়েছে বিশ্ব সমাজে আলাদা ভাবে পরিচিতি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যে একটি সম্মৃদ্ধ ও বলিষ্ঠ তা প্রতিভাত করে তুলেছে বিশ্ব সাহিত্য সংস্কৃতি পরিমন্ডলে। এই গীতাঞ্জলি কাব্যের অন্তর্গত অধিকাংশ রচনাই গান। এই সকল গান বা গীতগুলোর সাথে অনেকটা সাযুস্য খুঁজে পাই বাংলার বাউল স¤্রাট ফকির লালন শাহ এর রচনার সাথে। খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করলে মনে হয় গ্রাম্য শব্দ বিনাসের ভাবধারা ও চেতনাগুলো পরিশীলিত ভাষায় পরিমার্জিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে গীতাঞ্জলিতে।
লালন গীতির কোন লিখিত রূপ লালন সাঁইয়ের স্বহস্তে না থাকার কারনে তাঁর ভাব শিষ্যদের কন্ঠে বা খাতায় মূল ভাবাদর্শের রূপখানি অনেকাংশে বিকৃত হয়ে গিয়েছে। এমনকি তাঁর দেহান্তরের পরে বহু সংগ্রাহক ও সংকলকগনও সংশোধনের নামে যথেচ্ছ বিকৃত ঘটিয়েছেন। তথাপি লালন প্রেমিক বা লালন ভাবাদর্শে বিশ্বাসীগণ লালনের কালামকে অর্থাৎ, লালন সঙ্গীতকে - তাঁর দর্শনকে বা লালনের স্বকীয় প্রভাময় ভাবাদর্শকে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে ধরে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা ও কষ্ট করেছেন। বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা ও শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন। তাঁরা সংখ্যায় অনেক। সেই ফকির লালন শাহের জীবনকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি সেই সকল জ্ঞানী অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিগণ কর্ম প্রয়াস চালিয়ে আসছেন। ঐ সকল জ্ঞানী অনুসন্ধিৎসু সংগ্রাহক ও সংকলকদের মধ্যে আমরা পরম শ্রদ্ধাভরে একজনকে বিশেষভাবে স্মরন করতে পারি। তিনি হলেন মহৎ প্রাণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি মহারাজ ফকির লালন শাহের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা আর গুরু ভাবজ্ঞানে লালন সঙ্গীতের সংগ্রাহক ও সংকলক রূপে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন।
লালন সাঁই সব সময় বিলীন থাকেতেন পরমাত্মার মাঝে। আর সেই অসীম পরম আত্মার মাঝেই খুঁজে বেরায়েছেন মানবসত্ত্বার মানুষকে। মানবতাই তাঁর নিকট ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ । তাই তিনি সহজেই বলতে পারতেন প্রচলিত ধর্ম মানুষের মাঝে বিরোধের সৃষ্টি করে। পরমাত্মার সাথে মানুষের একাত্ম হওয়ার ধর্মই মানবতা ধর্ম। যা মানবাত্মার দিব্যজ্ঞানের পরিচায়ক। তাঁর ভাষায় -
‘ডানে বেদ, বামে কোরান,
মাঝখানে ফকিরের বয়ান,
যার হবে সেই দিব্যজ্ঞান
সেহি দেখতে পায় ’
আর এই বাণীর দ্যোতনা খুঁজে পাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় । তিনি সীমাবদ্ধতার ভেতর খুঁজেছেন অসীমের আলোক রশ্মি। অন্য এক ধরনের ভাব দর্শনে আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন অসীমত্বের মাঝে অস্তিত্বের সন্ধান। বিশালত্বের মাঝে খুঁজে ফিরেছেন স্বীয় আত্মার অস্তিত্ব। পরমের মাঝে বিলীন হওয়ার আনন্দ রাশি। তাই তিনি লেখনীর তুলিতে ছাপিয়ে তোলেন সেই আকাঙ্খার সুর ও ছন্দ -
‘সীমার মাঝে, অসীম, তুমি
বাঁজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এত মধুর।
কত বর্ণে কত গন্ধে
কত গানে কত ছন্দে,
অরূপ, তোমার রূপের লীলায়
জাগে হৃদয়পুর।’
অনন্ত কালচক্রের নানা পর্বে লোকান্তরের মহাপুুরুষগণ ধীর-স্থিরতা, ভারসাম্য ও শান্তি পূণঃ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ জগতে জন্ম গ্রহন করেন। সেই সকল মহা মানবগণ তাঁর চেয়ে অধিকতর শক্তিধর, গুণধর বা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ত্বের কাছে নিজেকে সমর্পন করে থাকেন। আর, এই আত্ম সমর্পন নীচতা নয়; হীনতা নয়। এ হলো শক্তির উন্মেষ। সেই শক্তি হলো ভক্তির শক্তি। শক্তিহীন অবস্থায় যেমন শক্তিমানকে ষ্পর্শ করা যায় না; ক্ষুদ্রতা দিয়ে যেমন বৃহৎকে বুঝা যায়না ; পরম সত্যকে তেমনি খন্ডিত বিচারবুদ্ধি বা সংকীর্ণতা দিয়ে অনুধাবন করা যায় না । এমনটিই ঘটেছে ফকিররাজ লালন শাহের মূল্যায়ন প্রচেষ্টায়। তাই হয়তো বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং লালন দর্শনের শক্তির মূল্যায়নে সর্বপ্রথম অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথাসাধ্য পরিমার্জনা করে ফকির লালন শাহের কুড়িটি গান সংগ্রহ করে সর্বপ্রথম ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৯০৫ সালে (১৩১২ সালের আশ্বিন সংখ্যায়) ‘‘হারামনি’’ বিভাগে প্রকাশ করেছিল। অর্থাৎ কবিগুরুর চিন্তা-চেতনায় বাউল লালন শাহের সঙ্গীত সম্পদ ছিল অমূল্য সম্পদ। তাই ‘‘হারামনি’’ শিরোনামে স্থান পেয়েছিলো লালনগীতি। লালন সঙ্গীতের দার্শনিক ও নান্দনিক প্রভাব যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করে তুলেছিলো - তেমনি শহুরে শিক্ষিত সমাজকে নাড়া দিয়ে গেলো।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায় - ‘আমার লেখা যারা পড়েছেন, তাঁরা জানেন বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ- আলোচনা হতো। আমার অনেক গানে আমি বহু সুর গ্রহন করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সাথে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বানী কোন এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স- শিলাইদহ (কুস্টিয়া) অঞ্চলের এক বাউল একতারা হাতে বাজিয়ে গেয়েছিল -
‘কোথায় পাবো তাঁরে - আমার মনের মানুষ যেঁরে।
হারায়ে সেই মানুষে- তাঁর উদ্দেশে
দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে ’
(এই গানটি গেয়েছিল-ফকির লালন শাহের ভাবশিষ্য গগন হরকরা। যার আসল নাম বাউল গগনচন্দ্র দাস।)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের ভাষায়, ঐ বাউলের গানের কথা ও সুরের মাধুর্য আমাকে এতোই বিমোহিত করেছিলো যে, আমি সেই সুর ও ছন্দে বাংলাদেশকে মাতৃরূপ জ্ঞানে লিখেছি -
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাঁজায় বাঁশি ’
যা বর্তমানে রক্তস্নাত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশকে মাতৃ-জ্ঞানে ভালোবেসে ,শ্রদ্ধায়, ভক্তি-প্রেমে, অন্তরে সমস্ত চেতনায় লালন শাহের সুর ও ছন্দে রচনা করেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। অর্থাৎ, আমাদের রক্তের ঝর্ণাধারার বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় সঙ্গীত ভাষা ও শব্দ বিন্যাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দৃশ্যমান হলেও ; সুর ও ছন্দে এবং প্রেরণার উৎস হিসেবে বাউল স¤্রাট লালন শাহের অবদানকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির গীতধারায় যদি আমরা আধ্যাত্মিকতার চেতনায় নিবিষ্টতায় রসাস্বাদন করি তা‘হলে আমরা দেখবো যে লালনের দর্শনের বা লালন কালামের পরিশীলিত রচনার ধারাবাহিকতা।লালনের কালামে বিনয় ও মানবীয় আমিত্ব শূন্যতার এক কৌশল মাত্র। গুরুর চরণে নিজেকে অধম ও গুরুত্বহীনভাবে তুলে ধরে গুরুকে সর্বোত্তমরূপে প্রকাশ করার এক কৌশল সাঁইজী তুলে ধরেছেন তাঁর সুরে ও কালামে। পরম আত্মাকে কল্পনা করেছেন গুরুর ভনিতায়। সেই কথাই যেন আমরা শুনতে পাই কবিগুরু রবী ঠাকুরের কন্ঠে -
‘তুমি কেমন করে গান কর যে, গুণী,
অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।
সুরের আলো ভূবন ফেলে ছেয়ে,
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
পাষান টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।’
রবীন্দ্রনাথ অরূপের (নিরাকার) অপরূপ রূপে অবগাহনের নিমিত্তে অতল রূপ সাগরে ডুব দিয়েছেন অরূপ রতন (অমূল্য রতন) আশা করি, তাঁর ভাষায়-
‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা করি ;
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর
ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী ।
সময় যেন হয় রে এবার
ঢেউ-খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার
সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে
অমর হয়ে রব মরি।’
লালন তাঁর একতারার তারে সুরে ও ছন্দে গেয়ে গেছেন -
‘রূপের তুলনা রূপে।
ফণি মণি সৌদামিনী
কী আর তাঁর কাছে শোভে
যে দেখেছে সেই অটল রূপ
বাক্ নাহি তার, মেরেছে চুপ।
পার হলো সে এ ভবকূপ
রূপের মালা হৃদয়ে জপে ’
এই রূপের তুলনা মানবসত্ত্বায় নিহিত বস্তুমোহমুক্ত নিষ্কামী মহা মানবের স্বরূপ। যে মহা মানব সম্যক গুরুদেবের কাছে সম্পূর্ন আত্ম-সমর্পিত চিত্তে কঠিন ধ্যানব্রত অবস্থায় শিক্ষা গ্রহন করেন। যেখানে অরূপে( অস্থিত্বহীনতায়) খুঁজে ফেরে রূপের সন্ধান। যেখানে ‘নিজেকে জানা’ এর জন্য পরিপূর্ন আত্মদর্শনে ব্যাপৃত থাকে। তাই লালন ফকির দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ করেছেন -
‘যার আপন খবর আপনার হয় না।
একবার আপনারে চিনতে পারলেরে
যাবে অচেনারে চেনা
আত্মরূপে কর্তা হরি,
নিষ্ঠা হলে মিলবে তাঁরই ঠিকানা।
ঘুরে বেড়াও দিল্লি লাহোর
কোলের ঘোর তো যায় না ’
ধর্ম তত্ত্বে পরমাত্মা বা ঈশ্বরকে অনুসন্ধানের জন্য বৈরাগ্য সাধন প্রক্রিয়ায় বনে-জঙ্গলে, পাহার-পর্বতে, অথবা মক্কা-কাশীতে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি লালন শাহ; তেমনি তাঁর ভাবশিষ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালন দর্শনের মতোই ঈশ্বরের মহিমা খুঁজে ফিরেছেন মানুষের মাঝে। মানুষই ঈশ্বর, মানুষই দেবতা, মানুষের মাঝেই পরমাত্মার অস্থিত্ব লীন। তাই লালন শাহের কন্ঠে যেমন শুনি-
‘ ভবে মানুষ গুরুনিষ্ঠা যার।
সর্বসাধন সিদ্ধি হয় তার
নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকার সাকার হইল সে
যে জন দিব্যজ্ঞানী হয়, সেহি জানতে পায়
কলি যুগে হল মানুষ অবতার ’
অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন শাহের ভাব দর্শনের দ্যোতনাকে আরও উচ্চমার্গ্মে তুলে ধরেছেন। মনে হয় লালনের চিন্তা-চেতনাকে শালীন ও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন স্বয়ং কবিগুরু। মার্জিত ভাষার পরিশীলিত সুরের মাধুর্য দিয়ে কবিগুরু একতারার সুরের স্থানে বীণার তারে ঝংকৃত করেছেন মানব ও মানবতার মাঝেই পরমাত্মার অস্তিত্ব। সেই পরমাত্মাকে পেতে হলে আমিত্বের অহংবোধকে লীন করে দিতে হবে মানুষ-গুরু সাধনে; মানবতার পরাকাষ্ঠা দেদীপ্যমান করে। কবিগুরুর ভাষায় তা হলো -
‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।
তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ -
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস।
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধূলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে -
তাঁরই মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয় রে ধুলার ‘পরে।’
অপরদিকে, ফকির লালন শাহ মানবদেহে নিহিত আলোকিত সত্তার উন্মেষের ইচ্ছায় স্বীয় কন্ঠে উচ্চারন করেন -
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই
মূল হারাবি ’
মানুষ ছাড়া মনরে আমার
দেখিরে সব শূন্যকার
লালন বলে মানুষ আকার
ভজলে পাবি ’
লালন ফকির তাঁর পরমাত্মার সাথে মিলনের প্রচন্ড আকাঙ্খা তাঁকে উন্মাতাল করে রাখতো, তাই সে প্রভুর সাথে মিলনের আকাঙ্খায় বেদন সুরে গেয়ে বেড়ায়-
‘ মিলন হবে কতোদিনে।
আমার মনের মানুষের সনে
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয়
থাকে না লোক লজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে ’
প্রভুর সাথে মিলনের ইচ্ছা লালনকে যেমন চাতক প্রায় জোছনালোকের প্রত্যাশায় দিন গুনতো , তেমনি প্রভুর সান্নিধ্য পাবার আশায় রবীন্দ্রনাথ ব্যাকুল হৃদয়ে গাইতেন -
‘যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু,
এবার এ জীবনে,
তবে তোমায় আমি পাইনি যেন,
সে কথা রয় মনে ।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।’
অথবা
‘আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।’
বাউল স¤্রাট লালন ফকির এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- এ দু’জন মহৎ-প্রাণ ও সাধুর কর্ম ও রচনার কিছু দিক নিয়ে আলোকপাত করেছি বটে। লালন শাহের প্রয়াণের সময়কালে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ যৌবনকাল। তখন তাঁর বয়স ২৮/২৯ বছর। যে ‘গীতাঞ্জলি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এবং বাংলা ভাষাকে এনে দিয়েছে সুনাম, সম্মৃদ্ধি ও বিশ্বজনীনতা। সেই গীতাঞ্জলির প্রতিটি ‘গীত’ ধীর-স্থীরতার সাথে পাঠ করলে নিজের অজান্তে মনে হবে - এ কথাগুলোতো তাঁর পূর্ব-পুরুষ বাউল কবি ফকির লালন শাহ আগেই বলে গেছেন। অর্থাৎ, গীতাঞ্জলির গানগুলো লেখার সময় কবিগুরু প্রচন্ডভাবে বাউল কবি লালনের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এশিয়ার প্রথম নোভেল বিজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেভাবে দুই বাংলায় বাঙালীগণ উচ্ছ্বাসিত ও উদ্বেলিত হয়ে স্মরন করেন; সেইরূপ হয়না বাউল স¤্রাট লালন শাহের ক্ষেত্রে।